"গল্প লেখা যেনো আমার অস্তিত্বের একটা অংশ"

কথাসাহিত্যিক অনুপ ভট্টাচার্যের মুখোমুখি আলোচক সৌম্যদীপ দেব

সৌম্য : গল্পের সাথে আপনার যাপন প্রায় চল্লিশ - পয়তাল্লিশ বছর হলো। মনে পড়ে আপনার প্রথম গল্পের কথা? কি ছিলো সেই গল্প?

অনুপ. ভ. : ১৯৭৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি নিয়ে শিলং শহর ছেড়ে আমি এই রাজধানী শহরে এসে আমার গল্প লেখার দ্বিতীয় ইনিংসের শুরুতে গল্পকার নিলীপ পোদ্দারে'র লিটল ম্যাগাজিনে যে গল্পটি লিখেছিলাম সেটির নাম ছিল 'সে মৃত ঈশ্বর ও অনন্ত জীবন '। থ্রি ডায়মেনশনাল এই গল্পটির বক্তব্যের উপস্থিতিতে এবং আঙ্গিক নিরীক্ষায় এক বিশেষ বার্তাবহ। যা ছিল জন্মের মতো স্বপ্নময়, জীবনের মতো গতিময়, মৃত্যুর মতো স্বাভাবিক। আর স্বাভাবিক বলেই তা সত্য। তাই শিল্প।

সৌম্য : গল্পের একমুখীনতার মতোই আপনার ব্যক্তি জীবনও একেবারেই গল্পমুখী । গল্পের কাছেই কি তবে আত্মসমর্পণ করেছেন কথাকার অনুপ ভট্টাচার্য?

অনুপ. ভ. : এটা স্বীকার করতেই হবে। সেই ছোটবেলা থেকেই লেখালেখি ছাড়া অন্য কোনো নান্দনিক কাজকর্ম আমাকে তেমনভাবে আকর্ষণ করতো না। আমি সেই বয়সে যে কাজটি কুন্ঠাহীন ভাবে করতে পারতাম - তা হলো লেখালেখি। গল্প লেখাতে ভেতরগত একটা শক্তি আজও আমাকে ব্যপকভাবে প্রেরণা যোগায়। গল্প লেখা যেনো আমার অস্তিত্বের একটা অংশ। তাই গল্পের কাছেই আমার সবিশেষ ও একমাত্র আত্মসমর্পণ।

সৌম্য : ছোটোগল্পে আপনার মানস চরিত্রেরা যতটা ধরা দিয়েছে উপন্যাসে ততটা নয়। কথাসাহিত্যের দুটি শাখা ছোটোগল্প ও উপন্যাস, দুটিতেই কলম চালিয়েছেন। জীবনের এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে ছোটোগল্প নাকি উপন্যাস, কার কাছে বেশি আশ্রয় পান?

অনুপ. ভ. : আমার লেখা ছোটোগল্পের সংখ্যা প্রায় শ'দেড়েক ছাপিয়ে গেলেও উপন্যাসের সংখ্যা মাত্র ছ'খানা। ছোটোগল্পে ভাষাশিল্প ও আঙ্গিকের পরীক্ষা - নিরীক্ষার যতটুকু স্কোপ আছে , তুলনামূলকভাবে উপন্যাসে সেটা কম। ছোটোগল্পের বিষয় ভাবনা, ভাষা ও চিত্রকল্প নির্মাণের যথেচ্ছ স্বাধীনতা মেলে। অন্তর্গত একটা তাগিদ থেকে আমি ছোটোগল্পের কাছেই বেশিরভাগ আশ্রয় নেই।

সৌম্য : উওর পূর্বাঞ্চলের পাঁচজন ছোটোগল্পকারের নাম বলতে বলা হলে আপনি কাঁদের নাম বলতে চাইবেন?

অনুপ. ভ. : এটা খুব কঠিন একটা প্রশ্ন। কাকে ছেড়ে কার কথা বলবো। এখনকার অনেকেই তো খুব ভালো লিখছেন এবং প্রত্যেকেই অমিত সম্ভাবনাময়। এই মুহূর্তে যাঁদের কথা মনে পড়ছে শিলং - এর শঙ্কু চক্রবর্তী, গৌহাটির কান্তারভূষণ নন্দী, শিলচরের মেঘমালা দে মহন্ত, আগরতলায় সৌম্যদীপ দেব, সুস্মিতা দাস। এছাড়াও হারাধন বৈরাগী, অমলকান্তি চন্দ প্রমুখ।

সৌম্য : 'জাতক' দিয়ে শুরু করে 'পাঁচ-ছয় ক্রীতদাসের' হয়ে 'পদক্ষেপ' করেছেন একটা সময় । বর্তমানে 'সময়ের পরিভাষা'। আপনাদের মধ্যে লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে উন্মাদনা বরাবরই লক্ষ্য করার মতো ছিলো এবং আছে । শুধুমাত্র ছোটোগল্পের কাগজই করেছেন আপনারা। কেনো এই ভাবনা?

অনুপ. ভ. : বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন নামে ছোটোগল্পের কাগজ বের করে বর্তমানে পরীক্ষামূলক ছোটোগল্পের কাগজ 'সময়ের পরিভাষা' ছাপানোর তাগিদ আজও দারুণভাবে আমরা উপলব্ধি করি। আমরা মনে করি গল্পের প্রাণ কেন্দ্রে থাকবে কবিতার অনুভূতির গভীরতা, আর এজন্য গল্প ভাষার মধ্যে নিজেকে আড়াল করার পদ্ধতি আমরা খুঁজেছি রচিত গল্পে নব নির্মাণের পথ ধরে।

সৌম্য : গল্পকার দীপক দেব - এর সাথে আপনার প্রবল সখ্যতা ছিলো। ত্রিপুরার এক মেধাবী লেখক। কালের অতলে তাঁর অনেক লেখা হারিয়ে গেছে। কি বলবেন?

অনুপ. ভ. : দীপক উপন্যাস ও ছোটোগল্পের সব্যসাচী লেখক হিসেবে চিহ্নিত ছিলো। আমি, দুলাল, কিশোর, রঞ্জিত ও দীপক প্রায় চার দশক একসাথে লেখালেখি করেছি। তার আখ্যান বিন্যাসে সামাজিক অন্তঃস্বরের উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষণীয় ছিলো। দীপক তার গল্পে নিজস্ব সময় ও পরিসরকে ঈঙ্গিত ধর্মী ভাষার ব্যবহারে উদ্ভাবনী আলোয় উপস্থিত করার জন্যেই বহমান ডুবুরির মতো তার উপস্থিতি আমরা তার সমগ্র লেখক সত্ত্বায় উপলব্ধি করেছি। দীপক সত্যিই ছিলো একজন বিদগ্ধ ও অতি সচেতন লেখক।

সৌম্য : কোনো কোনো সমালোচক বলেন "ছোটোগল্প হবে একলব্যের মতো, শব্দভেদী। যে ছোটোগল্প নিজের মধ্যে বহু গল্পের বীজ ধরে রাখে। " - আপনার অনুভবে কি মনে হয়?

অনুপ. ভ. : ছোটোগল্পে শব্দ - ভাষা চেতনা তো একান্ত জরুরি। ছোটোগল্প এমন একটি শিল্প যার শরীরে ভাষা শৈলীর প্রয়োগে গল্পের রূপ - রস - গন্ধে নির্যাস গ্রহণের যে প্রভুত আয়োজন তাকে পাঠক পূর্ণ মাত্রায় উপভোগের চেষ্টা করেন। বীজ তো ক্রমে ক্রমে পাঠান্তে পাঠক মনে অঙ্কুরে পরিণত হয়।

সৌম্য : "পাঠন কবিতার মধ্য দিয়ে কবিকে ধরতে চান। আর কবির লক্ষ্য কবিতাকে ধরা । এই কবিতার সন্ধান এক নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা। " - লেখক অনুপ ভট্টাচার্য কি কখনো কবিতার প্রতি আবিষ্ট হয়েছে?

অনুপ. ভ. : যেকোনো ভাষার লেখক বা পাঠক-ই তার পছন্দসই ভাষায় লিখিত কবিতার সন্ধান না করে পাঠ বিরত হয়ে থাকতে পারেন না। তাই প্রতিটি কবিতা প্রেমিকের নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা তো অনন্তকালের।

সৌম্য : আপনার সবথেকে জনপ্রিয় উপন্যাস ' প্রিয়ভূমি' । মানস প্রিয়ভূমির সন্ধান কি পেয়েছেন নাকি অবিরত করছেন?

অনুপ. ভ. : জন্মগতভাবে একজন উদ্বাস্তু সন্তান হয়ে নিরন্তর প্রিয়ভূমির খোঁজ না করে আমার উপায়ান্তর কোথায়!

সৌম্য : গল্প লেখালেখির অনেক পড়ে উপন্যাসে এসেছেন। কেনো মনে হল উপন্যাসে আসা প্রয়োজন? নাকি অন্তরের তাগিদ উপলব্ধি করেছিলেন?

অনুপ. ভ. : একজন কথাকার হয়ে উপন্যাস নিয়ে কাজ না করে পরিত্রাণ রয়েছে কি? জীবনের ঘাটে ঘাটে বিচরণ করতে করতে, এতো বিচিত্র বিষয় দেখাশুনা আর অজানা - অচেনার মুখোমুখি হতে হয়েছে যে - সেই অভিজ্ঞতার ভাড়ার উজাড় করে দিতে গিয়ে উপন্যাস নামক দীর্ঘ রচনা লিখতেই হয়েছে। কঠিন বাস্তবকে ভিত্তি করেই আমি উপন্যাসে প্রাণ সঞ্চার করেছি ৷

সৌম্য : ত্রিপুরার উপন্যাস চর্চা নিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী? ত্রিপুরার কোন কোন উপন্যাস আপনার পছন্দের তালিকায়?

অনুপ. ভ. : ত্রিপুরার উপন্যাস শিল্প নিয়ে আমি যথেষ্ট আশাবাদী। আর আমার পছন্দের তালিকায় যে সকল উপন্যাস রয়েছে, তার মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় -

দুলাল ঘোষে'র 'অগ্নিসূত্র' , কবি ও কথাকার কিশোর রঞ্জন দে'র 'ভালোবাসার কলাকৌশল ', মীনাক্ষী সেনে'র 'জেলের ভেতর জেল' , হরিভূষণ পালে'র 'যারে যায় না ধরা ' । শ্যামল বৈদ্যে'র চমৎকার উপন্যাস 'চাকমা দুহিতা' , সুতপা দাসে'র 'সোনার দুয়ারী ঘর রূপার দুয়ারী ঘর' এবং পদ্মশ্রী মজুমদারে'র 'দেও নদীর জল ' প্রভৃতি।

সৌম্য : নতুন কি কাজ করছেন? আপনার পাঠকদের যদি বলেন।

অনুপ. ভ. : অতিমারীর কবলে আমাদের চেনা পৃথিবীর চেহারা - চরিত্র চোখের সামনে একদম পাল্টে যাচ্ছে। এক অনির্দিষ্ট ভঙ্গুর পৃথিবীর দিকে এক পা এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের পথ পরিক্রমা। আর তাই এরই এক ভয়ঙ্কর বিভীষিকাময় বিষয় চিত্র আগামীদিনের জন্য কাগজে কলমে গদ্য ভাষায় বিবৃত করতে চলেছি বর্তমানে।

সৌম্য : সত্তর- আশির দশকের ত্রিপুরা আর একুশ শতকের দ্বিতীয় দশক, প্রকাশনা শিল্প থেকে নন্দন চর্চা সব কিছুতেই আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সেই সময়ের কোনো বিশেষ স্মৃতি আজও মনে পড়ে।

অনুপ. ভ. : সময় থেকে সময়ান্তরে মানে আশির দশকের ত্রিপুরা থেকে একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এই রাজ্যের প্রকাশনা শিল্প থেকে নন্দনচর্চা সবকিছুতেই আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে - এই মন্তব্য অনেকাংশেই সঠিক বলে আমার মনে হয়। বর্তমানে প্রকাশনা শিল্প ও নন্দনচর্চা দুটোই রাজ্যে বেশ গতিময়।

সৌম্য : অনেকেই বলেন ত্রিপুরায় তরুণ লেখক প্রজন্ম এক নতুন দিগন্ত রচনা করছে ৷ আপনি এই দিকটা কিভাবে দেখছেন? তরুণদের জন্য কতটা সম্ভবনাময় বলে মনে হয়?

অনুপ. ভ. : সব সময়ই - সময়ের সাথে তরুণদের উপরই সৃষ্টির ক্রিয়াকর্ম এগিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব বর্তায়। এ রাজ্যের তরুণ লেখকরাও সময়ের দাবি মেনে নিয়ে সৃষ্টিশীল রয়েছেন। সম্প্রতি সমালোচক ও গল্পকার সৌম্যদীপ দেব সম্পাদিত 'ছায়াতরু' সংকলনটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে নতুন দিগন্ত রচনার প্রয়াস আরো সার্থক রূপ পেয়েছে।

সৌম্য : "আন্তর্জাতিক পাঠ হীনতা সংকীর্ণতার জন্মদেয় । " - কথাটা কতটা বিশ্বাস করেন?

অনুপ. ভ. : এবিষয়ে আমিও সহমত পোষণ করি। আন্তর্জাতিক পাঠ মনের সংকীর্ণতাকে দূরীভূত করে মনে জ্ঞানের প্রসারতা ঘটায়। আমাদের কাছাকাছি পৃথিবীটা বড্ড ছোট আর সংকীর্ণতা ও কুসংস্কারে পরিপূর্ণ। সীমাহীন জগৎ সংসার থেকে জ্ঞানার্জন করতে গেলে আন্তর্জাতিক পাঠ গ্রহণ একান্ত জরুরী।

সৌম্য : আপনাদের ছোটোগল্প নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে উওর পূর্বাঞ্চলের এক প্রাবন্ধিক লিখেছেন "গল্পের জন্য জীবন সমর্পণ খুব কম গল্পকারই করতে পারেন। যাঁরা করতে পারেন তাঁদের কাছেই গল্প মহিরুহ হয়ে উঠে। গল্প নিয়ে পরীক্ষা- নিরীক্ষা, নতুন আবিষ্কারী ভাবনা, প্রচলিত গল্পের গন্ডি পায় হয়ে নতুন গল্প লেখাই এই লেখকদের মূল গল্প ভাবনা। আর এখানেই তাঁরা ব্যতিক্রমী।" - কিছু বলুন।

অনুপ. ভ. : এখানে আমরা মানে লেখক দুলাল ঘোষ, কিশোর রঞ্জন দে, রঞ্জিত রায় ও প্রয়াত কথাকার দীপক দেব। সময়ে সময়ে প্রকাশিত বিভিন্ন নামের ছোট পত্রিকায় আমাদের বর্তমান সময়ের গল্প সম্পর্কে প্রত্যেকের মতামত ছাপিয়েছি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ফর্ম ও বিষয় ভাবনায় নতুন আবিষ্কারী মনোভাব থেকেই আমাদের গল্পের সংঙ্গা নির্ণয়ের মূল ভাবনা ছিলো, নিজস্ব চিন্তা - চেতনায়। এইজন্য পাঠক ও সমালোচকদের দৃষ্টিতে আমাদের এই গ্রুপ ব্যতিক্রমী।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.