"আমি আলাদা করে ‘ত্রিপুরার বাংলা সাহিত্য’ নামক কোনও প্রকোষ্ঠে বিশ্বাস করি না। সেজন্যে আমি বলি ‘ত্রিপুরায় বাংলা সাহিত্য’।"

সৌম্যদীপ দেব

সাহিত্যিক শ্যামল ভট্টাচার্যে'র সাথে মুখোমুখি আলাপচারিতায় আলোচক সৌম্যদীপ দেব

সৌম্য: অসংখ্য সাময়িক পত্র থেকে শুরু করে মুখপত্র, এমনকি কিছু লিটল ম্যাগাজিনের বিশেষ সংখ্যা আপনার সম্পাদিত। - এই বিষয়টি নিয়ে কি বলবেন?

শ্যা. ভ. : পেশায় সাংবাদিক হওয়ার আগে আমার প্রায় তিন দশকের সাহিত্যচর্চা মূলত লিটল ম্যাগাজিনেই, ভারতের যে প্রান্তেই গেছি একটি করে বাংলা লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করেছি, রাজস্থান থেকে ‘সূর্যনগরী’, হিমাচল প্রদেশ থেকে ‘পাহাড়ি’,কর্ণাটক থেকে ‘মৃত্তিকা’, কিম্বা লাদাখ থেকে ‘হিমযামিনী’, এগুলি আমাকে একজন সাহিত্যিক হিসেবে বেঁচে থাকতে এবং নিজেকে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। তাছাড়া আগরতলা ও কলকাতা থেকে একযোগে প্রকাশিত ‘মুখাবয়ব’ এর সহযোগী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করি ১৯৯৯ থেকে। যেসব লিটল ম্যাগাজিনের বিশেষ সংখ্যা সম্পাদনা করেছি সেগুলি হল, কলকাতার ‘আরাত্রিক’, কৈলাসহরের ‘উন্মেষ’, কোচবিহারের ‘চিত্রকল্প’, রাঁচি থেকে প্রকাশিত অঙ্গিকা ভাষার পত্রিকা ‘নয়া হস্তক্ষেপ’ ইত্যাদি - সব ভালবেসে করেছি কোনও পারিশ্রমিক ছাড়াই। আর সরকারি- বেসরকারি যেসব সাময়িক পত্র, সংবাদপত্র বা মুখপত্র গত ১১ বছরে সম্পাদনা করেছি বা এখনও করে চলেছি সেগুলি সম্পূর্ণই অর্থ উপার্জনের জন্য। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই লাভ হয়েছে নিয়মিত নিজের ভাষা ও প্রতিবেশী সাহিত্য পাঠের সুযোগ। আকাশবাণী, দূরদর্শন ও অন্যান্য বৈদ্যুতিন মাধ্যমে, দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন বইমেলা, সাহিত্য সভা ও নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনারে ও রিফ্রেশার কোর্সে সাক্ষাৎকার ও বক্তব্য রাখার সুযোগ হয়েছে। অনেক লেখক ও বইপ্রেমিদের সান্নিধ্যে এসেছি। সব মিলিয়ে এটা একটা আনন্দ সফর।

সৌম্য : ত্রিপুরার বাংলা সাহিত্য দীর্ঘপথ অতিক্রম করে এখন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে । এখানকার তরুণ প্রজন্ম সাহিত্যের বাতিঘরকে কতটা সাফল্য দেবে বলে আপনি মনে করেন?

শ্যা. ভ. : কোথাও দাঁড়ায়নি, ছুটছে। আমি আলাদা করে ‘ত্রিপুরার বাংলা সাহিত্য’ নামক কোনও প্রকোষ্ঠে বিশ্বাস করি না। সেজন্যে আমি বলি ‘ত্রিপুরায় বাংলা সাহিত্য’। ত্রিপুরায় বাংলা সাহিত্য প্রতিদিন তাঁর দিগন্ত প্রসারিত করছে, একজন নিয়মিত পাঠক হিসেবে বলতে পারি নতুন লেখকরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন মাত্রা যোগ করছেন। আমি তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে আশাবাদী। পাশাপাশি, ত্রিপুরায় ইংরেজি, ককবরক, চাকমা ও মণিপুরী ভাষায় নবীন প্রজন্ম অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। অনলাইন ও অফলাইন মিলিয়ে পাঠকের সংখ্যাও অনেক বেড়েছে।

সৌম্য : অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে কাজের ক্ষেত্রে শ্যামল ভট্টাচার্য এক অগ্রণী নাম। আপনার অনুবাদ সাহিত্যের বিভিন্ন কাজ দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও সমান আলোচিত। আগামীদিনে অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে আপনার কি পরিকল্পনা রয়েছে?

শ্যা.ভ. : পরিকল্পনা নেই। প্রধানমন্ত্রী দপ্তরের দৈনন্দিন সরকারি অনুবাদ ছাড়াও প্রচুর কাজ আমার টেবিলে, যেমন ‘গুরু নানকের বাণী’, দুটো পাঞ্জাবী উপন্যাস, দুটো শিশুপাঠ্য গ্রন্থ, এগুলি শেষ করতে বছর পাঁচেক লাগবে। তারপর কোনও লেখা পড়ে খুব অনুপ্রাণিত না হলে আর অনুবাদ করবো না। নিজের লেখা লিখবো।

সৌম্য : বিদেশ ভ্রমণের বিশাল অভিজ্ঞতা আপনার। কোনো জায়গার আবেগ কি আপনাকে এখনো তাড়িত করে? কখনো সুযোগ হলে কোথায় আবার যেতে চাইবেন?

শ্যা.ভ. : সব জায়গায় যেতে চাইবো, বিশেষ করে ভূটান আমার খুব ভালো লাগে, তাছাড়া নেপাল, চীন, মঙ্গোলিয়া তিব্বত,শ্রীলঙ্কা, ইরান, মিশর, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কিম্বা বাংলাদেশ। আবেগের সম্পর্ক বাংলাদেশের সঙ্গেই বেশি, অনেক বন্ধুবান্ধব, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও সাধারণ পাঠকের সঙ্গে হৃদ্যতার সম্পর্ক রয়েছে। আফ্রিকার কোনও দেশে যাইনি, আরব দেশগুলিতেও যাইনি, যাইনি মধ্য ইউরোপেও। মূল ইউরোপ –আমেরিকা নিয়ে আমার তেমন আবেগ নেই। কিন্তু কানাডা নিয়ে আছে, লাতিন আমেরিকার দেশগুলি নিয়ে আছে, গ্রিনল্যান্ড নিয়ে আছে। আর যে কোনও দ্বীপরাস্ট্র আমার প্রিয় যেমন, মালদ্বীপ, সেশেলস, শ্রীলঙ্কা – সেসব জায়গায় আমি বারবার যেতে চাই।

সৌম্য : জনপ্রিয় ও সিরিয়াস সাহিত্য সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?

শ্যা.ভ. : প্রায় সব মেজর ভাষার সাহিত্যেই একটি জনপ্রিয় আর একটি ধ্রুপদী ধারা থাকে। আমার কাছে দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ পাঠককে সাহিত্যের প্রতি আকর্ষিত করতে জনপ্রিয় সাহিত্যের জুড়ি নেই। আর যিনি একবার সাহিত্যের আনন্দ নিতে শুরু করবেন, বোধের গভীরে যেতে শুরু করবেন, তিনি ক্রমে ধ্রুপদী সাহিত্যের পথে হাঁটবেন।

সৌম্য : 'বুখারী ', 'লোদ্রভার কাছাকাছি ', 'দীপান্তরে ফুল ফুটেছে ', 'বাঞ্ছা কল্পতরু ', 'খুবানীর ফলন ', 'মহাসত্যের বিপরীতে ' ( অসমাপ্ত উপন্যাস) - প্রত্যেকটি উপন্যাসেই আপনি কাহিনির বয়নে এক অভিনবত্ব এনেছেন । যেটা অনেকটা গ্রামবাংলার মৌখিক গল্পের কথ্য ভাষার রীতি। - এর পেছনে কোন ভাবনা কাজ করেছে?

শ্যা.ভ. : কোনও ভাবনা কাজ করেনি, এটাই আমার লেখার ধরণ। প্রাকৃতিক ভাবেই এটা গড়ে উঠেছে। আমার ছোটবেলায় গল্প শুনিয়ে ভাত খাওয়ানোর জন্য আমার দিদিমা ও মামাদের ভূমিকা অপরিসীম। আমি সৌভাগ্যবান। তাঁদেরও উপকার হয়েছে। স্নায়ুবিজ্ঞানীরা মনে করেন, গল্প বলার মাধ্যমে আমাদের মস্তিষ্কের বিভিন্ন কোষ জেগে ওঠে। এবং অনেক ক্ষেত্রেই শ্রোতা গল্পটিকে নিজের অভিজ্ঞতা, নিজের ভাবনা দিয়ে একেবারে নিজের অংশ বানিয়ে নেয়। মানে, একেবারে মন- বাক্সের ভেতরের খোপে গল্পটি অবলীলায় ঢুকে যায়। যে শিশুর জীবনে গল্প শোনানোর কেউ নেই সে অভাগা। আমরা যখন গল্প শুনি তখন ডোপামিন, অক্সিটোসিনের মতো রাসায়নিক নির্গত হয়। ডোপামিন আমাদের কাজ করার ইচ্ছাশক্তি বাড়িয়ে তোলে। আমাদের করে আরও মনোযোগী। অন্য দিকে অক্সিটোসিনের মতো রাসায়নিক একজনকে করে তোলে আরও সংবেদনশীল। আরও সহমর্মী। অর্থাৎ গল্পটির সঙ্গে শ্রোতা খুব সহজেই একাত্ম হয়ে যায় এবং ব্যক্তিগতভাবে জড়িয়ে পড়ে গল্পের ঘটনাগুলোর সঙ্গে। গল্প শিশুদের মধ্যে মায়া, মমতা, স্নেহ, ভালবাসা, বিবেক ও প্রকৃতিপ্রেম জাগায়। একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা ছেলেমেয়েকে শুধুই কেরিয়ারের পেছনে না ছুটিয়ে গল্পও শোনান, তাঁদেরকে খুব কম ক্ষেত্রেই বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে থাকতে হয়। আরেকটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, কবিদের তুলনায় গল্পকারদের বেশি পড়াশোনা এবং পরিশ্রম করতে হলেও তাঁদের গড় আয়ু কবিদের থেকে বেশি। আর আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, দেশজ উপাদান, প্রবাদ, প্রবচন ইত্যাদির ব্যবহার লেখককে পাঠকদের অনেক কাছে নিয়ে যেতে পারে। সেজন্যে আমি কোনও বিদেশি শৈলী অবলম্বন না করে আমাদের চিরায়ত পরস্তাবের ‘আমপাতা জোড়া জোড়া কাঠালপাতা জোড়া…’ শৈলী রপ্ত করেছি।

সৌম্য : বাংলা সাহিত্যের সাম্প্রতিক কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে কার কার লেখা ভালোলাগে আপনার?

শ্যা.ভ. : দীর্ঘ তালিকা, শুধু অগ্রজদের নাম উল্লেখ করছি, সমসাময়িকদের কথা পরে বলা যাবে। হাসান আজিজুল হক, বানী বসু, সাধন চট্টোপাধ্যায়, ভগীরথ মিশ্র, অভিজিৎ সেন, রামকুমার মুখোপাধ্যায়, সেলিনা হোসেন, নলিনী বেরা, ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, কিন্নর রায়, অমর মিত্র, নলিনী বেরা, মিথিলেশ ভট্টাচার্য, দেবীপ্রসাদ সিংহ, দুলাল ঘোষ, দেবব্রত দেব, কিশোর রঞ্জন দে, রণবীর পুরকায়স্থ, অনীতা অগ্নিহোত্রী, অজিত রায়, কুমার অজিত দত্ত, অমর মিত্র, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, অনুপ ভট্টাচার্য, সমরজিৎ সিংহ, শুভঙ্কর গুহ, সুরঞ্জন প্রামাণিক, স্বপন সেন, মনোরঞ্জন ব্যাপারী, সদানন্দ সিংহ, অলোক গোস্বামী – এরকম অনেকের নামই করতে হয়।

সৌম্য: সাহিত্য মনের বাতিঘর। সংকীর্ণতার বাইরে গিয়ে মুক্তি চেতনার প্রসারক। - তবুও কিছু কিছু সাহিত্য পাঠে এমন কেনো মনে হয় সাহিত্য ও সাহিত্যিক দুই মেরুর বাসিন্দা- এর জন্য কাকে দায়ী করবেন আপনি?

শ্যা.ভ. : আসলে সাহিত্যিকরা তাই লেখেন যা তাঁরা দেখতে চান,করতে চান বা হতে চান। বাড়িতে বাবা নিজে ধুমপায়ী হয়েও যেমন ছেলেকে ধূমপানের অপকারিতা বোঝান, আর নিজেও একদিন ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবেন। লেখক নিজে যেহেতু একজন রক্তমাংসের মানুষ তাই তিনিও লোভ লালসা কাম রিরংসা মাৎসর্য থেকে অনেক সময় উর্ধে উঠতে পারেন না। কিন্তু নিজে যেটা আদর্শ বলে ভাবেন, লেখার সময় সেটাই রচনা করতে চান। লেখক নিজে যত তাঁর স্বপ্নের কাছাকাছি নিজের চরিত্রকে নিয়ে যেতে পারবেন ততই এই ব্যবধান কমবে। তাই এর জন্যে আমি মনের জোরের অভাবকে দায়ী করবো।

সৌম্য : "জীবনের কাছে ঠিক মতো চাইলে সব পাওয়া যায়। " - কথাটা কি আপনি বিশ্বাস করেন?

শ্যা.ভ. : হ্যাঁ, বিশ্বাস করি,। সৎভাবে চাইলে আর তা পেতে কঠোর পরিশ্রম করলে পাওয়া যায়। আমি বারবার পেয়েছি।

সৌম্য : ত্রিপুরায় সফল উপন্যাসের প্রকাশ খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। তবে উপন্যাস শিল্প এখানে বহু দশক পার করেছে। ত্রিপুরার উপন্যাস কি সফল পাটাতন লাভ করতে পেরেছে - আপনার অভিমত কি?

শ্যা.ভ. : হ্যাঁ, পেরেছে। স্বাধীন ভারতে যোগদানের পর লেখা ত্রিপুরার কয়েকটি উপন্যাসকে আমি মাইলফলক মনে করি। বিমল সিংহের বাংলা উপন্যাস ‘লংতরাই’, সুধন্বা দেববর্মার ককবরক উপন্যাস ‘হাচুক খুরিঅ ’, নন্দকুমার দেববর্মার ‘ঠিকানা কিরাতভূমি’, ভীষ্মদেব ভট্টাচার্যের 'অগরুগন্ধা’, দুলাল ঘোষের ‘অগ্নিসূত্র’, দীপক দেবের ‘রক্তমাংসের শরীর’, সমরজিত সিংহের ‘আলান’, ‘ট্রা রা রা রা’ এবং ‘অন্তর্জল কথা’, প্রদীপ সরকারের ‘তবুও মানুষ’, ‘ অন্য পুরুষ’ ও ‘ জন জীবন যুদ্ধ’, জয়া গোয়ালার ‘দেয়াল’, তবুও মাদল বাজে’, ‘এই সীমান্তে’, ‘তুমি এসো সখা’ও ‘মুর্গাঝুটির লাল ধুল’, হরিভূষণ পালের ‘অচিন বৃক্ষ’ পল্লব ভট্টাচার্যের ‘কমলিনী উপাখ্যান’, অশোক দেবের’সদাপুরাণ’, শংখশুভ্র দেববর্মণের ‘আগরতলা আনলিমিটেড’, সুতপা দাসের ‘সোনার দুয়ারী ঘর রূপার দুয়ারী ঘর’, হারাধন বৈরাগীর ‘খুম্পুই থেকে সিকামনুকতাই’ পদ্মশ্রী মজুমদারের ‘দেও নদীর জল’, তাছাড়া মাধুরী লোধের ‘শান্তবালা হাসে’, শ্যামল বৈদ্যের ‘বুনোগাঙের চর’ পরবর্তী দুটি উপন্যাসও বেশ ভালো বলে শুনেছি, আমি পড়িনি। বিমল চক্রবর্তীর কাছে শুনেছি ত্রিপুরা থেকে এযাবৎ প্রকাশিত মোট উপন্যাসের সংখ্যা ১৬০ টিরও বেশি। এগুলির মধ্যে অনেক উপন্যাসই আমি পড়িনি।

সৌম্য : " সাহিত্যিক যতটা ভূগোল মুক্ত হবেন, ততটা আন্তর্জাতিকতায় উন্নীত হবেন। " তাই বলে কি লেখকের লেখায় স্থান - কাল গৌণ রূপে উদ্ভাসিত হবে! লেখক এবং তাঁর ভূগোল চেতনা কিভাবে দেখেন আপনি?

শ্যা.ভ. : ভূগোলে যুক্ত থেকেও আন্তর্জাতিক হওয়া যায়। পোস্ট মর্ডান থিওরির নানা ব্যাখ্যা রয়েছে, কিন্তু সব ক্ষেত্রেই মূল ভিত্তি হল লেখকের শিকড় থাকবে তাঁর সংস্কৃতির মাটির গভীরে, নিজস্ব ভূগোলে সম্পৃক্ত, আর মনন হবে ডালপালার মতন অসীম আকাশে, মস্তিষ্কে থাকবে ব্রহ্মাণ্ড। মানুষকে ভালবাসলে, পরিবেশ ও প্রকৃতিকে ভালবাসলে বিশ্বের যে কোনও অঞ্চলকেই মননের ভূগোলে জুড়ে নেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে আমার মতন গড়ানো পাথরেও অনেক শৈবাল জন্মাতে পারে।

সৌম্য : সাহিত্যে সমসাময়িক রাজনীতি কতটা উপেক্ষিত ও আবর্তিত হয় বলে মনে করেন?

শ্যা.ভ. : সাহিত্য যেহেতু সবসময় রিপোর্তাজ নয়, তাই কথাসাহিত্যে সমসাময়িক রাজনীতি কিছুটা উপেক্ষিত থাকে। আর বর্তমানকে বিশ্লেষণ করার মতন প্রজ্ঞাও সব লেখকের থাকে না। তবে কবিতায় ও প্রবন্ধ সাহিত্যে কিন্তু সমসাময়িক রাজনীতি অনেকটাই গুরুত্ব পায়। বিশেষ করে সংবাদপত্রের উত্তর সম্পাদকীয়গুলিতে কিন্তু উঠে আসছে এলিট বাঙালির মনোবিশ্লেষণ, শিক্ষাজগতে বিকল্প চিন্তার অভাব, বংশসংস্কৃতি, হিন্দুত্বের আজকাল, বামপন্থার ট্র্যাজিকমেডি, সংকীর্ণতা ও মুক্তির পথ, রবীন্দ্রনাথ- নজরুল সম্পর্কে দ্বিচারিতা, নতুন প্রজন্মের আত্মকেন্দ্রিকতা, নগ্নতা ও যৌনতা বিষয়ে মধ্যবিত্তের অসহায়তা, পরিবেশ সম্পর্কে উদাসীনতা, সবই ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব ও মনোসমীক্ষার আতসকাচের নীচে রেখে দেখছেন লেখকরা - এগুলিও তো সাহিত্যই – সংবাদ সাহিত্য!

সৌম্য : " যে স্থানে সমালোচনা সাহিত্য গড়ে উঠে না, সেখানে মৌলিক সাহিত্যের দুর্বলতা নিরসনের পথ অনুসন্ধান বৃথা। " - আপনি নিজেও সমালোচনা সাহিত্য নিয়ে কিছু বিক্ষিপ্ত কাজ করেছেন একসময়। ত্রিপুরার সমালোচনা সাহিত্যের গতিপথ নিয়ে কি বলবেন?

শ্যা.ভ. : ত্রিপুরায় প্রকৃত সমালোচনা সাহিত্য এখনও কৈশোরাবস্থায় থাকার মূল কারণ হল প্রকাশনা শিল্পের দেরিতে বিকাশ হওয়া। ত্রিপুরায় এ যাবৎ প্রকাশিত মোট ৯৮% গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে বইমেলা শুরু হওয়া ও অফসেট প্রিন্টিং শুরু হওয়ার পর গত ত্রিশ চল্লিশ বছরে। আর এ রাজ্যে অধিকাংশ সমালোচকই কলম ধরেন খেলনার ঘাড় নাড়া চীনা বুড়োর মতন, কোনও লেখার প্রশংসা বা অল্পকিছু ক্ষেত্রে নিন্দা করে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা মেটাতে। কিন্তু কয়েকজনের নাম উল্লেখ না করলেই নয়, যারা বিংশ শতাব্দীর পাঁচের দশক থেকে বিভিন্ন সময়ে ত্রিপুরায় বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের সলতে পাকিয়েছেন। তাঁরা হলেন নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ড. সচ্চিদানন্দ ধর,ড. নীলমাধব সেন, হীরেন্দ্রনাথ নন্দী, রণেন্দ্রনাথ দে,সলিলকৃষ্ণ দেববর্মণ, কার্তিক লাহিড়ী, সোমেন্দ্রনাথ বসু, দীনেশ চন্দ্র দাস, বিজনকৃষ্ণ চৌধুরী, অমিয় মুকুল দে, বাণীকন্ঠ ভট্টাচার্য, মোহিত পুরকায়স্থ, পূর্ণেন্দু প্রসাদ চক্রবর্তী, রমাপ্রসাদ দত্ত(পল্টুদা), ব্রজগোপাল রায়, জলধর মল্লিক, অপরাজিতা রায়, ড. শিশির কুমার সিংহ, কল্যাণব্রত চক্রবর্তী, ঋতেন চক্রবর্তী, ড. সিরাজুদ্দীন আহমেদ, ড. মঞ্জরী চৌধুরী, স্বপন সেনগুপ্ত, বিকচ চৌধুরী, ড. আশিস কুমার বৈদ্য, ড. দেবব্রত দেবরায়, ড. নির্মল কুমার দাশ ও ড. গীতা দেবনাথ। উপরোক্ত অনেকে আজও মাঝেমধ্যে পুস্তক সমালোচনা করেন। এদের মধ্যেও কেউ কেউ যে ব্যক্তিবিশেষের বই নিয়ে লিখতে গিয়ে ফেসবুকের পোস্ট হিউম্যান বিশ্বের মতন ধরি মাছ না ছুঁই পানি মানসিকতার বৈপরীত্য ও চতুরতার নগ্নতম প্রকাশ ঘটান নি তা নিজেরা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন না। এই সময়ে আমার প্রিয়তম সমালোচনা সাহিত্যিকদের নাম যদি জিজ্ঞেস করো, তাহলে বলবো সেলিম মুস্তাফা, কিশোর রঞ্জন দে, সমরজিৎ সিংহ, পল্লব ভট্টাচার্য, শুভাশিস তলাপাত্র, বিমল চক্রবর্তী, প্রবুদ্ধসুন্দর কর, তমালশেখর দে, স্বাতী ইন্দু, অভিজিৎ চক্রবর্তী, অলক দাশগুপ্ত, পারিজাত দত্ত, মঞ্জু দাশ, ড.পরমাশ্রী দাশগুপ্ত, ড.রিন্টু দাস, সুস্মিতা দাস, সেবিকা ধর ও সৌম্যদীপ দেব ।

সৌম্য : লেখক শ্যামল ভট্টাচার্যের পাঠক নতুন কি পেতে চলেছে যদি একটু বলেন।

শ্যা.ভ. : আপাতত ‘মহাসত্যের বিপরীতে' শেষ করতে আরও বছরখানেক লেগে যাবে। এর ফাঁকে কিছু গল্প আর শিশুকিশোরদের জন্য বেশ কিছু লেখা আমার মাথায় আছে।

সৌম্য : বর্তমান সময়ে বাংলা সাহিত্যে জীবনী মূলক উপন্যাস লেখার একটা বিশাল প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অবশ্য ত্রিপুরায় তা সেভাবে লক্ষণীয় নয়। - আপনি কি ভাবছেন লিখবেন?

শ্যা.ভ. : না, তবে আমার ‘মহাসত্যের বিপরীতে’ তে দালাই লামা ও মাও জে দং এর জীবন ও দর্শনের দ্বন্দ্ব প্রবলভাবে থাকছে।

সৌম্য : আপনার কাছে শেষ প্রশ্ন ত্রিপুরায় এই সময়ের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে কাঁদের লেখা ভালো লাগে? কাঁদের লেখা পড়ে আপনি ভাবিত হন? কাঁদের লেখা আরো পড়তে চাইবেন?

শ্যা.ভ. : অশোক দেব, পদ্মশ্রী মজুমদার, অলক দাশগুপ্ত, সত্যজিৎ দত্ত, পুলকেন্দু চক্রবর্তী, পারিজাত দত্ত, সুতপা দাস ও শ্যামল বৈদ্য। সম্প্রতি প্রবুদ্ধসুন্দর ‘নীল উপত্যকার রাখাল’ লিখছে। এটাও ভাল লাগছে। আরও নবীনদের মধ্যে সৌরভ চক্রবর্তী ও বিভাবসু দে'র লেখা কল্পবিজ্ঞান ও থ্রিলার বেশ ভালো লাগে।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
মন্তব্যের তারিখ (Posted On)মন্তব্যকারির নাম (Name)মন্তব্য (Comment)
02.02.2022মানিক বৈরাগীদীর্ঘ সাক্ষাৎকার টি ভালো লেগেছে।
30.06.2021Shyamal BhattacharyaThanks to Saumyadeep and Tripurainfo.com