আত্মনির্ভর ত্রিপুরার দিশা দেখাচ্ছে আগর চাষ, আগর বাণিজ্যিকীকরণে বিশেষ উদ্যোগ বন দপ্তরের
রোমেল চাকমা
আগর একটি অত্যন্ত অর্থকরী ও লাভজনক বনজ সম্পদ। ছোট থেকে বড় সকলেই পরিচিত এই নামটির সাথে। কারণ ছোট থেকেই এই সুগন্ধী দ্রব্যের সাথে কমবেশি সবাই পরিচিত অমরা। আগর চাষ কতটা লাভজনক সে সম্পর্কে কিছুদিন আগ পর্যন্ত কোনও ধারণাই ছিলো না। আগর একপ্রকারের সুগন্ধী উদ্ভিদ। এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘একুইলারিয়া মালাসেনসিস'। দেশের বাজার ছাড়াও বহির্বিশ্বের বাজারেও আগরের চাহিদা রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বহু মূল্যে বিক্রি হয় আগর গাছের কাঠ ও তেল। উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরাতেও আশা জাগিয়ে বিগত কয়েক বছর ধরে আগর চাষ হচ্ছে। রাজ্য বন দপ্তরও আগর চাষের জন্য কৃষকদের বিশেষভাবে উৎসাহিত করছে। ‘ঘর ঘর আগর হর ঘর আগর’ আগামী বনমহোৎসবে এই থিম নিয়েছে রাজ্য বন দপ্তর। আর এই শ্লোগানের মধ্য দিয়েই আগর চাষকে রাজ্যবাসীর কাছে পৌঁছে দিতে চাইছে বন দপ্তর। এই মুহূর্তে রাজ্যে আগর উৎপাদন অর্থাৎ আগর চাষের ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে উত্তর জেলার কদমতলা ব্লক এলাকা। এর পাশাপাশি ভালো পরিমাণে আগর চাষ হচ্ছে উনকোটি জেলার কৈলাসহর মহকুমা এলাকায়। যা আগামীতে ত্রিপুরার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নয়নে নয়া দিশা নিয়ে এসেছে। প্রশাসনিক স্তরেও আগর চাষে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব রাজ্যে আগর চাষের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আগর চাষের জন্য মানুষকে উৎসাহিত করছেন। মুখ্যমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেছেন আগামী কয়েক বছরের মধ্যে রাজ্যে আগর চাষের মাধ্যমে ২ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভাবনার অধিকাংশটাই আসবে উত্তর ত্রিপুরা জেলা ও উনকোটি জেলা থেকে। বন দপ্তর সূত্রে জানা যায়, আগরের বাণিজ্যিকীকরণের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে রাজ্য সরকারের তরফে কেন্দ্রের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। আগর একটি মাঝারি মাপের চিরহরিৎ বৃক্ষ। এই গাছের উচ্চতা সাধারনত ৬০ থেকে ৮০ ফুট হয়ে থাকে। ভারত ছাড়াও আগরের উৎপাদন হয় বাংলাদেশ, ভূটান, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ইরান, লাওস সহ কিছু রাষ্ট্রে।
ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্য ত্রিপুরাতেও দঘি বছর ধরে আগর চাষ হচ্ছে। কিন্তু আগে প্রশাসনিক স্তরে আগর উৎপাদনে তেমন একটা ফলপ্রসূ উদ্যোগ না নেওয়ায় আগর চাষে বিশেষ গতি আসেনি। তবে বর্তমান সরকার যথাযথ উদ্যোগ নিয়ে আরও বেশি মাত্রায় আগর চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করে চলছে। এই প্রক্রিয়ায় রাজ্য বন দপ্তরের আধিকারিকগণ বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে আগর চাষকে অধিক মাত্রায় নিয়ে যেতে সচেষ্ট রয়েছেন। বিশেষ করে আগর কাঠ এবং আগর তেল বহুমূল্য হওয়ায় বন দপ্তরের আইনে বেশকিছু নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আর সেই আইনকে সরলীকরণের মাধ্যমে আগরকে এক লাভজনক ব্যবসায় রূপান্তরিত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বন দপ্তর ও প্রশাসন। প্রাচীনকাল থেকেই আগর খুবই সুগন্ধী দ্রব্য ও শরীরের শক্তি বৃদ্ধিকারী বলে। মনে করা হয়। আদি চিকিৎসা পদ্ধতিতে শরীরের বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের জন্য আগর কাঠের প্রচলন রয়েছে। এর পাশাপাশি মূত্রবর্ধক, কোষ্ঠ্য পরিষ্কারক হিসেবেও এর ব্যবহার রয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন রোগ যেমন হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস, বাত উপশমেও আগরের উপকারিতা রয়েছে। আগর গাছের তেল বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হওয়ায় এটি ধর্মীয় ও সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হয়। আগর গাছের নির্যাস থেকে উৎপাদিত সুগন্ধী স্যাম্পু, সাবান ও অন্যান্য প্রসাধন সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
বন দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, বর্তমানে রাজ্যে ৫৫ লক্ষ আগর গাছ রয়েছে। এরমধ্যে প্রায় ৯৫ শতাংশই ব্যক্তিগত মালিকানাধীন বাগান। বন দপ্তরের পক্ষ থেকে আগর চাষীদের বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে। মূলত, আগর গাছ পূর্ণতা পাওয়ার পর একে কাটা এবং বাজারজাত করার জন্য যে সকল আইনি বাঁধা বা বেড়াজাল রয়েছে সেটা কাটিয়ে উঠার জন্য লাগাতর প্রচেষ্টা জারি রেখেছেন বন দপ্তরের আধিকারিকগণ। এই মুহূর্তে রাজ্যে অনেকেই আগর চাষে এগিয়ে আসছেন। পাশাপাশি আগর চাষ এবং আগর উৎপাদন প্রক্রিয়াকে আরও উৎসাহিত ও ত্বরান্বিত করার জন্য রাজ্য প্রশাসন ত্রিপুরা আগর বোর্ড’ নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়া ত্রিপুরা আগর উড পলিসি ২০২১' নামে একটি খসড়া প্রস্তাব প্রকাশ করেছে বন দপ্তর। আর এই প্রস্তাবিত পলিসি পাশ হওয়া আপাতত সময়ের অপেক্ষা মাত্র। এরমধ্য দিয়ে আগর চাষী বা আগর উৎপাদকরা বিভিন্নভাবে আরও বেশকিছু সুবিধা পাবেন। বর্তমান রাজ্য সরকার আগর চাষকে বিশেষভাবে অগ্রাধিকার দিয়ে কৃষকদের আর্থসামাজিক ব্যবস্থার মানোন্নয়নে সচেষ্ট রয়েছে। এই লক্ষ্যে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে আগর চাষ ও আগর বাজারজাতকরণের প্রক্রিয়াকে বৈধতা দিতে চলেছে প্রশাসন। বন দপ্তর সূত্রে জানা যায়, উত্তর জেলার ৬ জন আগরচাষীকে ইতিমধ্যে লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে। আরও বেশ কয়েকজনকে লাইসেন্স প্রদানের প্রক্রিয়া চলছে।
আগে রাজ্যের আগরচাষীদের আগর উৎপাদন ও বাজারজাত করা নিয়ে অনেক আইনি ঝামেলা পোহাতে হত। বিশেষ করে সরকারিভাবে আগর বিক্রির জন্য কোনও বৈধ কাজ না থাকাতে অধিকাংশ আগর সামগ্রী বাঁকা পথে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলে যেতো। এরমধ্যে কিছু আগর আবার মহাজনের হাত ধরে সুদূর মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও চলে যেতো। আর ত্রিপুরার উৎপাদিত আগরের একটা সিংহভাগ চলে যেতো আসামের হোজাই মার্কেটে। এতে ত্রিপুরা সরকারের রাজস্ব ক্ষেত্রে যেমন ক্ষতি হতো তেমন আগর'চাষীরা বঞ্চিত হতেন তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে। এসকল কারণেই বতমন রাজ্য সরকার আগর উৎপাদন ও বিক্রিকে আইনি বৈধতার মধ্যে এনে কষকদের মুখে হাসি ফোটানোর নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বন দর সূত্রে আরও জানা যায়, আগর থেকে উৎপাদিত তেলের মূল্য কেজি প্রতি ৪-৫ লক্ষ টাকা। যা প্রকার ভেদে বা গুণমানের বিচারে কেজি প্রতি ২৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত পৌছায়। আর এই আগর থেকেই সুগন্ধী ধূপকাঠি সহ বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী উৎপাদিত হয়। বর্তমানে রাজ্যে আগরের উপর নির্ভর করে কয়েক হাজার পরিবারের জীবন জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে।