আজ ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ ভালোবাসার দিন

রাজীব দত্ত

প্রেম আর যুদ্ধে সবই ন্যায্য এবং সম্ভব। তাই ভারতবর্ষ পাঁচ হাজার বছর আগেকার রাধা- কৃষ্ণের পরকীয়াকে আজও শ্রদ্ধা করে। বনবাসী অর্জুন মণিপুরে এসে ভালোবেসে ফেললেন চিত্রাঙ্গদাকে। তারও আগে উমা নেশারু স্বামী শিবের বদনাম সহ্য করতে না পেরে দক্ষ যজ্ঞে আত্মহত্যাই করে বসলেন। প্রেয়সীর জন্যে এই পৃথিবীর ইতিহাসে এটাই বোধহয় প্রথম আত্মহত্যার ঘটনা। স্ত্রী উমার শোকে শেষে তাণ্ডব শুরু করলেন শিব। পুরো সৃষ্টিই ধংশ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। সেই তান্ডব থেকেই আবার সঙ্গীত নৃত্যের সৃষ্টি।

এরপর উনিশ শতকে এলে শরৎচন্দ্রের দেবদাস কে দেখি আমরা। সেই নেশারু শিবের মতো রাফটাফ প্রেমিক। নাছোড়বান্দা প্রেমিক। বাঙালি দেবদাসের প্রেমে মজে গেলো। এলো টেলিভিশান আর বাংলা-হিন্দি সিনেমার যুগ। দীলিপকুমার, দেবআনন্দ, রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চন রেখা, রাখী, শর্মিলা ঠাকুর, তনুজা, ডিম্পল কাপাডিয়া’দের একের পর এক রোমান্টিক ফিল্ম সিল্ভার স্ক্রিন জুড়ে। দেশের মানুষ প্রেমের জোয়ারে ভাসল। আর বাংলায় সুচিত্রা-উত্তম কুমারের প্রেম সিল্ভার স্ক্রিন ছাড়িয়ে ব্যাক্তিগত জীবনেও তোলপাড়। বিংশ শতকে এসে মহুয়া রায় চৌধুরী খোঁপার গোলাপ দিয়ে বোকাবোকা ভালো ছেলে তাপস পাল’কে প্রেমে ফেললেন। আর এই দশকে শাহ্রুখ এখনও একশ কোটি আয় করেন দেবদাস সেজে। এই দেশ সবসময়েই প্রেমকে হৃদয় পেতে নিয়েছে। প্রেমে ক্ষতবিক্ষত হলেও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সেই প্রেমিকার দুয়ারে গিয়েই নিজেকে বলি দিতে বিন্দুমাত্র ভাবেনি। জয়চন্দ্রও শেষ মুহূর্তে প্রেমিকার দরজার সামনে এসেই নিজেকে আত্মাহুতি দিল।

আজকের এই আধুনিক সময়ে ওয়েব দুনিয়া আর স্যোসাল মিডিয়ায় প্রেমের ছড়াছড়ি। পোষ্ট অফিসের ডাক বাক্স গুলি আজ আর নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রেমও আধুনিক হয়েছে। তাই পৃথিবীটা নিরেট পাথরের মতো মনে হলেও প্রেম এখনও একই রকম। ফুলের রঙ অনেকটাই ফিকে হয়ে যাচ্ছে ক্লাইমেট চেইঞ্জের কারনে, কিন্তু প্রেম এখনও উজ্জল। তাই আজকেও ফুল, চকলেট দেয়ানেয়া হবে দেশজুড়ে, বিশ্বজুড়ে। আজ ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’।

এই ভ্যালেন্টাইন ডে’র ইতিহাস কিন্তু যুদ্ধ আর ক্ষমতার লড়াইয়ে রক্তাক্ত। ভ্যালেন্টাইন ডে’র ইতিহাস নিয়ে নানা মুনির নানা মত। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এক পরাক্রমশালী রাজা আর একজন সাধারণ পাদ্রীর মধ্যে ধর্মের সংঘাত। আসলে “ভ্যালেন্টাইনস” কোনও দিনের নাম নয়। রোমের এক পাদ্রী (ধর্মযাজক) এবং একজন সুপরিচিত চিকিৎসকের নাম ছিল ভ্যালেন্টাইন। “অরিয়া অফ জ্যাকবাস ডি ভোরাজিন” গ্রন্থ অনুযায়ী, তৃতীয় শতাব্দীতে রোম সম্রাট ক্লোডিয়াস- এর শাসনকালে, যুদ্ধবাজ রাজা ক্লোডিয়াস তাঁর রাজ্যকে শক্তিশালী করার জন্য একটি বিশাল সেনাবাহিনী তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি দেখেন যেসব সৈনিকদের স্ত্রী ও সন্তান রয়েছে তারা যুদ্ধক্ষেত্রে লড়তে চায় না। সেই কারণে রাজা ক্লোডিয়াস রেগে গিয়ে দেশের সমস্ত সৈনিকদের বিবাহ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। দেশের তরুণ-তরুণী, সাধারণ মানুষ সবাই রাজার এই নিয়মের বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু কেউই শাসকের বিরুদ্ধে কিছু বলতে সাহস দেখায়নি। তবে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন’ রাজার এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধীতা করেছিলেন এবং তিনি গোপনে সৈনিকদের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করতে থাকেন। কিন্তু রাজা একদিন এই খবর জেনে যায় এবং নিয়ম ভঙ্গ করার অপরাধে সেন্ট ভ্যালেন্টিনকে কারাগারে বন্দি করেন।

সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস যখন কারাগারে বন্দি ছিলো, তাঁর অনুগামীরা গোলাপ আর নানা উপহার নিয়ে তার সাথে দেখা করতে আসতো এবং তারা খ্রীস্টধর্ম গ্রহণ করতো। এছাড়াও বন্দি অবস্থায় তিনি অলৌকিক চিকিৎসা শক্তির দ্বারা এক কারারক্ষীর অন্ধ মেয়ের দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। মেয়েটিকে একটি চিঠিও লিখেছিলেন মৃত্যুর আগে ভ্যালেন্টাইন। সেই চিঠির শেষে লেখা ছিল “লাভ ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন”। মেয়েটি চিরকুটের ভেতরে বসন্তের হলুদ ত্রৌকস ফুলের আশ্চর্য সুন্দর রং দেখতে পেয়েছিল কারণ, ইতোমধ্যেই মেয়েটির অন্ধ দু’চোখে দৃষ্টি ফিরে এসেছিল। ভ্যালেন্টাইনের এই অলৌকিক শক্তির কথা জানতে পেরে বহু মানুষ অনুপ্রাণিত হয়ে খ্রীস্টধর্ম গ্রহণ করতে থাকে এবং পাদ্রী ভ্যালেন্টাইন একজন চিকিৎসক হিসেবেও সাধারণ মানুষের কাছে দারুন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। কারাগারে ভ্যালেন্টাইনের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়তে দেখে রাজা ভয় পেয়ে যান। ক্ষমতা হারানোর ভয়ে, সেন্ট ভ্যালেন্টাইনসকে ১৪ই ফেব্রুয়ারি ২৬৯ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁর অনুগামীদের উদ্দেশে একটি চিঠি লিখেছিলেন, যাতে তিনি ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখার অনুরোধ করেছিলেন। ভালবাসার এইসব কীর্তির জন্য ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে, ‘পোপ জেলাসিয়ুস’ ফেব্রুয়ারির মাসের ১৪ তারিখকে ভ্যালেন্টাইন্স ডে হিসেবে ঘোষণা করেন। সেই থেকে এই দিনটি বিশ্বজুড়ে ভ্যালেন্টাইন্স ডে হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

তবে ভিন্ন মতও রয়েছে। কথিত আছে, প্রাচীন রোমে ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল রোমানদের প্রেমের দেবী, জুনো’র সম্মানে ছুটির দিন। কারো করো মতে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস হওয়ার কারণ ছিল এটিই।

তবে এটিও সর্বজন স্বীকৃত ইতিহাস নয়। এখানেও দ্বিমত আছে। কারও কারও মতে, প্রাচীন রোমে ভ্যালেন্টাইন নামে একজন চিকিৎসক ছিলেন। তিনি রোগীদের প্রতি ছিলেন ভীষণ সদয়। অসুস্থ মানুষের ওষুধ খেতে কষ্ট হয় বলে তিনি তেঁতো ওষুধ ওয়াইন, দুধ বা মধুতে মিশিয়ে রোগীদের খেতে দিতেন। সেই ডাক্তার খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। প্রাচীন রোমে খ্রিস্টধর্ম তখন মোটেও জনপ্রিয় ছিল না। এই ধর্মে বিশ্বাসীদের শাস্তি দেওয়া হতো। একদিন রোমের এক কারা প্রধান তার অন্ধ মেয়েকে ভ্যালেন্টাইনের কাছে নিয়ে এসেছিলেন চিকিৎসার জন্য। ভ্যালেন্টাইন কথা দিয়েছিলেন তিনি তার সাধ্যমতো চিকিৎসা করবেন। মেয়েটির চিকিৎসা চলছিল এমন সময় হঠাৎ একদিন রোমান সৈন্যরা এসে ভ্যালেন্টাইনকে বেঁধে নিয়ে যায়। ভ্যালেন্টাইন বুঝতে পেরেছিলেন, খ্রিস্টান হওয়ার অপরাধে তাকে মেরে ফেলা হবে।

আরেকটি প্রচলিত ধারনা হলো, প্রাচীনকালে মানুষের বিশ্বাস ছিল, ১৪ ফেব্রুয়ারি হলো পাখিদের বিয়ের দিন। পাখিরা বছরের দ্বিতীয় মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ডিম পাড়তে বসে। আবার কেউ বলেন, মধ্যযুগের শেষদিকে মানুষ বিশ্বাস করত এদিন থেকে পাখিদের মিলন ঋতু শুরু হয়। পাখিরা সঙ্গী খুঁজে বেড়ায়। পাখিদের দেখাদেখি মানুষও তাই সঙ্গী নির্বাচন করে বসন্তের এই দিনে।

৪৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র উদ্ভব হলেও প্রথম দিকে এই উৎসব বিশ্বব্যাপী তেমনভাবে প্রচার ও প্রসার লাভ করেনি। পাশ্চাত্য দেশগুলিতে জন্ম দিন বা বিয়ের উৎসব, ধর্মোৎসব বা অন্য কোন উৎসব, সবক্ষেত্রেই ভোগের বিষয়টি মুখ্য। তাই গির্জার অভ্যন্তরেও মদ্যপান চলতো। খ্রিস্টীয় চেতনা, ভ্যালেন্টাইন দিবসের কারণে বিনষ্ট হওয়ার অভিযোগে ১৭৭৬ সালে ফ্রান্স সরকার ‘ভ্যালেন্টাইন্স উৎসব’ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ইংল্যান্ডে ক্ষমতাসীন পিউরিটানরাও একসময় প্রশাসনিক ভাবে এই দিবসটি উৎযাপন করা নিষিদ্ধ করেছিল। এছাড়া অস্ট্রিয়া,হাঙ্গেরি ও জার্মানিতে বিভিন্ন সময়ে এ দিবসটিকে জনগণ ও সরকার প্রত্যাখ্যান করেছিল।

তাছাড়া প্রাচীন রোমানরা পৌত্তলিক ধর্মীয় উৎসব ‘লুপারকেলিয়া’ পালন করতেন ফেব্রুয়ারি মাসের ১৩ থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত। পোপ কর্তৃক ভ্যালেন্টাইন কে ‘সেইন্ট’ হিসেবে ঘোষণা দেয়ার আগে এই ‘লুপারকেলিয়া’ উৎসবই প্রচলিত ছিল রোমে। এই উৎসবে, শহরের যুবকদের মধ্যে যুবতীদের বণ্টনের জন্য একটা লটারির আয়োজন হত। তারা যুবতী মেয়েদের নাম লিখে একটি বাক্সে তা রাখত এবং লটারির মাধ্যমে যুবকরা এসে মেয়েদের নাম লেখা সেই চিরকুট তুলে নিত। লটারিতে যার সাথে, যার নাম উঠত এক বছরের জন্য সেই যুবক-যুবতী একসঙ্গে জীবনযাপন করতে পারতো। যদিও ফ্রান্স সরকার ১৭৭৬ সালে এই প্রথাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ক্রমান্বয়ে এই প্রথা ইতালি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও জার্মান থেকেও উঠে যায়।

আজ সমাজ পাল্টেছে। তার সাথে ভাবনা চিন্তারও আমূল পরিবর্তন হয়েছে। ভারতবর্ষ সহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এই উৎসব মানেই ভালোবাসা আর প্রেমের দিন। যুক্তরাষ্ট্রে এই দিনে প্রায় তিন কোটি শুভেচ্ছা কার্ড আদান-প্রদান হয়। কেউ কেউ বলেন বিপণন আর ব্যাবসাই আসল উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য যাই হোক কাঠ পাথর আর মহামারীতে আচ্ছন্ন এই পৃথিবীর মানুষ আরেকটা উৎসব মুখর ফুরফুরে দিন পেল ভালো থাকার, ভালোবাসার। গোলাপ বিক্রি হবেই আজ। প্রেম হোক আর না হোক, আজ ভ্যালেন্টাইন।

তাই প্রেম হোক আর না হোক আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারি। কোভিড অতিমহামারিতে পৃথিবী যখন ক্লান্ত, মানুষ যখন অবসাদে ভুগছে তখন আরেকটা দিন উদযাপন করার জন্যে, ভালোবাসার জন্যেই শুধু খারাপ কি! মানুষের মানবিক দিকগুলি আজ অনেকটাই নিশ্চিহ্ন। তাই আজকের জেন-ওয়াই যেন অনেক ম্যাচুয়র এবং প্র্যকটিকেল। তবুও এই দিনটিকে ঘিরেই মেতে উঠবে মানুষ। গোলাপ, চকলেট, কার্ড, আর নানা উপহার দেয়া নেয়া চলবে। আরেকবার মানুষ নিজের প্রিয় মানুষটিকে হয়তো বলবে, ‘ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রেখো। প্রেম চিরন্তন, ভালোবাসা ফুরিয়ে যাওয়ার নয়’। বা তুমি কি আমার ভ্যালেন্টাইন হবে! সুন্দর দেখাচ্ছে আজ এই পৃথিবীকে অনেক শুধু ভালোবাসার জন্যেই হয়তো।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.