"পৃথিবীর যে কোনো সৃষ্টির পেছনে একটা উদ্দেশ্য থাকে।"
কথাসাহিত্যিক জহর দেবনাথে'র সাথে একান্ত আলাপচারিতায় আলোচক সৌম্যদীপ দেব
সৌম্য : ত্রিপুরার বাংলা ছোটোগল্প গত তিন- চার দশকে পরীক্ষা- নীরিক্ষার স্তর অতিক্রম করে বিশেষ স্থান লাভ করেছে। আপনি নিজেও গল্প চর্চা করছেন প্রায় দুই দশক । প্রথম গল্প লেখালেখিতে আসা কিভাবে?
জহর. দে. : সৌম্যদীপ, প্রথমেই তোমাকে ধন্যবাদ জানাই এই জন্য যে, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করার জন্য আমার কথা ভেবেছো । আমার সাহিত্য জীবনে তুমি প্রথম এমন বিস্তৃত বার্তালাপের সুযোগ এনেছো । তোমাকে আবারো ধন্যবাদ জানাই।
এবার আসছি গল্প বা গদ্য সাহিত্যে আমার কি ভাবে আসা। তার আগে ছোট্ট করে বলেনি, সাহিত্য নিয়ে আমার স্বপ্ন দেখা কি ভাবে শুরু। ছোট বেলাতে বাবার কাছে 'মহাভারত' আর 'রামায়ণ' - এর কাহিনি শুনতে শুনতেই আমার স্বপ্ন দেখা শুরু। তখনই ভাবনা ছিল বড়ো হয়ে আমিও মানুষের সমাজ জীবন নিয়ে কাহিনি লিখবো।
তারপর কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দেওয়ার সন্ধিক্ষণে আশি সালের ভাতৃঘাতী দাঙ্গা এবং তার পরবর্তী সময়ে জাতি- জনজাতি মানুষের মধ্যে অবিশ্বাসের বাতাবরণ ভীষণ ভাবেই আমাকে ব্যথিত করতো। অথচ আমার ছোটবেলার একাধিক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল জনজাতি সম্প্রদায়ের। আমি সবসময়ই চাই 'পুরানো সেই দিনের কথা' আবার ফিরে আসুক। আমার মনের এই যন্ত্রনার কথা প্রকাশ করার লক্ষ্যেই আমার গল্প লেখা শুরু।
পাশাপাশি আমার চারপাশের সমাজ জীবনের, জীবন যন্ত্রনার কথা সর্বসমক্ষে তুলে ধরার লক্ষ্যেই কলমকে আমার হাতিয়ার হিসেবে তুলে নিলাম।
সৌম্য : ওয়াল ম্যাগাজিন থেকে শারদীয়ার দু-মলাটে লিটল ম্যাগাজিন 'প্রবাহ'। দেখতে দেখতে কুড়ি বছর অতিক্রান্ত । তারপরেও - এর কলেবর বৃদ্ধি পায়নি। আগামীদিনে কোনো বিশেষ সংখ্যার পরিকল্পনা কি রয়েছে?
জহর. দে. : ছোট বেলায় আমি আর আমার ভাইপো বর্তমানে কলেজ শিক্ষক শ্রীনিবাস দেবনাথ, আমরা দু'জনেই 'আনন্দমেলা' এবং 'শুকতারা' ম্যাগাজিন পড়তে পড়তে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলাম, বড় হয়ে কোনো একদিন একজন সম্পাদক হব । পরবর্তীতে বিশিষ্ট সাহিত্য প্রেমি শ্রী পঙ্কজ চক্রবর্তী মহাশয়ের সক্রিয় অনুপ্রেরণাতেই সম্পাদনার জগতে আমার হাতে খড়ি। প্রসঙ্গত বলে রাখি, আমাদের এই 'প্রবাহ' দেয়াল ম্যাগাজিনটির সম্পাদনার কাজে আমারও আগে আরো তিনজন যুক্ত ছিলেন। সত্যরঞ্জন শর্মা,মানিক চক্রবর্তী এবং কবি ইরেশ দেবনাথ। পরবর্তী সময়ে আমার হাত ধরেই কয়েক বছর হাতে লেখার পর, ছাপার অক্ষরে আমাদের স্বপ্নের যাত্রার শুরু।
অনেক প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে বিগত একুশ বছর ধরে এখনো পর্যন্ত প্রকাশ করে আসছি। কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েছিলাম শারদীয়া সংখ্যা ছাড়া ও বাংলা নববর্ষে একটি সংখ্যা করা যায় কিনা। একবার সফলও হয়ে ছিলাম। কিন্তু ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারিনি। এবারে উদ্যোগ নিয়েও থমকে গেলাম, অতিমারি সমস্যার কারণে। তবে আমি আশাবাদী, আগামী দিনে আমরা পারবো।
আর বিশেষ সংখ্যার কথা যদি বলো তো 'প্রবাহ' ম্যাগাজিন এবং প্রবাহ ধলাই সংস্থার দশম বর্ষপূর্তি উৎসব উপলক্ষে আমরা একটি বিশেষ সংখ্যা করে ছিলাম। তেমনি কুড়ি বছর পূর্তি উৎসব উপলক্ষেও একটি বিশেষ সংখ্যা করেছি। আগামী পঁচিশ বছর পূর্তি উৎসব উপলক্ষে আরো একটি বিশেষ সংখ্যা করার ইচ্ছে রয়েছে।
প্রসঙ্গত প্রবাহ ম্যাগাজিন নিয়ে আমরা গর্ব বোধ করি এই জন্য যে প্রথম বার জ্ঞান বিচিত্রা আয়োজিত রাজ্যব্যাপি লিটল ম্যাগাজিন প্রতিযোগিতায় আমরা তৃতীয় হয়েছিলাম। পরবর্তীতে ত্রিপুরা পাবলিশার্স গিল্ড আয়োজিত প্রতিযোগিতায় আমাদের প্রবাহ ম্যাগাজিন পর পর তিন বার রাজ্যস্তরে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে
সৌম্য : "ছোটোগল্পে কাহিনি থাকা চলবে না । বর্তমান গল্পের পাঠক শুধু কাহিনি নিয়ে সন্তুষ্ট হন না। " - বলেন সমালোচকদের একাংশ । তারপরেও কোনো ছোটোগল্পই কাহিনি হীন হয় না। প্রত্যক্ষে না হোক পরোক্ষে। ছোটোগল্পের অন্তরে কাহিনিই গল্পের প্রাণ - কি বলবেন?
জহর. দে. : " ছোটোগল্পে কাহিনি থাকা চলবে না।" কথাটা আমার ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। গল্প ছাড়া একটা বিষয় গল্প হয়ে উঠবে কী করে! আমি মনে করি পৃথিবীর যে কোনো সৃষ্টির পেছনে একটা উদ্দেশ্য থাকে। উদ্দেশ্য ছাড়া কিছু হতে পারে না।আর সেই উদ্দেশ্যের পেছনে একটা লক্ষ্য নিয়েই সৃষ্টি কর্তা কিছু সৃষ্টি করেন।সে আপনি চলচ্চিত্র বলুন কিংবা নাটক, নৃত্য বা সঙ্গীত সব কিছুর মধ্যেই একটা কাহিনী বা বিষয় বস্তু থাকতে বাধ্য।আর যদি উদ্দেশ্য হীন ভাবে কিছু সৃষ্টি হয়, তা সৃষ্টির পর মুহূর্তেই কালের গহ্বরে তলিয়ে যাবে। কাহিনি আছে বলেই আমরা 'একাদশী বৈরাগী' কিংবা 'মহেশ' এখনো মনে রেখেছি।
সৌম্য : 'সাম্যবাদী' ,'উওরণ' ,'নদী থেকে হৃদয়ে' ,'পাহাড়ী ফুল', 'চিরন্তন ভাবনা' ,'গন্ডাছড়ায় গন্ডগোল' (শিশু কিশোর উপন্যাস) - আপনার উপন্যাসে নামকরণ বা চরিত্রের বিশেষ কোনো অভিনবত্ব নজরে না পড়লেও; প্রেম প্রকৃতির বর্ণনা দরাজ হাতে গুছিয়েছেন। বিষয় নির্বাচনে আপনি খানিক ব্যতিক্রমী। কেমন বিষয় নিয়ে আগামীদিনে কাজ করতে চান?
জহর. দে. : আমি মনে করি, সাহিত্য জীবনের কথা বলে।সে মানব জীবন বলো কিংবা সমাজ জীবন,বা রাষ্ট্রীয় অথবা প্রাকৃতিক জীবন। এর বাইরে তো আর কিছু হতে পারে না। আমাদের যত সৃষ্টিই বলো না কেনো - এর মধ্যেই আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি । সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমরা কেবল উপস্থাতপনার সময় প্রত্যেকেই তার নিজস্ব শৈলীতে উপস্থাপন করে থাকি।
আর বিষয় নির্বাচন - এর বেলায় আমি অবশ্যই চেষ্টা করি, আমার বাস্তব দেখা এবং নিজস্ব ভাবনার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে পাঠকের হাতে তুলে দিতে।সে ভাবেই আগামী দিনে আমার নিজস্ব ভাবনায়, একজন বৈষ্ণব গোঁসাই কে কেন্দ্র করে তার এক আদর্শ বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের কাহিনি উপন্যাস আকারে সবার সামনে তুলে ধরতে চাইছি। আর আমার এই স্বপ্নের রূপরেখা প্রায় শেষের পথে ।
পাশাপাশি আরো একটি কাজ আমার দিক থেকে শেষ করেছি,মূলত ছোটদের জন্য হলেও আমার বিশ্বাস ছোট-বড় সমস্ত অংশের পাঠকই পড়ে আনন্দ পাবেন, গোয়েন্দা কাম এডভ্যাঞ্চার উপন্যাস ' স্বর্ণ ত্রিভুজের আতঙ্ক '। মজাদার বইটি তুলসী পাবলিশিং হাউস এ আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশের অপেক্ষায়।
সৌম্য : "সামালোচনা সাহিত্য সাহিত্যের গতিপথ নির্ধারণ করে।" - কথাটি বিশ্বাস করেন?
জহর.দে. : এই ব্যাপারটায় আমি পুরোপুরি সহমত হতে পারলাম না। তবে এটা ঠিক যে সাহিত্য জগতে সমালোচনাটা অবশ্যই অপরিহার্য। কেননা আমি মনে করি, সমালোচনা সাহিত্য - সাহিত্যকে হৃদ্ধ করে, সমৃদ্ধ করে ।
সৌম্য : কবিতার কাছে কি আশ্রয় পেয়েছেন কথাসাহিত্যিক জহর দেবনাথ? কবিতা আপনার কাছে কিভাবে ধরা দেয়?
জহর.দে. : বেশ শক্ত একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলে। আমি হয়তো সরাসরি এই উত্তরটা দিতে পারছি না । তবে বলি আমার লেখক জীবনের শুরুটা কিন্তু হয়েছিল কবিতা দিয়ে।স্কুল জীবন থেকেই কবিতা লেখা শুরু। আমার
আদর্শ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। আমার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় আগরতলা রামনগর থেকে প্রকাশিত 'প্রত্যয়' নামে একটি লিটল ম্যাগাজিনে । তখন আমি একাদশ শ্রেণির ছাত্র।
পরবর্তী সময়ে ত্রিপুরার বিশেষ একটা রাজনৈতিক এবং সামাজিক অস্থিরতার সময়ে আমার কলমের অভিমুখ ঘুরে যায় গল্প লেখার দিকে। কিন্তু তার পরবর্তী সময়ে ও যখনই কোন কারণে আমার খুব কষ্ট হয়, অভিমান হয় কিংবা রাগ হয় বা হঠাৎ করে প্রেমে পড়ে যাই, তখনই তাৎক্ষণিক ভাবে কলম নিয়ে বসে যাই কবিতা লিখতে।
সৌম্য : "কালজয়ী উপন্যাসের অন্যতম শর্তই হলো সময় ও সমাজকে বিস্তৃত পরিসরে আবদ্ধ করা" - কালজয়ী উপন্যাস বললে আপনার দৃষ্টিতে বাংলা সাহিত্যের কোন কোন উপন্যাসের কথা বলতে চাইবেন?
জহর. দে. : এটা তো আমার জন্য সাংঘাতিক কঠিন তম প্রশ্ন । আমার সীমিত পরিসরে ক'টা উপন্যাসই আর পড়ে উঠতে পেরেছি ! তবে বলে রাখি, আমার প্রথম উপন্যাস পড়া শুরু 'আনন্দমঠ' দিয়ে। পরে আরো বেশ কিছু পড়েছি এবং পড়ছি তার মধ্যে এই মুহূর্তে যে ক'টা র নাম মনে পড়ছে 'পথের পাঁচালী', ' সেই সময়', 'শ্রীকান্ত', ' দেবদাস', ' কালবেলা', 'পূর্ব পশ্চিম', 'পদ্মা নদীর মাঝি', ' তিতাস একটি নদীর নাম', 'হাজার চুরাশির মা', ' জাল মোহান্ত' ।
সৌম্য : ত্রিপুরার প্রথম রাজনৈতিক উপন্যাস 'হোয়াইট লিকার ' লিখেছিলেন সত্তরের দশকে ঔপন্যাসিক প্রদীপ আচার্য । সতীনাথ ভাদুড়ি না পড়লে রাজনৈতিক উপন্যাসের পাঠ হয়তো শুরুই হয় না। ঔপন্যাসিক সমরেশ বসু বাংলা ভাষার রাজনৈতিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে নবনির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। আপনার 'সাম্যবাদী' রাজনৈতিক উপন্যাস। রাজনৈতিক উপন্যাস সাধারণ উপন্যাসের তুলনার অনেকবেশি জটিল।তুলনামূলক ভাবে আর সকল উপন্যাসের তুলনায় রাজনৈতিক উপন্যাসের পাঠক সংখ্যাও কম বলেই বিবেচনা করা হয় । এই উপন্যাসের জন্য যেমন সমালোচনা পেয়েছেন তেমনি প্রশংসাও কুঁড়িয়েছেন । কোন প্রেক্ষাপটে মনে হয়েছিল ত্রিপুরার রাজনৈতিক উপন্যাসের মরুভূমিতে রাজনৈতিক উপন্যাস লেখা প্রয়োজন ?
জহর. দে. : আমি আবারও বলি আমার লেখার বিষয়বস্তু একান্তই আমার নিজস্ব অনুভূতির তাগিদে। 'হোয়াইট লিকার' পড়ার সুযোগ আমার হয়নি। তবে সমরেশ বসু আমি পড়েছি।
প্রথাগত শিক্ষার জগতে আমি রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ছাত্র। আর আদর্শ গত ভাবে আমি মনে প্রাণে একজন সাম্যবাদী। পারিবারিক ঐতিহ্য গত ভাবেই এই মতাদর্শে বিশ্বাসী। কিন্তু ব্যাবহারিক জীবনে এসে একটা সময়ে আমার মধ্যে বহু প্রশ্নের জন্ম হল । প্রসঙ্গত বলি, কর্ম জীবনে বহুদিন আমি গ্রাম পাহাড়ে নর-নারীদের মধ্যে নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও সার্বিক সচেতনতা মূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নে যুক্ত ছিলাম। বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে দেখলাম, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং তাদের নেতৃত্বরা সহজ সরল নিরক্ষর মানুষদের ততটাই শিক্ষা এবং সচেতনতার আলো দেবে বা দিচ্ছে,যতটা দিলে তাদের শাসন কায়েম থাকবে। দেখলাম নেতারা মুখে বলছে এক আর বাস্তবে করছে আর এক। তারা সবাই আদর্শ চূত্য হয়ে, সমাজ জীবনে একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে শাসন কায়েম করতে চাইছে। কিন্তু আমার হিসাব বলছিল এটা সঠিক পথ নয়। এ ভাবে চলতে থাকলে বিপর্যয় অনিবার্য।
কিন্তু আমি তো নেতা নই, আমার কথা কে শুনবে!কেনই বা শুনবে ! তবে আমার তো কলম আছে।কলম হাতে আমি কাউকে সমীহ করে চলার মতো নই। লিখতে শুরু করলাম আমার অভিজ্ঞতার কথা। একসময় লিখেও ফেললাম - 'সাম্যবাদী' উপন্যাস।
কিন্তু কে প্রকাশ করবে! আমার কাহিনি শুনে অনেকেই পিছু হটল। অবশেষে স্রোত প্রকাশনার কর্ণধারও বলেছিলেন উপন্যাসের নামটা ভেবে দেখতে,অন্যকিছু দেওয়া যায় কিনা, কিন্তু না এ ব্যাপারে আমি অবিচল ছিলাম। এটা ঠিক যে এই উপন্যাস লিখে অনেকের দৃষ্টিতেই আক্রমণাত্মক ভাবে সমালোচিত হয়েছি। আবার পাশাপাশি প্রশংসাও পেয়েছি । দুটোকেই আমি সমান ভাবে গ্রহণ করেছি। চেষ্টা করেছি আমার সাম্যবাদী উপন্যাস এর মাধ্যমে,আমার মতো করে একটা সাম্যবাদী সমাজ উপহার দিতে। আমার এই ভাবনা কতটা বাস্তব কিংবা অবাস্তব সেটা সময়ই বিচার করবে।
সৌম্য : "সব কাজ শেষেও অনেক কাজ বাকি থেকে যায়। যা করতে তাগিদ আসে কালের অভ্যন্তর হতে।আর তখনই লেখককে কলম ধরতে হয়। আর এতেই প্রমাণ হয় যে কাজ কখনো শেষ হয় না। " - নতুন কি কাজ করছেন?
জহর. দে. : এক জনমে কাজ করে কি আর শেষ করা যায়! কতটুকুই বা করতে পেরেছি। প্রচুর বিষয়, অনেক ভাবনা, হাজারো স্বপ্নের ছবি আঁকা যে এখনো বাকি। চেষ্টা করছি একটা একটা করে বাস্তবায়িত করার।
এই মুহূর্তে আমার নতুন কাজ বলতে, আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য নাগাল্যান্ডের পটভূমিতে একটি উপন্যাসের কাজ শেষ হয়েছে। যা নাকি কোলকাতার সনেট পাবলিকেশন থেকে প্রকাশের অপেক্ষায়, নাম দিয়েছি ' কোয়নাক কন্যা '। নাগা দের কোয়নাক গোষ্ঠীর এক তেজস্বিনী কন্যা এবং তার ভালোবাসার পাত্র দু'জনের সন্মিলীত প্রচেষ্টায় সমাজের দুই মারণ ব্যাধি- মাদক এবং এইডস রোগের বিরুদ্ধে লরাই - এর কাহিনি । পড়ে দেখো, আশা করছি আগামী দিনে তোমাদের মতো বোদ্ধা পাঠক নিরাশ হবে না ।
আর আগেও বলেছি, বিশেষ এক বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সাম্যবাদী ভাবনা নিয়ে উপন্যাস 'মধুময় গোঁসাই ' কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।
সৌম্য : তরুণদের মধ্যে কাঁদের লেখা আপনাকে অনুপ্রাণিত করে? কাঁদের লেখা আপনি আরো আরো পড়তে চান?
জহর. দে. : ত্রিপুরার তরুণ লেখকদের উপন্যাস আমার তেমন করে পড়া হয়ে উঠেনি। এই ব্যাপারে আমার দীনতা স্বীকার করে নিচ্ছি। তার পরেও যে ক'জনের লেখা পড়েছি এবং আগামী দিনেও পড়তে চাই - পদ্মশ্রী মজুমদার,হারাধন বৈরাগী, মৌমিতা চক্রবর্তী,দিব্যেন্দু নাথ সহ আরো অনেকেই ৷
সৌম্য : 'গন্ডাছড়ায় গন্ডগোল ' ও ' জঙ্গলের রাজা রাই কাচাগ' - শিশু কিশোর সাহিত্যে আপনার অন্যতম অবদান। শিশু সাহিত্য নিয়ে কাজ করবেন এই ভাবনাটা কিভাবে এলো?
জহর. দে. : কৈশোরে ঠাকুমার ঝুলি দিয়ে শিশু সাহিত্যকে চেনা শুরু। তারপর 'আনন্দমেলা' এবং 'শুকতারা' দিয়ে আধুনিক শিশু সাহিত্যে প্রবেশ। তখন থেকেই অবচেতন মনে স্বপ্ন রচিত হয়েছিল, বড় হয়ে আমিও ছোটদের জন্য এমন কিছু গল্প- উপন্যাস লিখবো,যা থেকে শিশু কিশোররা আনন্দ পাবে, সাহসী হয়ে উঠবে, ওদের মধ্যে বিজ্ঞান ভাবনার বিকাশ ঘটবে। সর্বোপরি তাদের শিশু মনের সার্বিক বিকাশ ঘটবে।
সৌম্য : ধলাইয়ে বর্তমান সময়ে বাংলা সাহিত্য নিয়ে বিশেষ কিছু কাজের দৃষ্টান্ত যদি তুলে ধরেন।
জহর.দে. : বর্তমান ধলাই জেলার সাহিত্য- সংস্কৃতি চর্চার একটা সমৃদ্ধ অতীত রয়েছে। আমাদের অতীতের বাংলা সাহিত্যের বলিষ্ঠ সাহিত্যিক বিমল সিংহ মহাশয় কিন্তু ধলাই জেলার মানুষ এবং উঁনার বেশিরভাগ গল্প- উপন্যাস গুলো কিন্তু এই ধলাই জেলার পাহাড়-জঙ্গল, নদী- নালা আর এখানকার মানুষের জীবন যাত্রা নিয়েই সমৃদ্ধ হয়েছে। সেই সঙ্গে তৎকালীন সময়ের আরো একজন কথাসাহিত্যিক ছিলেন সুধাংশু ঘোষ মহাশয়। উঁনার লেখার মধ্যেও ধলাই জেলার মাটির গন্ধ পাই।
পরবর্তীতে আমরা অনেকেই আছি যারা নিজেদের মতো করে কবিতা, গল্প, উপন্যাস এমনকি গবেষণা মূলক প্রবন্ধ সাহিত্য নিয়ে কাজ করছি।
পাশাপাশি ধলাই জেলার দুটো সংস্থা 'প্রবাহ ধলাই' এবং 'ধলাই সাহিত্য পরিষদ' যৌথভাবে দীর্ঘদিন ধরে এই ধলাই জেলার সাহিত্য এবং সাহিত্যিকদের সার্বিক কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এবং বিশ্বাস করি আগামী দিনেও এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে।
সৌম্য : লেটার প্রেস থেকে আধুনিক মুদ্রণ শিল্পের পথে ত্রিপুরা। একজন লেখক হিসেবে এখানকার প্রকাশনা শিল্প নিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?
জহর.দে. : আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে আমি যখন কবি ইরেশ দেবনাথ -এর সঙ্গে যৌথভাবে 'যাযাবর' ম্যাগাজি সম্পাদনার কাজে যুক্ত ছিলাম, তখনকার সময়ের তুলনায় আমরা অনেক এগিয়ে গেছি, এটাই স্বাভাবিক । আমি ভীষণ ভাবেই আশাবাদী যে , আমাদের এই রাজ্যের প্রকাশনা শিল্প আগামী দিনে আরো অনেক এগিয়ে যাবে ।
সৌম্য :'ধলাইপারের রূপকথা' ( ২০০২) 'জালনোটের বেড়াজাল '( ২০০৩), 'গল্প দাদুর আসর '( ২০১৫), 'বিপর্যয় '(২০১৮) - এ যাবৎ কাল অব্দি আপনার প্রকাশিত গল্প সংকলন। প্রত্যেক লেখকই প্রথমে একজন পাঠক। ত্রিপুরার কোন কোন লেখকের গল্প আপনার পছন্দের তালিকায়?
জহর.দে. : এই বিষয়টিও যথেষ্ট কঠিন আমার কাছে। তবুও প্রসঙ্গ যখন উঠলো তা হলে বলি, গত কয়েক মাস ধরে কোলকাতার একটি প্রতিষ্ঠিত প্রকাশন প্রতিষ্ঠান 'সনেট পাবলিকেশ '। ওদের হয়ে ত্রিপুরা,আসাম,পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের গল্পাকারদের গল্প নিয়ে ' তিন ভুবনের গল্প ' শিরোনামে একটি সংকলন গ্রন্থের সম্পাদনার কাজ করতে গিয়ে, প্রায় একশত লেখকের গল্প খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। তার মধ্যে আমাদের ত্রিপুরার অনেক লেখক আছেন যারা সত্যিই খুব ভালো লেখেন। সবার নাম হয়তো এখানে উল্লেখ করার সুযোগ নেই। তবুও কয়েক জনের নাম বলতেই হয় - রীতা ঘোষ,তমা বর্মন, মুনমুন দেব,পায়েল দেব্বর্মা,চিরশ্রী দেবনাথ, অপর্না সিনহা,দেবোপম রায়, অশোকানন্দ রায় বর্ধন, শ্যামল বৈদ্য,সঞ্জীব দে, রাজা দেবরায়, বিজন বসু,অভীককুমার দে, মৌলিক মজুমদার, বিশ্বজিৎ বন্দোপাধ্যায় এমন আরো অনেকেই আছেন যাঁরা সত্যিই খুব ভালো লিখছেন। উঁনাদের লেখা অবশ্যই বাংলা সাহিত্যে সম্পদ হতে পারে।