ইন্ডিয়ান হ্যান্ডলুম ব্র্যান্ডের স্বীকৃতি পেয়েছে রিসা, রাজ্যের জনজাতি মহিলারা রিসার বর্ণে জীবনের ছন্দ খুঁজছেন
রাজীব চক্রবর্তী
উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রান্তিক পার্বত্য রাজ্য ত্রিপুরা নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যময় শিল্প ও কারুকার্যের নৈপুণ্যের উৎকর্ষতার জন্য সর্বত্র সমাদৃত। এই রাজ্যের জনজাতি মহিলাদের হাতে তৈরি রিসা এমনই এক শিল্পকর্মের নিদর্শন। জনজাতি রমণীরা নেহাতই অঙ্গ বস্ত্রের প্রয়োজন মেটাতে হস্ততাঁতের রিসা তৈরি করতেন। প্রাথমিকভাবে কোনও ধরনের বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি না থাকলেও বর্তমানে বিপুল সম্ভাবনাময় রিসা রোজগারের নয়া দিশা দেখাচ্ছে। রাজ্যের বর্তমান সরকার রিসাকে আন্তর্জাতিক স্তরে বাণিজ্যিকীকরণের উদ্যোগ নিয়েছে। রিসার মতো বর্ণময়। শিল্পকর্মের কথা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছে বর্তমান সরকার। এতে খুলে গিয়েছে রোজগারের এক নতুন দিশা। সম্প্রতি ইন্ডিয়ান হ্যান্ডলুম ব্র্যান্ডের স্বীকৃতি পেয়েছে রিসা। রাজ্যের বয়ন শিল্পীরা বিশেষ করে জনজাতি মহিলারা যারা রিসা তৈরি করেন তারা এখন বর্তমান রাজ্য সরকারের এই উদ্যোগে রিসার বর্ণে জীবনের ছন্দ খুঁজছেন। এক সময় এই রাজ্যে অতিথি আপ্যায়নে বা অভ্যর্থনায় রিসার চাহিদা সীমাবদ্ধ ছিলো। জনজাতি মহিলাদের তৈরি বিভিন্ন কারুকার্যের সংমিশ্রণে তৈরি বর্ণময় রিসার মাধ্যমে রোজগারের যে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে তা বর্তমান সরকার অনুভব করে। বিশেষ করে মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেবের আগ্রহে রিসার বাণিজ্য দেশ বিদেশে প্রসার ও প্রচারের উদ্যোগ নেয় সরকার।
রাজ্যে একটা সময়ে রিসা শুধুমাত্রই পোশাকের প্রয়োজন মেটাতে হস্ততাঁতের মাধ্যমে তৈরি করা হতো। কাপড়ের মিল থেকে উৎপাদিত কাপড়ের বদলে জনজাতি রমণীরা, নিজের ও পরিবারের অঙ্গবস্ত্র ও প্রয়োজনীয় কাপড়ের চাহিদা মেটাতে রিসা ছাড়াও হস্ততাঁত ও কোমর তাঁতের কাপড় তৈরিতে নিপুণ ছিলেন। জনজাতি মহিলাদের বহুল ব্যবহৃত পোশাকের মধ্যে ছিলো রিগনাই (পাছড়া) এবং রিসা। পাছড়া কোমরের নীচের অংশে পরিধান করা হতো। রিসা ব্যবহৃত হতো বক্ষ আবরণী হিসেবে। সময়ের বিবর্তনে পরিবর্তন হয়েছে রিসার ব্যবহারিক দিকও। শিশুদের ঝুলিয়ে কোলে পিঠে নেওয়া, পাগড়ির মতো ব্যবহার, উত্তরীয় বা পুরুষেরা ধূতির সাথে কোমরে জড়িয়েও পড়তে পছন্দ করতেন। রিয়াং, জমাতিয়া, নোয়াতিয়া, হালাম, চাকমা রমণীরা হস্ততাঁত বা কোমর তাঁতের কাজে ছিলেন দক্ষ। জুম থেকে সংগৃহীত কার্পাস তুলা শুকিয়ে চরকার মাধ্যমে তার থেকে সুতা সংগ্রহ করে নানা ভেষজ উপায়ে সেই সুতাগুলি রং করে রিসা বুনতেন।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভোকাল ফর লোকালের ভাবনায় মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব রিসা নির্ভর বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে গুরুত্বের ভিত্তিতে সমগ্র দেশে মেলে ধরে রাজ্যের জনজাতিদের ঐতিহ্যের ছাপ বয়ে চলা এই রিসার প্রচার ও প্রসারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। নিজে রিসা ব্যবহার করে অন্যদেরও এর ব্যবহারে উৎসাহিত করেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি ও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অভ্যর্থনায় স্থান করে নেয় রিসা। বর্তমানে রাজ্যের পরম্পরা হয়ে উঠে রিসার ব্যবহার বেড়েছে। বেড়েছে এর ব্যাপ্তি। প্রায় সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি অনুষ্ঠানে অতিথি বরণে বা অভ্যর্থনার স্বগৌরবে উত্তরীয় হিসেবে ব্যবহৃত হয় রিসা।
ত্রিপুরায় তৈরি রিসার বাণিজ্যিক বিপণনের সমস্ত রকমের উদ্যোগ নিয়েছে ত্রিপুরা হস্ততাঁত ও হস্তকারু শিল্প উন্নয়ন নিগম। নিগমের চেয়ারম্যান বলাই গোস্বামী জানান, সম্প্রতি ইন্ডিয়ান হ্যান্ডলুম ব্র্যান্ডের স্বীকৃতি পেয়েছে ত্রিপুরার রিসা। এরফলে রিসা ত্রিপুরার ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। দিল্লিস্থিত হস্ততাঁত ও হস্তকারু শিল্প নিগমের পূর্বাশা বিপণন কেন্দ্র সহ সর্বত্র এর চাহিদা নিয়ত বাড়ছে। বৈদেশিক অতিথি আপ্যায়নেও কদর বাড়ছে রিসার। আরও অধিক বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অনলাইনে রিসা বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে নিগম। ত্রিপুরা হস্ততাঁত ও হস্তকারু শিল্প উন্নয়ন নিগম তাঁতীদের উৎপাদিত পণ্যের বিক্রয়ের নিশ্চয়তা দেওয়ায় তাঁতীরা রিসা তৈরিতে আগ্রহী হচ্ছেন। প্রচুর চাহিদা থাকায় তাঁত শিল্পীগণ দিন রাত রিস তৈরিতে ব্যস্ত। তৈরি হয়েছে। রোজগারের সুযোগ। নিগমের চেয়ারম্যান বলাই গোস্বামী বলেন, মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরের প্রতিচ্ছবি অঙ্কিত অঙ্গবস্ত্র বা রিসার চাহিদাও প্রচুর। মাতাবাড়ির ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরে পূর্বাশা কেন্দ্রে এ ধরনের রিসা বিক্রয় হয়। তাঁতের তৈরি রিসার মূল্য তুলনামূলক একটু বেশি হওয়ায় সমস্ত অংশের ক্রেতাদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে বিভিন্ন দামের এবং বিভিন্ন সাইজের রিসা তৈরি করা হচ্ছে। এরমধ্যে রয়েছে সুতির কাপড়ে সিল্ক প্রিন্ট করা রিসাও। যা তুলনামূলকভাবে দামের দিকে অনেকটাই কম। অন্যদিকে, নীরমহল, ঊনকোটির সহ রাজ্যের পর্যটন কেন্দ্রগুলির প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে এই পর্যটন কেন্দ্রের অনুকরণে রিসা তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বয়ন শিল্পীদের আরও বেশি করে উৎসাহিত করতে ও তাদের সুবিধার্থে রাজ্যে অবস্থিত হস্ততাঁত ও হস্তকারু শিল্প উন্নয়ন নিগমের সমস্ত বিপণন কেন্দ্রের মাধ্যমে রিসা তৈরির বিশেষ ধরনের অ্যাক্রেলিক সুতো সহ অন্যান্য সুতো সহায়ক মূল্যে সরবরাহ করার উদ্যোগ নিয়েছে নিগম। খোলা বাজারে এই ধরনের সুতোর মূল্য বেশি হওয়ায় উৎপাদিত পণ্যে লাভ হতো কম। সহায়কমূল্যে সূতো পাওয়ায় তাঁত শিল্পের সাথে যুক্ত শিল্পীরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। হস্ততাঁতের সাথে পাল্লা দিয়ে চাহিদা বাড়ছে সিল্ক প্রিন্ট রিসার। উৎপাদিত রিসাগুলি বিভিন্ন ক্লাস্টার এবং সমবায় সংস্থার মাধ্যমে পূর্বাশা বিপণন কেন্দ্রে তাঁতীরা বিক্রির নিশ্চয়তা পাওয়ায় আরও বেশি করে এই পেশায় যুক্ত হওয়ার আগ্রহী হচ্ছেন।
ক্রেতাদের চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে রিসায় এখন স্থান পেয়েছে আধুনিক ডিজাইন। প্রচলিত ও সমকালীন দুটোতেই সমান গুরুত্ব দিয়ে রিসাকে আরও হৃদয়গ্রাহী করে তুলতে ডিজাইনাররা নতুন নতুন নক্সা তৈরি করে চলেছেন। তাঁতী পাড়াগুলিতে এখন নিয়ত কর্মব্যস্ততা। বিভিন্ন কারণে একটা সময়ে উৎসাহ হারিয়ে ফেলা শিল্পীরাও এখন নতুনভাবে এই শিল্পের সঙ্গে পুনরায় নিজেদের যুক্ত করছেন। নতুন প্রজন্মের শিল্পীরাও এই পেশায় আগ্রহী হচ্ছেন। সিমনার সনখলায় সোনারাম মহিলা তাঁত শিল্প সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাথে যুক্ত প্রায় ১০০ জন জনজাতি মহিলা গৃহস্থালীর কাজের পাশাপাশি রিসা তৈরির মাধ্যমে খোঁজে পেয়েছেন স্বাবলম্বী হওয়ার পথ। আত্মনির্ভর ত্রিপুরার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আত্মনির্ভর পরিবার গড়তে সহায়ক ভূমিকা নিচ্ছেন তারা। এদের মধ্যে অনেককেই প্রশিক্ষণের পর সরকারি সহায়তা ফ্লেইম তাঁত মেশিন প্রদান করা হয়েছে। রিসা তৈরির সাথে যুক্ত রাজলক্ষ্মী দেববর্মা, শঙ্খমালা দেববর্মা ও কাজল দেববর্মা জানালেন, ঘরের কাজ শেষে যতটুকু সময় পাওয়া যায় তাতেই গড়ে প্রায় প্রতি মাসে ৬ হাজার টাকা অনায়াসে রোজগার করছেন। এর ফলে তৈরি হচ্ছে বিকল্প কর্মসংস্থানও সোনারাম মহিলা তাঁত শিল্প সমবায় সমিতি লিমিটেডের এমডি পারবিতা দেববর্মা জানান, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরও সংখ্যায় মহিলারা যুক্ত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পূর্বাশায় উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রির নিশ্চয়তা ও সাথে সাথেই টাকা পাওয়ার ফলে তাঁত শিল্পীরা আগ্রহী হচ্ছেন। ফ্রেইম তাঁত ও কোমর তাঁতের মাধ্যমে তারা এইগুলি তৈরি করছেন।