পাল্টে ফেলার রাজনীতি আর কত?

রাজীব দত্ত

নোটবন্দী দিয়ে শুরু হয়েছিল পাল্টে ফেলার রাজনীতি। টাকার রঙ পাল্টে গেল রাতারাতি। আপাতত প্রধানমন্ত্রী খান্ত হলেন, সাধারণতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজ থেকে গান্ধীজির প্রিয় সুর, নেতাজীর ট্যাবলো সরিয়ে দিয়ে। এরপর কি পাল্টাবেন? লোকসভায় কোন আলোচনা ছাড়াই একটার পর একটা বিল পাশ নতুন কিছু নয়। এরপর দেশের সংবিধান? অথবা আস্ত দেশটাই? কারন খুব সম্প্রতি মোদী সরকার এলাহাবাদ কে প্রয়াগরাজ বানিয়ে দিয়েছেন। ঘটি-বাটি পিটিয়ে হয়তো তিনি একদিন বেতার ভাষণে ঘোষণা দেবেন, আজ থেকে দেশের শাসন ক্ষমতা কর্পোরেটদের হাতে। অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারন নিলামে উঠছে একটার পর একটা সরকারী সম্পত্তি। দেশের ৭০ শতাংশ সম্পদ মাত্র ১৪২ জন ভারতীয় ব্যাবসায়ির হাতে গচ্ছিত। উল্লেখ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একটা সুরার লাইসেন্স দিয়ে ব্যাবসা শুরু করে দেশে। এরপর একে একে পুরো দেশটাই গ্রাস করে এবং ২৫০ বছর ধরে শাসন চালায়। পরাধীন দেশে সেই সময়ে ব্রিটিশ এভাবেই পাল্টে ফেলেছিল সম্রাট-রাজা মহারাজাদের যাবতীয় কীর্তি। এমনকি হিন্দুস্থান ছেড়ে যাওয়ার সময় তাজমহলের দামী পাথর, কোহিনূর হীরা থেকে শুরু করে সব লুঠ করে নিয়ে যায়। চারিদিকে শুধু ধংসস্তূপ। আজকের মহান দেশের অধিপতিও কিন্তু সেই পথেই হাঁটছেন। এবং উনার উত্তরসূরিরাও আজ একই পথের পথিক।



আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব, দেশের প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত স্নেহভাজন এবং দুজনেই একই ঘরানার রাজনীতিক। তাই সরকারে এসেই প্রথম সিদ্ধান্ত নিলেন, দুর্গাপূজার আগে পাল্টে ফেলবেন রাজন্য আমলের দুর্গা বাড়ীর রঙ। যদিও শেষপর্যন্ত জন চাপে বিরত থাকলেন। এরপর? কিছুদিন করোনা চাপে ভুগলেন। এরপর আস্ত বিমান বন্দরের নাম পাল্টে ফেললেন। রাস্তার নাম পাল্টে দিলেন। মুখ্যমন্ত্রী আবাস স্থলকে করে দিলেন দীনদয়াল উপাধ্যায় সরণী। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দশরথ দেবের মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা হলেও উনি কিন্তু স্পিকটি নট!



এরপর নামলেন আসল খেলায়। পূর্ণ রাজ্য দিবসের দিন এই রাজ্যের আঠারোমুড়া পাহাড় আর গন্ডাছড়ার নাম পাল্টে ফেলার ঘোষণা দিলেন। এতদিন পরে বোঝা গেল কেন কামান সরিয়ে ফেলা হলো? কেন পোষ্ট অফিস চৌমুহনীর বিজয় মিনারটা উপরে ফেলা হল? কারন ইন্দিরা গান্ধী এবং জাতীয় কংগ্রেসের সমস্ত ইতিহাস তিনি (প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী) মুছে ফেলবেন। নতুন ইতিহাস লিখবেন যা কিনা হবে ২৯১৪ সালের পরের ইতিহাস। প্রথমে আগরতলা থেকে শুরু, আপাতত গিয়ে ক্ষান্ত হলেন দিল্লীর ইন্ডিয়া গেইটে। কেন্দ্রীয় সরকার নিভিয়ে দিলেন ‘অমর জওয়ান জ্যোতি’। ১৯৭১ এর যুদ্ধে শহিদ ভারতীয় সেনাদের সাথে এতো বড় অবিচার করার সাহস এর আগে কিন্তু কেউ দেখায়নি স্বাধীন ভারতবর্ষে। অজুহাত গ্যাসের দাম বেড়ে গেছে! সত্যিই তো বেড়েছে জ্বালানী গ্যাসের দাম। কিন্তু অমর জওয়ান জ্যোতি জ্বালানোর মতো অর্থ যদি না থাকে দেশের, তাহলে তো এই দেশ দেওলিয়া! তাই না? ইতিহাসকে বিকৃত করার, উপরে ফেলে দেয়ার এই খেলার শেষ কোথায় হবে কেউ জানেনা।



আসলে প্রধানমন্ত্রীর লক্ষ্য একটাই ২০১৪ সালের আগেকার সমস্ত ইতিহাসকে ডিলিট করে দেয়া। যদিও অনেক ইতিহাস এখনও বিচার কক্ষে হাঁসফাঁশ করছে। গোধারা এই দেশ ভুলেনি। পাঁচ হাজার মানুষের কান্না এখনও শুনতে পায় গুজরাট আর এই দেশের মানুষ।



বাংলাদেশের বিজয় দিবস পালনের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উৎসব চলছিল কিছুদিন আগেও ঘটা করে। ঠিক তার আগেই ১৯৭১ সালের দুটো স্মৃতি ফলককে সরিয়ে নিল বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব, স্মার্ট সিটির অজুহাত দিয়ে। কার নির্দেশে এবার কিন্তু স্পষ্ট। ঠিক এর পরে পরেই এবছরের ২৬ জানুয়ারির অনুষ্ঠান থেকে ছেঁটে ফেলে দেয়া হল পশ্চিমবঙ্গের প্রস্তাবিত নেতাজীর ট্যাবলো। শুধু তাই নয় ১৯৭১ এর ভারত-পাকিস্থান যুদ্ধের শহিদদের সম্মানে জ্বলতে থাকা ইন্ডিয়া গেইটের ‘অমর জওয়ান জ্যোতি’ কে নিভিয়ে দিলেন। অবশ্য নেতাজীর হলোগ্রাম মূর্তিও স্থাপন করে নেতাজী ভক্ত হিসেবে দেশবাসীর বাহবা কুড়ালেন। কিন্তু ইন্ডিয়া গেইটে কেন নেতাজী মূর্তি? লালকেল্লায় নয় কেন? এতেই মোদী’জী থেমে থাকলেন না, সাধারণ তন্ত্র দিবসের প্যারেড থেকে মহাত্মা গান্ধির খুব পছন্দের সঙ্গীত ‘Abide with me’ কে বাদ দিয়ে দেশীয় বলিউডি গান বাজানোর নির্দেশ দিলেন। অথছ মহাত্মা গান্ধির চশমা, খাদি এখনও উনার বিজ্ঞাপনে। ট্র্যাম্প সাহেব এলেন, গান্ধির চড়কাই দেখালেন এবং প্রমোট করলেন পৃথিবীজুড়ে। অথছ উনি এবং উনার দল ক্ষমতায় আসেন গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসের দলের (আর এস এস) সমর্থনে। উদ্দেশ্য খুব স্পষ্ট, জাতীয় কংগ্রেসের সমস্ত ইতিহাস তিনি মুছে দেবেন। কিন্তু দেশের মানুষ নিরক্ষর আনপার, গাওয়ার নয়।



ত্রিপুরার মানুষ এই ইতিহাসকে সাক্ষী রেখেই গত পঞ্চাশ বছর ধরে এই আগরতলা শহরের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা স্মৃতিসৌধ গুলিকে ঘিরে উদযাপন করেছে। তাই ইতিহাস সহজে মুছে ফেলা যায়না। বরং রাজনীতির এই কারবারিরাই একদিন ইতিহাস থেকে মুছে যাবে হয়তো। অথবা অন্য নামে পরিচিতি পাবে। মিরজাফর মরেছে অনেক আগেই কিন্তু ইতিহাস এখনও তাকে ক্ষমা করেনি। এই দেশ গরীব হতে পারে, কিন্তু এই দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, পরম্পরা, বিশ্বাস, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব এবং আতিথেয়তা এখনও ভারতবাসীর গর্ব।



‘ট্রিগারটা চাপতেও খুনির বন্দুকের আদ্যোপান্ত জানতে হয়’, এই সরকার ইতিহাসকে বিকৃত করে ট্রিগার চালাচ্ছে যথেচ্ছ’। কিন্তু এক একটা বুলেটের হিসেব কিন্তু চাইছে ভারতবাসী। অন্যথায়, এটাই সত্যি, ‘হিটলার আত্মসমর্পণের ভয়ে আত্মহত্যা করেছিল নববধুকে নিয়ে’ ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনা।








You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
মন্তব্যের তারিখ (Posted On)মন্তব্যকারির নাম (Name)মন্তব্য (Comment)
30.01.2022Dhitisree SahaDestruction of history in the name of modernity .. damn .. they are not ashamed .. Democracy is in question today .. History will not forgive anyone ..Ordinary people are not so stupid .. History has always been in people's minds and will remain forever .. Thus it is not possible to destroy history from our minds .. How much is the politics of change? Great writing.