আগরতলায় মণিপুরের বিদ্রোহী রাজকুমার নরেন্দ্রজিতের স্মৃতিচিহ্ন
পান্নালাল রায়
১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ অর্থাৎ দেশের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রভাব পড়েছিল উত্তর পূর্বাঞ্চলে। চট্টগ্রামের ৩৪নং পদাতিক বাহিনীর ভারতীয় সিপাহিরা বিদ্রোহ করে ত্রিপুরার দিকে ধাবিত হয়েছিল। তারপর মণিপুরে যাবার উদ্দেশ্যে তারা সিলেট হয়ে কাছাড়ে রায়। শেষ পর্যন্ত কাছাড়ে ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে অসম যুদ্ধে বিদ্রোহীদের অনেকের মৃত্যু ঘটে।তার আগে কুমিল্লা ও সিলেটে ধরা পড়ে কয়েকজন বিদ্রোহীর ফাঁসিও হয়। এভাবেই চট্টগ্রাম থেকে বয়ে আনা বিদ্রোহের মশাল নির্বাপিত হয়। সেদিন মণিপুরের রাজ্যত্যাগী রাজকুমার নরেন্দ্রজিৎ কাছাড়ে বিদ্রোহী সিপাহিদের সঙ্গে যোগ দিয়ে ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর শেষ পরিণতি এখনও রহস্যাবৃত। তিনি 'মণিপুরের নেতাজি' হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আছেন।
১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ চলাকালীন সময়ে আসাম,জয়ন্তিয়া,ডিমাছা রাজ্য কাছাড় পুরোপুরি ইংরেজ নিয়ন্ত্রণে। মণিপুর এবং পার্বত্য ত্রিপুরার রাজাদের স্বাধীনতা ছিল প্রশ্ন কন্টকিত।সেই স্বাধীনতা ছিল অনেকটা ইংরেজদের অনুকম্পা নির্ভর।
মণিপুরী রাজকুমার নরেন্দ্রজিৎ কাছাড়ে বিদ্রোহী সিপাহিদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। ইংরেজ বিরোধিতার পাশাপাশি হয়তো বিদ্রোহী সিপাহিদের সহায়তায় মণিপুরের সিংহাসনে বসার অভিলাষী ছিলেন তিনি।মণিপুরের রাজা চন্দ্রকীর্তি সে সময় দ্বিমুখী চাপের মুখে ছিলেন। ইংরেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মিত্রতা পূর্ণ সম্পর্কের মধ্যেও ছিল এক অবিশ্বাসের বাতাবরণ।ইম্ফলে নিযুক্ত ইংরেজ দূতের উপর নজরদারির দায়িত্ব ছিল। এছাড়া রাজপরিবারের অন্তর্দ্বন্দ্ব, ষড়যন্ত্র ইত্যাদিতো ছিলই।
কাছাড়ে অবস্থানরত নরেন্দ্রজিৎ কিছু অনুগামী নিয়ে চট্টগ্রামের বিদ্রোহী সিপাহিদের সঙ্গে যোগ দিয়ে ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। বিদ্রোহী রাজকুমার টিকেন্দ্রজিতের শেষ পরিণতি আজও রহস্যাবৃত। ইংরেজ কর্তৃপক্ষের রিপোর্ট অনুসারে জানা যায়,যুদ্ধে আহত হয়ে তিনি মণিপুরে আত্মগোপন করেছিলেন। তারপর রাজার সৈন্যদের হাতে বন্দী হন তিনি। রাজা নরেন্দ্রজিৎকে বন্দি অবস্থায় কাছাড়ের সুপারিনটেনডেন্ট স্টুয়ার্টের কাছে পাঠিয়ে দেন। অন্যান্য বন্দিদের সঙ্গে তাঁকেও বিচারের জন্য কলকাতা পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। বিদ্রোহী রাজকুমারকে তারপর পাঠিয়ে দেয়া হয় আন্দামানে। কিন্তু সেখান থেকে তিনি ফিরে এসেছেন কিংবা তাঁর মৃত্যু ঘটেছে এরকম কোনো খবর পাওয়া যায়নি। নেতাজি সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধান রহস্যের মতোই নরেন্দ্রজিতের শেষ পরিণতি নিয়ে থেকে যায় এক রহস্য। তিনি যেন কিংবদন্তির রাজকুমার হয়ে বেঁচে আছেন মণিপুরীদের মধ্যে। তিনি মণিপুরের রাজা ভাগ্যচন্দ্রের পৌত্র এবং চৌরজিতের পুত্র।এক সময় চৌরজিৎ কাছাড়ের একটি অংশে রাজত্ব করেছিলেন।
আন্দামান থেকে নরেন্দ্রজিতের অন্তর্ধান নিয়েও নানা কাহিনি প্রচলিত আছে।এই রাজকুমার নাকি মণিপুরী চিকিৎসা রীতিতে খুবই দক্ষ ছিলেন। শোনা যায়, এই ভাবেই তিনি আন্দামানে জেলারের স্ত্রীর কঠিন অসুখ সারিয়ে তুলেছিলেন এবং কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিসেবে জেলার নরেন্দ্রজিৎকে জেল থেকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। তারপর নাকি মাদ্রাজ হয়ে ফিরে আসেন মণিপুর। কিন্তু এরপর আর তাঁর কোনো কাজ খোঁজ পাওয়া যায় নি। নানা সময়ে তাকে নিয়ে শোনা গিয়েছিল নানা কথা। কেউ কেউ নাকি কাছাড়ের ভুবন পাহাড়ে এক সাধুর বেশে দেখেছিল তাকে। আবার কাছাড়ের লক্ষ্মীপুরের কাছে বরাক নদীর মাঝে ছোট্ট এক দ্বীপেও নাকি এক সাধুকে দেখা যেত।আজানুলম্বিত তাঁর হাত। হঠাৎ হঠাৎ প্রয়োজন মতো এই সাধু এসে দুঃস্হ রোগীদের চিকিৎসা করে যান।
১৮৫৭ সালের মহা বিদ্রোহের সময় অনুগামী সহ বিদ্রোহী সিপাহিদের সঙ্গে যোগ দিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মধ্য দিয়ে রাজকুমার নরেন্দ্রজিৎ কাছাড়-মণিপুরের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছেন।এই রাজকুমারের উত্তর পুরুষরা আজ আগরতলায় বাস করছেন। তারা পরম শ্রদ্ধায় সংরক্ষণ করেছেন তাঁর নানা স্মৃতিচিহ্ন।
নরেন্দ্রজিতের পরবর্তী চতুর্থ পুরুষ হলেন রাজকুমার জিতেন্দ্রজিৎ সিংহ। ত্রিপুরার বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী।প্রায় দেড় দশক আগে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, নরেন্দ্রজিৎকে নিয়ে মণিপুরীদের মধ্যে রয়েছে অসীম আগ্রহ আর শ্রদ্ধাবোধ।বরাক উপত্যকার হাইলাকান্দির জারিবন এলাকা, যেখানে বড় হয়ে উঠেছেন নরেন্দ্রজিৎ, সেখানে তাঁকে নিয়ে চর্চা হয়। সেদিন জিতেন্দ্রজিৎবাবু আরও বলেছিলেন যে, আগরতলার ধলেশ্বরে তাদের আত্মীয় বীরজিতের বাড়িতে বিদ্রোহী রাজকুমার নরেন্দ্রজিতের আচকান, কাঠের পাদুকা,জন্ম কোষ্ঠী,হাতে লেখা ভাগবত ইত্যাদি পবিত্র ভাবে সংরক্ষিত আছে। বছরে একবার তা সাধারণের জন্য খুলে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।আগরতলার ধলেশ্বর -কল্যাণীর জাফিরবন বলে পরিচিত এলাকায় 'বিপ্লবী নরেন্দ্রজিৎ' সরণি নামে একটি রাস্তাও আছে।