পূর্বোত্তরে ইংরেজ বিরোধিতাঃ চাকমা রাজার সঙ্গে যুদ্ধ
পান্নালাল রায়
দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে আদিবাসী সম্প্রদায়ের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।১৮৫৭ সালের মহা বিদ্রোহকে দেশের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু এই স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে এবং পরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসীরা স্বভূমির স্বাধীনতা রক্ষার জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। চাকমা,মিজো, খাসি,মটক,কোল, মুন্ডা,ভিল,সাঁওতাল-এই সব আদিবাসী সম্প্রদায় নানা সময়ে নানা কারণে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। অনেক রক্ত ঝরেছে সবুজ বনভূমিতে।
ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলেও ইংরেজরা আদিবাসীদের কাছ থেকে প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়েছিল। বিভিন্ন এলাকায় আদিবাসীদের সঙ্গে তাদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।পূর্বোত্তরের এক প্রত্যন্ত অংশে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আদিবাসী বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছিল ১৭৭৬ খ্রীষ্টাব্দে।পার্বত্য চট্টগ্রামে ইংরেজরা তখন চাকমা আদিবাসীদের প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়েছিল। ইংরেজদের আগমনের আগে চট্টগ্রামের মোগল শাসকদের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা আদিবাসীদের সুসম্পর্ক বজায় ছিল। চাকমা রাজাগণ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের বিনিময়ে মোগলদের কার্পাস সরবরাহ করতেন। এছাড়াও চাকমা রাজাদের কর দানের বিনিময়ে ব্যবসা বাণিজ্য করার সুযোগ পেতেন সমতল এলাকার মুসলমান ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এই অবস্হার পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে চট্টগ্রামে ইংরেজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর থেকে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে,বাংলার মসনদ প্রাপ্তির কৃতজ্ঞতা স্বরূপ নবাব মীর কাশিম ১৭৬০ সালে বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম অধিকারে আসার পর ইংরেজদের ধারণা হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রামও এর অংশ। চট্টগ্রামের মোগল শাসকদের মতো ইংরেজদেরও পূর্ব নির্ধারিত হারে কার্পাস সরবরাহ করতে থাকে চাকমারা। কিন্তু মোগলদের তুলনায় কার্পাসের অনেক বেশি চাহিদা ছিল ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর। তারা তাদের মুনাফার লক্ষ্যেই যাবতীয় ব্যবস্থা গ্ৰহণ করেছিল। এখানে উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে,একদা ত্রিপুরার রাজারা সমতল ত্রিপুরার জন্য মোগলদের কর হিসেবে হাতি দিতেন। কিন্তু ১৭৬১ সালে সমতল ত্রিপুরা ইংরেজদের অধিকারে আসার পর তারা হস্তীকর তুলে দিয়ে নগদ অর্থে কর নিতে থাকে ত্রিপুরার রাজাদের কাছ থেকে।হাতির তুলনায় তাদের নগদ অর্থের প্রয়োজন ছিল বেশি।কার্পাসও তাদের কাছে খুবই মূল্যবান ছিল সে সময়।
যাইহোক, চাকমা রাজার কার্পাস সরবরাহের বিষয়টি ইংরেজরা কর হিসেবে গণ্য করেছিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বহুল পরিমাণে উৎকৃষ্ট কার্পাস উৎপন্ন হতো। ইংরেজরা এই অঞ্চলটি 'কার্পাস মহল' হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।এই কার্পাস সংগ্ৰহের বিষয়টাকে কেন্দ্র করেই ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সঙ্গে সংঘাত শুরু হয় চাকমাদের। আর্থিক সমৃদ্ধির জন্য ইংরেজরা নানা ভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে কার্পাস সংগ্ৰহে তৎপর হয়ে উঠে। এমনকি, চট্টগ্রামের সমতলবাসী ব্যবসায়ীরাও ইংরেজদের কাছে বিক্রির জন্য নানা কৌশলে চাকমাদের কাছ থেকে অধিক পরিমাণে কার্পাস সংগ্ৰহে উদ্যোগী হয়।আগে সমতলের ব্যবসায়ীরা চাকমা রাজাকে যে কর প্রদান করত, চট্টগ্রামে ইংরেজ আধিপত্যের পর তাও তারা বন্ধ করে দেয়। এরকম নানা ভাবে চাকমা রাজা ক্ষতির সম্মুখীন হন।কর বন্ধ করা নিয়ে সমতলবাসী ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও চাকমাদের সংঘাত শুরু হয়।আর সমস্ত কিছুর জন্য চট্টগ্রামে ইংরেজ আধিপত্যকেই দায়ী করেন চাকমা রাজা।
এদিকে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীও চাকমা রাজার কাছে বর্ধিত হারে কার্পাস কর দাবি করে চাপ দিতে থাকে। স্বাভাবিক ভাবেই রাজা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। একদিকে ইংরেজদের উপর্যুপরি কার্পাসের চাহিদা বৃদ্ধি,কর দাবি এবং অপরদিকে সমতল অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের কর দেয়া বন্ধ করে দেয়া-সব মিলিয়ে চাকমা রাজা সমূহ ক্ষতির সম্মুখীন হন। শেষপর্যন্ত ১৭৭৬ খ্রীষ্টাব্দে তদানীন্তন চাকমা রাজা শের দৌলত খাঁ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে কার্পাস সরবরাহ বন্ধ করে দেন। পাশাপাশি তিনি সমতল অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কর আদায়ে গুরুত্ব আরোপ করেন। এইভাবে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সঙ্গে চাকমা রাজার সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠে।
ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সঙ্গে চাকমা রাজার বেশ ক'বার সংঘর্ষ ঘটে। প্রথম দিকে চাকমারা জয়ী হলেও শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের কাছে তাদের পরাজয় ঘটে।১৭৭৭ সালে কিল্লামুড়াতে চাকমা রাজার সঙ্গে কোম্পানীর বাহিনীর তীব্র লড়াই হয়।সেই লড়াইতে কোম্পানীর পরাজয় ঘটে। তারপর ১৭৮০ সালে কর্ণফুলী নদীর পাড়ে কাউখালী ও বেতাগী নামক স্হানে চাকমাদের সঙ্গে ইংরেজদের পর পর দুটি যুদ্ধ হয়। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হলেও ইংরেজ বাহিনী এ দু'টি যুদ্ধেও শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়।১৭৮২ সালে আবার যুদ্ধের দামামা বেজে উঠে। চাকমা রাজা জানবক্স খাঁ আবার ইংরেজদের বিরুদ্ধে সামরিক তৎপরতা সুদৃঢ় করেন। তিনি চেঙ্গী মহাপ্রুমে একটি সুরক্ষিত দুর্গ স্হাপন করেন। ইংরেজদের প্রতিরোধে বিভিন্ন অঞ্চলে সৈন্য সমাবেশ ঘটান।১৭৮৩ থেকে ১৭৮৫ সালের মধ্যে ইংরেজদের সঙ্গে চাকমা রাজার পরপর তিনবার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। প্রথম দুটি যুদ্ধে কোম্পানীর বাহিনী পরাজিত হলেও শেষ যুদ্ধে চাকমাদের মহাপ্রুম দুর্গের পতন ঘটে। পরাজিত হয়ে পালিয়ে যান রাজা জনবক্স খাঁ। কিন্তু তারপরও চাকমা রাজা কোম্পানীর বাহিনীর পরবর্তী আক্রমণ মোকাবেলায় যথাসাধ্য উদ্যোগ নেন। আবার সৈন্য সমাবেশ ঘটান। কিন্তু এবার ইংরেজরা অন্যরকম কৌশল নেয়। তারা আর্থিক অবরোধ গড়ে তুলে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদের বিরুদ্ধে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সংলগ্ন বাজার গুলো তারা বন্ধ করে দেয়। এরকম অবস্থায় সাধারণ চাকমারা খাদ্য সামগ্রী সহ নিত্য পণ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে তীব্র সংকটের মুখে পড়ে।এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে চাকমা রাজা জনবক্স খাঁ ১৭৮৭ সালে শেষপর্যন্ত ইংরেজদের অধীনতা স্বীকার করে নেন। তিনি কলকাতায় গিয়ে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস-এর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং বার্ষিক কর দানে স্বীকৃত হন। এইভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইংরেজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা শুরু হলেও ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত কিন্তু তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা রাজার আভ্যন্তরীণ শাসনে কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। যদিও সেদিন অবস্হার পরিপ্রেক্ষিতে চাকমা রাজা শেষপর্যন্ত ইংরেজদের অধীনতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন, তবু, ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনচেতা চাকমা আদিবাসীদের লড়াই দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে।