শেষ প্রতিশ্রুতি

দেবারতী দত্ত

ভোরের শিউলি কুরোনো যেমন দারুন রোমাঞ্চকর, ঠিক তেমনি, মনের ঘরে যার নিত্য আনাগোনা, সেই মানুষটাকে একটু দেখা তৈরি করে ভাবনার সমুদ্রে আবেগী জোয়ারভাঁটা। তাকে কাছ থেকে পাওয়ার যে তীব্র ইচ্ছা, তা কোনোভাবেই হ্রাস পায় না। ক্রমশ বেড়েই যায়। এই ভালোলাগার বীজ বপন হয়েছিল আজ থেকে কিছু বছর আগে। শ্রাবণ ইউনিভার্সিটি শেষে রোজ ডুব সাঁতার দিতো নতুন বইয়ের গভীর জলে। শহরের এক বহু পরিচিত বইয়ের দোকানে। দোকান বললে ভুল হবে, সেটা ছিল এক শান্তির নীড়। কত কত রঙিন মলাটে মোড়া বইয়ের সমগ্র। হালকা গজলের সুরে ভরে উঠত সেই নীড়।ছোট ছোট চেয়ারে বসে শ্রাবণ হারিয়ে যেত অজানার টানে। একরকম নেশা লেগে থাকতো মনজুড়ে। ঠিক এমনই এক বৃষ্টির দিনে, বইয়ে মুখ লুকিয়ে ডুবে গিয়েছিল শ্রাবণ, জয় গোস্বামীর কবিতা সমগ্রে। হঠাৎ কারোর গম্ভীর গলার আওয়াজে ঘোর ভাঙলো। "কি নিলাদ্রী দা" বইটা এসেছে? এই বলে টেবিলে বসে আড্ডা জমিয়ে দিল। চা সিঙারায়, কথার আমেজে আরো গাঢ় হয়ে উঠলো। বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়তেই লাগলো। শ্রাবণ কেমন মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকে অপলক দৃষ্টিতে দেখেই গেলো। তার স্বর, তার কথার ধরন, সবকিছুই কেমন যেন একটা মায়াবী জালে জড়িয়ে নিয়েছিল শ্রাবনকে। শ্রাবণ ঠিক এমন ভাবেই হঠাৎ ভালো লাগার মোহে আটকে পড়েছিলো। রোজ একটা অজানার আকর্ষনে চলে আসতো সেই পুঁথিঘরে। বই পড়ার বাহানায় চোখ দুটো খুঁজে বেড়াতো সেই অচেনা মানুষটাকে।

একদিন শ্রাবণ অপেক্ষা করে বেরিয়ে আসছিল বইয়ের দোকান থেকে। ঠিক তখনই দরজার বাইরে দেখতে পেলো সেই লোকটাকে। "কি বই পড়া শেষ"? এমন প্রশ্নে শ্রাবণ কেমন হতচকিত হয়ে পড়ল। আমতা আমতা করে বলল "হ্যাঁ শেষ"। সেই দিনের এতটুকু কথার রেশ থেকে গেল শ্রাবণের মনে। অলস কোনো দুপুরে ফেসবুকে শ্রাবন তার প্রোফাইলটা দেখছিলো। হঠাৎ, সৌম্য মুখার্জী নামে একটা বন্ধু হওয়ার অনুরোধ ভেসে উঠলো প্রোফাইলের আইকনে। বিশ্বাস করতে পারছিল না শ্রাবণ, সত্যিই কি মানুষটা বন্ধু হতে চাইছিলো? শুরু হলো তাদের পথচলা কবিতার হাত ধরে। খুব ভালো লিখতো সৌম্য। তার ভাবনার শেকড় গাঁথা ছিল খুব গভীরে। ভাবনার এত মিল ছিল তাদের, যে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেত সেই তাদের চেনা পুঁথি ঘরের রুফটপে।

সৌম্য শ্রাবণের জন্মদিনে উপহারে দিলো গালিবের একটা বই।শায়েরিতে ভরাছিল সেই বইয়ের পাতা। উর্দুতে লেখা ছিল বলে, সেটা বাংলায় অনুবাদ করে বুঝিয়ে দেবার দায়িত্ব ছিল সৌম্যর। এমন ভাবে চলতে লাগল সৌম্য এবং শ্রাবণের প্রেমের ফল্গুধারা। একদিন সৌম্য সকালে ফোনে শ্রাবনকে সারপ্রাইজ করলো। লং ড্রাইভে যাওয়ার প্ল্যান করেছিল সৌম্য। শ্রাবণ খুব বেড়াতে ভালোবাসতো, তাই তাকে একটু খুশি রাখার জন্যই এই আয়োজন। ঐদিন নীল শাড়িতে শ্রাবনকে মনে হচ্ছিল, পুরো আকাশটাকে নিজের মধ্যে লুকিয়ে নিয়েছে। সৌম্য হালকা অলিভ রঙের টি-সার্ট পড়েছিল। সৌম্য শ্রাবণের ধারায় নিজেকে সিক্ত করে নিয়েছিলো। দুজন হারিয়ে গিয়েছিলো আঁকাবাঁকা রাস্তায়। রাস্তার দুধারে শাল গাছের বাগান বিস্তৃত। কিছুদূর এগিয়ে রক্তিম কৃষ্ণচূড়ার হাতছানিতে হারিয়ে গেলো শ্রাবণ। হঠাৎ গুনগুন করে গেয়ে উঠলো "ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে"। সৌম্যর কাঁধে মাথা রেখে শ্রাবণ অনুভব করেছিলো এক অমোঘ আকর্ষণ। নির্ভরতার এক বিশাল জায়গা খুঁজে পেয়েছিলো শ্রাবণ। নামে নাম গাঁথবে বলে হাজারো প্রতিশ্রুতি দিয়ে বুনেছিলো স্বপ্নহার। হয়তো বা তাই হলে, শ্রাবনকে আজও অপেক্ষায় থাকতে হতো না, সৃষ্টির শহর এমনভাবে তছনছ হয়ে যেত না।

সৌম্য বেশ কিছুদিন হলো ফোনে যোগাযোগ রাখছে না। হোয়াটসঅ্যাপেও শ্রাবণের কোনো প্রশ্নের উত্তরও দিচ্ছে না। শ্রাবণ বুঝেই উঠতে পারলো না কেনো সৌম্য তাকে এভোয়েড করছে? দেখা হচ্ছে না দুজনের অনেকটা দিন। শ্রাবণের কবিতার ঘর ভেঙে চুরে শেষ হয়ে গেছে। সৌম্যর ভালবাসায় কোনো খাদ ছিল না। সেটা শ্রাবণ ভালো করেই জানতো। বিশ্বাস ভাঙবে এমনও ছিলনা সৌম্য। তাহলে কেনো? শ্রাবনের কাছে সেটাই ছিল অজানা। সেই তাদের চেনা পুঁথি ঘরে শ্রাবণ অপেক্ষা করতো তার জন্য, যদি একবার দেখা হয়ে যায়। এমনভাবে একমাস দুমাস করে বছর কেটে গেলো। শ্রাবণ ও ক্রমশ স্বাভাবিক জীবন থেকে সরে এসে নিজেকে ঘরবন্দী করে নিয়েছিলো। শুধু সারা ঘর জুড়ে সৌম্যর লেখা কবিতারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে। শ্রাবণ প্রতিদিন সৌম্যর পাঠানো এসএমএস গুলোকে একবার পড়তো। জানিনা কি শান্তি খুঁজে পেতো মেয়েটা। হয়তোবা সৌম্যকে এমনভাবেই বাঁচিয়ে রাখতো সে।

একদিন অঝোরে বৃষ্টি পড়ছিলো। জানালায় চোখ রেখে, শ্রাবণ তাকেই মনে করছিলো। হঠাৎ ফোনের শব্দে ঘোর ভাঙলো তার। দৌড়ে এসে দেখে সৌম্যর কল। ফোনটা ধরে চিৎকার করে কেঁদে বলল "কোথায় ছিলে তুমি এতদিন? ফিরে এসো সৌম্য, ফিরে এসো"। ও পাড় থেকে ভেসে আসলো " শ্রাবণ আমাদের একসাথে আর পথ চলা হবে না। কবিতার সৃষ্টি না হয় তোমার হাত ধরে এগিয়ে চলুক"। শ্রাবন ছুটে গিয়ে বৃষ্টিতে তার জমানো কষ্ট, অভিমান, অভিযোগগুলোকে ভাসিয়ে দিলো। ঠিক দু'দিন পরে, সৌম্যর এক বন্ধু এসে শ্রাবনকে নিয়ে গেল সৌম্যর বাড়িতে। শ্রাবণ ঘরে ঢুকে দেখলো, একটা হালকা আলো জ্বলছে। টেবিলে পড়ে আছে সৌম্যর কবিতার বইগুলো। শ্রাবণের ছবি, তার দেওয়া উপহারগুলো সৌম্যর বিছানাজুড়ে। কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে পাচ্ছে না শ্রাবণ। রজত শ্রাবণকে একটা বাক্স দিয়ে বলল "এটা তোমার জন্য সৌম্য রেখে গেছে। সৌম্য প্রায় একবছর মৃত্যুর সাথে লড়াই করেছে। তাই তোমাকে নিজের থেকে সরিয়ে রেখেছিলো। গত পরশুদিন সে হারিয়ে গেল না ফেরার দেশে"। শ্রাবণ বাড়ি ফিরে সৌম্যর দেয়া বাক্সটা খুললো। বাক্স ভর্তি নানান রঙ্গের চিঠির খাম। একটা চিঠি শ্রাবণ তুলল, দেখলো শ্রাবনকে লেখা গত একবছরের কয়েকশো অভিমান, ভালোবাসা আর তার সাথে শ্রাবনকে দিয়ে গেল সৌম্যর অর্ধ সমাপ্ত কবিতার পান্ডুলিপি। পাঁচ মাস কেটে গেলো। শ্রাবণ সৌম্যর দেয়া শেষ কথা রেখেছে। সৌম্যর ফেলে রেখে যাওয়া কবিতার সম্ভার গুলো এখন নতুন বইয়ের মোড়কে ছাপা হয়েছে।

শ্রাবণ আজও সৌম্যকে সবার মাঝে বাঁচিয়ে রেখেছে, তারই লেখা 'শেষ প্রতিশ্রুতি' তে।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
মন্তব্যের তারিখ (Posted On)মন্তব্যকারির নাম (Name)মন্তব্য (Comment)
26.02.2022SupriyaMesmerized ❤️
25.02.2022Dhiman DebnathJust Awesome
25.02.2022B.DuttaHeart touching theme of the story. Well illustrative. Keep writing.
25.02.2022Akashdeep RakshitTruly amazing work..
25.02.2022Bharati duttaLikhgalper anuvoti,sabda chayan asadharan.parte give do chokh jalevore geche,asamvab valo likha,