নেতাজী এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন প্রকৃত স্বাধীনতার
রাজীব দত্ত
২৩ জানুয়ারী, এই শহরের জন্য এই রাজ্যের জন্য এবং এই দেশের জন্য একটি বিশেষ দিন। শুধু বাঙালি নয় সারা দেশের কাছেই একটি গর্বের দিন। পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা প্রত্যেকটি ভারতবাসীর জন্যে আরেকবার গর্ব করে বলার দিন, ‘আজ নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্মদিন’।
ভারতের জাতীয় কংগ্রেস, জহরলাল নেহেরু থেকে শুরু করে গান্ধীজী, এই প্রবাদপ্রতিম স্বাধীনতা সংগ্রামীকে কোণঠাসা করেছিল বহুবার। বামপন্থীরা ও ছেড়ে কথা বলেনি। সাভারকার সাহেবও ছাড়েননি নেতাজীকে। ইতিহাস তার সাক্ষী। গত কয়েক দশক ধরে নেতাজীকে নিয়ে কম জল ঘোলা হয়নি। এখনও পর্যন্ত নেতাজী সংক্রান্ত বহু ফাইল কিন্তু চাপা পড়ে আছে লাল ফিতার বাধনে। কিন্তু স্বাধীন ভারতের একটি গণতান্ত্রিক সরকার যেভাবে ২০২২ সালে এসে নেতাজীকে কেটে ছেঁটে বাদ দিলেন, সাধারণতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠান থেকে সেটাও কিন্তু ইতিহাস হয়েই থাকবে।
এবার বোধহয় আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীরাও আধুনিক নব্য রাজনিতিকদের, রাজনীতির মারপ্যাঁচ থেকে রেহাই পাবেন না! টেলিপ্রম্পটার বিভ্রাট, নেতাজী বিতর্ক, পি এম কেয়ার ফান্ড নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় সরকার বোল্ড আউট। এরপর কি? ইউ পি ইলেকশান!
সাধারণতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে কেন্দ্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রস্তাবিত নেতাজীর ট্যাবলো নাকচ করে দেয়। এই নিয়েই যাবতীয় বিতর্ক। পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতারাও কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তে বিরুপ প্রকাশ করেছেন। মুখে যদিও বলছেন, এটা তৃণমূলের রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং এবং অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন আদাজল খেয়ে যেভাবে মাঠে নেমেছেন ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে, তা সত্যিই যথেষ্ট ইঙ্গিতবহ। জার্মানি থেকে নেতাজী কন্যা অনিতা বসু পাফ কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিধান্তকে কড়া ভাষায় সমালোচনা করেছেন। এই ধরনের ঘটনা কি এই প্রথম! শুধু নেতাজীর সঙ্গেই? উত্তর টা ‘না’।
বছর দুয়েক পিছে যাই, দীর্ঘদিন ধরেই কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন শাসকদলের নেতাদের একাংশ নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন সম্পর্কে প্রকাশ্যে অভিযোগ করেছিলেন, শান্তিনিকেতনে তাঁর বাড়ি ‘প্রতীচী’ সংলগ্ন জমির একাংশ বিশ্বভারতীর। প্রসঙ্গত কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় শান্তিনিকেতনের আচার্য পদে রয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তিনি এই বিতর্কে একটি শব্দও করেননি। শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদকে চিঠি দিয়ে আশ্বস্ত করেন এবং পাশে থাকার আশ্বাস দেন। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদকে লেখা চিঠিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘অনুগ্রহ করে এ দেশের আধিপত্যবাদ এবং অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাকে আপনার বোন এবং বন্ধু হিসেবে গণ্য করুন’। অমর্ত্য এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গে শান্তিনিকেতনের দীর্ঘদিনের নিবিড় যোগাযোগের প্রসঙ্গ তুলে মমতা লিখেছেন, ‘আপনার মাতামহ পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন শান্তিনিকেতনের প্রথম যুগের বাসিন্দাদের একজন। আপনার বাবা শিক্ষাবিদ এবং প্রশাসক আশুতোষ সেন আট দশক আগে প্রতীচী নির্মাণ করেছিলেন। শান্তিনিকেতনের সংস্কৃতি এবং বন্ধনের সঙ্গে আপনাদের পরিবার নিবিড় ভাবে আবদ্ধ’।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য অমর্ত্য সেন বামপন্থী হিসেবেই রাজনীতির অঙ্গনে সুপরিচিত। কিন্তু মাথায় রাখা দরকার তিনি একজন বাঙালি এবং অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী’জী কিন্তু উনাকেও ছেড়ে কথা বলেন নি। অবশ্য দেশের বুদ্ধিজীবীরা বহুদিন ধরেই প্রশ্ন তুলেছেন নিজেদের বাক স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ আছে তো! দেশের সংবিধান সংকটের মুখে নেই তো!
আমাদের দেশের সংবাদমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে তো! সাংবাদিকদের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’ এই সূচক প্রকাশ করে প্রতি বছর। গত বছরের ১লা জুনে প্রকাশিত এই রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘Modi tightens his grip on the media…. India is one of the world’s most dangerous countries for journalists trying to do their job properly’ অর্থাৎ ‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, মিডিয়া বা সংবাদমাধ্যম কে খুব শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করছেন। সাংবাদিকদের জন্য ভারতবর্ষ এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী বিপজ্জনক একটি দেশ…’। গত দু-বছর আগেই এই সংস্থার রিপোর্টে সতর্ক করে দিয়ে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল, ‘আসছে দিন সাংবাদিকদের জন্য আরও বেশী সাঙ্ঘাতিক হয়ে উঠবে ভারতবর্ষে’। এর প্রমাণও আমরা পেলাম সাম্প্রতিক কালে অনুষ্ঠিত নির্বাচন, অতিমারি এবং বিভিন্ন রাজ্যে সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবীদের উপর সরকারের একের পর এক সংঘবদ্ধ আক্রমণের বহর দেখে।
এবার আসি নেতাজী প্রসঙ্গে। কেন এই কাটছাট? এই প্রথম নেতাজীকে ব্রাত্য করে রাখার প্রয়াস? মোটেই না। গত শতকের চল্লিশের দশকের গোড়ার দিক। দেশ স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য তৈরি। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের আজাদ হিন্দ ফৌজ ঝাঁপিয়ে পড়েছে স্বাধীনতার সশস্ত্র লড়াইয়ে। সেই লড়াইকে প্রথম পেছন থেকে ছুরি মারে সাভারকারের নেতৃত্বে আর এস এস। নেতাজীর আজাদ হিন্দ ফৌজে, নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলিম-শিখ সবার সমানাধিকার ছিল। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস যখন আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করছেন ব্রিটিশ দের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য, তখন হিন্দু মহাসভা তথা আর এস এস বিনায়ক দামোদার সাভারকার প্রচার করছেন, ‘স্বাধীনতার যুদ্ধে হিঁদুরা ঝাঁপিয়ে পড়ুক এবং ব্রিটিশের বাহিনীতে হিঁদুরা নাম লেখাক’। এবং তাই হয়েছিল। সমগ্র উত্তর-পূর্ব বিশেষ করে আসাম এবং বাংলার হিঁদুদের তিনি নির্দেশ দিলেন, ব্রিটিশের হয়ে সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়ে প্রবল আনুগত্যের সাথে যুদ্ধ করতে হবে। প্রচুর হিন্দু বাধ্য হয়েই নাম লেখায় ব্রিটিশ বাহিনীতে। সাভারকার রিক্রুটম্যান্ট ক্যাম্প করে কয়েকবছর ধরে হিন্দুদের ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করেন এবং তারা উত্তরপূর্ব ধরে এগিয়ে আসা নেতাজীর আজাদ হিন্দ ফৌজকে আটকাবে। সাভারকরের এই উদ্যোগ নেতাজীর আজাদ হিন্দ ফৌজ কে রাজনৈতিক এবং সামরিকভাবে যথেষ্ট বিপাকে ফেলে। সাভারকারের লক্ষই ছিল, ‘সমগ্র রাজনীতিকে হিন্দুকরণ এবং হিন্দুদের সামরিকী করণ’। আসল উদ্দেশ্য প্রভাবশালী হিন্দুদের ক্ষমতায় নিয়ে আসা। সেই সময়ে বি আর আম্বেদকর সাভারকারের এই উদ্দেশ্যকে তীব্র ভাষায় উন্মোচিত করেছিলেন। এখানেই শেষ নয়, যুদ্ধ শেষে সাভারকারের এই রিক্রুটাররা সেনা থেকে বাদ পড়ে হিন্দু জঙ্গিবাহিনী গঠন করে উত্তরপ্রদেশ, বিহারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মূল ভুমিকা নিয়েছিল। শুধু তাই নয় যুদ্ধ বন্দীদের ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছিল এই রিক্রুটাররা। ব্রিটিশ অফিসাররা নেটিভ সেনাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল আজাদ হিন্দ ফৌজ আসলে দেশদ্রোহী। ব্যারাকপুর-বারাসাত রোডের নীলগঞ্জ বন্দী শিবিরে ১৯৪৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর অন্তত হাজার তিনেক স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা যুদ্ধ বন্দীকে হত্যা করা হয়েছিল। আর এতে অগ্রণী ভুমিকা নিয়েছিল এই দেশীয় ভারতীয় সিপাইরা। যদিও এতোকিছুর পরেও নেতাজী থেমে থাকেননি। মাত্র দুই বছরের মাথায় ব্রিটিশকে পাততাড়ি গুটিয়ে ঘরে ফিরতে হলো। কিন্তু নেতাজী ফিরলেন না। বি আর আম্বেদকর ব্রিটিশের এই পরাজয়ের পেছনে নেতাজীর নিরলস সংগ্রামকেই অন্যতম কারন হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু আজও নেতাজীর অন্তর্ধান লাল ফিতের বাধুনিতে আটকে আছে। কেন? জহরলাল নেহেরু থেকে শুরু করে নরেন্দ্র মোদী কেউই এই অন্তর্ধান রহস্যকে উন্মোচন করলেন না। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী’জি আজাদহিন্দ সরকারের প্ল্যাটিনাম জয়ন্তীতে লালকেল্লা থেকে ভাষণে বলেছিলেন, ‘নেতাজী সংক্রান্ত সমস্ত ফাইল তিনি জন সমক্ষে আনবেন’। কিন্তু তিনিও রাজনীতি থেকে বেরোতে পারলেন না। কারন তাতে আর এস এস-এর সেই বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস হয়তো সামনে চলে আসবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি-জাপানের সাহায্য নেয়ার জন্য একসময় বামপন্থীরাও সমালোচনা করেছিল নেতাজীর। যদিও বামপন্থীরা আজ তাদের সেই ভুল থেকে বেড়িয়ে এসেছে দেশব্যাপী বিরোধিতার মুখে।
আজ আরেকবার মোদী সরকার সাধারণতন্ত্র দিবসের ট্যাবলো থেকে নেতাজীকে বাদ দিয়ে প্রমান করে দিল, এখনও নেতাজী তাদের ভয়ের কারন। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী, বুদ্ধিজীবী, নোবেল ল্যরিয়েট, সাংবাদিক দের নিয়ে এই নোংরা রাজনীতি বন্ধ হোক। তা নাহলে ইতিহাস কাউকে কিন্তু ক্ষমা করবে না। কারন ইতিহাসকে চেপে দেয়া যায় সাময়িকভাবে, কিন্তু হত্যা করা যায়না।