কিরাত দেশের লড়াকু মেয়ে
শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ
উত্তরপূর্ব ভারতের বাইরে কাজ করতে গিয়ে বুঝেছি আমাদের অঞ্চল সম্পর্কে বেশির ভাগ ভারতীয়ের অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। রয়েছে আমাদের অঞ্চলের
মানুষ, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস এবং ভৌগলিক অবস্থান সম্পর্কে আগে থেকেই ওদের মাথায় এঁড়ে বসে থাকা কিছু নেতিবাচক ধ্যান ধারণা। আমাদের অঞ্চলের
লোকজনদের ওপর এর প্রভাবের ফলে দুই রকম প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেছি। প্রথমত, ত্রিপুরার অধিকাংশ লোকজন বাইরে গেলে নিজেদের পশ্চিমবঙ্গের
অধিবাসী বলে চালিয়ে দেন। এতে প্রবাসে কর্মরত অথবা বাসরত ত্রিপুরার লোকজনদের সম্পর্কে দেশের মূল ভূখণ্ডের অধিকাংশ ভারতীয়দের যেন অকারণ
ছুৎমার্গের ব্যাপারটা তখন আর থাকে না ! দ্বিতীয়ত, দেশের মূল ভূখণ্ডের অধিকাংশ ভারতীয়দের আবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই ত্রিপুরা বাদে বাকি উত্তরপূর্ব
ভারতের মানুষ প্রবাসে শুধু নিজেদের মধ্যেই গুটিয়ে রাখে। এতে দূরত্ব আরও বাড়ে। কিরাতদেশের লোকজনদের সম্পর্কে ঘৃণার মাত্রা আরও বৃদ্ধি পায়।
দেশের মূল ভূখণ্ডে কর্মরত উত্তরপূর্ব ভারতের লোকজন বিশেষ করে মেয়েদের ওপর শারীরিক নিগ্রহ, যৌন হেনস্থা এবং ঘৃণা হল সেই আবদ্ধ মানসিকতারই
বহিঃপ্রকাশ।
এর উদাহরণ কম নয়। গণহত্যার হুমকি পেয়ে ২০১২’র আগস্টে ব্যাঙ্গালোর সহ দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন শহরে কাজ করা উত্তরপূর্ব
ভারতের ছেলেমেয়েরা দলেপালে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। ২০১৪’র ফেব্রুয়ারিতে বিনা কারণে অরুণাচল প্রদেশের ছেলে নিডো তানিয়াকে দিল্লির কিছু ছেলে
পিটিয়ে মেরে ফেলে। গত বছর অর্থাৎ ২০২০’র মার্চ এপ্রিলে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সময় দেশের মূল ভূখণ্ডে কর্মরত উত্তরপূর্ব ভারতের
ছেলেমেয়েদের কী অত্যাচারই না সইতে হয়েছে। দেশপ্রেমী হওয়া সত্বেও ওদের গালিগালাজ করা হয়েছে ‘চাইনিজ’ বলে। ২০২০’র এপ্রিলে মুম্বাইয়ে
এক মোটর সাইকেল চালক রাস্তায় হেঁটে যাওয়া ২৫ বছরের মণিপুরী যুবতীর দেহে থুথু ছিটিয়ে বলে, ‘’ দূর হ চাইনিজ। তোরাই করোনা
ভাইরাস।‘’
আমি এসব ঘটনা খুব কাছ থেকে দেখেছি। উত্তরপূর্ব
মানুষ হিসেবে আমার সমস্যা অন্যত্র। বঙ্গভাষী বলে আমিও নিজেকে আরামসে পশ্চিমবঙ্গের লোক বলে চালিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু আত্মসম্মান-বোধ
খুইয়ে ভিন প্রদেশের লোক বলে পরিচয় দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অথচ আজও আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগতে হয় আমায়। ত্রিপুরাটা কোথায় - এই
প্রশ্নে আজও বিব্রত হতে হয়। এসব বিষয় প্রবাসে কর্মরত উত্তরপূর্ব ভারতের অনেক ব্যক্তির কাছে তেমন কিছু নয় - কিন্তু আমার মতো মানুষের পক্ষে এক
গুরুতর সমস্যা। তাই এই আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’এ আমিও পীড়িত হই বারবার।
এই অঞ্চলের একজন পুরুষ হিসেবে নিজের এহেন আত্ম
সংকটের কথা ভেবে অস্বস্তিতে পড়ি যখন - ভাবি উত্তরপূর্ব ভারতের মেয়েদের ভয়াবহ দুরাবস্থার কথা। আঁতকে উঠি বারবার। জানি উত্তরপূর্ব ভারতের
মেয়েদের হামেশা কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মোকাবিলা করে বেঁচে থাকতে হয়। নিজের রাজ্যে জলের সন্ধানে কলসী কাঁধে নিয়ে হেঁটে যেতে হয় মাইলের পর
মাইল। অর্থাভাবে গাঁয়ের একজন খেলোয়াড়কে বাসের ছাদে চেপে যেতে হয় শহরে প্রশিক্ষনের জন্য। উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে
একজন জিমন্যাস্টকে পুরনো বাতিল সরঞ্জামের ওপর অনুশীলন করতে হয়। অর্থকড়ির অভাবে এই অঞ্চলের মহিলাদের ভালো খাদ্যও জুটে না। দুঃস্বপ্নের
মতো এই সংকটের কথাগুলিই বারবার ফুটে উঠে আমার লেখালিখিতে।
বনকুন্তলার উপাখ্যান, জতুগৃহের পাখি, মিস প্রদুনোভা ত্রিপুরা’র মতো
উপন্যাস, গন্দে লোগ’এর মতো গল্প, দিল্লি ব্লুজ’র মতো কবিতায় উত্তরপূর্ব ভারতের মেয়েদের করুণ আর্তিই ফুটিয়ে তুলেছি। কনটেন্ট বা ফর্মে পশ্চিমবঙ্গের
সাহিত্যের অনুসরণ না করে গড়ে তুলেছি অরণ্য অধ্যুষিত উত্তরপূর্ব ভারতের নিজস্ব আলেখ্য। হেঁটেছি ত্রিপুরার বাংলা সাহিত্যের একেবারে ভিন্ন ব্যতিক্রমী
পথে। অফিশিয়ালি চেষ্টা করেছি দেশের মূল ভূখণ্ডের মানুষের কাছে ত্রিপুরা তথা উত্তরপূর্ব ভারতের মহিলা কবি সাহিত্যিকদের প্রতিভা তুলে ধরার। গত বছর
(২০২০) লকডাউনের বন্ধ্যা সময়ে গুয়াহাটির অন্যতম সাংস্কৃতিক সংস্থা ব্যতিক্রম’এর সঙ্গে প্রযোজনা করেছি ত্রিপুরার মহিলা কবিদের কবিতা নিয়ে
অফিশিয়াল ইউটিউব ‘’সপ্তরাগ’’। ‘ব্যতিক্রম’ জানিয়েছে ‘সপ্তরাগ’এর ভিউয়ারশীপের সংখ্যা এখন লক্ষাধিক ছুঁয়েছে।
এইভাবে চলতে
গিয়ে কিন্তু নিজ রাজ্যেরই বহু লোকের বিরাগভাজন হয়েছি। অশ্লীল গালিগালাজ শুনেছি। কিন্তু আমাদের ক্রাইসিস’টা আসলেই কতখানি গভীর সে আমি
উত্তরপূর্ব ভারতের বাইরে ঘোরাঘুরি করেছি বলেই জানি। তাই নিজেদের মেলে ধরার এই অপার তৃষ্ণা ! আমাদের উত্তরপূর্ব ভারতের এই ক্রাইসিস’টা
অনুভব করতে না পারলে এহেন ‘তৃষ্ণা’র কারণ কারোর পক্ষে বোঝা বা হৃদয়ঙ্গম করা অসম্ভব।
মন ভালো হয়ে যায় আজ যখন শুনি ২০২১’র
টোকিও অলিম্পিক্সে মণিপুরের মেয়ে সাইখম মীরাবাই চানু ভারতের হয়ে প্রথম পদক জিতেছে। মেরি কম, দীপা কর্মকার, হিমা দাশ, লালরেমসিয়ামি, সুশীলা
চানু পুখরামবাম, ল্ভলীনা বরগোহাঁই, সুশীলা লিখামবাম’দের নিয়ে আমাদের গর্বের অন্ত নেই। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সইয়েও এইসব লড়াকু মেয়েরা গোটা
বিশ্বে আজ ভারতের মুখোজ্জ্বল করে তুলেছে। হ্যাঁ, দেশের মূল ভূখণ্ডের বেশ কিছু মানুষের অকারণ ঘৃণা সইয়েও আমাদের উত্তরপূর্বের মেয়েরাই আজ গোটা
বিশ্বে ভারতকে উজ্জ্বল করে তুলেছে। জনসংখ্যার অনুপাতে ভারতের ক্রীড়াক্ষেত্রে আমাদের মেয়েদের অংশগ্রহণের সংখ্যা অবশ্যই প্রশংসনীয়। গোটা
জনসংখ্যার বিচারে দেশে উত্তরপূর্ব ভারতীয় শুধু ৩.৭ শতাংশ ! উল্লেখ্য, ২০১৬’র রিয়ো অলিম্পিক্সে উত্তরপূর্ব ভারতের খেলোয়াড়দের সংখ্যা ছিল ৭
শতাংশ। এবার টোকিও অলিম্পিক্সেও সংখ্যাটা প্রায় একই রকম। জনসংখ্যার অনুপাতে গোটা দেশে উত্তরপূর্ব ভারতের খেলোয়াড়দের তাই প্রশংসনীয়ভাবে
বেশি। .
শুধু খেলাধুলোতেই নয় - বিনোদন দুনিয়াতেও আমাদের মেয়েরা সর্ব ভারতীয় ক্ষেত্রে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছে। আজ গোটা দেশ উত্তরপূর্ব
ভারতের মেয়েদের সাফল্যে গর্বিত। উত্তরপূর্ব ভারতের আত্ম সংকটের মেঘ ধীরে কাটছে নিশ্চয়। আলোকিত হয়ে উঠছে আমাদের ভুবন। কিরাতদেশের লড়াকু
মেয়েদের তাই অভিবাদন জানাই।