"একজন লেখক উভচর , নৈর্লৈঙ্গিক উভচর হবেন এমনটি আমার বিশ্বাস ।"

কথাসাহিত্যিক সুতপা দাসে'র মুখােমুখি আলােচক সৌম্যদীপ দেব

সৌম্য : “ Women's Empowerment ” শব্দটা এই সময় খুব প্রচলিত । কিন্তু বাঙালি পরিবারের অন্দরেই নারীর ক্ষমতায়নকে এখনাে মান্যতা দেওয়া হয় না । আপনি কিভাবে দেখেন এই বিষয়টাকে ?

সুতপা : আমি হাসছি হাসলাম জৈবিক বিচারে আমি মহিলা বলেই কি আমাকে এ প্রশ্নটা করা হল ? তার উপরে বাঙালি পরিবারের অন্দরেই নারীর ক্ষমতায়নকে এখনাে মান্যতা দেওয়া হয় না - এটা বলে এবং অন্দর শব্দটির সঙ্গে ' ই ' যােগ করে আবার এই আমাদের মহিলাদের দৌর্বল্য বাড়িয়ে দেওয়া হল। যেন অন্যদের পরিবারে ( জাতি ধরে উচ্চারণে আমার সুতীব্র আপত্তি রয়েছে ।) ক্ষমতায়ন বেশি , বাঙালিদের পরিবারেই তা কম । বঞ্চনার ইতিহাস পৃথিবীতে যথেষ্ট । তবু যতদিন এই প্রশ্নগুলাে করা হবে ততদিনই মেয়েদের দৌর্বল্যকে আরও প্রকারান্তরে বেশি করে ঠেলে দেওয়া হবে বলে আমার বিশ্বাস । ' আপনি কি দুর্বল ’ ? এই প্রশ্নটি কাকে করা হয় ? পরােক্ষে যিনি দুর্বল বলে ধরে নেই তাকে । তাই নয় কি। বাকিটা প্রমাণ করবার অপেক্ষা । হ্যাঁ মেয়েদেরও যাপিত জীবন রয়েছে আর সে জীবন জৈবিক আয়তন , হরমােনীয় এবং সামাজিক - অর্থনৈতিক দিক থেকে লব্ধ অভিজ্ঞতা ও অবস্থানগত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। তার কথা বলায় বা কথা রচনায় এক ধরনের Discourse তৈরি করে অথবা তার কাছে বিশেষ Discourse - এর প্রত্যাশার আকাক্ষা / চাহিদা প্রকাশ করে । মিশেল ফুকো বলেছিলেন , যে ব্যক্তি রচনাধারা নিয়ন্ত্রণ করে সত্য তার উপরে নির্ভর করে । তাঁর কথার সূত্র ধরলে এই সমাজ যদি পিতৃতান্ত্রিক বা পুরুষ প্রাধান্যের সমর্থক হয় তবে তা নারীর রচনারীতির বিচারেও বিশেষ ধরন এবং নির্মাণের তকমা খোঁজে । প্রত্যাশিত এই , নারীর লেখায় নারীবিশ্ব থাকবে অথবা পুরুষের সমান হয়ে তিনি উঠবেন বা প্রমাণিত করবেন এই বিষয়ও তথাকথিত দুর্বলতা থেকে সবলতা প্রাপ্তির আকাঙ্খায় এক ধরনের নারীবাদের জন্ম দেয় । মেয়েদের ভাষাভঙ্গিতে নাকি দুর্বলতা ও অনিশ্চয়তার চিহ্ন থেকে যায় । সেখান থেকে মুক্ত হবার জন্য , সংকীর্ণ পরিধি থেকে বাইরে আসবার জন্য কেউ কেউ বৈপ্লবিক বিধ্বংসী বিচিত্রমুখীন লেখালেখি নাকি করে থাকেন । আমি কোনো ধরনের কর্তৃত্বের ধারণা মুক্ত হওয়া বা না মুক্ত হওয়ার বিতর্কের প্রস্তাবনা করছি না । বরং একজন লেখক উভচর , নৈর্লৈঙ্গিক উভচর হবেন এমনটি আমার বিশ্বাস । যে যার নিজস্ব অবস্থানে সম্মানিত , আত্মপ্রত্যয়ী হবেন এই আশাই করি । কেউ কারাের প্রতিপক্ষ প্রতিস্পর্ধী নন বা সমকক্ষতার লড়াইতে নামেন নি , এটাই যথােচিত বলে বিবেচ্য হােক । স্বাতন্ত্র্যের gynocratics -এ কেন , বরং একজন মানুষ, মানুষ বলেই বিচার্য হবেন এটুকুই আমার বলার ।

সৌম্য : মূলত দু ' হাজার পরবর্তী সময়ে আপনার লেখালেখির কথা বেশি চর্চিত হয়েছে । আপনার কাছে জানতে চাই কখন এলেন এই পথে ? সরাসরিই আসতে চেয়েছিলেন নাকি এক্সিডেন্টালি এসে পড়েছেন ?

সুতপা : লেখক হব বলে যেমন ভাবিনি তেমনি লেখক বলে নিজেকে মান্যতা দিতে আমি প্রস্তুত হইনি । জীবনে বহুকিছু হবার বাসনা হয়েছে বা সম্ভাবনাও একেবারে দরজায় আসেনি এমনটি নয় । তারপরই জীবন হয়তাে আমার রাস্তা বদলে দিয়েছে বা পথ আগলে নতুন বাঁকে ঠেলে দিয়েছে । তবে হ্যাঁ জীবনের একটা লম্বা সময় পর্যন্ত শিল্পী হতে চেয়েছিলাম । ছবি আঁকতে চেয়েছিলাম । তার জন্য প্রথাগত কোন শিক্ষা জোটেনি । পরিবার অন্য কিছু চেয়েছিল ; আলস্যে পরিশ্রমী না হবার দোষে তাও হওয়া হয়নি । ( এই বয়সে পৌঁছে মদীয় পিতৃদেব কর্তৃক নালিশগুলােকে অকাট্য বােধ করে আক্ষেপ হয় । ) আসলে প্রত্যেক জীবনের একটা অমােঘ গতি থাকে । 'সরাসরি ’ বা 'এক্সিডেন্টালি ' কোন শব্দই আমার বেলায় প্রযুক্ত নয় । সবকিছুরই কিছু হয়ে ওঠার অন্তঃশীল রসায়ন নেপথ্যে থেকে যায় । বরং বলি কিছু যদি লিখে ফেলতে পেরে থাকি তবে জীবনই লিখিয়ে নিয়েছে । নাহ লেখক পরিচিতির অর্জনে কোন আকাঙ্ক্ষা এখনও আমার নেই । বরং এই লিখে ফেলতে পারাকে আমাকে ধারণ করা ধূলােমাটির প্রতি আমার ঋণশােধ করা বলে মনে হয় । কথাটা অতিকথন বলে কেউ বিশ্বাস করতে পারেন কিন্তু আমার কাছে এটা সত্য ।

সৌম্য : একটা সময় বিশেষ কিছু কাজ করেছেন সমালােচনা সাহিত্যে । তার প্রমাণ বহন করছে ‘ পিঞ্জিরা থেকে খােলা আকাশের খোঁজে' বা 'উনিশ শতকের নবচেতনার প্রেক্ষিতে বঙ্কিম উপন্যাসের মেয়েরা' প্রভৃতি । সমালােচনা সাহিত্য থেকে উপন্যাসে টার্নওভার ২০১৬ সালে । কেন ?

সুতপা : আমার প্রথম উপন্যাসটি ছিল ছােট । ধারাবাহিক ভাবে “ আজকের ফরিয়াদ ” পত্রিকায় ২০০৯ - এ প্রকাশিত । এটা সত্যি তথাকথিত একাডেমিক কাজ আপাতত এ মুহূর্তে করছি না । তবে গবেষণা বৃত্তি থেকে সরে গেছি এই কথাটিও ঠিক নয় । 'সােনার দুয়ারী ঘর রূপার দুয়ারী ঘর ’ বা ‘ নিশি অন্ধারী ' এক অর্থে গবেষণা বৃত্তিরই ফসল । 'বনফুটকির লতা ' বলে যে লেখাটি প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে তাতেও খানিকটা সত্য ঘাটবার সাক্ষ্য রয়েছে । এ মুহূর্তে ঘর আর যাপিত জীবনের সমঝােতায় সময় করে উঠতে পারছি না । আসলে তথ্য এবং উপাদান ব্যবহারে আমি অসম্ভব খুঁতখুঁতে - তাই দুম করে কোন একাডেমিক কাজ করা আমার জন্য সম্ভব নয় । তবে কয়েকবছর পরমায়ু পেলে নিশ্চয়ই একাডেমিক কাজ করার ইচ্ছে এবং উপাদান রয়েছে । আমি নিজে মনে করি , বুদ্ধদেব বসু'র উপরে করা গ্রন্থটি ( অসম্ভব মুদ্রণপ্রমাদ থাকা সত্ত্বেও ) আমার সবচাইতে ভালাে লেখা । উপন্যাস কেন লিখলাম - এর কোন উত্তর নেই । হয়তাে নিজের জন্য এটা একটা নিরীক্ষা ছিল । আমি রােজ বা নিয়মমাফিক রুটিন বেঁধে লিখিনা । পারিনা। আলস্যদোষ। সব লেখাই রাত সাড়ে দশটার পর ঢুলতে ঢুলতে লিখতে হয় । আবার শুরু হয়ে গেলে এঁটুলি পােকার মতন লেগে থাকে । লেখা চলতেই থাকে । এই যেমন একটি উপন্যাসের প্রচ্ছায় ভেতরে ভেতরে প্রায় শেষ কিন্তু বসবার সময়ই করে উঠতে পারছি না । একাডেমিক লেখা লিখতে না পারার এটাই কারণ , অন্য কিছু নয় ।

সৌম্য : লিটল ম্যাগাজিনে লিখে লেখক হয়ে ওঠা । আর সরাসরি গ্রন্থ লিখে লেখক রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ - কোনটা আপনার কাছে বেশি ফলপ্রসূ বলে মনে হয় এবং কেন ?

সুতপা : অনায়াস বলে কিছু নেই । কোন মানুষই হঠাৎ একটা বই লিখে ফেলতে পারেন কি । ( এর উদাহরণ কম ) । পরীক্ষা , নিরীক্ষা , প্রচেষ্টা এবং নিজের ক্ষমতার যাচাই হওয়াটা প্রয়ােজন। সেক্ষেত্রে লিটলম্যাগে লেখালেখি নিশ্চয়ই একভাবে উত্তীর্ণ করে দেয় ।

সৌম্য : আপনার পছন্দের ঔপন্যাসিক ও কয়েকটি উপন্যাস সম্পর্কে আপনার পাঠক জানতে চায় ।

সুতপা : এইরে তালিকা তাে দীর্ঘ । নির্দিষ্ট কোন ঔপন্যাসিক নেই । প্রিয়তর আখতারুজ্জামান ইলিয়াস । কমলকুমারে'র কিউবিজম ধরনে ত্রিমাত্রিক , না , না তাঁর বহুমাত্রিক লেখা আমার প্রিয় । প্রিয় নাট্যকার সেলিম আলদীন , অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর , দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার - এর লেখার রীত । এত এত প্রিয় বই রয়েছে যে বলাটা দীর্ঘায়িত হবে । গত দু'বছরে নলিনী বেরা'র 'সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা ' ভীষণ ভালাে লেগেছিল আবার সাম্প্রতিক কয়েকমাসের পড়াদের মধ্যে পাপড়ি রহমানের 'বয়ন ’ আস্বাদনে ভালাে লেগেছে ।

সৌম্য : উত্তর - পূর্বাঞ্চলের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের শিক্ষার্থীরা নিজের আশপাশের লেখালেখি বা নিজ রাজ্যের লেখালেখি সম্পর্কে খুব একটা জানে না । এক চরম উপেক্ষা ও উদাসীনতা । - দীর্ঘদিন ধরে অধ্যাপনার সাথে যুক্ত আছেন । এই অজানার প্রধান কারণ কি বলে মনে করেন ?

সুতপা : লেখালেখি সম্পর্কে জানা জীবনের প্রত্যক্ষভাবে জরুরী চাহিদার মধ্যে পড়ে না । কাজেই খেতে পাবার চাহিদার কাছে এই জানাটা প্রথমেই হেরে যায় । লেখাপড়ার ধরন ও রেওয়াজ বদলে গিয়েছে । এই বদলে যাওয়া , সেমেস্টারের একাদিক্রমিক বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষায় বসা ইত্যাদি - এর সবটাই আমার নিজের জন্য সুবিধার বলে মনে হয় না । ( হয়তাে হয় না আমি পুরানাে বা সেকেলেপন্থী বলে ) ইদুরদৌড়ের পৃথিবীতে খেয়ে পরে বাঁচবার জন্য ডিগ্রী এবং নম্বর তােলা চাই । এতে দোষের কিছু আমি দেখতে পাই না । যত ছাত্র সাহিত্য নিয়ে পড়তে আসে তাদের অধিকাংশ তার মধ্যে পরীক্ষা পাশের বিষয় খুঁজতে আসে । ভালােবাসা বা ইমােশান নিয়ে তেমন ছাত্র আসে কই ? সব মিলিয়ে অধিকাংশের সাহিত্য পড়বার মানসিকতা নির্মিত হয় না । সাহিত্য পড়তে গেলে নিজের যে নির্মাণ প্রয়ােজন তা তাদের অনেকেরই তৈরি হয় না । তাছাড়া পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্তির বিষয়ও রয়েছে ।

স্নাতকোত্তর স্তরে নিজ রাজ্যের লেখালেখি জায়গা করে নিতে পারলেও স্নাতকস্তরে এখনও ঠাই করে নিতে পারেনি । আশাবাদী যে তা অদূর ভবিষ্যৎ - এ ঘটবে ।

সৌম্য : কোথাও ঘুরতে যেতে বলা হলে কোথায় কোথায় যেতে চাইবেন ?

সুতপা : এর একটাই উত্তর - পথ যেখানে নিয়ে যাবে ।

সৌম্য : জয়িতা দাস তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ‘ হিন্দুরা পর্দা প্রথা পালন করতেন সভ্যতা এবং ভব্যতার অংশ হিসেবে । অপর পক্ষে , পর্দা প্রথার সঙ্গে মুসলমানদের ধর্মেরও যােগ রয়েছে । সে কারণে , শিক্ষিত এবং স্বচ্ছল মুসলমানদের মধ্যে পর্দা প্রথা হিন্দুদের তুলনায় বেশি কঠোর ছিলাে । ' বাস্তবের পর্দা হয়তাে নেই , কিন্তু পােস্টমর্ডানিজম যুগেও আমরা কি বলতে পারি নারী ও পুরুষের মধ্যে সমাজ কোনাে পর্দা বিচার করে না ?

সুতপা : নারী পুরুষের বিভাজন ? সে তাে জন্মপরিচয়েই প্রকৃতির দ্বারা বিভাজিত । উত্তর - উত্তর আধুনিকতার যুগে একটাই প্রার্থনা- সন্মানজনক সহাবস্থান । বাকি ? আমার প্রথম প্রশ্নের উত্তরটির মধ্যেই বােধহয় আমার বিশ্বাসের যথেষ্ট ঈঙ্গিত রয়েছে ; পর্দা নিয়ে কোন আলােচনায় তার পরে আর যেতে আমি রাজি নই ।

সৌম্য : কোনাে বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করতে চাইবেন যা আপনাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল ?

সুতপা : অস্থির জীবনে বাস্তব অভিজ্ঞতার ঘাত যথেষ্ট সংখ্যক । বাধা পেরোনাের নামই জীবন । ব্যক্তিজীবনের কথা বলতে আমি অকুণ্ঠ বা অভ্যস্ত নই । এটুকু বলতে পারি ব্যক্তি সুতপার সঙ্গে লেখক সুতপার লেখায় কোন সংগতি - প্রভাব কিছু নেই । এখনও কোথাও ব্যক্তি সুতপার ছাপ নেই ।

সৌম্য : অনেক খ্যাতনামা লেখকরা যেখানে নবীন প্রজন্মের প্রশংসা করতে গিয়ে অকারণ কুণ্ঠা বােধ করেন , সেখানে আপনি ব্যতিক্রমী । আপনার কি মনে হয় এতে আপনি নিন্দিত হচ্ছেন ? স্রোতের বিপরীতে হাঁটছেন ? এই প্রজন্মের কাদের কাজ নিয়ে আপনি আশাবাদী ?

সুতপা : পাঠক হিসাবে কারাের লেখা ভালাে লাগলে স্বীকার করতে , বলতে অসুবিধে হবে কেন ? এতে ব্যতিক্রমী হবার বা স্রোতের বিপরীতে হাঁটার কী বিষয় রয়েছে ? নিন্দিত হয়ে যাবার / হবার কোন বিষয়ই বা এতে থাকবে কেন ? এতটা আত্মমন্যতা এখনও অর্জন করে উঠতে পারিনি । নতুনদের মধ্যে ভালাে লাগা দু'জনের কথা বলতে পারি মৌমিতা চক্রবর্তী এবং শান্তনু চক্রবর্তী । তবে এদেরকে আরও পরিণতি , আরও স্থৈর্য অর্জন করে নিতে হবে ।

সৌম্য : “ Language Politics " বিষয়টা কিভাবে দেখেন ?

সুতপা : ' Language Politics ' ? ওরে বাবা আমার জন্য ভীষণ ভারি এবং খটোমটো শব্দ । রীতিমতো Discourse- এ প্রহেলিকাপূর্ণ । Politics এ Language নিয়ে আকচাআকচি না Language নিজেই রাজনীতি তৈরি করে নেয়— Language poli tics is a discourse where politics is supreme authority and language is overruled by it or language itself creates politics যদি বলা যায়। তবে প্রথমক্ষেত্রে ভাষা এক রাজনৈতিক পরিভাষ্য যখন কেউ যাপিত জীবনের সংস্কৃতি , আর্থ- সামাজিক আগ্রাসনের ওপরে হাত বাড়ায় ; কোন কিছুকে সংখ্যালঘুত্বে কোণঠাসা করে নিজে সংখ্যাগুরু হয়ে আত্মপ্রকাশ করতে চায় । তখন মানুষের ভাষার উপরে দখলদারি এবং নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি সে বেছে নেয় আর ভাষাকে শুদ্ধিকরণের কোন কোন উদ্যোগ তখন এজেন্ডা হয়ে ওঠে । আসলে যে কোন ভাষাই নানান উৎস হতে জাত তার শব্দঋণ বা Loan word এর উপরে নির্ভর করে পুষ্ট । এ এমন এক ঋণ যা ফেরত যায় না , তাতে কোন ক্ষতি ভাষার হয় বলে আমি মনে করি না । স্বকীয়তা বজায় রেখে ছুৎবাই এর পরিত্যাগ হওয়া উচিত কারণ ভাষা ও সাহিত্য দু'টিই বহতা আর তাদের বহমানতা সমাজজীবনের যাবতীয় রূপান্তরের সাক্ষ্যকে অঙ্গীকার করেই ঘটে । বাংলা একটি মিশ্রভাষা তবে বােধ ও বােধিহীন কোন কোন বাংলাভাষা আমরা নিশ্চয়ই চাই না । লেখক গােষ্ঠীর দ্বৈততা , দ্বৈধতার আকচা আকচি অনেক সময় এই Discourse টিকে জন্ম দিতে পারে । মন্দ কি ? মতবিভেদ থাকতে পারে । স্বাস্থ্যকর জিনিস । মতবিভেদ আছে । বলেই তাে সাহিত্যক্ষেত্রে এত নানারকমের স্কুল বা ভাবনাধারার জন্ম । সাহিত্যের তাত্ত্বিক বিশ্বের জন্মই তাে Language politics থেকে । জীবনীশক্তি সম্পন্ন যে কোন ভাষারই নিজস্বশক্তি আছে তাকে বিকৃত করে , তারা বহতাধারাকে কোন কাটা খালের মধ্যে বওয়াবার চেষ্টা মানে সেই শক্তিকে আক্রমণ করা যা কোন বলশালী পুষ্টভাষা টিঁকতে দেয় না বরং তাকে ছুঁড়ে ফেলে । আমি মনে করি কেবল লিখবার নান্দনিক সংরূপে নয় , কোন ভাষার মান তাে তার মায়ের ছেলেভুলানাের মধ্যে , ঝগড়ায় - গালিগালাজে , তার স্ল্যাং ব্যবহারে বা প্রকৃতির স্পন্দিত হবার মধ্যে নির্ভর করে । অন্ধকার যত গাঢ়ই হােক না কেন আশঙ্কা এবং হীনমন্যতাকে ঝেড়ে ফেলা হবে উচিত বিধি ।

সৌম্য : কাজই জীবনের একমাত্র শেষ কথা । নতুন কি কি কাজ করছেন ?

সুতপা : নতুন কাজ ? পারছি না । সময় সঙ্গ দিচ্ছে না । কুঁড়েমিও হতে পারে । তবে একটা দীর্ঘ সময় কাটিয়ে লেখা 'ষোল ঘুঁটির ছক' হয়তাে শিগগীরই প্রকাশিত হবে । তারপর এই লেখাটির পাশাপাশি লিখেছি 'বনফুটকির লতা’ যা 'উনিশ শতকের আগরতলার এক গৃহবধূ আমােদিনী দাশের আত্মজজীবনীকে কেন্দ্র করে লেখা'।

সৌম্য : কখনাে কি মনে হয় যা লিখতে চেয়েছিলেন তা এখনাে লিখতে পারেননি ?

সুতপা : ক্রমান্বয়িক এবং ধারাবাহিক জীবনের কী শেষ আছে ! তার আখ্যানের গভীরে একাধিক পরা আর অপরা কথা চলতে থাকে । বহুস্বরিক এই জীবনের কতটাই বা লেখা যায় । নতুন বিষয় , নতুন সংরূপের - জঁর প্রার্থনা আমার কেবল নয় , লিখতে চাওয়া সব মানুষের মধ্যে চলতেই থাকে । সেটাই তাে অতৃপ্তি । 'নিশি অন্ধারী' যে রাতে লিখে শেষ করেছিলাম সেদিন আমার এক অকথন আনন্দ হয়েছিল । নাহ ! ভাষা রীতির নিরীক্ষা আমাকে ভাবায়নি । আমার একমাত্র বিষয় ছিল দেবদীন ; তার প্রেম , অপ্রাপ্তি , যন্ত্রণা আর এষণার অনুসন্ধান ।

সৌম্য : লেখক তার ভূগােলকে অস্বীকার করতে পারেন ?

সুতপা : লেখালেখির , লেখকের কোন ভূগােল হয় না ।

সৌম্য : আপনার কাছে শেষ প্রশ্ন , ‘ সােনার দুয়ারী ঘর রূপার দুয়ারী ঘর ’ থেকে ‘ নিশি অন্ধারী ’ – যাত্রা পথটি কেমন ছিলাে ?

সুতপা : অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং । প্রত্যেকবার নতুন করে জীবনযাপন না চাইলেও প্রত্যেক লেখার চরিত্রেরা তাদের নিজস্ব যাপন নিয়ে এঁটুলির মতন লেগে থাকে । তারা ছেড়েও যায় না শেষ পর্যন্ত কথাও শােনে না । আমার কোন চরিত্রেরা আমার কথা শােনেনি ; 'আমি' নামক নিয়ন্ত্রক প্রভুকে তারা অগ্রাহ্য করে ( আমি আবারও হাসছি ) , মান্যতা দেয়না । আসলে উপন্যাসের শুরু করাটাকে আমার একটা প্রার্থনার মতন মনে হয় আর শেষটা ? একটি এরােপ্লেনের রানওয়েতে ঠিকভাবে ল্যান্ডিং করে যাবার মতন । তথ্য ব্যবহার নিয়ে আমার খুতখুতানি রয়েছে আগেই উল্লেখ করেছি । তাছাড়া সাধ্যমতন প্রত্যেকবার নতুন ফর্ম ভাবার চেষ্টা করেছি । আশা করছি , আগামী কয়েক মাসে দুটো বই প্রকাশিত হয়ে যাবে । তাদের বেলাতেও অল্পবিস্তর একই কথা । আসলে আমি তেমন ওস্তাগর লিখিয়ে নই । ফলত লিখে ফেলাটাই নিজের কাছে আস্পর্ধার । এরপর কিছু ভাবিনা । বাকি জানেন পাঠক ; পাঠক আমার কাছে ইশ্বর স্বরূপ ।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.