"বাংলা সাহিত্যে ব্যতিক্রমী ধারা বহু আগে থেকেই চলে আসছে।"
কথাসাহিত্যিক দুলাল ঘোষের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় আলোচক সৌম্যদীপ দেব
সৌম্য : আপনার ছোটোগল্প ত্রিপুরার সাহিত্য তথা সমগ্র বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ স্থানের দাবি রাখে। মনোবিকলন ,শব্দ চয়ন , বিষয় নির্বাচন সবেতেই আপনি প্রচলিত পথের পথিক না হয়ে দূরতর দেশ হয়ে আপন বন্দরে নোঙর করেছেন । এই ব্যতিক্রমীতা আপনাকে কালোতীর্ণ করে দেবে বলেই বাংলা ছোটোগল্পের পাঠক মহলে জোর গুঞ্জন চলে এবং চলছে।আপনার এই ব্যতিক্রমী নির্মাণের ইতিবৃত্ত শুনতে চাই।
দু. ঘো. : ১৯৭৫-৭৬ সাল থেকে আমি লেখালেখির সাথে যুক্ত। এ পর্যন্ত ১০/১২ টি ছোট গদ্য ও দুটি উপন্যাসই লিখতে পেরেছি। গদ্য বললাম এই কারণে যে যতটা পারি গল্পচ্ছল ব্যবহার না করারই চেষ্টা করেছি। তুমি ব্যতিক্রমী নির্মাণের কথা জানতে চেয়েছ! আমি এটুকুই বলতে পারি যে বাংলা সাহিত্যে ব্যতিক্রমী ধারা বহু আগে থেকেই চলে আসছে। আমাদের স্বতন্ত্র নির্মানের চেষ্টা কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে তা পাঠকই বলতে পারবেন। ত্রিপুরার বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক অনুপ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে রনজিৎ রায়, পীযূষ কান্তি দাস বিশ্বাস, দীপক দেব, কিশোর রঞ্জন দে'র সঙ্গে আমিও এই আন্দোলনের একজন শরিক।
সৌম্য : উওর পূর্বাঞ্চলের এক প্রাবন্ধিক আপনাদের ছোটোগল্প নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন "গল্পের জন্য জীবন সমর্পণ খুব কম গল্পকারই করতে পারেন। যাঁরা করতে পারেন তাঁদের কাছেই গল্প মহিরুহ হয়ে উঠে। গল্প নিয়ে পরীক্ষা- নিরীক্ষা, নতুন আবিষ্কারী ভাবনা, প্রচলিত গল্পের গন্ডি পাড় হয়ে নতুন গল্প লেখাই এই লেখকদের মূল গল্প ভাবনা। আর এখানেই তাঁরা ব্যতিক্রমী।প্রথমে তাঁদের গল্প পত্রিকার পথ চলা শুরু হয়েছিল ' জাতক' ( বর্তমানে লুপ্ত) এর হাত ধরে। কয়েক বছর পর 'পাঁচ - ছয় ক্রীতদাসের' যাত্রা পথ মসৃণ হয়। তারপর আসে 'পদক্ষেপ' এর সময়কাল। দীর্ঘ একটা পথ, বার বার পত্রিকার নাম বদল হয়েছে কিন্তু লেখক গোষ্ঠীর কোনো বদল হয়নি। থেমে যাওয়া মানেই শূন্যে পৌঁছে যাওয়া - হয়তো এই কথাটাই গল্পকারেরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন, আর তাই কখনো তাঁদের দূরন্ত লেখনী মন ও প্রাণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি। এই গল্পকারেরা সৃজনশীলতায় বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন নীরবে বয়ে চলা স্রোতের মতো। " কি বলবেন?
দু.ঘো. : 'জাতক', ' পদক্ষেপ' , 'পাঁচ/ছয় ক্রিতদাসের' এবং ' সময়ের পরিভাষা' নামে গল্পের কাগজ আমরা সময়ে সময়ে প্রকাশ করেছি এবং করে চলেছি। বারবার থেমে গেছি, আবার করেছি। হাতগুলি একই , উদ্দেশ্যও এক। এই যুদ্ধে কোনো ছন্দপতন না ঘটলেও , দীপক দেবে'র মৃত্যু আমাদের কাছে বজ্রাঘাত সম। ত্রিপুরার এই অপ্রতিদ্বন্দ্বী গল্পকার হঠাৎই আমাদের হাত আলগা করে চলে গেল। বৃত্ত ছোট হয়ে গেল ঠিকই কিন্তু আমরা থামিনি। ত্রিপুরার গদ্য সাহিত্যে পাতা পড়া কম্পন তুলতে পারলেই নিজেদের ধন্য মনে করব।
সৌম্য : আপনারা যে সময় লিটল ম্যাগাজিন করতে শুরু করেন তখন নানাবিধ প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছেন । কিন্তু এখন অর্থাৎ এই আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর সময়ে দাঁড়িয়ে ছোট পত্রিকার প্রকাশ করা অনেকের কাছেই খুব সহজসাধ্য , কিন্তু নিয়মিত ধরে রাখতে অনেক সম্পাদকই ব্যর্থ হন। আপনার স্মৃতির সঞ্চয় থেকে কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিনের কথা শুনতে চাইছি।
দু.ঘো. : তখন লিটল ম্যাগাজিন করতে যে প্রতিকূলতার - প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে , এখন সেই গল্পগুলি অবিশ্বাস্য মনে হবে। সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল অর্থের। নিজেদের পকেটমানির টাকায় এতো খরচ চালানো সম্ভব ছিল না। তাছাড়া দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেও প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন পাওয়া যেত না , একমাত্র পথ ছিল সরকারি সংস্থার বিজ্ঞাপনের জন্য দৌড়ঝাপ করা। জুতোর শুকতলা ক্ষয় করে যদি বা একটা বিজ্ঞাপন জোগাড় করা যেত - সেই টাকা হাতে আসতে সময় লাগত ছয়মাস থেকে এক বছর। বাকি সব কাজ তো পড়েই রইল। দোকান দোকান ঘুরে উপযুক্ত কাগজ কেনা, প্রচ্ছদের জন্য লিটো কেনা। আমরা নিজেরা লিনো কাটতে পারতাম না , ছুটতে হতো কবি বন্ধু নকুল রায়ের কাছে। প্রেসের কাজ বড় কাজ , কম করেও মেশিন প্রুফ পর্যন্ত চার- পাঁচ বার দেখতে হতো। শেষমেশ কাগজ খানা পাঠকের হাতে হাতে পৌঁছে দেওয়াই ছিলো চ্যালেঞ্জ। সেই পরিস্থিতির সঙ্গে এই সময়ের কোনো তুলনা চলে না। এখনও আমরা লিফ সাইজে 'সময়ের পরিভাষা ' প্রকাশ করছি। আধুনিক প্রযুক্তির ফলে এখন পর্যন্ত পুরো কাজটা করতে এক দিনের বেশি সময় লাগে না। যাই হউক , সেই সময় আমাদের এখানে উল্লেখযোগ্য লিটল ম্যাগাজিনের কথা জানতে চেয়েছ তুমি! এই মুহূর্তে আমার শুধু 'নান্দিমুখ' , 'জোনাকি' , 'পৌণমী' , 'পূর্বমেঘ' , 'সমকাল ব্রততী' , 'চন্দনা' , 'জ্বালা'-র কথাই মনে পড়ছে । প্রদীপ চৌধুরীদের কাগজও ছিল - 'সকাল' , 'ফুঃ'। পরবর্তী পর্যায়ে' সৈকত' , 'বাংলা কবিতা' , 'মুখ' , 'ভাষা'-র কথা। সেইসময় ত্রিপুরার আরো উল্লেখযোগ্য কাগজ করতেন সেলিম মুস্তাফা'রা , আগরতলায় 'গ্রুপ সেঞ্চুরি' , উদয়পুর থেকে 'শাব্দিক' । আরো ছিলো, আমি মনে করতে পারছি না।
সৌম্য : "বন্ধুত্বকে পাথেয় করে বন্ধু জন্য পথিক হতেও রাজি। ঘর ছেড়ে বিবাগী হবো। বন্ধু শুধু তোর জন্যই যাবো। সমুদ্র বিহারে নয়, অন্ধ পৃথিবীর মোহ ভাঙাতে যাবই।"- আপনার সমসাময়িক বন্ধুত্বের দৃষ্টান্ত আজও উজ্জ্বল। এই প্রভাব বারংবার আপনাদের সাহিত্যেও বিশেষ লক্ষণীয়। কি বলবেন?
দু.ঘো. : তোমার এই প্রশ্নটা মনে হয় আমাদের সংঘবদ্ধতা নিয়ে, বিগত ৪০-৪৫ বছরে আমরা বহুবার থেমে গেছি , আবার শুরু করেছি , তবে কাগজের সম্পাদকমন্ডলি একই , তুমি একে বন্ধুত্ব বলছ! আমরা একই লক্ষ্যে কাজ করে চলেছি এখনও - ব্যতিক্রমী গল্পের কাগজ।
সৌম্য : একটা সাধারণ সমীক্ষায় দেখা যায় - প্রায় প্রতি বছর ত্রিপুরা থেকে যতগুলো কাব্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয় তার তিনভাগের একভাগও ভালো গল্পের সংকলন প্রকাশিত হয় না। এর মূল কারণ কি হতে পারে বলে মনে করেন? একজন গল্পকার হিসাবে আপনাকে কখনো এই বিষয়টা ভাবিয়েছে?
দু.ঘো. : প্রতি বছর কাব্যগ্রন্থের তুলনায় গল্প সংকলন অনেক কম বের হয়। তার কারণ গল্প কম লেখা হয় বলেই মনে হয় আমার।
সৌম্য : আমরা জানি কথাকার দুলাল ঘোষ লেখালেখিতে যতোটা একনিষ্ঠ, তেমনি পাঠক হিসাবেও সমান দক্ষ। উওর- পূর্ব ভারতের গল্পকারদের মধ্যে কাঁদের গল্প আপনি আবারও পড়তে চাইবেন?
দু.ঘো. : উওর-পূর্ব ভারতের যে গল্পকারদের গল্প আমি বারবার পড়তে চাই উঁনারা হলেন মানস দেববর্মণ, অখিল দত্ত, দেবীপ্রসাদ সিংহ , মলয় কান্তি দে , শেখর দাশ , রণবীর পুরকায়স্থ , বদ্রুজ্জমান চৌধুরী, অনুপ ভট্টাচার্য , কিশোর রঞ্জন দে , রনজিৎ রায় , দেবব্রত দেব , শুভাশিষ তলাপাত্র , হরিভূষণ পাল , পল্লব ভট্টাচার্য , অশোক দেব , শ্যামল বৈদ্য , কান্তারভূষণ নন্দী , মেঘমালা দে মহন্ত ও পদ্মশ্রী মজুমদার ।
সৌম্য : দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে আপনার উপন্যাস ' অগ্নিসূত্র ' একযোগে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য হিসাবে সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত হলো। একাডেমিক স্বীকৃতি লেখককে অনেক বেশি উৎসাহিত করে। এই স্বীকৃতি পাওয়ার পর কি বলবেন?
দু.ঘো. : 'অগ্নিসূত্র' একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য হয়েছে শুনেছি , অনুপ্রাণিত হয়েছি ।
সৌম্য : ত্রিপুরার কয়েকটি উপন্যাসের কথা বলতে বলা হলে আপনি কোনগুলোর কথা বলতে চাইবেন?
দু.ঘো. : ভীষ্মদেব ভট্টাচার্যে'র 'অগরুগন্ধা' , সমরজিৎ সিংহে'র ' বিপন্ন ' , অনুপ ভট্টাচার্যে'র ' প্রিয়ভূমি ' ,
শ্যামল ভট্টাচার্যে'র 'বুখারি ' , শুভাশিষ তলাপাত্রে'র 'পাতাম কাঠের নৌকা ' , পল্লব ভট্টাচার্যে'র 'কমলিনী উপাখ্যান ' , সুতপা দাসে'র ' সোনার দুয়ারী ঘর রূপার দুয়ারী ঘর ' , অশোক দেবে'র 'সদাপুরাণ' এবং শ্যামল বৈদ্যে'র ' বুনোগাঙের চর ' এছাড়া মাধুরী লোধ- ও ভালো লিখছেন।
সৌম্য : ঔপন্যাসিক দুলাল ঘোষ কি কখনো কবিতার কাছে ধরা দিয়েছেন?
দু.ঘো. : অনেকের মত আমিও কবিতাকে শ্রেষ্ঠ শিল্প জ্ঞান করি , কিন্তু তিনি কোনদিনই আমার কাছে ধরা দেননি বা আমি তাকে ছুঁতে পারিনি।
সৌম্য : শোনা যাচ্ছে ঔপন্যাসিক দুলাল ঘোষ নতুন উপন্যাসে হাত দিয়েছেন। নতুন কি পেতে চলেছে দুলাল ঘোষের পাঠক?
দু.ঘো. : কে না বেঁচে থাকতে চায় বলো সৌম্য! মিথ্যাকে আশ্রয় করে হলেও বাঁচতে চায়। নিরুত্তাপ আচরণ আর ঔদাসিন্য কিছুতেই সহ্য করা যায় না, তবু না লিখে লিখছি বলতে পারব না প্রিয় পাঠক। এটুকু বলতে পারি - শুরু থেকে এখন পর্যন্ত একবারও বৃত্তের বাইরে ছিটকে পড়িনি।
সৌম্য : একটা কথা ইদানিং সাহিত্য মহলের অন্দরে খুব চর্চা হচ্ছে যে "দুলাল ঘোষ আগের মতো লেখালেখি করেন না। " এটা কি ঠিক? আর যদি হয় তবে কেনো?
দু.ঘো. : আমার লেখালেখি সবসময়ই কম। সবসময়ই আপনজনের কথা শুনতে হয়! কেন লিখছি না - এর যেমন সদুত্তর নেই , তেমনি যখন লিখি কেন লিখি তারও উত্তর দিতে পারি না। ভালবাসা ছাড়া আর কি!
সৌম্য : "পাঠকের প্রতি লেখক দায়বদ্ধ থাকেন।" - এই ডিজিটাল লার্নিং এর যুগে কথাটা কতটা বিশ্বাস করেন?
দু.ঘো. : মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে পাঠকের সঙ্গে , তবে লেখকের দায়বদ্ধতা থাকে সত্য - সুন্দর আর মানবিকতার প্রতি।
সৌম্য : লেখায় দুর্বোধ্যতা সৃষ্টিও একটি শিল্প - কৌশল - বিশেষ মানসিক ক্ষমতা। দুর্বোধ্য সাহিত্যের পাঠক কারা? পাঠক তো দুর্বোধ্যতা খোঁজেন না। তবে লেখক কি সৃষ্টি করতে গিয়ে ভ্রষ্ট হয়েছেন? বর্তমান সময়ের বহু আলোচ্য বিষয় " সাহিত্যে দুর্বোধ্যতা " নিয়ে কি বলবেন?
দু.ঘো. : জটিলতর বিষয় উপস্থাপনায় অনেকসময় লেখাটি দুর্বোদ্ধ হয়ে উঠতে পারে, আবার উপস্থাপনার আঙ্গিক নিরীক্ষার কারণেও দুর্বোদ্ধ হয়ে উঠতে পারে একটি লেখা। জটিলতর বিষয় বা আঙ্গিক নিরীক্ষা যাই হউক না কেন, লেখাটি সার্থক হয়ে ওঠে পাঠকের স্বীকৃতি পেলেই।
সৌম্য : ত্রিপুরায় এক ঝাঁক তরুণ লেখক- লেখিকা নব সৃষ্টির আনন্দে মেতে উঠেছে। এতে সাহিত্যের জন্য উপকার ও অপকার দুই-ই আছে বলে বিশেষজ্ঞ জনেরা মনে করেন। আপনি কি বলবেন এই বিষয়ে?
দু.ঘো. : একঝাঁক তরুণ- তরুণী এসে ত্রিপুরার সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করছে , নতুন দিশা দেখাচ্ছে - এর চেয়ে বড় পাওনা কি হতে পারে আমাদের! আমরা গর্বিত পূর্বসূরী।
সৌম্য : কাহিনি বিহীন গল্পই বর্তমান সময়ের পাঠক প্রিয় হয়ে উঠছে। গল্প কাহিনি থেকে কাহিনি বিহীন পথে হাঁটছে। এটাও একটা বাঁক। এটা কতটা ভাবায় গল্পকার হিসাবে আপনাকে?
দু.ঘো. : সদর্থক নতুনত্বের সমর্থক আমি। কাহিনি বিহীন পথে হাঁটা অবশ্যই একটি পথ।
সৌম্য : আঞ্চলিকতা, সংকীর্ণতা, স্থানিকতা, নিজস্বতা, বিনির্মাণ, লেখকের ভূগোল - এই বিষয়গুলোকে কিভাবে দেখেন?
দু.ঘো. : এ সবই গ্রহণীয় শব্দ সমষ্টি। তবে শব্দের অনুপযুক্ত ব্যবহারই বিভ্রান্তির জন্ম দেয়।