এন আর সি একমাত্র অসমে প্রযোজ্য। এটা গোটা দেশে চালু করার পেছনে কী যুক্তি থাকতে পারে?
বিজন ধর
ভারতের বাইরে থেকে হিন্দু উদ্বাস্তু আসায় ত্রিপুরার জনসংখ্যার ভারসাম্য পাল্টেছে। উপজাতিদের জমি, ভাষা, কৃষ্টি- সংস্কৃতির ওপর চাপ বেড়েছে। উপজাতিরা সংখ্যালঘু হয়েছেন। এটা ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী ছিল উভয় দেশের শাসকগোষ্ঠী, এই দায় বাঙালিদেরও নয়, উপজাতিদেরও নয়।
পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারগুলি সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে উপজাতিদের স্বার্থরক্ষায় বহুবিধ পদক্ষেপ নিয়েছিল। এই কর্মযজ্ঞের ফলে জাতি- উপজাতি মৈত্রী শক্তিশালী হয়েছে।
এখন যে পরিবেশ তাতে কেউ কাউকে ত্রিপুরা থেকে তাড়ানোর প্রশ্ন অবান্তর, অবাস্তব এবং অসম্ভব। অনেক বিচ্ছিন্নতাবাদী, বিভেদকামী ও উগ্রজাত্যাভিমানী আওয়াজ তুলে, হিংসা- হানাহানি করে কেউ বাঙালিদের ত্রিপুরাছাড়া করতে চেয়েছে; কেউবা উপজাতিদের জমিজমা গ্রাসসহ বৃহত্তর বাঙালিস্হান করার আওয়াজ তুলেছিল। কাজের কাজ কিছু হয়নি। বরং উভয় অংশের বহু কমিউনিস্ট নেতা, কর্মী, দরদী সহ বহু নিরীহ মানুষকে খুন করা হয়েছে। দেশ-বিদেশের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর মদতপুষ্ট হয়ে স্হানীয় কায়েমিস্বার্থবাদীরা বামফ্রন্ট সরকারকে হটানোর জন্য বারেবারে হিংসার আশ্রয় নিয়েছে। রাজ্যের শান্তি ও সম্প্রীতিকামী জনগণের সহায়তায় বামফ্রন্ট সরকার শান্তি-সম্প্রীতি - জননিরাপত্তা- - জাতীয় সংহতি ও উন্নয়নের পরিবেশ গড়ে তুলেছিল। এটা জনবিরোধী শক্তিগুলির চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল।
এখন ক্যা-এন পি আর- এন আর সি নিয়ে আবারও সেই পুরনো খেলা শুরু হয়েছে। উপজাতিদের একাংশের মধ্যে এন আর সি চালু করার পক্ষে দাবি রয়েছে। অথচ তাঁরাও ক্যা- র বিরোধিতা করছেন। এই অংশটির ধারণা, এন আর সি হলে 1971 সালের 24 মার্চের পর বেআইনি অনুপ্রবেশকারী বাঙালি হিন্দুদের চিহ্নিত করে এ রাজ্য থেকে তাড়ানো যাবে। তাতে উপজাতি জনসংখ্যার হার বাড়বে এবং তাতে চাকরি ও অন্যান্য সরকারি সুযোগের ক্ষেত্রে উপজাতিদের সংরক্ষণের সুযোগ সম্প্রসারিত হবে। এ রকম ভাবাটা তাঁদের পক্ষে অস্বাভাবিক নয়।
কিন্তু তাঁরা কি ভেবে দেখেছেন যে এন আর সি লাগু হলে চিহ্নিত অ-মুসলিমদের ক্যা প্রয়োগ করে নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়া হবে? এবং তাতে কাট- অব- ডেট হবে 1971 এর 24 মার্চের পরিবর্তে 2014 সালের 31 ডিসেম্বর। লাভ কী হবে এন আর সি- তে? এন আর সি- প্রক্রিয়া শুরু করা হবে এন পি আর দিয়ে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হবে। যে- কোনও অংশের নাগরিকের কাছে এমন সব প্রশ্ন রাখা হবে যার উত্তরের সপক্ষে আপনাকে প্রমাণপত্র দাখিল করতে হবে। যেমন, আপনার বাবা- মা'র জন্মস্থান ও জন্মের তারিখের প্রমাণপত্র জমা দিতে হবে। শুধু মুখে বললেই হবে না। অনেক সাধারণ মানুষ নিজেদেরই জন্মস্থান ও জন্মের তারিখের প্রমাণপত্র দিতে পারবেন না। বাবা- মা'র তথ্য দেওয়া দূরে থাক। এরকম হলে উপজাতি বলে আপনিও সন্দেহজনক ভোটার হিসেবে চিহ্নিত হতে পারেন। আসামের এন আর সি প্রক্রিয়া আমাদের সামনে জ্বলন্ত উদাহরণ।
তাহলে বিভ্রান্তির কোনও অবকাশ নেই। ক্যা না হলে এন আর সি'র কিছুটা মূল্য হয়তো থাকত। কিন্তু ক্যা চালুর পর এন আর সি'র কোনও মূল্য তো থাকবেই না, বরং 1971 এর কাট- অব-ইয়ার পরিবর্তিত হয়ে এটা হবে 2014। কী লাভ হলো? 43 বছরের মধ্যে আসা বেআইনি অ-মুসলিম অনুপ্রবেশকারীরা নাগরিকত্বের লাইসেন্স পেয়ে যাবেন।
সে কারণেই সিপিআইএম ও বামপন্থীরা এবং আরও কিছু দোদুল্যমান রাজনৈতিক শক্তি ধর্মের ভিত্তিতে ক্যা এবং বিভাজন সৃষ্টিকারী বিভেদকামী এন আর সি এবং এন পি আর বাতিলের দাবি করে চলেছে। সে জন্যই এন পি আর- সংক্রান্ত কোনও প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিজেকে নিরাপদ রাখার আবেদন জানিয়েছে। এন আর সি একমাত্র অসমে প্রযোজ্য। এটা গোটা দেশে চালু করার পেছনে কী যুক্তি থাকতে পারে? তারপরও বামপন্থীরা বলেছিল ক্যা- টাকে পূর্বোত্তরে কার্যকর করা থেকে কেন্দ্রীয় সরকার বিরত থাকুক। বিজেপি সরকার সেটা- ও মানল না।