।। পুলিশ বন্ধু ।।
অরিন্দম নাথ
আগরতলায় আমার প্রথম আসা এম বি বি কলেজে পড়ার সূত্রে । তখন আমি গোবেচারা ভালো ছেলে । ফিজিক্স অনার্স এর পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ততা । পাশাপাশি লাইব্রেরি থেকে বই পড়া । মাঝেমধ্যে সিনেমা দেখা । এবং অবশ্যই আড্ডা দেওয়া । দ্বিতীয় পর্যায়ে আগরতলা আমার কর্মক্ষেত্র । কঠিন রণভূমি । সময়টা ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বর মাস । ডি এস পি সেন্ট্রাল হিসেবে যোগ দিলাম । এর আগে উদয়পুরের মহকুমা পুলিশ অফিসার হিসেবে দেড় বছর কাজ করেছি । আগরতলার আইনশৃঙ্খলার কাছে উদয়পুরের দায়িত্বভার নিতান্তই ডালভাত । আমার আগে যিনি ডি এস পি সেন্ট্রাল ছিলেন ভীষণই ডাকসাইটে অফিসার । অপূর্ব ব্যানার্জী । খুবই দক্ষ । লোকজন প্রতিনিয়ত ওনার কর্মক্ষমতার সঙ্গে আমার কাজ যাচাই করবে । শহরের পশ্চিম থানার ও সি মিহির কান্তি দাস । কিছুদিন হল প্রয়াত হয়েছেন । পূর্ব থানার ও সি শ্যামাপ্রসাদ বিশ্বাস । বয়সে এবং পুলিশের অভিজ্ঞতার বিচারে আমি তাদের হাঠুর বয়সী । তাই আগে একবার পোস্টিং হয়েও যখন বাতিল হয়ে গিয়েছিল, মনে মনে খুশিই ছিলাম ।
আমি ডি এস পি সেন্ট্রাল হিসেবে যোগ দেওয়ার সাত দিনের মধ্যে দুটো বড় ডাকাতি হল । আমার কাছে ছিল শাপে বড় । আরও দিন তিনেকের মধ্যে পুরো ডাকাত দলটিকে অস্ত্রশস্ত্র সহ ধরতে সক্ষম হলাম । প্রচুর অলঙ্কার উদ্ধার হয় । এই ঘটনা শহরের দুইটি থানাকে একসূত্রে বাধতে সক্ষম হয় । আমি সবসময়ই রেকর্ডের প্রতি যত্নবান । একটি জিনিস লক্ষ্য করলাম, শহরে কোনওকিছু উদ্ধার হলে খুব কমই তৎক্ষণাৎ সিজার লিস্ট তৈরি হয় । এখানে পুলিশের কিছু বন্ধু থাকেন । ওনারাই সাক্ষী হিসেবে দস্তখত দেন ।
রূপকদার সঙ্গে পরিচয় এইরূপ পুশিশ বান্ধব হিসাবে । ভালো নাম অশোক কুমার বর্মণ । সবাই রূপক বর্মণ হিসেবেই চেনেন । প্রতিদিন একবার হলেও থানাতে আসতেন । একটি বাজাজ স্কুটার । হাফ-হাতা সার্ট । সার্টের বুক খোলা । মুখ কিছুটা তাম্বুলরঞ্জিত হেলমেট পরার বালাই নেই । সহসা স্কুটারের সীট থেকে নামতেন না । সীটে বসেবসেই কিছুক্ষণ কথা বলতেন । যেন পরিস্থিতি বেগতিক দেখলে পালিয়ে যেতে পারেন । তারপর স্কুটার পার্ক করে ভেতরে এসে আড্ডা দিতেন । কখনও সখনও আমাদের সঙ্গে রেইডে যেতেন । পরিস্থিতি দূর থেকে যাচাই করতেন । কখনও কাছাকাছি আসতেন । নতুন ডেভেলপমেন্ট থাকলে বলতেন ।
ততদিনে তিনিও আমার রূপকদা হয়ে গেছেন । মোটামুটি তার সম্পর্কে জানতে পেরেছি । ট্রাক গাড়ির মালিক । সংহতি ক্লাবের কাছে বাড়ি । ছোট্ট সংসার । স্ত্রী, এক ছেলে এবং এক মেয়ে । অজাতশত্রু । যদিও দেখে মনে হত যৌবনে ভীষণ ডানপিটে ছিলেন ।
দিনের বেশিরভাগ সময় শকুন্তলা রোডের ট্রাক ওনার্স এসোসিয়েশনে কাটে । অল্প কমিশনের বিনিময়ে তারা ট্রাক মালিকদের পরিষেবা দেন । বিশেষ করে যারা রাজ্যের বাইরে থেকে ট্রাক নিয়ে আসতো তাদের স্বার্থ দেখতেন । তখন নগদ টাকায় ভাড়া মেটানো হত । অনেক সময়ই বাইরের ট্রাকের ড্রাইভার ভাড়ার জন্য অপেক্ষা করত । সপ্তাহের শেষে অফিস বন্ধ থাকে । পেপার প্রসেসিং করতে সময় লাগে । এই অবস্থায়, অন্য কোনও সোর্স থেকে টাকা যোগাড় করে মিটিয়ে দিতেন । কিছু লাভ হত । তখন ট্রাক ওনার্স এসোসিয়েশনের মুখ্য পদে নীরেন ভট্টাচার্য । তারপর রূপকদা ওই পদে নির্বাচিত হন । ট্রাকের সম্পর্কিত যেকোনও প্রশ্ন থাকলে রূপকদার স্মরণাপন্ন হতাম । কিছুনা কিছু সূত্র মিলত ।
আমি তখন ধলাইয়ের এস পি । শিকারীবাড়িতে রেডিও স্টেশন তৈরি হচ্ছে । এই অবস্থায় খবর পেলাম সেখান থেকে কালোবাজারে বিক্রির জন্য সিমেন্ট পাচার হচ্ছে । একটি ট্রাকসহ সিমেন্ট আটক হল । ঠিকাদার বলল তার অন্য সাইটে অর্থাৎ আমবাসা থেকে জিরানিয়া সিমেন্ট নিয়ে যাচ্ছে । বাস্তুকারের অনুমতি ছিল না । অনেক সমস্যা । বৈরীরা ঠিকাদারকে চাদার রসিদ ধরিয়েছে । আমরা একটি মামলা নিয়ে সিমেন্ট আটক করলাম । ইচ্ছে ঠিকাদারকে চাপ দিয়ে বৈরীদের বিষয়ে খবর সংগ্রহ করা । রূপকদাকে গাড়িটির নাম্বার দিলাম । তিনি জানালেন গাড়িটির বর্তমান নাম্বার জাল এবং এটি এর চতুর্থ নাম্বার । গাড়িটি প্রথম কেনা হয় জামসেদপুরে । তারপর শিলং-এ পাহাড়ধ্বসে পড়ে । কিছুদিন লাপাত্তা থাকে । তারপর মেঘালয় এবং নাগাল্যাণ্ডের নাম্বারে চলে । শেষ পর্যন্ত ত্রিপুরার নাম্বার । যতদূর মনে আছে গাড়িটি আদালতের আদেশে নিলাম করা হয় ।
রূপকদার মত পজিটিভ মাইন্ডেট লোক খুব কমই পেয়েছি । জিরানিয়া মহকুমার থানাগুলি ইন্সপেকশন করছি । একটি মামলা ফুড গোডাউন থেকে চাল পাচার সংক্রান্ত । অনেকদিন যাবত তদন্তকারী অফিসার নিয়ে বসে আছে । কোনও প্রোগ্রেস নেই । রূপকদাকে ফোন করলাম । তাদের ট্রাক মাল ওঠানো নামানো করে । একমাসের মধ্যে কেইসের সূরাহা হল । আসামী সনাক্ত হল । ধরা পড়লো ।
মানস পাল আর আমি মিলে বাড়ি করছি । আগরতলার নন্দননগরে । ঘরের ছাদ দেওয়া হবে । স্থানীয় একটি দোকান থেকে আমার সিমেন্ট নেই । দুই বন্ধু মিলে দোকান দিয়েছে । আমার শ্বশুর বাড়ির প্রতিবেশী । ঢালাইয়ের আগের দিন সিমেন্ট দেখে রাজমিস্ত্রি ওনাপোনা করছে । সবকিছু মুখ ফুটে বলে না । শেষ পর্যন্ত বুঝলাম সিমেন্টের বস্তাগুলোতে পুরো পঞ্চাশ কেজি করে নেই । ওজন করার ব্যবস্থা করলাম । গড়ে আট কিলো করে কম । পুলিশে মামলা দিতে চাইলাম না । রূপকদার স্মরণাপন্ন হলাম । তিনি সিমেন্টের এরিয়া ম্যানাজারকে ডেকে আনলেন । নতুন সিমেন্টের ব্যবস্থা হল । ওজন ও পরিমাপ দপ্তর ফাইন করলো ।
রূপকদা যত সহজে বিষয়টি মিটিয়ে দিলেন সেরকম আমি পাড়িনি । আমি তখন এস পি এস বি । একদিন একটি ছেলেকে নিয়ে এলেন । ইঞ্জিনিয়ার । একটি মোবাইল পরিষেবার দোকানে কাজ করে । সেখানে অসাম্য প্রতিযোগিতা । তাকে তার বস চাপ দিচ্ছিল বেনামে সিম বিক্রি করে ব্যবসা বাড়ানোর জন্য । তার অগ্রণী কয়েকজন ছিল । সে বেপথে যেতে চায় না । আবার চাকুরীও হারাতে চায় না । আমি সাদা পোশাকে লোক পাঠালাম । একটি গলিতে ভীষণ ভিড় । সকালে নাম লেখিয়ে যায়, দুপুরের পর বেনামি সিম নিয়ে যায় । দ্বিতীয় দিন আমার লোকটিকে বললাম একটি বেনামি সিম বানিয়ে আনতে । লোকগুলো খুবই চালাক । পুলিশের লোককে সনাক্ত করে ফেলল । তার পরদিন সেখান থেকে ব্যবসা গুটিয়ে অন্য কোথাও চলে গেল । রূপকদাকে তার ঈপ্সিত ফল দিতে পারলাম না ।
তিনি মাঝেমাঝে ফোন করতেন । তার বি এস এন এল নাম্বার আমার মুখস্থ । অন্য নাম্বার থেকে ফোন করলে, গলা চিনতে পারলে খুব খুশি হতেন । তাকে নিয়ে অনেক স্মৃতি এদিক সেদিক ছড়িয়ে আছে । হয়তো কোনওদিন আমার কোনও গল্পের চরিত্রে স্থান পাবেন । তার মৃত্যু আমার কাছে অপূরণীয় ক্ষতি । শেষ করছি ফরাসি কবি Charles Baudelaire এর একটি কবিতার কয়েকটি পঙক্তি দিয়ে :
"মিথ্যে বলে মন ভোলানো নয়,
সত্যি বলে সাহস জোগানোর নাম বন্ধুত্ব!
ভুল দেখে সরে যাওয়া নয়,
ভুল শুধরে দিয়ে ভালোবাসার নাম বন্ধুত্ব!
সময়ের সাথে পাল্টে যাওয়া নয়,
সময়কে পাল্টা জবাব দেবার নাম বন্ধুত্ব!
আজকের বেপরোয়া ব্যাস্ত জীবনকে পরোয়া না করে......
কেমন আছিস জানতে চাওয়ার নাম বন্ধুত্ব!"
রূপকদা ছিলেন প্রকৃত পুলিশ বন্ধু । যতদিন তাকে দেখেছি তার বন্ধুত্ব অমলিন ছিল । গতকাল ১৮ ই মে, ২০২১ কোভিভ তাকে ছিনিয়ে নিল । আক্ষেপ, যতই দিন যাচ্ছে রূপকদার মত লোকগুলোকে হারিয়ে ফেলছি ।