নারী আপন ভাগ্য জয় করে চুলুবাড়ির ছায়া দাস এখন অনুপ্রেরণার নাম

তুহিন আইচ

নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার/ কেন নাহি দিবে অধিকার /হে বিধাতা? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সবলা’ কবিতার এই পঙক্তিগুলির সাথে মিলে যায় কমলপুরের চুলুবাড়ির ছায়া দাসের জীবন কথা। ছায়া দাস আপন ভাগ্যকে জয় করে নিয়েছেন তার দৃঢ় মানসিকতা দিয়ে। ২০০৬ সালে কলাছড়ির সঞ্জয় দসের সাথে তার বিয়ে হয়। ছায়া দাস কমলপুর ডিগ্রি কলেজের স্নাতক। স্বামী পলিটেকনিকে পড়তেন। দু’জনে গৃহশিক্ষকতা করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এভাবে চলছিলো তাদের সংসার। ২০০৮ সালে তাদের এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। তাদের এই সুখের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হলো না। ২০১০ সালে স্বামী এক ঘৃণ্য অপরাধে যুক্ত হয়ে আজীবন কারাবাসে দন্ডিত হলেন। এই ঘটনায় ছায়া দাসের জীবনে অন্ধকার নেমে এলো। একমাত্র পুত্র সন্তানকে নিয়ে কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। নিজের জীবন ও তার সন্তানের কথা ভেবে তিনি শুরু করতে চাইলেন এক নতুন জীবন গৃহশিক্ষকতার অভিজ্ঞতা তার আগেই ছিলো। সেই অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে চুলবাড়িতে বাবার বাড়ি ফিরে এলেন সন্তানকে নিয়ে। বাবার বাড়িতে থেকেই শুরু করলেন গৃহ শিক্ষকতার কাজ। কিন্তু চোখে ছিলো স্বনির্ভর হওয়ার স্বপ্ন। এই স্বপ্ন তাকে অদম্য করে তুলেছিলো। ছোটবেলায় এক সময়ে তিনি খেলার মাঠে দাপিয়ে বেড়াতেন। অ্যাথলেটিক্সে এক সময় চুলুবাড়ির গর্ব ছিলেন ছায়া দাস। কলেজ স্তর থেকে রাজ্যস্তরের অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায়ও অংশ নিয়েছিলেন। খেলার মাঠের এই লড়াকু মানসিকতা তাকে প্রেরণা দিয়েছে।

চুলবাড়িতে ফিরে এসে গৃহ শিক্ষকতার পাশাপাশি স্থানীয় পঞ্চায়েত কার্যালয়ে রেজিস্টার তৈরি সুবিধাভোগীদের নামের তালিকা তৈরি করে দিয়ে কিছু বাড়তি রোজগারের সুযোগ হলো। ২০১৭ সালে চুলুবাড়ির ৩ জন মহিলার সাথে সাক্ষাৎ হলো ছায়া দাসের। এই ৩ জন মহিলাই একটি অসহায়ক দলের সঙ্গে যুক্ত। তাদের কথা শুনে ছায়া দাস উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। এই ৩ মহিলাকে সাথে নিয়ে যোগাযোগ হলো দুর্গাচৌমুহনি ব্লকের গ্রামীণ জীবন জীবিকা মিশনের সাথে। তাদের পরামর্শে ছায়া দাস গ্রামের আরও ৭ জন মহিলাকে নিয়ে গঠন করলেন “শারদীয়া’ স্বসহায়ক দল। স্বসহায়ক দলের সদস্যারা প্রথমে ২০ টাকা করে জমাতে লাগলেন। স্বসহায়ক দলের সঞ্চয় ১ হাজার টাকা হওয়ার পর ত্রিপুরা গ্রামীণ ব্যাঙ্কের দুর্গা চৌমুহনি ব্রাঞ্চ থেকে ১ লক্ষ টাকার ঋণ দেওয়া হলো। দলের এই ঋণ থেকে ৫০ হাজার টাকা স্বল্প সুদে নিয়ে ছায়া দাস পোল্ট্রি ফার্ম গড়ে তুললেন। এই পোল্ট্রি ফার্মই এখন ছায়া দাসের অন্যতম অবলম্বন। পরম যত্নে পোল্ট্রি ফার্মটিকে যেমন গড়ে তুলেছেন তেমনি নিয়মিত ফার্মের মোরগদের যত্নও নিতেন। পাশাপাশি চলতে লাগলো গৃহশিক্ষকতার কাজও প্রথমে ১০০টি মোরগের বাচ্চা দিয়ে পোল্ট্রি ফার্ম শুরু করেছিলেন। এখন তার ফার্মে ১ হাজার মোরগ রয়েছে। কথা বলতে গিয়ে তিনি জানালেন, পোল্ট্রি ফার্ম থেকে খুব সহসাই তিনি লাভের মুখ দেখেছেন। ফার্ম থেকে এখন তার ভালো রোজগার হচ্ছে। কিন্তু এখানেই থেমে থাকলেন না ছায়া দাস। স্বনির্ভরতার স্বপ্ন সব সময়েই তাকে তাড়া করে বেড়িয়েছে। স্বসহায়ক দল থেকে যে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন তা ১০ মাসেই তিনি পরিশোধ করে দিতে সক্ষম হন। ২০১৯-এর নভেম্বর মাসে শারদীয়া স্বসহায়ক দল আবারও ২ লক্ষ টাকা ঋণ পায়। দলের এই ২ লক্ষ টাকা ঋণ থেকে ছায়া দাস পুনরায় স্বল্প সুদে ৯০ হাজার টাকা ঋণ নিলেন। এই টাকা দিয়ে ৪টি ছাগল কিনে তিনি গড়ে তুললেন ছাগলের ফার্ম ও ১ কানি জমি নিয়ে ধান চাষ শুরু করলেন। ২০২০ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস নাগাদ তার এই জমি থেকে ৬৮০ কেজি ধান পেলেন। তার ছাগলের ফার্মে এখন রয়েছে ৮টি ছাগল৷ ধান বিক্রি করে তার ১২ হাজার টাকা আয় হলো। এভাবে তিনি বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে থাকলেন। কিছুদিন পর তার রোজগার থেকে তিনি একটি গাভী ক্রয় করলেন। এই গাভীর ৩ লিটার করে দুধ প্রতিদিন ৪০ টকা লিটারে বাজারে বিক্রি করছেন। দল থেকে যে ৯০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন সেই টাকাও ইতিমধ্যে তিনি পোল্ট্রি ফার্ম ছাগল ফার্ম ও ধান বিক্রয় করে যে আয় হচ্ছে তা দিয়ে পরিশোধ করেছেন। ছায়া দাস গর্ব করে জানালেন, এখন আমি স্বনির্ভর। ছেলেকেও উপযুক্তভাবে গড়ে তোলার জন্য ৮২ মাইল নবোদয় স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। সে এখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ছে। আমার এই সাফল্যের পেছনে আমার পরিবার, মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই মানসিকভাবে আমাকে সাহস যুগিয়েছে। তাই আমি সফল হতে পেরেছি।

কমলপুর মহকুমার চুলুবাড়ির ছায়া দাস আজ নারীর আপন ভাগ জয় করে স্বমহিমায় উজ্জ্বল এক অনুপ্রেরণার নাম। তিনি এখন দুর্গাচৌমুহনি ব্লক এলাকায় নানা সমাজসেবার কাজেও যুক্ত হয়েছেন। তিনি এখন ফুলবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের স্বচ্ছগ্রাহী। স্বচ্ছ ভারত মিশনে গ্রামে গ্রামে সামাজিক সচেতনতা তৈরি করার কাজে যুক্ত রয়েছেন।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.