সুপ্রিমকোর্ট, কেন্দ্রীয় সরকার ও বিচারপতি এ কুরেশি

পুরুষোত্তম রায় বর্মন

১৭ ই আগস্ট, ২০২১, সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য দিন। ঐ দিন সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম বিভিন্ন হাইকোর্টের ৪ জন প্রধান বিচারপতি সহ আট জন বিচারপতির এবং সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবীর নাম সুপারিশ করে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিযুক্তির জন্য। প্রায় দুই বছর ধরে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অচলাবস্থা চলছিল। সুপ্রিম কোর্টে একসাথে ৯ জন বিচারপতি নিযুক্তির সুপারিশ অভূতপূর্ব । সবচাইতে উল্লেখযোগ্য হলো ৯ জনের মধ্যে তিনজনই মহিলা বিচারপতি। এই প্রথম একসাথে তিনজন মহিলা বিচারপতিকে সুপ্রিম কোর্টে নিযুক্তির জন্য সুপারিশ করা হলো। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের মোট সংখ্যা 34 । বিচার বিভাগে এক অদৃশ্য কাঁচের দেওয়াল রয়েছে। সেই দেওয়াল অতিক্রম করে বিচার বিভাগে বিশেষত হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে মহিলাদের নিযুক্তি প্রায় অসম্ভব। এখনো অব্দি কোন সময় সুপ্রিম কোর্টে একসাথে দুজনের বেশি মহিলা বিচারপতি ছিলেন না। 1989 সনে মহিলা বিচারপতি ফাতেমা বিবি প্রথম মহিলা বিচারপতি হিসেবে সুপ্রিম কোর্টে নিযুক্তি পান। বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের মহিলা বিচারপতি চারজন। কলেজিয়ামের সুপারিশ মেনে কেন্দ্রীয় সরকার নজিরবিহীন দ্রুততায় ৯ জনকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত দিয়েছেন এবং ৯ জন বিচারপতি একসাথে শপথ গ্রহণ করেছেন 31 শে আগস্ট, ২০২১।

সংবিধানের ১২৪ ধারা মোতাবেক রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের সাথে পরামর্শ করে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ করবেন। সংবিধানের ১২৪(৩) ধারায় বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিযুক্তির ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতা, হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে 5 বছরের অভিজ্ঞতা অথবা হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা অথবা রাষ্ট্রপতির বিবেচনায় পারদর্শী আইনজ্ঞ হিসাবে বিবেচিত হওয়া। বলাবাহুল্য রাষ্ট্রপতিকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হয়।

সুপ্রিম কোর্ট অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড এসোসিয়েশন বনাম ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়া, মামলায়, সুপ্রিমকোর্টের ৯ সদস্যক সাংবিধানিক বেঞ্চ , যার নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জে এস ভার্মা , সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগের ক্ষেত্রে কলেজিয়াম পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। সংবিধানের ১২৪ ধারার ব্যাখ্যা করে সুপ্রিম কোর্ট বলে যে, সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের মতামতই নির্ধারক হবে । প্রধান বিচারপতিসহ পাঁচজন বরিষ্ঠ বিচারপতিদের দ্বারা গঠিত কলেজিয়াম সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের নিযুক্ত জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সুপারিশ করবে এবং এই সুপারিশে অনুমোদন দিতে কেন্দ্রীয় সরকার বাধ্য থাকবে। সংবিধানের ১২৪ ধারায় বলা আছে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের সাথে পরামর্শ করবে। এই ধারার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের ৯ সদস্যক বেঞ্চ বলল, সংবিধানের ১২৪ ধারার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ও নির্দেশ হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের মুখ্য ও চূড়ান্ত ভূমিকা থাকবে। এই রায়ে এই ব্যাখ্যার স্বপক্ষে বলা হয়, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের অন্যতম মৌলিক কাঠামো এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্যই বিচার বিভাগের নিযুক্তির ক্ষমতা বিচার বিভাগের হাতেই থাকবে।

১৯৯৩ এর পূর্বে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের নিযুক্তির ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ছিল। নিয়োগ পদ্ধতির স্বচ্ছতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন ছিল। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে দায়বদ্ধ বিচারব্যবস্থা তৈরীর উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে বিচারপতি নিযুক্তির অনেক অভিযোগ ছিল। কলেজিয়াম পদ্ধতি নিয়েও অনেক প্রশ্ন রয়েছে। কলেজিয়াম পদ্ধতির স্বচ্ছতার অভাব নিয়ে অনেকেই বিভিন্ন সময়ে সোচ্চার হয়েছেন । এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিরা রয়েছেন, আইনবিদরা ও আইনজীবীরা রয়েছেন। পৃথিবীর কোনো দেশেই বিচার বিভাগের হাতে বিচার বিভাগের নিযুক্তির একছত্র ক্ষমতা নেই। কলেজিয়াম পদ্ধতির বিকল্প ও স্বচ্ছ ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি উঠেছে। সংবিধানের ৯৯ তম সংশোধনীর মাধ্যমে কলেজিয়াম পদ্ধতির বিকল্পে ন্যাশনাল জুড়িশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছিল। যদিও সুপ্রিম কোর্ট এই সংশোধনীকে অসাংবিধানিক বলে নাকচ করে দিয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানা দায়িত্বভার গ্রহণ করে সুপ্রিম কোর্টের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারে কিছু কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র, প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ ও প্রধান বিচারপতি এস এ বোবদের সময় কালে সুপ্রিম কোর্ট কার্যত কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরবর্ধক যন্ত্রে পর্যবসিত হয়েছিল। এটা দুঃখজনক হলেও সত্য। নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষায় সুপ্রিম কোর্ট প্রকটভাবে ব্যর্থ হচ্ছিল। প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানা দায়িত্বভার গ্রহণ করে তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতায় নাগরিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন । এর ফলে নাগরিকদের মধ্যে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। প্রধান বিচারপতির রামানা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের শূন্য পদগুলি পূরণ করেছেন। মহিলা বিচারপতিদের নিযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। এটা অবশ্যই অভিনন্দনযোগ্য । কিন্ত ত্রিপুরা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি অকিল কুরেশির সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে পদোন্নতি না হওয়াতে গুরুতর প্রশ্ন উঠে এসেছে। হাইকোর্টের বিচারপতিদের সর্বভারতীয় সিনিয়রিটি তালিকায় বিচারপতি কুরেশি দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন। প্রথম স্থানে ছিলেন ছিলেন কর্ণাটক হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এ এস ওকা । তিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন । কিন্তু বিচারপতি কুরেশি বাদ পড়েছেন নিযুক্তি থেকে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিযুক্তির ক্ষেত্রে সিনিওরিটি অবশ্যই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিচার্য বিষয়। বিচারপতি কুরেশির দক্ষতা ও সততা নিয়ে কোনরকম প্রশ্ন নেই। ২০০৪ সন থেকে বিচারপতি কুরেশি নির্ভয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন । তার পরেও কেন তাঁকে নিয়ে বিতর্ক এবং সুপ্রিম কোর্টের নিযুক্তি থেকে কেন তাকে বঞ্চিত করা হলো।

ঘটনা পরম্পরার দিকে নজর দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে উঠে। ২০১০ সনে বিচারপতি কুরেশি গুজরাট হাইকোর্টের বিচারপতি থাকাকালীন সোহরাবুদদিন শেখ এনকাউন্টার মামলায় অমিত শাহ এর সিবিআই হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছিলেন। অমিত শাহ গুজরাটের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী। বর্তমানে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী । যদিও পরবর্তী সময়ে সোহরাবুদদিন শেখ এনকাউন্টার মামলায় তিনি অব্যাহতি পেয়েছেন।

২০১৮ সনে গুজরাট হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির পদ ফাঁকা হয়। বিচারপতি কুরেশি গুজরাট হাইকোর্টের সবচাইতে সিনিয়র বিচারপতি ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে তাঁর দায়িত্বভার নেওয়ার কথা। কিন্তু বিচারপতি কুরেশিকে মুম্বাই হাইকোর্ট বদলি করা হয় এবং এর ফলে গুজরাট হাইকোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হওয়া থেকে তিনি বঞ্চিত হন। মুম্বাই হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে কুরেশি দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। মুম্বাই হাইকোর্টের বিচারপতিদের তালিকায় তিনি চতুর্থ স্থানে ছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট কলেজিয়াম ২০১৯ এর মে মাসে মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিযুক্তির জন্য বিচারপতির কুরেশির নাম কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সুপারিশ করে পাঠান। কেন্দ্রীয় সরকার প্রচন্ড আপত্তি তুলে। সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম ২০১৯ সনের মে মাসে বিচারপতি কুরেশি সহ অন্যান্য বিচারপতিদের নাম ও সুপারিশ করেছিল বিভিন্ন উচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিযুক্তির জন্য । কিন্তু প্রবল আপত্তি উঠে শুধুমাত্র বিচারপতি কুরেশির নাম নিয়ে। কিন্তু এই আপত্তির মধ্যে কলেজিয়াম আশ্চর্যজনকভাবে পিছু হটে। কেন্দ্রীয় সরকারের আপত্তি সত্ত্বেও সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম যদি সুপারিশে দৃঢ় থাকতো তাহলে কেন্দ্রীয় সরকার সুপারিশ মেনে বিচারপতি অকিল কুরেশিকে মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিযুক্তি দিতে বাধ্য থাকত। কিন্তু কলেজিয়াম সুপারিশ সংশোধন করে কুরেশিকে ত্রিপুরা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠায়। কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রস্তাব গ্রহণ করে। মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্টের বিচারপতিদের মোট সংখ্যা ৪২। অন্যদিকে ত্রিপুরা হাইকোর্টে রয়েছেন চারজন বিচারপতি।

গত দু'বছর ধরে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিযুক্তি প্রক্রিয়ায় অচলাবস্থা চলছিল। সুপ্রিম কোর্টের বরিষ্ঠ বিচারপতি আর এফ নরিম্যান কলেজিয়ামের অন্যতম সদস্য ছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট কলেজিয়াম গত দুই বছরে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে ঐক্যমত্যে আসতে পারছে না বলে সংবাদ মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে খবর হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কাটজু বেশ কয়েকমাস পূর্বে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করে জানিয়েছিলেন, সুপ্রিম কোর্ট কলেজিয়ামে বিচারপতি কুরেশির নিয়োগের প্রশ্নে নরিম্যান দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন। বিচারপতি কুরেশিকে সুপ্রিম কোর্টে পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনোভাবেই বঞ্চনা করা যাবে না। সিনিয়রিটির ভিত্তিতেই তাঁর নাম অবশ্যই সুপারিশ করতে হবে, না হলে কলেজিয়ামের সিদ্ধান্তের সাথে তিনি একমত হতে পারবেন না। বিচারপতির নরিম্যান ১৩ই আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। অবসর গ্রহণ করার পর কলেজিয়ামে তার জায়গায় এসেছেন বিচারপতি এল নাগেশ্বর রাও।

বিচারপতি কুরেশির নিয়োগ বঞ্চনা নিয়ে সারা দেশেই প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে, কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সংঘর্ষ এড়াতেই কি সুপ্রিম কোর্ট কলেজিয়াম কুরেশির নাম সুপারিশ করেননি। কারণ বিচারপতি কুরেশির নাম সুপারিশ করলে পরে কেন্দ্রীয় সরকার আপত্তি তুলবে এটা অবধারিত এবং সে ক্ষেত্রে গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া আটকে যাবে। যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের আপত্তি সত্ত্বেও কলেজিয়াম যদি কুরেশির পক্ষে সুপারিশে দৃঢ় থাকে তাহলে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বিচারপতি কুরেশিকে নিযুক্তি না দিয়ে অন্য কোন রাস্তা খোলা থাকবে না। কেন্দ্রীয় সরকার প্রক্রিয়াটাকে ঝুলিয়ে রাখতে পারে অহেতুক কালক্ষয় করে। কিন্তু শেষ অবধি কলেজিয়ামের সুপারিশ কেন্দ্রীয় সরকার মানতে বাধ্য। যদি সুপারিশকৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আই বি বা অন্য কিছু আপত্তিজনক রিপোর্ট না থাকে। বিচারপতি কুরেশির ক্ষেত্রে এসব কোন কিছুর প্রশ্নই উঠে না।

সুপ্রিম কোর্ট কলেজিয়াম কিসের ভিত্তিতে নয় জনকে বিচারপতি পদে নিযুক্তির জন্য বাছাই করল , কি কারনে সর্বভারতীয় সিনিয়রিটি লিস্টে দ্বিতীয় স্থানে থাকা সত্ত্বেও কুরেশির নাম সুপারিশ করা হলো না এ সম্পর্কে কিন্তু কোনো কারণ বা ব্যাখ্যা এখন অব্দি জনপরিসরে উপস্থিত করা হয়নি। যেকোনো নিয়োগ প্রক্রিয়াকেই নায্যতা ও স্বচ্ছতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হতে হয় । এটাই আইনের শাসনের অন্যতম মূল কথা। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া কলেজিয়ামের বন্ধ দরজার মধ্যে আবদ্ধ থাকতে পারেনা। নিয়োগ প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতার কোনো সুযোগ নেই। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগের সাথে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা , মর্যাদা ও নিরপেক্ষতার প্রশ্ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ঘটনা পরম্পরা থেকে এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট, বিচারপতি কুরেশিকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি পদে নিয়োগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট কলেজিয়াম কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে বিচারপতি নিয়োগের প্রশ্নে সংঘাতে যেতে চাইনি। বিচারপতি কুরেশির নাম সুপারিশ করে কেন্দ্রীয় সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলতে চায়নি কলেজিয়াম। সারাদেশে প্রতিদিন বহু মানুষ অবিচারের শিকার হচ্ছেন, প্রতিদিন বহু মানুষ নায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সেই তালিকায় বিচারপতি কুরেশির নাম সংযুক্ত হলো। একজন উচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি যিনি নাগরিকদের ন্যায় দেন বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি ন্যায় থেকে বঞ্চিত হলেন। শুধুমাত্র এই টুকুতেই বিষয়টি সীমাবদ্ধ থাকলে এ নিয়ে আমরা কথা বলা এড়িয়ে যেতে পারতাম । কিন্তু প্রশ্নটি একজন প্রধান বিচারপতির প্রতি অবিচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আজ গুরুতর প্রশ্নের মুখে এসে পড়েছে। সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম বিচারপতি কুরেশির নাম প্রস্তাব না করাতে এক ভয়ঙ্কর শীতল বার্তা সমগ্র বিচারব্যবস্থায় ছড়িয়ে পড়েছে। বার্তাটি হলো, ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়ায় আইনের নির্দেশ ও বিবেকের নির্দেশ অনুযায়ী ভূমিকা পালন করলে পরবর্তীতে তার খেসারত দিতে হবে। অর্থাৎ বিচার ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করার লক্ষ্যেই বিচারপতি কুরেশির সুপ্রিম কোর্টের পদোন্নতি আটকে দেওয়া হয়েছে । প্রথমত গুজরাট হাইকোর্ট থেকে মুম্বাই হাইকোর্টের বিচারপতি কুরেশিকে বদলি করে ও দ্বিতীয়তঃ মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি পদে বিচারপতি কুরেশির নিয়োগ আটকে দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে যে, বিচারপতি কুরেশি সরকারের অপছন্দের তালিকার শীর্ষে রয়েছেন । কেন্দ্রীয় সরকারের অপছন্দের লোকের নাম সুপারিশ না করে সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সমন্বয় রক্ষা করে চলেছে। এটাই প্রচন্ড দুঃখজনক , আপত্তিজনক ও একইসাথে চরম উদ্বেগজনক। বিচারপতিদের ভূমিকা কী হবে এ সম্পর্কে বলতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট ৯ সদস্য সাংবিধানিক বেঞ্চ সুপ্রিম কোর্ট অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড বনাম কেন্দ্রীয় সরকারের মামলায় বলেছে "Judges should be stern stuff and tough fire, unbending before power, economic or political, and they must uphold the core principle of the rule of which says " Be you ever so high, the law is above you. " This is the principle of Independence of the judiciary which is vital for the establishment of real participatory democracy, maintenance of rule of law as a dynamic concept and delivery of social justice to the vulnerable sections of the community. It is this principle of Independence of the judiciary which we must keep in mind while interpreting the relevant provisions of the Constitution.

বিচারপতি কুরেশি কি এই ভূমিকা পালনের জন্য শাস্তি পেলেন?

সম্প্রতি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় সুপ্রিম কোর্টে নিযুক্তি থেকে বিচারপতি কুরেশিকে বঞ্চনা করার বিষয়ে প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে জানা যায়, বিচারপতি কুরেশির পিতামহ মহাত্মা গান্ধীর সহকর্মী ছিলেন । ডান্ডি অভিযানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং গান্ধীবাদী হিসেবে পরিচিত ছিলেন । বিচারপতি কুরেশির পিতার জন্ম হয়েছিল সবরমতী আশ্রমে। মৃত্যুর পর বিচারপতি কুরেশির পিতামহের শেষকৃত্য গান্ধীবাদী পদ্ধতিতে সবরমতী আশ্রমে সম্পন্ন হয়েছিল । এই ঐতিহ্যের কারনেও বোধহয় বিচারপতি কুরেশিকে না পছন্দ। একজন বিচারপতিকে বঞ্চিত করা শুধু হয়নি। শুধু বিচার ব্যবস্থায় নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতার উপর গুরুতর রকম হস্তক্ষেপ করা হয়েছে।

(লেখাটি 13 সেপ্টেম্বরের দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে)


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.