নতুন পরিচয় পেতে চলেছে পুষ্পবন্ত প্রাসাদ
পান্নালাল রায়
অনেক স্মৃতি বিজড়িত, নানা ইতিহাসের সাক্ষী আগরতলার পুষ্পবন্ত প্রাসাদকে জাতীয় স্তরের একটি মিউজিয়াম ও সংস্কৃতি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।যদি আগরতলার সৌন্দর্যের মুকুটে উজ্জ্বয়ন্ত প্রাসাদ একটি পালক হয়, তবে অপর একটি পালক নিঃসন্দেহে পুষ্পবন্ত, সাধারণ্যে কুঞ্জবন প্রাসাদ হিসেবেও যা পরিচিত।একদা এই প্রাসাদ মুগ্ধ করেছিল কথা শিল্পী বিভূতিভূষণকে, রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ছিল প্রাসাদের গোল বারান্দা। এখানে অবস্হান করেছেন অনেক বিখ্যাত ব্যাক্তি।একদা শিল্পী রাজা বীরেন্দ্র কিশোর এখানে নিভৃতে শিল্প চর্চা করতেন।আজ আবার এই প্রাসাদটি এক নতুন পরিচয় পেতে চলেছে। রাজ্য সরকার ত্রিপুরার ঐতিহাসিক এই প্রাসাদটিকে জাতীয় স্তরের একটি মিউজিয়াম ও সংস্কৃতি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে ত্রিপুরার পর্যটন মন্ত্রী প্রাণজিৎ সিংহ রায় তাঁর এক ফেসবুক পোষ্টে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, পূর্বতন রাজভবন পুষ্পবন্ত প্রাসাদকে জাতীয় স্তরের মিউজিয়াম হিসেবে গড়ে তুলতে সরকার প্রাথমিক ভাবে ৪০.১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। মন্ত্রী শ্রী সিংহরায় জানান, উত্তর পূর্বাঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফাইন আর্টস, সমকালীন আলোকচিত্র, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আর্কাইভ ইত্যাদিতে পুষ্ট করা হবে এই জাতীয় স্তরের মিউজিয়াম ও সংস্কৃতি কেন্দ্রটিকে। মন্ত্রী আরও বলেন, আমাদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি এক্ষেত্রে ত্রিপুরার রাজবংশের অবদানের কথাও উল্লেখ করেন।এই উদ্যোগকে উৎসাহিত করা সহ অর্থ বরাদ্দের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসা করেন।
আগরতলায় এক অনুপম স্হাপত্যের নিদর্শন হলো কুঞ্জবন প্রাসাদ।১৯১৭ সালে ত্রিপুরার মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোর মাণিক্য (১৯০৯-২৩) উঁচু টিলা ভূমির উপর এই সুন্দর প্রাসাদটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। বীরেন্দ্র কিশোর ছিলেন খুবই উঁচু মানের চিত্রশিল্পী। তিনি এই প্রাসাদে নিভৃতে শিল্পচর্চা করতেন।একদা বিখ্যাত কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাঁর আগরতলা ভ্রমণকালে এই অনুপম প্রাসাদটি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন।১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন শেষবারের মতো ত্রিপুরা সফরে আসেন তখন তিনি পুষ্পবন্ত প্রাসাদে অবস্হান করছিলেন।
১৯৪৯ সালের ১৫ অক্টোবর ত্রিপুরার ভারতভুক্তির পর অবলুপ্ত হয়ে যায় দেওয়ান পদ। তাঁর জায়গায় আসেন চীফ কমিশনার। তখন চীফ কমিশনারের সরকারি আবাস হয় এই পূ্ষ্পবন্ত প্রাসাদ। আগরতলায় সাধারণ্যে তখন এর পরিচিতি হয়ে যায় সিসি'র বাংলো বলে।চীফ কমিশনারের পর আসেন উপ রাজ্যপাল। তখনও এই প্রাসাদ হয় তাঁর সরকারি আবাস।১৯৭২ সালে ত্রিপুরা পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা লাভ করে। এবার আসেন রাজ্যপাল।পুষ্পবন্ত প্রাসাদই হয় রাজ্যপালের আবাস। ধীরে ধীরে রাজভবন হিসেবে তা সাধারণ্যে পরিচিতি লাভ করে। দীর্ঘ দিন এই প্রাসাদ ছিল ত্রিপুরার রাজভবন। অবশেষে ২০১৮ সালে ক্যাপিটেল কমপ্লেক্সে নব নির্মিত একটি ভবনে রাজভবন স্হানান্তরিত হয়ে যায়।অবসান ঘটে একটি যুগের। রাজকীয় আমল থেকেই দীর্ঘ দিন সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল এই প্রাসাদ।
পুষ্পবন্ত প্রাসাদটি অবশ্য সাধারণ্যে কুঞ্জবন প্রাসাদ হিসেবেও পরিচিত ছিল।এর অনবদ্য নির্মাণশৈলী মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোরের উচ্চ শিল্পরুচির পরিচয় বহন করছে।প্রাসাদের সামনে বাগান, সবুজের সমারোহ ছিল। মহারাজা নিজে একজন বড় মাপের শিল্পী ছিলেন। তিনি অবকাশ যাপনের জন্য তাঁর রুচিসম্মত ভাবে প্রাসাদটি নির্মাণ করিয়েছিলেন।উজ্জ্বয়ন্ত প্রাসাদের চেয়েও নাকি কুঞ্জবন প্রাসাদের স্হাপত্যশৈলী বিভূতিভূষণের ভালো লেগেছিল। তিনি তাঁর 'অভিযাত্রীক' গ্ৰন্হে আগরতলা ভ্রমণ প্রসঙ্গে লিখেছেন --"কুঞ্জবন প্যালেস একটি অনুচ্চ পাহাড়ের উপর অবস্হিত। পুরনো আমলের তৈরী বলেই দেখতে ঢের ভালো লাগলো,মার্টিন কোম্পানীর তৈরী মহারাজের নতুন প্রাসাদের চেয়ে। কুঞ্জবন প্যালেসের একটি ঘরে অনেক প্রাচীন চিত্র,হাতীর দাঁতের শিল্প, ত্রিপুরা রাজবংশের পূর্ব্ব পুরুষদের বড় বড় ছবি ইত্যাদি আছে-এসব খুঁটিনাটি করে দেখতে অনেক সময় গেল।"
পুরনো আমলের তৈরি বলতে কি লেখক পুরনো স্টাইল বুঝিয়েছেন? কারণ উজ্জ্বয়ন্ত প্রাসাদ হয়েছিল ১৯০১ সালে,আর কুঞ্জবন অর্থাৎ পুষ্পবন্ত প্রাসাদ ১৯১৭ সালে।কাজেই তুলনায় নতুন ছিল কুঞ্জবন প্রাসাদটিই।সম্ভবত তিনি পুরনো স্হাপত্য রীতির কথাই বলেছেন। যাইহোক,এই প্রাসাদের ছাদ থেকে সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করেছিলেন বিভূতিভূষণ। তিনি লিখেছেন-"প্রাসাদের ছাদ থেকে সূর্য্যাস্ত দেখে মনে হল এমন একটা সূর্য্যাস্ত কতকাল দেখিনি!"
প্রাসাদের গোল বারান্দার লাগোয়া ঘরটিতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ অবস্হান করেছিলেন।গোল বারান্দাটি কবির খুব প্রিয় ছিল। সেখানে ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে তিনি অদূরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতেন।এই প্রাসাদে কবির অবস্হান সম্পর্কে সত্যরঞ্জন বসু 'ত্রিপুরায় রবীন্দ্র স্মৃতি' প্রবন্ধে লিখেছেন--"কুঞ্জবন প্রাসাদের পূর্ব অংশে অর্দ্ধ-বৃত্তাকার অলিন্দ। এখানেই ছিল কবির নিভৃত চিন্তার স্হান।প্রশস্ত অলিন্দে ছোট একখানা গালিচার উপর একখানা কেদারাই ছিল আসবাব।..."
একসময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই প্রাসাদে অবস্হান করেছেন। কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ মুগ্ধ হয়েছেন প্রাসাদটি দেখে। শুধু তাই নয়,স্বাধীনোত্তর পর্বেও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি এই প্রাসাদে অবস্হান করেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু সহ প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীগণ।সব মিলিয়ে ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করছে এই পুষ্পবন্ত প্রাসাদ।এবার জাতীয় স্তরের মিউজিয়াম ও সংস্কৃতি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠলে তা নিশ্চিত ত্রিপুরায় দেশ-বিদেশের মানুষের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্র হবে। শুরু হবে এক নতুন অধ্যায়।