পাহাড়ে আইপি এফটি-র পতন, তিপ্রা মথা-র উত্থান- একটি পর্যালোচনা

।। জয়ন্ত দেবনাথ ।।

২০২১ সালের এডিসি ভোটের ফলাফল থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার- কংগ্রেস, সিপিএম ও আইপিএফটি দলের প্রতি এরাজ্যের পাহাড়ি এলাকার মানুষের এখন আর তেমন কোন আগ্রহ আনুগত্য নেই। বিশেষ করে আইপিএফটি দলের শোচনীয় ফলাফল থেকে এটা স্পষ্টতই বলা যায়, এই দলের প্রতি পাহাড়ের মানুষের ভরসা প্রায় নেই বললেই চলে। আর সিপিআইএম ও কংগ্রেসের প্রতি পাহাড়ের মানুষ গত বিধানসভা ভোটেই অনাস্থা প্রদর্শন করে রেখেছে যা এখনো বজায় আছে। এই দুই দলের নেতা ও কর্মসূচির উপরও পাহাড়ের মানুষের কোন সমর্থন বা ভরসা নেই। পরিবর্তে তিপ্রা মথার গ্রেটার তিপ্রা ল্যান্ড –এর শ্লোগান ও এডিসি এলাকার সামগ্রিক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতির প্রতি এডিসি এলাকার মানুষ বেশি করে ভরসা করেছেন। আর তাঁর সবচেয়ে বড় প্রমান হলো এডিসি ভোটের মাত্র মাসাধিককাল আগে এনজিও থেকে একটি রাজনৈতিক দলের উত্থানের পরও তিপ্রা মথার ১৮ (২টি আইএনএফটি) আসনে জয়ী হওয়া। শুধু তাই নয়, হঠাৎ গজিয়ে উঠা একটা রাজনৈতিক দল এক লাফে ৩৭.৪৩% ভোট পেয়ে এডিসি-র ক্ষমতার মসনদে বসে যাওয়ার এমন নজীর বা ইতিহাস এরাজ্যে তো বটেই গোটা দেশেই বিরল বলা যায়।

পক্ষান্তরে, এডিসিতে টানা ১৫ বছরের একটি শাসক শক্তি বা দল যারা গত ২০১৫ সালেও এডিসি-র ২৮টি আসনে জয়ী হয়েছিল ৪৮.৮৮% ভোট পেয়ে সেই বাম দলের এভাবে ১৪.৫১% এ নেমে আসা এবং একটি আসনেও জয়ী না হওয়ার ঘটনাটি যে আগামী দিনে ত্রিপুরার ভোট রাজনীতির ইতিহাসকে নতুন করে লিখতে বাধ্য করবে তা বলাই বাহুল্য। অথচ ১৯৮২ সালে জন্মের পর থেকে ১৯৯০ ও ২০০০ সালে দুই দফায় দশ বছর বাদ দিলে এডিসিতে ৩৯ বছরের মধ্যে ২৮ বছর বামেদের শাসন ছিল। এর মধ্যে ২০০৫ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত টানা ১৫ বছর বামেরা এডিসির ২৮টি আসনের ২৮টি তেই জয়ী হয়ে আসছিল। কিন্তু এবারই প্রথম এডিসিতে বামেরা একটি আসনেও জিততে পারেনি। মাত্র পাঁচটি আসনে দ্বিতীয় স্থানে ছিল বাম প্রার্থীরা। ২০০০ সালে ও ১৯৯০ সালে যখন বামেরা এডিসি ভোটে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল তখনো দলের দশজন করে প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন। এবারই প্রথম এডিসির জনতা বামেদের উপর থেকে পুরোপুরি মুখ ঘুড়িয়ে নিলেন।

এডিসি ভোট ২০২১-ফলাফল এক নজরে







রাজাদের সমালোচনাই কি সিপিএম-এর কাল হয়েছে?

ত্রিপুরার রাজ পরিবার ও এরাজ্যের ১৮৪ জন রাজা তাদের রাজত্বকালে ত্রিপুরার মানুষের উন্নতির জন্যে কিছুই করেনি। সিপিএম-এর এই নিয়ে লাগাতর প্রচারের ফলই কি এবার এডিসি ভোটে পাহাড়ী এলাকায় সিপিএম-এর কাল হয়েছে? এবং ত্রিপুরার পাহাড়ী এলাকার মানুষ সিপিএম –এর এই কুপ্রচারের জবাব দিয়েছেন? হ্যাঁ, তিপ্রা মথাকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে এডিসি-র ২৮- আসনের মধ্যে ১৮ আসনে জয়ী করে পাহাড়ী এলাকার মানুষ যেভাবে প্রদ্যোৎকে জিরো থেকে হিরো বানিয়েছেন এর পর এই প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক। কেননা, এটা আজ অনস্বীকার্য যে রাজ্যে রাজা বা রাজতন্ত্র না থাকলেও রাজ্যের রাজধানীতে এখনও একটা রাজবাড়ি রয়েছে। রাজ্যের মানুষ দেশ বিদেশে ত্রিপুরাকে তোলে ধরতে এখনও এই রাজবাড়ীর সুদৃশ্য বিল্ডিংটিকেই তোলে ধরেন। তাছাড়া ত্রিপুরার নয়া প্রজন্মের জাতি উপজাতি কোন অংশের ছেলেমেয়েরাই এটা নিয়ে একেবারেই ভাবিত নয় যে পঞ্চাশ বা একশত বছর আগে এরাজ্যের রাজারা রাজ্যের সামগ্রিক উন্নয়নে কি করেছেন বা কি করেননি। কিন্তু এটা ঘটনা ত্রিপুরার পাহাড়ে রাজন্য শাসন ও ত্রিপুরার রাজাদের নিয়ে আবেগ এখনো আছে।

মহারাজা প্রদ্যোৎ কিশোর দেববর্মন এডিসি ভোটে এই আবেগকে একশত শতাংশ কাজে লাগিয়েছেন। তাই তিনি ভোটের মুখে কোন নির্বাচনী লিখিত প্রতিশ্রুতিও দেননি। তিনি শুধু গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড ও উপজাতি জনগোষ্ঠীর লোকদের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য (থানছা) গড়ে তোলার শ্লোগান দিয়েছেন। রাজার দল ক্ষমতায় এলে রাজ্যের এডিসি এলাকার মানুষের সুখ স্বাচ্ছন্দের জন্যে কি কি করা হবে এর বিন্দু বিসর্গও পাহাড়ের মানুষের জানা নেই। কিন্তু তারপরও গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডের অলিক স্বপ্নের পিছনে ব্যাপক সমর্থন দিয়ে রাজার দলকে জয়ী করেছেন পাহাড়ের মানুষ। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে ত্রিপুরার পাহাড়ের মানুষের বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষায় সিপিএম-এর শ্লোগান ও কাজকর্মের প্রতি যদি বিশ্বাস থাকতো তাহলে সিপিএম প্রার্থীদের এমন করুন ফল হতে পারেনা। একশত বছর আগে এরাজ্যের রাজা মহারাজার এরাজ্যের উন্নয়নে কিছুই করেনি বলে ‘এখন আমাদের ভোট দিন’ সিপিএম-এর এই শ্লোগান যে আজকের দিনে অচল ২০২১ সালের এডিসি ভোটের ফলাফলই তার সবচেয়ে বড় প্রমান?



স্বশাসিত জেলা পরিষদের শাসন ক্ষমতা একনজরে (১৯৮২-২০২১)







১৯৭১ সালে ত্রিপুরা স্বাধীন পূর্ন রাজ্যে উন্নীত হওয়ার ৫০/৫২ বছর পরও রাজাদের ব্যর্থতার প্রচার করে ত্রিপুরার নয়া প্রজন্মের উপজাতি যুবক যুবতীদের কাছে যে সিপিএম-এর পুরানো কায়দায় প্রচার আজকাল অচল তা সিপিএম এর বুড়ো বয়োবৃদ্ধ নেতৃত্ব যদি মেনে নিয়ে নতুন চিন্তা চেতনায় নিজেদের সমৃদ্ধ এবং জাগ্রত করেন ভালো, অন্যথায় আগামী দিন যে গোটা রাজ্যেই বামপন্থী চিন্তাভাবনা ও আদর্শ অন্ধকারের কড়াল গ্রাসে সমাহিত হতে বাধ্য তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

তিপ্রা মথার উত্থানে আইপিএফটি ও বিজেপি-র অবদান!

আইপিএফটি ও বিজেপি-র প্রতিশ্রুতির মিথ্যাচারও পাহাড়ে তিপ্রা মথার উত্থানের জন্যে কম দায়ী নয়। মাত্র তিন বছর আগে রাজ্য বিধানসভার ভোটের মুখে আইপিএফটি দল তিপ্রাল্যান্ডের শ্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় আসে। আইপিএফটি-র তিপ্রাল্যান্ডের দাবী তখন ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিল পাহাড়জুড়ে। তিপ্রাল্যান্ডের দাবীর প্রতি সমর্থন না জানিয়েও পাহাড়ী মানুষের সমর্থন পাওয়ার জন্য আইপিএফটি-র সাথে বিজেপি ভোট সমঝোতা করতে বাধ্য হয়। কিন্তু ভোট চলে যাওয়ার পর আইপিএফটি নেতৃত্ব তাদের প্রতিশ্রুতির কথা বেমালুম বলে যান। একবারের জন্যেও গত তিন বছরে আইপিএফটি নেতৃত্ব তিপ্রাল্যান্ডের দাবী নিয়ে রাজ্যে বা দিল্লীতে কোনরকম আন্দোলনে যাননি। তাই পাহাড়ের মানুষ স্পষ্টতই বোঝে যান আইপিএফটিকে দিয়ে তাদের কোন কিছুই হবেনা। এবং তিনবছরের মাথায় এডিসি ভোটে তা ভোটের মাধ্যমেই আইপিএফটি নেতৃত্বকে বুঝিয়ে দেন।

একই রকম ভাবে ২০১৮ সালের ভিসন ডকুমেন্টে বিজেপি যে ১৪ টি প্রতিশ্রুতির কথা পাহাড়ের মানুষের জন্যে প্রচারে নিয়ে এসেছিল এব্যাপারে বিজেপিও খুব একটা কিছু করেনি। তাই বিজেপি একা সব আসনে লড়াই করার ক্ষমতা দেখাতে পারেনি। পাহাড়ে আইপিএফটি-র আগের মতো ধবধবা নেই এটা জানা থাকার পরও নিজেদের অস্তিত্বকে ধরে রাখতে তিপ্রা মথার সাথে এডিসি ভোটের আগে রাজনৈতিক ও ভোট সমঝোতা হয়ে যাওয়ার পরও আইপিএফটিকে তিপ্রা মথার খপ্পর থেকে ছিনিয়ে এনে তাদের দাবী মেনে ১৭টি আসন তাদেরকে দিতে বাধ্য হয় বিজেপি। যদিও বিজেপি-র উপজাতি নেতৃত্ব প্রকাশ্যেই দলের দিল্লী ও রাজ্য শীর্ষ নেতৃত্বের এই ফর্মূলার বিরোধিতা করেছিলেন। যার খেসারত বিজেপিকেও দিতে হলো।

বন্ধুত্বপূর্ন লড়াই করতে গিয়ে হাড়তে হল বিজেপিকে?

১৪ বুধজংনগর-ওয়াকিনগর, ২২ কাঁঠালিয়া-মির্জা-রাজাপুর ও ২৫ নতুন বাজার মালবাসা আসনে বিজেপি ও আইপিএফটি-র মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ন লড়াই হয়েছিল এবারের এডিসি ভোটে। দেখা গেছে ভোট কাটাকাটির কারনে এই তিনটি আসনের মধ্যে ২৫ নতুনবাজার- মালবাসা আসনে বিজেপিকে হাড়তে হয়েছে। যদি এই আসনের বিজেপি ও আইপিএফটির ভোট ভাগাভাগি না হতো তাহলে অনায়াসে এই সিটটিও বিজেপি-র ঝুলিতে যেতে পারতো। বিজেপি এই আসনে পেয়েছে ১২৭২৮ ভোট, আইপিএফটি পেয়েছে ১২৭০ ভোট। তিপ্রা মথা পেয়েছে ১৩৮৫৫ ভোট। অর্থাৎ বিজেপি ও আইপিএফটি-র জোট যোগ করলে তিপ্রা মথা প্রার্থী জয়ী হতে পারে না।
বিজেপি ১৪ টি আসনে প্রার্থী দিয়ে নিজেদের দমে ৯ টি আসনে জয়ী হলেও আইপিএফটি একটি আসনেও জয়ী হতে পারেনি। আইপিএফটি এগারটি আসনে দ্বিতীয় স্থানে ছিল। আর বিজেপি ১৪ টি আসনের মধ্যে নয়টি আসনে দ্বিতীয় স্থানে ছিল। বিজেপি-র এই ফলাফল থেকেই এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে দলের উপজাতি নেতারা আইপিএফটি-র সাথে আসন সমঝোতায় না যাওয়ার যে দাবী তোলেছিল তারা সঠিকভাবেই তা করেছিল। কেননা, বিজেপি যদি একা ২৮টি আসনে লড়াই করতো তখন ভোট কাটাকাটিতে বিজেপি-র পক্ষে ১৪/১৫ টি আসন পাওয়া এতটা কঠিন হতোনা। কিন্তু আইপিএফটি-র হাতে এতগুলি আসনে জয়ের দা্যিত্ব দিয়ে বিজেপি নিজেরাও এডিসি-র শাসন্ন ক্ষমতা হারালো বল চলে।

তিপ্রা প্রধানের প্রতিশ্রুতি সমুহ

ভোটের আগে স্পষ্ট করে কোন প্রতিশ্রুতি না দিলেও ভাষন বক্তৃতায় এডিসি ভোটের প্রাক্কালে তিপ্রা মথা প্রধান প্রদ্যোৎ বিক্রম কিশোর দেববর্মন যা যা বলেছেন তার থেকে এটা পরিষ্কার যে দল ক্ষমতায় এলে তারা এডিসিকে সেন্টার করে গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড তৈরী করবেন। গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডের রুপরেখাটি আদতেই কি এটা তিপ্রামথা প্রধান প্রদ্যোৎ কিশোর দেববর্মন ছাড়া অন্যেরা কতটা জানেন বলা কঠিন। প্রদ্যোৎ কিশোর দেববর্মনের কথায় যেটা উঠে এসেছে ত্রিপুরার এডিসির বৃহত্তর এলাকার সাথে রাজধানীতে রাজবাড়ী, কৃষ্ণনগর, নন্দন নগরকে জুড়ে দিয়ে বাংলাদেশের খাগড়াছড়ি বান্দরবন এবং ত্রিপুরার পার্শ্ববর্তী রাজ্যের যেখানে যেখানে ত্রিপুরার উপজাতি জনগোষ্ঠীর লোকেরা বসবাস করেন সেসব এলাকাগুলিকে নিয়ে গঠনা করা হবে গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড। এটা কতটা কিভাবে সম্ভব তা সময়ই বলবে। কিন্তু এটা ঘটনা যে, এন সি দেববর্মা ও মেবার কুমার জমাতিয়ারা তিপ্রাল্যান্ডের শ্লোগানকে বাস্তবায়নে কোন কিছুই করেননি বলেই এডিসি ভোটে পাহাড়ের মানুষ আইপিএফটিকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন। এখন দেখার তিপ্রা মথা গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কখন কিভাবে কোথায় থেকে শুরু করেন। তবে রাজনৈতিক তথ্যবিজ্ঞমহল ও বিশ্লেষকরা অনেকেই মনে করেন বর্তমান গনতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক পরিকাঠামোতে দাঁড়িয়ে একটা স্বাধীন রাজ্যের ভিতরে আরও একটা স্বাধীন ল্যান্ড বা রাজ্য গঠন করা শুধু অসম্ভবই নয়, অবাস্তব। আর এক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী বিদেশী রাষ্ট্রের মাটি দখলের স্বপ্নকেও অনেকে অলীক স্বপ্ন বলেই মনে করেন। কিন্তু তারপরও সুশিক্ষিত উপজাতি অংশের যুবক যুবতীদের সামনে রেখে ত্রিপুরার রাজবংশের স্বপ্নদ্রষ্টা সর্বশেষ যুবনেতা তথা তিপ্রা মথা প্রধান প্রদ্যোৎ কিশোর দেববর্মন যে শ্লোগান দিয়েছেন তার সফল বাস্তবায়নে তিনি কোথায় থেকে কিভাবে শুরু করেন তাই এখন দেখার। তবে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, রাজনীতিতে কামান চাইলে দরকষাকষিতে অন্তত একটা বন্দুক হলেও পাওয়া যায় নীতিকে সামনে রেখেই তিপ্রা মথা প্রধান গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডের শ্লোগান দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত যদি কেন্দ্রের সাথে দরকষাকষিতে রাজ্যের বিধানসভায় উপজাতি সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা এক দুটি বাড়ানো যায় বা অন্য কিছু উপজাতি স্বার্থে আদায় করা যায় তাতেও মন্দ কি? দল ক্ষমতায় এলে পাহাড়ি এলাকার মানুষের উন্নয়নে কি কি করা হবে এমর্মে তিপ্রা মথা নেতৃত্ব ভোটের আগে লিখিত কোন প্রতিশ্রুতি পত্র প্রচার করেনি। কিন্তু তিপ্রা প্রধান প্রদ্যোৎ বিক্রম কিশোর দেববর্মন ভোট প্রচারে ভাষণ বক্তৃতা বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু প্রতিশ্রুতির কথা শুনিয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম ক’টি প্রতিশ্রুতি হলো-

১) তিপ্রা মথা উপজাতি জনগোষ্ঠীর লোকদের সামগ্রিক উন্নয়নে কাজ করবে।
২) উপজাতি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলবেন।

৩) এডিসিকে কেন্দ্র করে গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড গঠন করবেন।

৪) যে সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল তিপ্রা মথার দাবী মানবে ভোটের পরে প্রয়োজনে তিপ্রা মথা সেই সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দলের সাথেই এডিসি-র উন্নয়নে আঁতাতে যাবেন।

৫) এডিসি প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার পথে হাঁটবে। কোথাও কোন রকম দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেবেন না।

৬) এডিসি-র সামগ্রিক উন্নয়নে কোন কাজটি কবে কিভাবে শুরু করা হবে, বাজেট বরাদ্দের টাকা কিভাবে খরচ করা হবে তা ওয়েবসাইটে দিয়ে দেওয়া হবে। তথ্য জানান জন্যে সাধারন মানুষকে আরটিআই-ও দিতে হবে না অফিসে অফিসে।
৭) এডিসি প্রশাসন পরিচালনায় সব অর্থ ন্যায় নিষ্ঠা ও স্বচ্ছতার সাথে খরচ করা হবে। এডিসি কাউন্সিলের সদস্যদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তার নামে টাকার অপচয় করা হবে না। সব অর্থই মানুষের কল্যাণে ব্যয় করা হবে। সর্বোপরি এডিসি প্রশাসনে সব কাজ দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছতার সাথে করা হবে বলে তিপ্রা প্রধান ভোটের আগে ও পরে বার বার এসব কথাগুলি উচ্চারণ করেছেন এবং এখনো সমানতালে করে যাচ্ছেন।

প্রথম রাউন্ডেই ডাহা ফেল মহারাজা?

২৮ আসনের মধ্যে ১৮ আসনে জয়ী হয়ে এডিসি-র ক্ষমতা দখলের পর আইএনপিটি ও তিপ্রা জোটের প্রধান প্রদ্যোৎ দেববর্মণের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নির্বাচনের সন্ত্রাস না হতে দেওয়া। এবং এলক্ষ্যে তিনি ফলাফল ঘোষণার আগে থেকেই দলীয় কর্মী সমর্থক ও শাসক বিরোধী সব দলের কাছে আন্তরিক আবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু দেখা গেলো তিপ্রা প্রধানের এই আবেদনে দলের লোকেরাই সারা দেয়নি বা দলীয় অনুশাসন মেনে চলেনি। গত ১০ই এপ্রিল ভোট গণনা শেষের পর থেকে পুলিশী তথ্য অনুযায়ী সারা রাজ্যে কম করেও ৩৯টি জায়গায় ১৩৭টি রাজনৈতিক হামলা সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে। খোয়াই থেকে সাব্রুম পর্যন্ত এডিসি-র ভিতরে ও সংলগ্ন নন এডিসি এলাকার এমন একটি অঞ্চল বাদ যায়নি যেই এলাকায় তিপ্রা মথা আইপিএফটি ও বিজেপি-র কর্মী সমর্থকদের মধ্যে গোলমাল, হামলা ও পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটেনি। কম করেও ৮/১০টি বিজেপির পার্টি অফিসে হামলা ভাংচুর ও অগ্নি সংযোগ হয়েছে। আইপিএফটি-র তিনটি অফিসে ভাংচুর ও আগুন দেওয়া হয়েছে। রাজধানী সংলগ্ন নেপালিবস্তী ও চড়িলামে হামলা বিধ্বস্থদের জন্য শরনার্থী শিবির চালু করতে হয়েছে। বিজেপি-র কম করেও ৪৫টি পরিবার শহর সংলগ্ন নেপালিবস্তী থেকে শরনার্থী হয়ে গান্ধীগ্রামে বৈদ্যনাথ কমিউনিটি হলে আশ্রয় নিয়েছেন। একইরকম ভাবে চড়িলামের লীলাবতী কমিউনিটি হলেও শতাধিক বিজেপি সমর্থক শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। গত বিধানসভা ভোটের পরও রাজনৈতিক সন্ত্রাসের কারনে কোথাও এভাবে শরনার্থী শিবির চালু করতে হয়নি। শুধু তাই নয়, শহরের অনতিদূরে জারুলবাচাই-এ কমল দেববর্মা নামে এক তিপ্রা মথা সমর্থকের বাড়িতে আইপিএফটি-র হামলায় গৃহকর্তার স্ত্রী বিশ্বলক্ষী দেববর্মা (৪৫) দুষ্কৃতীদের ছুরিকাঘাতে ঘটনাস্থলেই প্রান হারায়। বিশালগড়ে, চড়িলাম, আমতলী, গোলাঘাটি, বোধজংনগর, সিমনা, সিধাই, মান্দাই, টাকারজলা, জম্পুইজলা, জিরানিয়া থেকে সাব্রুম, গন্ডাছড়া, ছামনু, লংতরাইভ্যালী প্রভৃতি জায়গা থেকে বিজেপি, আইপিএফটি ও তিপ্রা মথার সমর্থকদের মধ্যে দফায় দফায় হামলা পাল্টা হামলার খবর রয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রশাসন রাজ্যের সব জেলাতেই ১৪৪ ধারা জারী করেছে। কিন্তু কোন ফল হয়নি। চড়িলামে লীলাবতী কমিউনিটি হলে প্রায় একশটির মতো পরিবার প্রান ভয়ে বাড়ি ছেড়ে এসে শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। গত ১১ই এপ্রিল বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব এই শিবিরটি দেখতে গিয়ে তিপ্রা মথার দুষ্কৃতীদের হাতে আক্রান্ত হন। ঢিলেঢালা পুলিশী ব্যবস্থার কারনে বিশালগড়ের চেলিখলায়ও খোদ বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি ডাঃ মানিক সাহা, সাংসদ প্রতিমা ভৌমিক, টিআইডিসি-র চেয়ারম্যান টিংকু রায় সহ স্থানীয় মন্ডল সভাপতি সুশান্ত দেবকে প্রান বাঁচাতে পুলিশী ব্যারিকেডেই পালিয়ে আসতে হয়েছে। তিপ্রা মথা প্রধানের শান্তির আহ্বানে কোন কাজ হচ্ছে না। তিপ্রা সমর্থকরা রসিদ দিয়ে চাঁদা আদায়ের পাশাপাশি বিরোধী দলের কর্মীসমর্থকদের বাড়িঘরে যেভাবে হামলা সন্ত্রাস জারী রেখেছে উদ্ভত অবস্থার প্রেক্ষিতে পাহাড়ের সার্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, রাজার হাট বহু জায়গায় অঘোষিত ভাবে বন্ধ হয়ে পড়েছে। উদ্ভত অবস্থার প্রেক্ষিতে তিপ্রা প্রধান দলের বিজয় উৎসব বাতিল ঘোষণা করলেও দলের একাংশ নেতা কর্মীরা রসিদ দিয়ে ও কোন কোন ক্ষেত্রে রসিদ ছাড়া দলের নামে চাঁদা আদায় অব্যাহত রেখেছে। বিজেপি ও আইপিএফটি-র ক্যাডার বাহিনীর চাঁদাবাজি, অন্যায় অবিচার ও হামলা সন্ত্রাসের হাত থেকে রক্ষা পেতে পাহাড়ের শান্তিপ্রিয় মানুষ তিপ্রা মথাকে ভোট দিয়ে এডিসিতে ক্ষমতায় বসিয়েছে। এক্ষেত্রে তিপ্রা মথাও যদি একইভাবে একই ভুল করে পাহাড়ে অশান্তি জিইয়ে রাখেন তাহলে নিকট দিনে যে তিপ্রা মথার অবস্থাও আইপিএফটি-র মতোই হবে তাও বলাই বাহুল্য.



You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.