"সুখকর অভিজ্ঞতার চেয়ে বিপরীত অভিজ্ঞতাই বেশি জোটে আমার ভাগ্যে।"
কথাসাহিত্যিক তমা বর্মণে'র সাথে একান্ত আলাপচারিতায় প্রাবন্ধিক সৌম্যদীপ দেব
সৌম্য : সাধারণ বাঙালি পরিবারের ছেলে- মেয়েদের মতোই কবিতা দিয়ে লেখালেখিতে আসা। ২০১৭ তে প্রথম ছোটোগল্পের আঙিনায়। বর্তমান সময়ে এতো এতো কবিতা লেখা হচ্ছে চারপাশে। সব কবিতাই কি 'কবিতা' ? কি বলবেন?
তমা : কবি কবিতা লেখেন। 'সব কবিতাই কি কবিতা?' - এ প্রশ্ন সব কালের-ই। শুরুতে লিখতে এসে যে লেখা হয়, আর পরবর্তীতে লিখতে লিখতে যা লেখা হয় - তার মধ্যে তফাৎ তো থাকবেই। যে কোনও কবির বেলাতেই তাঁর সব কবিতা 'কবিতা' নাও হতে পারে। ওই যে কথায় আছে-- সবাই কবি নন। কেউ কেউ কবি । কবিতা প্রচুর লেখা হচ্ছে। লেখা হলেই তো ভালো। তবে, অনেক দিন লিখিনি , আজকে আমাকে একটা কবিতা লিখতেই হবে - এই ভাবনা থেকে লেখাটা না হলেই ভালো। ধরা না দিলে যার ছিটেফোঁটা পাওয়া যায় না, তাকে নিজে থেকে আসতে দিলেই ভালো। চেষ্টাকৃত লেখাগুলো সবসময় কবিতা না-ও হতে পারে। আসলে শুকনো আকাশে বৃষ্টি বজ্রবিদ্যুৎ ঘটার এমন এক ব্যাপার হল কবিতা - এ যে কখন, কার কাছে, কিভাবে আসবে বোঝা মুশকিল! কবিতা হলো অথবা হলো না এটা বুঝতেও চর্চার প্রয়োজন। লেখার চর্চা করতে তো হবেই। আশ্চর্যের জিনিস এটাই - কবিতা ধারণ করার ব্যাপার একদিকে, আবার লিখতে হলে তার জন্য অনেক কিছু শেখারও প্রয়োজন আছে। শুধু ভাব প্রকাশ করে লিখলেই সব কবিতা হয় না। সহজ জিনিসকে দুর্বোধ্য করে তোলার একটা সহজাত প্রবণতা কবিতার থাকে। আবার এতটাই দুর্বোধ্য করে ফেললাম যে পাঠক দূর দূর পর্যন্ত সম্পর্ক স্থাপন করতে পারল না, এও মনে হয় কবিতার ক্ষতি। আসলে কবিতা যে কি তা ঠাহর করতে পারাটাই বড্ড কঠিন।
সৌম্য : আপনার কবিতা একটা নিজস্ব জগতের কথা বলে। সংগোপনের কথা বলে। সময় ও বদলে যাওয়া মুখচ্ছবির কথা বলে। - আপনার পছন্দের কবি কে?
তমা : অনেকেই আছেন। তার মধ্যে কবি ভাস্কর চক্রবর্তী এবং কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ে'র কবিতা আমায় জাদুর মতো সম্মোহিত করে ! কবি সেলিম মুস্তাফা'র কবিতা, কবি তমালশেখরে'র কবিতাও খুব টানে। হ্যাঁ। আর একজনের কথা বলতেই হয়। তিনি কবি প্রদীপ চৌধুরী।
সৌম্য : "কথাকার তমা বর্মণ অন্তর যাপনে তিনি গ্রামের চিত্র অঙ্কন করেন যা বাস্তবোচিত। তাঁর গল্পের ভাষা স্পর্ধিত ও শানিত - যা তাঁর গল্পকে স্বাবলীল করে তুলতে অনেক বেশি সহায়ক। সংসারে আবদ্ধ নারীর চিন্তা - চেতনা ও মনস্তত্ত্বের প্রস্ফুটন ও বিশ্লেষিত দিকগুলো তিনি যে পারদর্শিতার সাথে তুলে ধরেছেন, তা তাঁর গল্পকে অনেক বেশি সফলতা দান করেছে।" - আপনার ছোটোগল্প সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে উত্তর পূর্বাঞ্চলের এক প্রাবন্ধিক এই মন্তব্য করেছেন। আপনার অনুভব জানতে চাই।
তমা : তাঁকে আমার নমস্কার। এই আলোচনা আমি মাথা পেতে নিলাম। সবসময় চেয়েছি মানুষের কথা লিখতে। এটাই চাই। সুখ- দুঃখ নিয়ে লিখতে। চেয়েছি মানুষের যন্ত্রণা থেকে বেরিয়ে আসার আকুতি এবং তার জন্য যে প্রতিবাদগুলো তাকে চাঁচাছোলা ভাষায় লিখতে। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে একটা কথা। আমার 'পিঞ্জর' গল্পগ্রন্থে ব্যবহৃত কিছু ভাষা প্রয়োগ নিয়ে শুনতে হয়েছিল, একজন মেয়ে হিসেবে কিভাবে লিখলাম আমি! বোঝাই যায় না এমন ভাষা আমি লিখতে পারি। হয়তো মেয়ে হিসেবে আমার ক্ষেত্রে এই ভাষার প্রয়োগ অশ্লীল বলে মনে হয়ে থাকতে পারে (কারো কারো কাছে) । দ্বিধা বোধ করিনি। গল্পের আখ্যানে কোনো চরিত্র ভাষার দাবি করলে তারচেয়েও এগিয়ে লিখতে পারি। বরং চরিত্র চাইছে না অথচ লেখক আরোপিত এমন শব্দ সেখানে এনেছেন, তখন রগরগে মনে হয়। যাইহোক। এ অন্য আলোচনার বিষয়। গল্পের ক্ষেত্রে বলবো চেষ্টা করি মানুষের বাস্তবতাগুলো থেকে আমার ভাবনা যেন এক ইঞ্চিও দূরে না থাকে। নারী হিসেবে দায়িত্ব বোধ জাগে চারদেয়ালে আটকে থাকা সে'সব মানুষের কষ্টগুলি লিখতে। নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে লিখতে। চলার পথে বহু মানুষ দেখেছি। সুখকর অভিজ্ঞতার চেয়ে বিপরীত অভিজ্ঞতাই বেশি জোটে আমার ভাগ্যে। একেও এভাবেই ভাবি - এই তো কিছু শিখিয়ে গেল। মন্দ কি ? বোঝার চেষ্টা করি মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলো। খুব ভাবায় আমাকে। লেখায় হয়তো তারই প্রতিফলন ঘটে। মানুষের কাছে পাওয়া অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা, সে সবকেও ইতিবাচক মনে করি। সাহিত্য চর্চা করতে এসে পরোক্ষভাবে এই উপকারটা আমার হয়েছে - সবেতেই নির্বিকার থাকতে পারি, এটাই তো বেশ। সমালোচনা বা প্রশংসা কিছুই তেমন নাড়ায় না। বরং সবসময় ক্রাইসিস-এ ভুগি। একটু ভালো লিখতে পারার জন্য। এখনও ততটা গভীর জীবনের কথা লিখতে পারলাম কই? 'অন্তর যাপনে গ্রামের চিত্র' কথাটি খুব ভালোলাগলো। আসলেই তো আমি গ্রামের মেয়ে। মন মানসিকতা যা তৈরি হবার সেখানেই হয়েছে। দীর্ঘকাল হাই-সোসাইটির জীবন যাপন, কংক্রিট শহরে থেকেও আমি 'আমি'ই। গ্রাম বাংলা কিংবা বাউল জীবন থেকে বেরোতেই পারিনি। বরং ঝকঝকে লাইফ-স্টাইলে বাহ্যিকভাবে যত আবদ্ধ হয়েছি, ততটাই অন্তরে প্রকট হয়েছে - আমার গ্রাম বাংলা। হাত বাড়িয়ে ছুঁতে না পারলে মানুষ যেমন মনে মনে তাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করে, অনেকটা এমন। ছুঁয়ে থেকেছি মনে । লেখায় তাকে ধরার চেষ্টা করেছি সবসময়। তাই যেনো থাকতে পারি ।
সৌম্য : কি বলবেন - একজন লেখকের সব লেখাই কি প্রকাশিত হওয়া উচিত? যদি উত্তর 'হ্যাঁ' হয় তাহলে কেনো আর উত্তর যদি 'না' হয় তাহলেও কেনো বলবেন?
তমা : লিখেই প্রকাশ করার জন্য অস্থিরতা এই ব্যাপারটাই যেনো কেমন কেমন ! একটু ধীরেসুস্থে হলে ক্ষতি কি ? মাঝেমাঝে বিরাম নিলেও ক্ষতি নেই। কেউ তো আর লেখা নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে না? অবশ্য লেখক তৃপ্ত হলে লেখাটি প্রকাশ করতেই পারেন। তবে আমার মনে হয়, তাতেও লেখক ধীরেসুস্থে চললে অন্তত জানতে পারার অবসরটুকু পেতে পারেন, আদৌ প্রকাশিত লেখাগুলি নতুন কিছু দিচ্ছে কিনা, একঘেয়ে হচ্ছে কিনা এটা বুঝতে বোধহয় কখনও কখনও সময় নেওয়া ভালো। যদিও এটা সম্পূর্ণই আমার ব্যক্তিগত ধারণা। সবক্ষেত্রে যথাযথ না-ও হতে পারে। তাড়াহুড়োর তো কিছু নেই? একটা ভালো লেখা যেকোনো সময় প্রকাশ পেলেও তার উতকৃষ্ট মান তাকে টেনে আনবেই পাঠকের দরবারে। আবার গাদাগুচ্ছ প্রকাশ করে তার মধ্যে একটাও যদি মনে রাখার তাগিদ অনুভব না করতে পারল পাঠক, কি লাভ? হোক না ধীরেসুস্থে। আমি আমার কথাই বলি। গল্প লেখায় আমি যতটা উদার, প্রকাশ করতে হলে জানি না কেন এগুলোকে ছাড়তে চাই না সহজে। আমার মতো শম্বুক গতি নিশ্চয় ভালো কথা নয়। অসংখ্য লেখা হোক। কিন্তু লিখে ফেলেছি মানে এবার প্রকাশ হয়ে গেলে স্বস্তি, এত তাড়া কিসের ? প্রকাশিত সংখ্যা নিয়ে কোনও প্রতিযোগিতার ব্যাপার তো নেই? সময় হলে লেখাই তাগাদা দেয় এবার বের হতে দাও বলে। স্রষ্টার নিজেরও ক্ষমতা থাকে না আটকে রাখার। আমার প্রথম কবিতার বই, 'নির্জন কোলাহল' বেরিয়েছিল অন্তত পনেরো বছর কষ্ট করে লেখার পরে। দুর্ভাগ্য যদিও স্থানিক দূরত্বের কারণে এতে প্রচুর ভুলভ্রান্তি থেকে গেছিল। প্রুফ দেখাতে সমস্যা ছিলো । পরবর্তীতে অবশ্য যথাযথ ভাবে বের হয়েছে 'নির্জন কোলাহল' বইটি। কিন্তু আফসোস যায়নি। ভাবি, আরও ধীরেসুস্থে করা উচিত ছিল। স্থানিক দূরত্বের কারণে যা হয়েছে তাহলে হয়তো তা হতো না। আসলে একটা লেখা হওয়া মানে তো সন্তান প্রসব করার মতোই। ধীরে ধীরে লালনপালন করে বাইরে বের হতে দিলেই বোধহয় বেশি ভালো।
সৌম্য : উত্তর পূর্বাঞ্চলের ৫ জন গল্পকারের নাম সাজেস্ট করতে বলা হলে - আপনি কাঁদের কথা বলবেন?
তমা : গল্পকার কিশোররঞ্জন দে ( ত্রিপুরা), গল্পকার শ্যামল বৈদ্য ( ত্রিপুরা), গল্পকার মেঘমালা দে মহন্ত(আসাম), গল্পকার রণবীর পুরকায়স্থ( আসাম), কান্তারভূষণ নন্দী( আসাম) এবং আরও অনেকেই আছেন।
সৌম্য : আপনার পছন্দের কয়েকটি বইয়ের নাম জানতে চাই।
তমা : এই মুহূর্তে মনে পড়ছে- আখতারুজ্জামানে'র 'খোয়াবনামা', সমরেশ মজুমদারে'র 'কালপুরুষ' এবং জয় গোস্বামী'র কাব্যগ্রন্থ 'পাতার পোশাক', শক্তি চট্টোপাধ্যায়ে'র 'যেতে পারি কিন্তু কেনো যাবো' এটি তো আছেই। এছাড়াও অনেক আছে। 'আগুন পাখি', 'পূর্ব পশ্চিম', 'অক্ষয় মালবেরি', 'অগ্নিসূত্র' অনেক আগের পড়া তবু আজও প্রিয় বইয়ের মধ্যে অন্যতম। সম্প্রতি তাতে সংযোজন হয়েছে 'চাকমা দুহিতা' উপন্যাসটিও।
সৌম্য : জীবনানন্দ দাশ ' বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ ' সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছিলেন " আমাদের কবিতা আজ পর্যন্ত, আমার মনে হয় , বাঙলাদেশের রাষ্ট্রকর্মের বৃত্তান্তে তেমন কিছু আবেগ ও মননভূমি না পেয়েও গভীরতর প্রসার পেয়েছে - বিশেষত শেষের দিকে - পৃথিবীরই আধুনিক কালের মহত্তম তাৎপর্যগুলোর সঙ্গে অনেকখানি যোগ রেখে। ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের থেকে বাঙলাদেশে স্বভাবতই ভালো কবি জন্মায় শুনে এসেছি। সত্য কিনা নির্ধারণ করা আমার পক্ষে কঠিন। প্রদেশ - ভাষাগুলো আমার প্রায়ই তেমন কিছু জানা নেই। স্পষ্ট অনুবাদ পাচ্ছি না। ও সব দেশের চেয়ে বেশি সংখ্যক কবি বাঙলাদেশে জন্মায় খুব সম্ভব। এ দেশে এক - আধটি কবি প্রায় প্রতি যুগেই থাকে - অথবা সমগ্র কবিতার একটা আবহ - যাকে বলা যেতে পারে বিশেষ কুশল। " - একজন কবি কখন কালজয়ী হয়ে ওঠেন?
তমা : 'কালজয়ী' অর্থাৎ সময়ের আত্মোপলব্ধিতে যিনি সময়কে পেরিয়ে যেতে পেরেছেন। সমগ্র সময় ধরেই একজন কালজয়ী কবি তাঁর নিজস্ব চিন্তাভাবনা, দৃষ্টিকোণকে সামনে রেখে যান। সময় বলতে - মানুষ, রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের উত্থান - পতন, আভ্যন্তরীণ সিস্টেম নিয়ে একটা সমগ্রতা বোঝায়। তাকে সামগ্রিকভাবে ধরতে হলে একজন কবিকে সম্পূর্ণ সমাজ সচেতন মানুষ হতে হবে আগে। মানবিক চেতনার কথা বলবো এখানে। কালজয়ী একজন কবি দেশ-জাতি- মানুষ এবং মানুষের নিপীড়ন, দুর্দশা, সর্বোপরি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল নিয়ে জাগ্রত চেতনার কথা তবেই বলতে পারবেন। কবি কারও অনুগত হন না। বরং তাঁর অবস্থান অনেকটা ঈশ্বর প্রকৃতির মতো। সব মঙ্গলেই আছি। কিন্তু আমি কোথাও আটকে নেই! না থাকারই কথা। দেশ বা সময়ের উর্দ্ধে তাঁর বিচরণক্ষেত্র । আটকে থাকবেন কেনো? অতএব কালজয়ী কবি সময়ের আগে সময়কে অনুধাবন করে দর্শনে অন্য এক সময়ের কথাই বলবেন। এই দূরদর্শিতা 'আজ-কাল-আগামী'কে ধরে ফেলার! আবার সমাজ সচেতনতাই শুধু নয়। কবি জীবনানন্দ দাশ কবিতায় যেভাবে বাংলার চিত্র তুলে ধরেছেন সে কথা যদি বলি, আজকেও বাংলার প্রকৃতির প্রতি আমাদের আকুলতা জাগিয়ে তোলে ! তারমানে একজন কবি হাজার হাজার মানুষের আবেগকে যখন একসূত্রে গ্রথিত করে ফেলেন কবিতায় এবং দেশ-কাল পেরিয়ে একাকার হয়ে ওঠেন তখনই তিনি কালজয়ী। বড়ো কঠিন কাজ। অমরত্ব পাওয়া কি এতো সহজ? কিন্তু এখানে আর একটা কথাও বলবো, "ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের থেকে বাংলাদেশে ভালো কবি জন্মায় অথবা ও সব দেশের চেয়ে বেশি সংখ্যক কবি বাংলাদেশে জন্মায় অথবা এ দেশে এক-আধটি কবি প্রায় প্রতি যুগেই থাকে" -
ব্যাপারটাই তো কেমন যেনো ! থাকলেও সবাই নিশ্চয়ই কবি শামসুর রহমান, কবি জসীমউদ্দিন বা কবি জীবনানন্দ নন। এটা সবক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আর কালজয়ী কবি কখনও ভারত কিংবা বাংলাদেশ বলে তো আর হবেন না? হওয়ার কথাও নয়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল কথাটা তবেই বোধহয় আসে। তাই না।
সৌম্য : নতুন কি কি কাজ করছেন? উপন্যাস লিখছেন?
তমা : এই প্রশ্নটায় সত্যিই বিপদে পড়েছি। যা-ই বলবো শেষপর্যন্ত নিজের ঢাক পেটানো হয়ে যাবে না তো? আজকাল এর ঠেলায় তো শ্বাস নেয়া মুশকিল। যাইহোক। উত্তর দিতে হবে যখন বলি, মোটামুটি আড়াইটে উপন্যাস নিয়ে দিব্যি আছি। বা বলা যায়, সময়ে সময়ে লেখা হয়ে পড়ে আছে। প্রায় সাড়ে তিন-চার বছর হলো। বই আকারে ভূমিষ্ঠ হয়নি এখনও। আপাতত আশাবাদী, হয়তো খুব দেরি করবো না। এতদিন লেগেছে, থাক না আরও কিছুদিন। তাড়া কিসের? কিন্তু এবার ভাবা দরকার। দেখা যাক কতদূর কি হয়। মাঝেমাঝে শুনি কেউ যখন বলেন, গত কুড়ি দিনে একটি দীর্ঘ উপন্যাস লিখে শেষ করে ফেললাম। সত্যি - সত্যিই তখন ঘাবড়ে যাই! শম্বুক গতিটাকে নাড়াচাড়া দিতে সত্যিই এবার ইচ্ছে হচ্ছে। দেখা যাক। আগাম বলছি না।
সৌম্য : লেখকের ব্যক্তি জীবনের বিপর্যয় তাঁর সাহিত্যকেও ভেঙে চুরমার করে দিতে পারে ; নাকি অক্ষত রাখতে পারে। - কোনটাতে বিশ্বাস করেন?
তমা : এই ভেঙে চুরমার করে দেয়াটা যদি নেতিবাচক অর্থে হয়, বলবো - একজন লেখক সবকিছুর পরেও শুধু লিখতেই চাইবেন। যিনি লিখতে চান তিনি সমস্ত পরিস্থিতিতেই লিখে যাবেন। লেখা ছাড়া লেখকের গতি নেই। বরং এক্ষেত্রে ব্যক্তি জীবনের যন্ত্রণাগুলো থেকে ভারমুক্ত হবার জন্য এটাই হতে পারে একজন লেখকের শ্রেষ্ঠ উপায়। সুখ-দুঃখ, জীবনের নানান যন্ত্রণা, আঘাত এ সমস্ত ব্যক্তিগত সমস্যা, অনুভূতিগুলো সবার মতোই সামান্য হলেও, কিয়দংশে হলেও আলাদা হয় লেখক - সাহিত্যিকদের । একটু বেশিমাত্রাতেই স্পর্শকাতর হন তাঁরা। একজন সাধারণ মানুষ যিনি জীবন বলতে - খেয়ে বেঁচে ঘুম বা দশটা-পাঁচটা ডিউটি বোঝেন, তার বাইরেও যে ভাববার একটা জগৎ আছে তা মনেই করেন না - স্বভাবতই তাঁর সঙ্গে একজন লেখকের তফাৎ থাকবে। কারণ, লেখকরা সূক্ষ্ম অনুভব এবং চেতনার রাজ্যে বসবাস করেন খুব গোপনে। বাইরে থেকে এতটা বোঝাই যায় না। উপার্জনের চিন্তা থেকে শুরু করে কমবেশি সব দায়িত্বই তাঁকে ব্যক্তি জীবনে পালন করতে হয়। আপাতদৃষ্টিতে এক মনে হলেও একজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁদের পার্থক্যটা এই, প্রতিদিনকার ঘটনা যারা হয়তো লেখক নন এমন কেউ তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না বা দেবেন না । বলাবলি সেরেই ভুলে যাচ্ছেন। কিন্তু লেখকের তাতে সন্তুষ্টি নেই। লেখক মাত্রই শুধু মৌখিক নন, প্রত্যেকটি ঘটনার একটা নিজস্ব তদন্ত তিনি তখন মনে মনে করবেন। এটাই হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। এবং এই বিশ্লেষণাত্মক ব্যাপারগুলিকেই কলমে ধরতে চাইবেন। চেতন - অবচেতন যেকোনও পর্যায়ে চলতে পারে ব্যাপারগুলো। বিশ্লেষণ করতে করতে চাপ আসে মাথায়। একসময় লেখক মাত্রই তখন ছুটে যান কলমের কাছে। নিজস্ব উপলব্ধিকে কলমে ধরতে মরিয়া হয়ে ওঠাটা - ব্যক্তিগত জীবনে বিপর্যয় এলেও একই ব্যাপার। অন্তত তিনি (লেখক) জানেন চাপগুলি থেকে নিজেকে মুক্তি দেবার এই একটাই রাস্তা তাঁর জানা আছে । কোনওভাবেই ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে যাবেন না। বরং সেখানেই জীবনের টাটকা কাঁচাগন্ধটুকু বের হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। গল্প- উপন্যাস পড়তে গিয়ে অনেক সময় প্লাস্টিক ফ্লেভার পাই। মনে হতে থাকে, বেশ গল্পটা বানিয়ে বলে দেয়া হলো যেনো ! আর টানে না তখন। পাঠক হিসেবে অক্ষমতাও হতে পারে। কিন্তু গল্প উপন্যাসের ক্ষেত্রে প্রাণ সঞ্চারটাই আমি খুঁজি সবসময়। জীবনের নানান অভিজ্ঞতা, তা থেকে লেখকের দর্শনবোধ, নিশ্চিত এসব কিছু হলেও ম্যাটার করে। ব্যক্তি জীবনে যার যতো বেশি অভিজ্ঞতা, তাঁর কাছে রসদ ততো বেশি থাকার কথা। বেশ তো। ব্যক্তি জীবনের বিপর্যয়টাকে যদি একজন লেখক ইতিবাচক ভাবে নেন তাহলে লেখালেখির জন্য তো ভালো । যন্ত্রণা থেকে বেড়িয়ে আসার জেদটাকে চাইলে লেখার ফর্মে ইচ্ছেমতো ভাঙচুর করে কাজে লাগাতে পারেন। আমি ক্ষতি তো কিছুতেই দেখছি না। ওই যে আগেই বললাম, ব্যক্তি জীবনে বিপর্যয়ের অভিজ্ঞতা পরিসরটি যত যার বিস্তৃত, স্বাভাবিকভাবে তাঁর জীবনমুখী চিন্তাগুলো অন্যরকম হবার কথা। অতএব এতে একজন লেখকের সাহিত্যের দিকে ক্ষতবিক্ষত হবার কিছু কারণ দেখছি না, তাঁর তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়াগুলো যা-ই থাকুক। হয়তো তার জন্য কিছুটা সময় নেবেন। কিন্তু ব্যক্তি জীবনের বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে বেড়িয়ে আসতে লেখকরাই ভালো পারেন আর তা অবশ্যই লেখার মাধ্যমে । বরং তখনই লেখাকে আরও বেশি জীবন্ত করে তোলার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আমার ধারণা।
সৌম্য : আপনার কাছে শেষ প্রশ্ন, ত্রিপুরার নতুন প্রজন্মের মধ্যে কাঁদের কাজ নিয়ে আপনি আশাবাদী বা কাঁদের লেখা পড়েছেন?
তমা : অনেকেই কাজ করে যাচ্ছেন। যার যার মতো করে। গবেষক সাহিত্যিক সৌম্যদীপ দেব নতুন নতুন ভাবনা চিন্তার ফসল আমাদের দিয়ে চলেছেন। অত্যন্ত সিরিয়াস কাজ করেন তিনি । ভালো লাগে। অনেকেই কাজ করছেন। মাঝে মাঝে স্যোশাল মিডিয়ায় পড়ি কারও কারও লেখা। ভালো লাগে। যদিও খুব কম থাকি। বাকি নির্দিষ্ট করে তেমন কারও পড়া হয়ে ওঠেনি। নতুন লিখছেন যারা। বলা যায় বই আকারে সুযোগ পাইনি পড়ার তেমন। হলে নিশ্চয় পড়বো। পড়া তো উচিত।