কার্বন ট্রেডিং ; বিদেশী অর্থ উপার্জনের নয়া মাধ্যম
জয়ন্ত দেবনাথ
গ্রীন হাউস গ্যাসের (GHG) নির্গমন বৃদ্ধির কারনে গত কয়েক শতাব্দীতে কার্বন ফুটপ্রিন্ট বৃদ্ধির ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন একটি বাস্তব ঘটনা। এর ফলে বিশ্ব উষ্ণায়ন, আবহাওয়ার ব্যাঘাত, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে বিশ্বজুড়ে। বৈশ্বিক উষ্ণতা হ্রাস এবং জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমিত করার জন্য বিশ্বব্যাপী নেতারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এলক্ষে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসে কিয়োটো প্রোটোকল গৃহীত হয়েছিল যেখানে গ্রীন হাউস গ্যাস (GHG) নির্গমন হ্রাসের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। এই প্রোটোকলটি সদস্য রাষ্ট্র গুলি তাদের গ্রীন হাউস গ্যাসের নির্গমন হ্রাসের লক্ষ্য পূরণের জন্য বাজার-ভিত্তিক প্রক্রিয়া গুলি প্রবর্তনের ফলে কার্বন ক্রেডিট বাজারের বিকাশ ঘটেছে।
একটি কার্বন ক্রেডিট হল একটি ট্রেডযোগ্য পারমিট বা শংসাপত্র যা ক্রেডিট ধারক বা এর ক্রেতাকে এক টন কার্বন ডাই অক্সাইড বা অন্য যেকোনো গ্রিনহাউস গ্যাসের সমতুল্য নির্গত করার বা বায়ুমণ্ডলকে দূষিত করার স্বাধীনতা বা ক্ষমতা দেয়। ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী কার্বন ক্রেডিটের প্রয়োগকে আরও শক্তপোক্ত ভাবে ক্ষমতা ও স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং এর সুবিধার জন্য বিস্তৃত বিধান নির্ধারণ করা হয়।
ত্রিপুরা দেশের হাতে গুনা কয়েকটি রাজ্যের মধ্যে অন্যতম যারা কার্বন ক্রেডিট নিয়ে সম্প্রতি কাজ শুরু করেছে। উত্তর পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় রাজ্য আসামও এখন পর্যন্ত গ্রিনহাউস গ্যাসের (CO2) নির্গমন হ্রাস বা কার্বন ক্রেডিট কিংবা কার্বন ট্রেডিং-এর বাণিজ্যিক ধারনাকে কাজে লাগিয়ে বৈদেশিক অর্থ উপার্জনের কাজ শুরু করতে পারেনি। ত্রিপুরার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তরকে রাজ্য সরকার কার্বন ক্রেডিট নিয়ে যাবতীয় কাজের নোডাল দপ্তর হিসাবে ঘোষণা করেছে। যদি সঠিক ভাবে ত্রিপুরার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তর একাজটি করতে পারে, তাহলে নিকট ভবিষ্যতে ত্রিপুরাও দেশের একটি অন্যতম কার্বন ক্রেডিট বিক্রেতা রাজ্য হিসাবে উঠে আসার সম্ভাবনা প্রবল। এর ফলে সরকারী ও বেসরকারি ক্ষেত্রে গাছপালার মালিকরাও কার্বন ক্রেডিট বিক্রেতা হিসাবে প্রচুর টাকা কামাতে পারবে। অবশ্য এলক্ষে রাজ্য সরকারকে বেশ কিছু নীতি নির্দেশিকা প্রনয়ন করতে হবে। ইন্দুর স্মার্ট সিটি লিমিটেড দেশের প্রথম রাজ্য যারা ইতিমধ্যেই কার্বন ট্রেডিং করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করেছে। তাই ইন্দুর স্মার্ট সিটির সাথে মিলে রাজ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তর সম্প্রতি এব্যাপারে কাজ শুরু করেছে। এবং গত ৫ জানুয়ারী ত্রিপুরার মুখ্য সচিব কুমার আলোক ও রাজ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তরের-এর প্রধান সচিব বি কে সাহু-র উপস্থি্তিতে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ইন্দুর স্মার্ট সিটির বিশেষজ্ঞদের সাথে প্রথম কার্বন ক্রেডিট মনিটাইজেশনের জন্য অ্যাগ্রিগেটর বিজনেস মডেল (Aggregator Business Model for Carbon Credits Monetization) নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে, কার্বন ট্রেডিং-এর ধারণা ১৯৯৭ সালে জাপানের কিয়োটো প্রোটোকলে বায়ু দূষনকারী পদার্থের (CO2) নির্গমন হ্রাসের লক্ষে গৃহীত হয়েছে। এর মাধ্যমে বিশ্ব উষ্ণায়নের হাত থেকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে রক্ষার উদ্দেশ্যে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে ২০০২ সাল থেকে কার্বন ট্রেডিং-এর ধারণার বিকাশ ঘটে। একে বায়ুমণ্ডলে CO2-এর পরিমান হ্রাসের উদ্দেশ্যে একটি আন্তর্জাতিক বাজার কেন্দ্রিক পদক্ষেপও বলা যেতে পারে।
কিয়োটো প্রোটোকলে জলবায়ু পরিবর্তনের উপর জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন (United Nations Framework Convention on Climate Change) অনুযায়ী পৃথিবীর প্রতিটি দেশ কি পরিমান বায়ু দূষক বাতাসে নিঃসরণ করতে পারবে তার একটি নিদিষ্ট মাত্রা ঠিক করে দেয়া আছে। যদি কোনো দেশ সেই নিদিষ্ট মাত্রার থেকে বেশি বায়ুদূষক (CO2) নির্গমন করতে চায়, তাহলে অন্য যে দেশ গুলি তাদের সেই নিদিষ্ট মাত্রার থেকে কম বায়ুদূষক (CO2) বায়ুমণ্ডলে ত্যাগ করে, সেই দেশ গুলি থেকে অর্থের বিনিময়ে অতিরিক্ত বায়ুদূষক (CO2) ত্যাগের পারমিট ক্রয় করতে হবে। এই ভাবে বিশ্ব ব্যাপী বায়ুদূষনের পরিমান কমানো সম্ভব। আর বায়ু দূষণ কমানোর এই বাণিজ্যিক কৌশলকেই সংক্ষেপে বলা হচ্ছে কার্বন ক্রেডিট। অর্থাৎ যে দেশ বেশী বায়ু দূষণ করছে তারা যে দেশ গুলি অপেক্ষাকৃত কম বায়ু দূষণ করছে তাদের কাছ থেকে কার্বন ক্রেডিট –এর পারমিট নিয়ে বায়ু দূষণ খানিকটা বাড়াতে পারবে। এক কথায় বলতে গেলে কার্বন ক্রেডিট হল এক ধরনের বানিজ্যিক শংসাপত্র বা অনুমোদন যা কোনো একটি দেশকে ১ টন কার্বন বা কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) ত্যাগ করার অনুমোদন দেয়। অর্থাৎ ১ টি কার্বন ক্রেডিট ১ টন কার্বন ডাই অক্সাইডের সমান।
২০০৫ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সর্বপ্রথম কিয়োটো প্রোটোকল অনুযায়ী এই ধরণের কার্বন ট্রেডিং ব্যবস্থার সূচনা করেন। ২০১১ সালে পৃথিবীর সর্ব প্রথম দেশ হিসাবে কানাডা জলবায়ু পরিবর্তনের উপর জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন (UNFCCC) দ্বারা কিয়োটো প্রোটোকলে নির্ধারিত সেই নিদিষ্ট মাত্রায় পৌছাতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে, বিশ্বের কার্বন ট্রেডিং-এর বাজারে প্রধান দুটি বায়ুদূষনকারী দেশ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ সেই নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌছাতে এখনও অবধি সফল হয়নি। জাপানের ক্রিয়োটো প্রোটোকলে ১৬৯ টি দেশ কার্বন ক্রেডিট-এর আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে । যেসব দেশ জাপানের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে, সে সব দেশ তাদের শিল্প কারখানা বা সংস্থা গুলিকে গ্যাস (CO2) নির্গমনের নিয়ম বেধে দিয়েছে। এক্ষেত্রে কোম্পানি গুলি দুটি উপায়ে গ্যাস (CO2) নির্গমনের পরিমান কমাবে।
১. গ্যাস নির্গমনের নতুন নিয়ম অনুসারে গ্রিনহাউস গ্যাসের (CO2) নির্গমন কমানোর জন্য নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে বা পুরনো প্রযুক্তি গুলির উন্নতির ঘটাতে হবে জাতে করে কার্বন ডাইওক্সাইড বাতাসে কম নির্গত হয়।
২. উন্নত দেশ গুলি উন্নয়নশীল দেশ গুলিতে পরিবেশ বান্ধব নতুন প্রযুক্তি গুলি স্থাপন করবে। এভাবে উন্নয়নশীল দেশ গুলিকে কার্বন ক্রেডিট পেতে সাহায্য করতে পারে। এরপর উন্নত দেশটি এই কার্বন ক্রেডিট অর্থাৎ ১ টন কার্বন ত্যাগ করার অনুমতিটি নিজের দেশে প্রয়োগ করে গ্রিনহাউস গ্যাসের (CO2) নির্গমন সেই অনুযায়ী কিছুটা বাড়াতে পারবে।
ভারত ও চিন উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে পরিচিত বিশ্ব জুড়ে। এই হিসাবে ভারত ও চিন বিশ্বের অন্যতম প্রধান কার্বন ক্রেডিট বিক্রেতা দেশ হিসাবে পরিচিত । গ্রিনহাউস গ্যাসের (CO2) নির্গমনকারী দেশ হিসাবে পরিচিত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশ গুলি বিশ্বের সর্বাধিক কার্বন ক্রেডিট ক্রেতা। বর্তমানে চিন বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো কার্বন ক্রেডিট বিক্রেতা দেশ। বিশ্ব বাজারের প্রায় ৭০% দখল করে আছে চিন । কার্বন ক্রেডিট বিক্রীর বিশ্ব বাজারে ভারত অনেকটাই পিছিয়ে আছে। দেশের খুব কম রাজ্যই গ্রিনহাউস গ্যাস, কার্বন ক্রেডিট নিয়ে কাজ শুরু করেছে। এক্ষেত্রে ত্রিপুরা দেশের হাতে গুনা কয়েকটি রাজ্যের মধ্যে অন্যতম যারা কার্বন ক্রেডিট নিয়ে ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করেছে।ত্রিপুরার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তরকে রাজ্য সরকার কার্বন ক্রেডিট নিয়ে যাবতীয় কাজের নোডাল দপ্তর হিসাবে ঘোষণা করেছে। যদি সঠিক ভাবে ত্রিপুরার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তর একাজটি করতে পারে তাহলে নিকট ভবিষ্যতে ত্রিপুরাও দেশের একটি অন্যতম কার্বন ক্রেডিট বিক্রেতা রাজ্য হিসাবে উত্থিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এর ফলে সরকারী ও বেসরকারি ক্ষেত্রে গাছপালার মালিকরাও কার্বন ক্রেডিট বিক্রেতা হিসাবে প্রচুর টাকা কামাতে পারবে। অবশ্য এলক্ষে রাজ্য সরকারকে বেশ কিছু নীতি নির্দেশিকা প্রনয়ন করতে হবে। যা বিলম্বে হলেও ইন্দুর স্মার্ট সিটির সাথে মিলে রাজ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তর সম্প্রতি শুরু করেছে। এবং গত ৫ জানুয়ারী ত্রিপুরার মুখ্য সচিব কুমার আলোক ও রাজ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি-এর প্রধান সচিব বি কে সাহু-র উপস্থি্তিতে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ইন্দুর স্মার্ট সিটির বিশেষজ্ঞদের সাথে প্রথম কার্বন ক্রেডিট মনিটাইজেশনের জন্য অ্যাগ্রিগেটর বিজনেস মডেল (Aggregator Business Model for Carbon Credits Monetization) নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
কার্বন ক্রেডিট থেকে সুযোগ এবং সুবিধা
১। জাতির জন্য বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের সুযোগ।
২। কোন অতিরিক্ত মূলধন বিনিয়োগ ছাড়াই গাছপালা থেকে নিশ্চিত আয়ের সুযোগ।
৩। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে খ্যাতি উন্নত করার সুযোগ।
৪। পরিচ্ছন্ন পৃথিবী ঘটনে অবদান রাখার মতো উদ্ভাবনী উদ্যোগে নিজেকে সামিল করা।
কার্বন ক্রেডিট বিক্রির জন্য যোগ্য প্রকল্প বা সুযোগের একটি নির্দেশক তালিকা
১। পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি প্রকল্প - বায়ু, হাইড্রো ও ছাদের উপরে সৌর বিদ্যুৎ, LED-র ব্যাবহার বাড়ানো।
২। কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বায়ো-গ্যাস, স্যুয়েজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বেশী করে স্থাপন।
৩। পরিবহন – ক্ষেত্রে ইলেকট্রিক কারের সংখ্যা বাড়ানো বা বাইসাইকেল ভিত্তিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম, মেট্রো রেল-এর প্রসার।
৪। বনায়ন ও বড় আকারের বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম, বাণিজ্যিক বৃক্ষরোপণ প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করা ।
৫। প্লাস্টিক বর্জন এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্রকল্প ও প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করা ।
৬। শিল্প ক্ষেত্রে কার্বনডাই অক্সাইড নির্গমন হ্রাস প্রকল্প
৭। গবাদি পশু ব্যবস্থাপনা - বায়োগ্যাস এবং গো-কাস্ট উৎপাদন প্রকল্প ও প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করা ।
৮। বৈদ্যুতিক যানবাহন এবং নেট কার্বন নিঃসরণ কমাতে সাহায্য করে এমন অন্য যেকোনো প্রকল্পে ও প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করা ।
ইন্দোর স্মার্ট সিটি হল দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম স্মার্ট শহর যারা সফলভাবে কার্বন ক্রেডিট বিক্রি করে এবং ভারতের একমাত্র রাজ্য যারা প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য পরিমানে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করছে। একই সাথে ত্রিপুরা সরকারের সাথে চুক্তির ভিত্তিতে ইন্দোর স্মার্ট সিটি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড এ রাজ্যের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগকেও পরামর্শ দিচ্ছেন। ঠিকঠাক ভাবে ত্রিপুরার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তর একাজটি করতে পারলে নিকট ভবিষ্যতে ত্রিপুরাও দেশের একটি অন্যতম প্রধান কার্বন ক্রেডিট বিক্রেতা রাজ্য হিসাবে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের সম্ভাবনা রয়েছে। (লেখক-জয়ন্ত দেবনাথ tripurainfo.com – এর সম্পাদক ও এমডি)