অতিতে দিল্লির শাসকরা ত্রিপুরা সহ উত্তর পূর্বকে বরাবর উপেক্ষা করেছে
পুরুষোত্তম রায় বর্মন
১৯৭২ সনের ২১ শে জানুয়ারি ত্রিপুরা পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা লাভ করে। পূর্ণ রাজ্য হিসেবে ত্রিপুরা ৫০ বছর অতিক্রম করল। ১৯৪৭ সনের ১৫ই আগস্ট যখন ভারত স্বাধীনতা লাভ করে তখন ত্রিপুরা সামন্ত রাজার শাসনাধীন। ১৯৪৯ সনের ১৫ই অক্টোবর ত্রিপুরা ভারতভুক্ত হয়। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে 'গ' শ্রেণি রাজ্যের মর্যাদা লাভ করে। চিফ কমিশনারের শাসন। গণতন্ত্রের স্বাদ থেকে ত্রিপুরাবাসী বঞ্চিত থাকে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা শাসনের দাবিতে শুরু হয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন। ১৯৫২ সনে ইলেকটোরাল কলেজের নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি ও গণতান্ত্রিক সংঘের জোট ২১ আসনে জয়লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার ইলেকটোরাল কলেজের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে রাজী হয়নি। ১৯৫৩ সনের ১৪ই এপ্রিল এক আদেশে ভারতের রাষ্ট্রপতি তিনজন কংগ্রেস নেতাকে ত্রিপুরা সরকারের উপদেষ্টা নিয়োগ করেন। তারা হলেন শচীন্দ্রলাল সিংহ, সুখময় সেনগুপ্ত ও জিতেন্দ্র দেববর্মা। নির্বাচিত বিধানসভার দাবিতে গণআন্দোলন ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে থাকে। ১৯৫৫ সনে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন ত্রিপুরাকে আসামভুক্তির সুপারিশ করে। এর বিরুদ্ধে রাজ্যজুড়ে বামপন্থীদের নেতৃত্বে প্রবল প্রতিবাদ শুরু হয়। স্বতন্ত্র ত্রিপুরার দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে রাজ্য। গণ আন্দোলনের চাপে ত্রিপুরার আসাম ভুক্তির পরিকল্পনা বাতিল হয়। ১৯৫৬ সনে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ত্রিপুরা 'গ' শ্রেণী রাজ্য থেকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত হয়। পাস হয় ত্রিপুরা টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল অ্যাক্ট। এই আইনের বিধান অনুযায়ী ৩২ সদস্য বিশিষ্ট ত্রিপুরা আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হয়। সীমাবদ্ধ ক্ষমতা আঞ্চলিক পরিষদের। রাজ্য তালিকাভুক্ত ৯ টি ও যুগ্ম তালিকাভুক্ত ১টি বিষয়ের উপর আঞ্চলিক পরিষদের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ ছিল। ত্রিপুরায় আঞ্চলিক পরিষদের শাসন ছিল জনপ্রতিনিধিত্বমূলক প্রথম শাসন ব্যবস্থা। ১৯৬৩ সনে ত্রিপুরার প্রথম ৩০ সদস্যের বিধানসভা। পরবর্তী সময়ে চীফ কমিশনারের জায়গায় লেফটেন্যান্ট গভর্নর। ১৯৭২ সনের ২১ শে জানুয়ারি ত্রিপুরা পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা লাভ করে। ৬০ সদস্যের বিধানসভা। পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা লাভের জন্য রাজ্যের জনগণকে লড়াই করতে হয়েছে । এই লড়াইয়ের নেতৃত্বে ছিলেন বামপন্থীরা। আধুনিক ত্রিপুরার ভিত স্হাপিত হয়েছে মূলত ১৯৭৮ সন থেকে। ত্রিপুরায় রেল আদায়ের জন্য এ রাজ্যের মানুষকে দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়েছে। স্বাধীনতার পর ত্রিপুরার প্রতি কেন্দ্রের বঞ্চনা ছিল সীমাহীন। আজকের ত্রিপুরার পেছনে রয়েছে ৭৫ বছরের লড়াই সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস। দেশভাগজনিত চাপ ত্রিপুরার আর্থিক সামাজিক জীবনে প্রচন্ডভাবে পড়েছে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসে নি। ত্রিপুরার জাতি ও উপজাতির মানুষ ঐক্যবদ্ধ লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বর্তমানে অবস্থান করছেন । বিগত ৩০ - ৪০ বছরে ত্রিপুরার ব্যাপক পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে মানুষের সম্মিলিত শক্তির ফলেই। দিল্লির শাসকরা ত্রিপুরা সহ উত্তর পূর্বকে বরাবর উপেক্ষা করেছে। ত্রিপুরার মানুষ আত্মশক্তির জোরে সমুন্নত রাজনৈতিক চেতনা ও ঐক্যের শক্তির দ্বারাই যাবতীয় বঞ্চনা ও উপেক্ষার জবাব দিয়েছেন। ত্রিপুরা জাতি উপজাতির মিলন ভূমি। রাজার শাসনে উপজাতিদের উপর শোষণ-নিপীড়ন জুলুম ছিল সীমাহীন। ইতিহাসের এই নির্মম সত্যকে ধামাচাপা দেওয়া যাবে না। উপজাতি অংশের মানুষের বিকাশ ও মর্যাদার প্রশ্নে জাতি উপজাতি উভয় অংশের মানুষই লড়াই করেছে মিলিতভাবে। আজ ত্রিপুরা ফ্যাসিস্ট শাসনের কবলে। কালো অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে ত্রিপুরা যাচ্ছে। এই অন্ধকার চিরস্থায়ী হবে না আমরা নিশ্চিত। যারা রাজ্যকে ধ্বংস করছে তাদের কোন নৈতিক অধিকার নেই পূর্ণ রাজ্য দিবস পালন করার। পূর্ণ রাজ্য মর্যাদা প্রাপ্তির ৫০ তম বার্ষিকীতে আমাদেরকে অতীতকে ভুলে গেলে চলবে না। ইতিহাসকে যারা বিকৃতি করতে চাইছে তাদের বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে হবে জোরালো ভাবে। পূর্ণ রাজ্য দিবস আমাদের সংকল্প হোক, ত্রিপুরাকে আমরা অন্ধকার মুক্ত করবোই।