বেঁচে থাকতে মরন প্রায়ই বলতো যদি পারেন ব্যাবস্হাটাকে পাল্টান !

পুরুষোত্তম রায় বর্মন

পরিচয় খুব বেশিদিনের নয়। ২০১৯ সনের প্রথমদিকে পরিচয়। লম্বা চেহারা । গায়ের রং কালো। পরিশ্রমী শরীর। পৌরনিগমে ডি আর ডব্লিউ হিসেবে কর্মরত দীর্ঘদিন ধরে। ২রা এপ্রিল ১৯৯৮ সনে ডি আর ডব্লিউ হিসেবে কাজে যোগদান। স্বল্প মজুরির অনিয়মিত কর্মচারী। কাঁধে সংসার প্রতিপালনের দায়িত্ব। স্ত্রী, এক ছেলে। ক্লাস নাইন অব্দি উঠে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। মেয়ে দশম শ্রেণীতে পাঠরত। বৃদ্ধা মা। সবার দায়িত্ব মরন দাসের কাঁধে। ২০০৮ - ০৯ সনে সরকার ঘোষণা করে, দশ বছর মেয়াদ অতিক্রম করলে সব ধরনের অনিয়মিত কর্মচারীকে নিয়মিত করা হবে। সেই অনুযায়ী মরণ দাসেরও চাকুরীতে নিয়মিত হওয়ার কথা ২০০৯ সন থেকে। কিন্তু ঘোষিত নীতির সুফল মরণ দাস পায়নি। যদিও মরণ দাসের মতো শত শত অনিয়মিত কর্মচারী চাকুরীতে নিয়মিত হয়েছেন। আগরতলা পুরনিগমের অনেক অনিয়মিত কর্মচারী চাকুরীতে নিয়মিত হয়েছে । কিন্তু মরণ দাসের ক্ষেত্রে কতৃপক্ষ বড়ই অবিবেচক। সামান্য আয়ে সংসার চলে না। তাই ডিউটির বাইরে রিকশা চালানো, গাছ কাটা, কুয়ো খনন করা ইত্যাদি। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বাড়তি রোজগার করা। পরিবারের সদস্যদের একটু স্বচ্ছন্দ রাখার বিরামহীন চেষ্টা। ২০১৯ এর মার্চ মাসে মরণ দাস রিট মামলা দায়ের করে চাকুরী নিয়মিতকরনের আর্জি নিয়ে। মামলায় আগরতলা পৌরনিগম অদ্ভুত বক্তব্য রাখেন। স্বীকার করে মরণ দাস ২রা এপ্রিল ১৯৯৮ থেকে ডি আর ডব্লিউ হিসেবে কর্মরত। কিন্তু তার জন্ম তারিখ ২৪.০৭.১৯৮৪ হওয়াতে কাজে যোগদানের সময় তার বয়স হয়েছিল ১৪ বছর থেকে কিছুটা কম। তাই তার সার্ভিসকে 'বয়' সার্ভিস হিসেবে ট্রিট করার আর্জি জানায় পুরনিগম। বিজেপি শাসিত পুর নিগম নয়। বাম শাসিত পুরনিগমের এই বক্তব্য। এই বক্তব্যের উপর ভিত্তি করেই উচ্চ আদালতে সওয়াল করেন পুর নিগমের বামপন্থী আইনজীবী। কোনভাবেই মরণ দাসকে নিয়মিত করা যাবে না। যদিও পূর্বে পুরনিগম নগর উন্নয়ন দপ্তরের কাছে মরন দাসকে নিয়মিত করার জন্য সুপারিশ করেছিল । কিন্তু সেই সুপারিশের মাথা খেয়ে আদালতে পুরনিগমের ডিগবাজি। যাইহোক উচ্চ আদালত ২৬ শে জুন ২০১৯ সনে প্রদত্ত রায়ে মরন দাসের চাকুরী নিয়মিত করার জন্য পুরো নিগমকে ইতিবাচক বিবেচনার নির্দেশ দেয়। রায় পেয়ে মরণ দাস খুশিতে দিন গুনতে শুরু করে। বোধহয় সুদিন আসবে। তিন মাসের মধ্যে রায় কার্যকর করার নির্দেশ অপেক্ষার প্রহর গণনা। কিন্তু আদালতের সদর্থক নির্দেশ সত্ত্বেও পুরনিগম মরন দাসের চাকুরী নিয়মিত করেনি। আশার প্রদীপ টিমটিম করে জ্বলতে জ্বলতে নিভে যায়। কত আর লড়া যায় হৃদয়হীন পাথর প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে । আমাদেরও জেদ চেপে যায়। একটা বিহিত করতে হবে। তাই দ্বিতীয়বার রিট মামলা মরন দাসকে দিয়ে করানো হয়। ২০২০ এর জুনে মামলা দায়ের হয়। দ্বিতীয় রিট মামলায় ২৬ শে নভেম্বর ২০২০ উচ্চ আদালত সরাসরি নির্দেশ দেয় পুরনিগম ও রাজ্য সরকারকে চার মাসের মধ্যে মরণ দাসকে নিয়মিতকরণ করতেই হবে। রাজ্য সরকার ও পুরনিগমের সব উজর আপত্তি উচ্চ আদালত নস্যাৎ করে দেয়। এবার আবার নতুন করে আশায় বুক বাঁধে। চার মাসের মেয়াদ শেষ ২৬শে মার্চ। মার্চ মাস শেষ। চার মাসের মধ্যে রায় কার্যকর করেনি পুরনিগম। মরণ দাস অসহায়ভাবে জানতে চাইত, রায় মানবে তো পুরনিগাম। ভরসা দিয়ে বলতাম ঘাড়ে মানবে। তখন তো জানতাম না মরণ দাস সবাইকে ফাঁকি দিয়ে অচিরেই চলে যাবে। কদিন আগেও সকালে এসেছিল। বলেছিলাম আর কয়েকটা দিন দেখি, না হলে আদালত অবমাননার মামলা করব । তোমার চাকরি হবেই। এলে অনেক সময় গল্প হত। কিভাবে বড় গাছ কাটতে হয়, নামাতে হয় মরণ দাস আমাকে বুঝিয়ে দিত। কোন মাটিতে কূপ খনন করা যায়, কিভাবে মাটির ঘর তৈরি করতে হয় ইত্যাদি অনেক কিছু মরন দাসের কাছ থেকে জেনেছিলাম। দুদিন আগে সকালে মা ছেলে বাড়িতে আসে । সঙ্গে পাড়ার একজন । ছেলের গলায় ধরা। আমি একটু হতচকিত হয়ে পড়ি। তারা কারা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না । কিন্তু যখন বলল, আমার বাবা পুরনিগমের মরন দাস, তখন আর বুঝতে কিছু বাকি রইল না। এর জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। জানলাম দুদিনের পেট ব্যথায় ভোগে মরন দাস হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন ১৮ই মে। সঠিক চিকিৎসা হয়েছিল কিনা বলা মুশকিল। মরণ দাসের মত সাধারন মানুষদের মরার হিসাব কে রাখে। আগরতলা পুরো নিগমের দেওয়ালের একটি ইটও খসে পড়বে না মরন দাসের মৃত্যুতে। ২রা এপ্রিল ১৯৯৮ থেকে ১৮ই মে ২০২১ অব্দি ডি আর ডব্লিউ হিসেবে কর্মরত মরণ দাসের মৃত্যুর পর তার পরিবার একটি কানাকড়িও পাবেন না। কারণ মরন দাস তো অনিয়মিত কর্মচারী। মাসিক মজুরি ছাড়া বাড়তি কোনো সুবিধা ও অধিকার নেই। মরণ দাসরা এতই সাধারণ যে তাদের মৃত্যুর পর পুরো নিগমের দুঃখ প্রকাশ করা, শোক জানানো বা মৃতদেহে ফুল দেওয়ার কোন প্রশ্নই উঠে না। বেঁচে থাকতে শুধু উপেক্ষা, বঞ্চনা , আর মরলে পরে বিস্মৃতি। মরণ দাসদের মত সাধারন মানুষদের মামলাতেই আদালতে প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের পোষিত আইনজীবীরা সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে । ধনুভাঙ্গা পণ। বাম চালিত প্রতিষ্ঠানও মাঝেমধ্যে হৃদয়হীনতার পরাকাষ্ঠা দেখায়। মরন দাস জীবনে কিছুই পেল না। শুধুই দিয়ে গেল সমাজকে । কিন্তু মরন দাসদের তিল তিল শ্রমেই গড়ে উঠেছে সভ্যতার সব সৌধগুলো। মরণ দাসের পরিবার এখন নিদারুণ অসহায়। মাথার উপর থেকে ছাদটা উড়ে গেছে এক ঝড়ে। কি ভাবে দিন যাবে, কিভাবে বাকি দিনগুলো যাবে। দশম শ্রেণীতে পাঠরত মেয়েটির পড়াশোনা বন্ধ হওয়া নিশ্চিত। পুরনিগম কি দাঁড়াবে মদন দাসের পরিবারের পাশে। পাপমোচন করবে। মৃত্যুর পর মরন দাসকে কি ন্যায় দেবে সমাজ। ন্যূনতম মরণোত্তর মর্যাদা ও সম্মান দেবে কি মরণ দাসকে। মরণ দাসদের মত সাধারণদের জীবনে কোন হিসেবই মেলে না। জমা খরচের খাতায় সঞ্চয়ের ঘরে সব শূন্য থাকে। 'দেবতারা' তো সব বড় লোকদের জন্যই। মরণ দাশের মৃত্যু মেনে নেওয়া কঠিন। তারপরও সময়ের হিসেবে ক্ষতে নিরাময়ের প্রলেপ পড়বে। আমাদের বিবেক ঘুমিয়ে পড়বে। মনে হচ্ছে মরন দাস মরন দিয়ে বলে দিয়ে গেল, যতই বলেন , স্যার, সংসারটা আমাদের মতো গরীবদের জন্য নয়। আপনাকে তো মাঝেমধ্যে বলতাম হাতের কুঠারটা দিয়ে পুরনিগম তছনছ করে ফেলি, তবেই হবে। আপনি বলতেন মরণ শান্ত হও, ধৈর্য ধরো সব হবে। দেখলেন তো কিছুই হয়নি আমি চললাম। যদি পারেন ব্যবস্থাটাকে পাল্টান।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.