।। রকি ।।

অরিন্দম নাথ

আমার নাম রকি । আমি একটি কুকুর ছানা । কুকুরের বাচ্চা বলছি না । গালি গালি শুনায় । দেশীয় কুকুর । আমার বয়স তিনমাস । মানুষের অনুপাতে সোয়া দু'বছর । আমাদের এক বছর বয়স মানুষের সাত বছরের সঙ্গে তুল‍্য । কারণ সহজেই অনুমেয় । আমাদের সর্বোচ্চ আয়ু চৌদ্দ বছরের কাছাকাছি । মানুষের সাত চৌদ্দ আটানব্বই । গড় আয়ু আরও কম । আমার গায়ের রঙ মেটে-খয়েরি । আমার মনিব যে কে এখনও ঠাহর করে উঠতে পারিনি । একটি মুসলিম মহল্লায় আমি থাকি । এক ওঠানে চার-পাঁচটি ঘর । অনেক কাচ্চা-বাচ্চা । সবাই খুব আদর করে । অথচ এক সপ্তাহ আগে আমার কোথায় প্লেসমেন্ট হবে ধারণা ছিল না । পাশের একটি পাড়াতে আমরা থাকতাম । একটি জনজাতি বাড়িতে । আমরা পাঁচ ভাইবোন ও মা । চারটি ভাই । একটি বোন । আমাদের বাবা কে জানি না । আমার মায়ের গায়ের রঙ সাদা । বোন কালো । আমরা চারভাই কাছাকাছি রঙ । তামাটে কালার । হালকা খাকিও বলা যায় । পাঁচটি বাচ্চার জন্ম দিয়ে মা ভীষণই শীর্ণকায় হয়ে গিয়েছিলেন । তথাপি, আমাদের মাতৃস্নেহে, মাতৃদুগ্ধে বড় করছিলেন । আমি একটু গাবলু-গুবলু । তাই প্রথমে প্লেসমেন্ট হয়েছে ।

এখানে এসে জানলাম আমার আগে এখানে আরেকটি কুকুর ছানা ছিল । আমার চেয়ে মাস খানেকের বড় । ওরও নাম ছিল রকি । সাদা-কালো রঙ । রকি যেন প‍্যাটেন্ট নাম । ওই রকি একটি পথ দুর্ঘটনায় মারা যায় । আমি যেখানে থাকি সামনে দিয়ে একটি পিচ-রাস্তা চলে গেছে । সঙ্গে চৌমাথা । ভীষণই ব‍্যস্ত-সমস্ত । বিশেষ করে দিনের বেলায় । সন্ধ্যায় গাড়ি চলাচল কমে আসে । তবে বেয়াড়া বাইক চালকদের উৎপাত শুরু হয় । হঠাৎ করে দ্রুত গতিতে বেরিয়ে যায় । অধিকাংশই বেপাড়ার যুবক । অনেকে নেশা করে থাকে । আমার পূর্ববর্তী রকি এমনি একটি বাইকের চাপা পড়ে । বাইক চালক না থামিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায় । রকি তখন সামনের দোকানে এক কাকুর আদর খাচ্ছিল । পুলিশ কাকু । বিস্কুট খেয়ে লেজ নাড়ছিল । অসাবধানে রাস্তায় এসেছিল তখনই বিপত্তি । বাইকটি দাড়ায় না । কাকু একটি স্কুটি নিয়ে পিছু পিছু ধাওয়া করেন । কিন্তু ধরতে পারেন না । এর আগে রকির এক ভাইও একটি গাড়ি চাপায় মারা যায় । মাস-তিনেক বয়স হয়েছিল । পাড়ার এক ডাক্তারবাবু গাড়ি চাপা দেন । তিনি একটু অপ্রকৃতিস্থ ছিলেন । দোকানের কাকু এইজন‍্য পাঁচশো টাকা আদায় করেন । এনিয়ে তাদের মধ্যে কিছুটা মনোমালিন্যও হয় । এতে অবশ্য দোকানের কাকুরই ক্ষতি হয়েছে । তিনি একজন মালদার খরিদ্দার হারিয়েছেন । ছোট সবজির দোকান । সঙ্গে চায়ের আয়োজন । রুগ্ন ব‍্যবসা । অধিকাংশ বাকিতে খরিদ্বারী করে । যখন বাকির পরিমাণ বেশি হয়ে যায়, অন‍্য দোকানে চলে যায় । ডাক্তারবাবু নগদে জিনিসপত্র কিনতেন ।

এর আগে পূর্ববর্তী রকির মা রকি, সবার মনোরঞ্জন করতেন । কিঞ্চিৎ অধিক তিন বছর বেঁচে ছিলেন । দুইবার মাতৃত্বের স্বাদ অনুভব করেন । সিনিয়র রকি ছিল তার প্রথম সন্তান । প্রথম পক্ষেরও হতে পারে । ওর রঙ ছিল হলদেটে । দ্বিতীয়বার মা হয়ে তিনি তিনটে বাচ্চার জন্ম দেন । একটি আতুর ঘরেই মারা যায় । বাকি দুজনের মৃত্যু আমি উল্লেখ করেছি । রকির মা রকির মৃত্যু ভীষণই দুঃখের । গলায় মাছের কাটা বা কিছু আটকে গিয়েছিল । গলা থেকে বিচিত্র আওয়াজ বেরুত । মানুষের গলার মত । বাড়ির লোকজনেরা হাসপাতালে নিয়ে গেলে তিনি বেঁচে যেতেন । কিন্তু কে-যেন তাদেরকে পরামর্শ দিয়েছিল দৌড়ের উপর রাখলে বস্তুটি গলা থেকে বেরিয়ে যাবে । সেই থেকে বাড়ির বড়রা তাকে দৌড়ানির উপর রাখতো । ক্ষুধায় তৃষ্ণায় রকির মা রকি, তৃতীয় দিন সকালে মারা যান । মৃত্যুর কারণ আমি চোকিং বলবো না । চোকিং হলে, শ্বাস আটকে গিয়ে খুব দ্রুত মৃত্যু ঘটে ।

সিনিয়র রকি আততায়ীর হাতে খুন হয় । তার ছিল পেটানো শরীর । খুবই স্মার্ট ছিল । তখন তার বয়স দেড় বছর । তার দাপটে বাইক আরোহীরা র‍্যাশ ড্রাইভ করতে পারতো না । অনেকে বাইক ফেলে দৌড়ে পালাতো । বিশেষতঃ হিরোহুন্ডা স্প্লেন্ডার আরোহীরা । অনেক সময় কামড়ে দিত । হয়তো এই মডেলের কোনও বাইক তাকে ব‍্যথা দিয়েছিল । একদিন রাত্রিতে কোনও দুষ্কৃতি তাকে স্ট‍্যাব করে । মরণাপন্ন অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় । বেশ কয়েকটি স্টিচ লাগে । সবার সেবায় রকি সুস্থ হয়ে ওঠে । এরপর সে আর কাউকে কামড়াতো না । তবে অনাচার দেখলে প্রতিবাদ করতো । গালাগালি দিত । পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে অপরিচিত লোকজন তাকে সমীহ করতো । পরিচিত জনেরা আদর করতো । এরপর সে মাস ছয়েক বেঁচে ছিল । রাত্রিতে অজ্ঞাত আততায়ী তাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলে । সকালে তার মৃতদেহ উদ্ধার হয় ।

এরও সিনিয়র এক রকি ছিল । খুবই তেজী । সেও খুন হয়েছিল । আমি যার মুখে রকিদের গল্প শুনেছি তিনি সেই রকিকে দেখেননি । তবে পাড়ার একটি বধূর দুঃখের কথা বলেছেন । ভদ্রমহিলা একটি টেইলার্সের দোকান চালান । স্বামী পরিত্যক্তা । তবে খরপোশের একটি মামলা চলছে । পারিপার্শ্বিকের বিচারে লোকটি অগাধ সম্পত্তির মালিক । এটি ছিল তার চতুর্থ বিয়ে । এর আগের তিনটি বৌয়েরই অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে । এনিয়ে মামলা মোকদ্দমা হয় । দুইবার কিছুদিন করে জেলে ছিল । সে যেহেতু আর্থিকভাবে স্বচ্ছল পণের জন্য চাপ দিত না । গরীব ঘরের মেয়েকে বিয়ে করতো । পণের জন্য মৃত্যু মামলা দাঁড়াতো না । পণের মামলায় অভিযুক্তকে প্রমাণ করতে হয় সে নির্দোষ । আর খুন কিংবা আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলায় পুলিশকে প্রমাণ করতে হয় লোকটি দোষী । যা সত্যিই খুব কঠিন । সে যাক । আসন্ন জীবন সংগ্রামের কথা ভেবে আমি কিছুটা শঙ্কিত । প্রকৃতি আমাকে এই প্লেসমেন্ট দিয়েছেন । টেইলর বধূটির মতো । তাঁর থেকে প্রেরণা নেই । বাস্তবকে মেনে নিয়েই আমি সংগ্রাম চালিয়ে যাব । মনে মনে ROCKY নামের একটি অর্থ খুঁজে পেয়েছি, Remembrance of past, Ocean of sorrow, Courage for fight, Knowledge of valour and Yarn for yesteryear... সংক্ষেপে, বিগত দিনের সাহসী জীবন-সংগ্রামের সুখ-দুঃখের স্মৃতি রোমন্থন ।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.