ভালোবাসায়, বিপ্লবে, রেশনে, মুদ্রায় চকলেট আজ ‘চকলেট ডে’
রাজীব দত্ত
চলছে ভ্যালেন্টাইন উইক। আর এই প্রজন্মের কাছে আজ ‘চকলেট ডে’। তবে চকলেট কি শুধুই ভালোবাসায়? না চকলেট রেশনে, সেনাবাহিনীকে চাঙ্গা রাখতে চকলেট, মুদ্রায় চকলেট, বিশেষ লেনদেন চূড়ান্ত করার অনুষ্ঠানে, শক্তি বাড়াতে চকলেট। আমেরিকার বিপ্লবেও চকলেট। এমনকি হার্ট আর ব্রেইন ভালো রাখতে, ক্যান্সার থেকে বাচতেও চকলেট। আনন্দে থাকতেও চকলেট। নিশ্চই ভাবছেন এটাও সম্ভব? হ্যাঁ একসময়ে আমেরিকান সেনাদের, রেশনে নিয়মিত চকলেট দেয়া হতো।
কিন্তু বিজ্ঞানীরা দৈববাণী করেছেন, এই চকলেট ফুরিয়ে যাচ্ছে আগামী ২০৫০ সাল অর্থাৎ আর মাত্র ত্রিশ বছরের মধ্যেই। তাই চকলেট ডেইজ’টা উদযাপন করেই ফেলুন এবার ডার্ক চকলেটের সঙ্গে। প্রতিবছর চকলেট প্রেমিরা বিশ্বজুড়ে ৭ই জুলাই ‘বিশ্ব চকলেট দিবস’ পালন করে। এছাড়া আজকের প্রজন্ম ভ্যালেন্টাইন উইকের তৃতীয় দিনটি অর্থাৎ রোজ ডে, প্রপোজ ডে-এর পরের দিনটিই উদযাপন করে চকলেট দিবস হিসেবে (এবছর ৯ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২) ।
তাই মন আর হৃদয় ভালো রাখতে, প্রেমিকাকে মিষ্টি প্রেমে ভরিয়ে দিতে চকলেটের জুরি মেলা ভার। তাই একটি ডার্ক চকলেটের আনন্দ নিতে নিতে চলুন, চলে যাই আড়াই হাজার বছর আগেকার চকলেটের মিষ্টি ইতিহাসের খোঁজে।
প্রায় আড়াই হাজার বছরের ইতিহাস চকলেটের। তবে বিজ্ঞানীদের মতে, ৪০০০ বছর আগেই মেক্সিকোতে প্রথম কোকো গাছের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে অ্যাজটেকরা প্রথম চকোলেট কে পানীয় হিসেবে খেতে শুরু করেন ২৫০০ বছর আগে। সে হিসেবে চকলেটের ইতিহাস আড়াই হাজার বছর পুরোনো।
ইতিহাসে বুঁদ হয়ে যাওয়ার আগে চলুন জেনে নেই কিভাবে এলো চকলেট!
কোকো গাছের ফল থেকেই তৈরি হয় চকলেট। সেন্ট্রাল এবং দক্ষিণ আমেরিকায় পাওয়া যায় এই কোকো গাছ। গুটি গুটি ফলগুলোর একেকটিতে ৪০টির মতো বিন বা শুটি থাকে। শুটিগুলিকে প্রথমে শুকিয়ে নেওয়া হয় এরপর তা পুড়িয়ে বানানো হয় কোকো বিন। কে কখন কিভাবে চকলেট তৈরির এই উপায় আবিস্কার করেছিলেন তা এখনও জানা যায়নি। চলুন জেনে নেই চকলেটের ইতিহাস।
মায়া সভ্যতার ইতিহাসে চকলেটঃ
মায়া সভ্যতায় চকলেট কে সম্মান জনক পানীয় হিসেবে গণ্য করা হতো। ওলমেকরাই কোকো’কে সেন্ট্রাল আমেরিকার মায়া সভ্যতায় ছড়িয়ে দিয়েছিল এনিয়ে কোনও দ্বিমত নেই ঐতিহাসিকদের মধ্যে। প্রাচীন মায়া সভ্যতায় মানুষ চকলেট শুধু পানই করতেন না, একে খুব সম্মান জনক পানীয় হিসেবে সমীহ করতেন। প্রাচীন মায়ার লিখিত ইতিহাসে উল্লেখ আছে, বিশেষ কোন লেনদেন চূড়ান্ত করার অনুষ্ঠানে চকলেটের পানীয় দিয়ে তারা উদযাপন করতেন। একেই শুভ বলে মানা হতো। অর্থাৎ অর্থনৈতিক ভাবেও কোকো বা চকলেট বিশেষ স্থান পেয়েছিল মায়া সভ্যতায়। মায়া সভ্যতায় অনেক পরিবারেই প্রতিবেলার আহারে বরাদ্দ ছিল চকলেটের পানীয়। মায়া সভ্যতায় চকলেট ছিল ঘন আর ফেনাময়। এমনকি এই চকলেটের সাথে লাল লঙ্কা, মধু এবং জল মিশিয়ে পান করা হতো।
আজটেক সভ্যতায় চকলেটঃ
১৪২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত আজটেক সভ্যতায় মানুষ চকলেটকে আরেকটি স্তরে নিয়ে গেছে। তারা বিশ্বাস করতেন, এই কোকো ফল স্বয়ং ‘ঈশ্বরের উপহার’। মায়া সভ্যতার মানুষদের মতো আজটেক সভ্যতার মানুষেরাও সুসজ্জিত পাত্রে গরম বা ঠাণ্ডা ক্যাফেইন বা স্পাইসি বা মশলা চকলেট পানীয় হিসেবে পান করতেন। আজটেক সভ্যতায় চকলেট ছিল মূলত উচ্চবিত্তদের বিলাসিতা। যদিও বিয়ে বা বিশেষ কোনও অনুষ্ঠান উপলক্ষে নিম্নবিত্তরাও চকলেটের স্বাদ উপভোগ করতেন। তবে চকলেটের দাম কিন্তু মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তদের নাগালের বাইরেই ছিল।
আজটেক সভ্যতায় চকলেট খাদক হিসেবে এখনও কুখ্যাত আজটেক শাসক দ্বিতীয় মণ্টেজুমার। ৫৪ বছর ধরে তিনি শক্তিমান এবং বীর্যবান হতে প্রতিদিন গ্যালন ভর্তি চকলেট পান করতেন। শুধু তাই নয় নিজের সামরিক বাহিনীর যোদ্ধাদের আরও বেশী শক্তিশালী করে তোলার জন্যেও কোকো বিন সংরক্ষণ করতেন। উল্লেখ্য, আজটেক সভ্যতায় মানুষ, খাদ্যপণ্য বা অন্য কোন সামগ্রী কেনাবেচা করতে মূদ্রা হিসেবে কোকো বিন ব্যাবহার করে। আজটেক সভ্যতায় কোকো বিন স্বর্ণ বা রৌপ্যর থেকেও দামী হিসেবে গণ্য করা হতো।
ইউরোপে চকলেটঃ
স্পানিশ হট চকলেট; এই চকলেটের সাথে প্রায় সব চকলেট প্রেমীরাই কিন্তু পরিচিত। ইউরোপে চকলেটের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, স্পেনের বাসিন্দারাই প্রথম চকলেটের স্বাদ উপভোগ করেছিলেন। একদল ঐতিহাসিক মনে করেন, ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা পাড়ি দেয়ার পথেই কোকো বিন আবিস্কার করেন এবং স্পেনে ফেরার সময় এই কোকো বিন সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। সময়টা ১৫০২ সাল। আরেক দল ঐতিহাসিক মনে করেন, ১৫৪৪ সালে স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ গুয়াতেমালান, মায়া ভিক্ষুদের কাছ থেকে কোকো বিন পেয়েছিলেন উপহার হিসেবে। অন্যদিকে স্পেন চকলেট আমদানি শুরু করে ১৫৮৫ সালে। ইতালি ও ফ্রান্সসহ অন্য যেসব ইউরোপীয় দেশের অভিযাত্রীরা সেন্ট্রাল আমেরিকায় ভ্রমণ করতে যেতেন, তারাও সেখানে চকলেটের খোঁজ পেয়েছিলেন এবং সেই চকলেট নিয়ে আসতেন নিজ নিজ দেশে। আর কিছুদিনের মধ্যেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চকলেট ম্যানিয়া ছড়িয়ে পড়ে। চাহিদা বাড়তে থাকায় কোকোর চাষাবাদ এবং চকলেট উৎপাদনে শ্রমিক হিসেবে হাজার হাজার ক্রীতদাসকে খাটাতে শুরু করে মালিকপক্ষ।
কেমন ছিল ইউরোপীয় চকলেটের স্বাদ! আজটেকের চকলেট তৃপ্ত করতে পারেনি ইউরোপিয়ান দের। তাই এই চকলেটের সঙ্গে আখের রস, দারুচিনি, জল এবং অন্যান্য উপাদান মিশিয়ে নিজেদের পছন্দমতো হট চকলেট বানাতে শুরু করেন ইউরোপিয়ানরা। খুব কম সময়ের মধ্যেই লন্ডন, আমস্টারডম সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ইউরোপীয় শহরে চকলেটের দোকান গড়ে উঠতে থাকে।
আমেরিকান বিপ্লবেও চকলেটঃ
১৭৭৫ সাল থেকে ১৭৮৩ সাল আমেরিকান বিপ্লবের সময়। এই বিপ্লবের দিনগুলিতেও সামরিক বাহিনীর রেশন তালিকায় যুক্ত হয় চকলেট। কখনও কখনও সৈনিকদের বেতন হিসেবেও টাকার পরিবর্তে কোকো বা চকলেট দেয়া হতো। প্রসঙ্গত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও আমেরিকান সৈনিকদের রেশন হিসেবে চকলেট দেয়া হয়েছে।
ইউরোপে যখন প্রথম চকলেট এলো, তখন এই চকলেট এতোটাই দামী এবং বিলাসী খাদ্য ছিল যে শুধু উচ্চবিত্তিয়রাই চকলেটের স্বাদ পেতো। তবে ১৮৮২ সালে ডাচ রাসায়নবিদ, কোয়েরাড জোহানেস ভয়ান হাউটেন, লবণের ক্ষারের সঙ্গে কোকো বিন মিশিয়ে এক ধরনের পাউডার চকলেট উদ্ভাবন করেন। এই কোকো পাউডারটি খুব সহজেই জলের সঙ্গে মিশিয়ে পান করা যেত। এই প্রক্রিয়াটি ‘ডাচ প্রসেসিং’ নামে খ্যাতি পায়। এরপর আসে ‘কোকো প্রেস যন্ত্র’। ডাচ প্রসেসিং এবং চকলেট প্রেস এই দুই পদ্ধতির কারনে চকলেট পৌঁছে গেলো সব অংশের মানুষের মধ্যে। দামও চলে এলো সব শ্রেণির মানুষের সাধ্যের মধ্যেই। এর সাথে সাথে চকলেটের উৎপাদনেও দারুণ গতি এলো।
শিল্প বিপ্লবের সময় চকলেটের উৎপাদন দ্বিগুণ বেড়ে যায়। এর ফলে কোকো গাছের উৎপাদনও বেড়ে যেতে শুরু করে। আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ভালো জন্মায় কোকো গাছ। আর সেখানেই দাসত্বপ্রাপ্ত মানুষদেরকে দিয়ে কোকো বাগান চাষ করানো হতো। অ্যাড্রিয়েনা মরগানেলি দ্বারা প্রকাশিত ‘দ্য বায়োগ্রাফি অব চকোলেট’ (২০০৫) অনুসারে, প্রাথমিকভাবে স্পেনীয় উপনিবেশকারীরা মেসো আমেরিকানদেরকে কোকো বাগান চাষ করতে বাধ্য করেছিল। আদিবাসীরা যখন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে শুরু করে, তখন দাসত্বপ্রাপ্ত আফ্রিকানদের শ্রম সংকট মেটাতে নিয়ে আসে ইউরোপিয়ানরা। আখ, নীল এবং অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি, দাসত্বপ্রাপ্ত আফ্রিকানরা ক্যারিবীয়, মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকা জুড়ে চকলেট শিল্পে যোগদান করে।
আধুনিক চকলেটঃ
১৮৪৭ সালে ব্রিটিশ চকলেট কোম্পানি জে. এস. ফ্রাই অ্যান্ড সনস প্রথমবার চিনি, তরল চকলেট ও কোকো বাটার মিশিয়ে চকলেট বার উৎপাদন করেন। ১৮৭৬ সালে সুইস চকলেট ব্যবসায়ী ড্যানিয়েল পিটার প্রথম চকলেটের সঙ্গে দুধের গুড়ো মিশিয়ে মিল্ক চকলেট উৎপাদন করেন। এর কয়েক বছর পরই বন্ধু হেনরি নেসলের সঙ্গে তিনি নেসলে কোম্পানি গড়ে তোলেন এবং মিল্ক চকলেটকে বড় পরিসরে বাজারে ছড়িয়ে দেন। উনবিংশ শতকের শেষভাগ ও বিংশ শতকের প্রথমভাগে ক্যাডব্যারি, মার্স, নেসলে ও হার্সলের মতো কোম্পানিগুলো বিপুল পরিমাণ মিষ্টি চকলেট উৎপাদন ও বাজারজাত করতে থাকে। আজকের দুনিয়ায় বা আধুনিক সময়ে চকলেট খুবই সুস্বাদু এবং খেতে দারুণ। এখনও পানীয় হিসেবে চকলেট পাওয়া যায়, কিন্তু চকলেট বারের চাহিদাই বেশী।
বিশ্ব কোকোয়া ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী, শুধু ইউরোপ-আমেরিকাতেই বছরে প্রায় ৩ মিলিয়ন টনেরও বেশি কোকোয়া বীজ কেনা-বেচা হয়ে থাকে। চকলেট খেলে আপনি শুধু আনন্দিতই হবেন না বরং ভালো থাকবে আপনার হার্ট এবং ব্রেইনও।
কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে কোকো গাছ গুলি আস্তে আস্তে নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে। ‘দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট’ রিপোর্ট করেছে, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে’র বিজ্ঞানীরা কোকো গাছের ডি এন এ পরিবর্তন করার জন্য CRISPR (একটি জিন পরিবর্তনকারী টুল) প্রযুক্তির সাহায্য নিয়েছেন। যদি গাছের ডি এন এ বদল করে উচ্চ-তাপমাত্রা এবং নিম্ন আর্দ্রতা সহ্য করার জন্য গাছের স্বভাবে জিনগত পরিবর্তন করতে পারে, তাহলেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো আবার চকলেটের স্বাদ পেতে পারে। অন্যথায় চারহাজার বছরের ইতিহাস রেয়ার স্পিসিস হয়ে যাবে, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে পৃথিবী থেকে। বিপ্লবে, বিদ্রোহে, ভালোবাসায়, মন খারাপে হয়তো আর চকলেট থাকবেনা।
সবাইকে চকলেট দিবসের অনেক শুভেচ্ছা।