প্রকাশনা শিল্পে ত্রিপুরা : নির্মাণ ও বিনির্মাণের এক অনালোকিত অধ্যায়

সৌম্যদীপ দেব

যেকোনো শিল্প গড়ে তোলার জন্য তার পেছনে প্রাথমিকভাবে প্রবল ইচ্ছা শক্তি ও উদ্যোগ গ্রহণ করা একটা নতুন পরিবেশের সাথে অভিযোজন করার থেকে কোনো অংশে কম নয়। শিল্পের জন্য প্রথমত শিল্পী প্রয়োজন। দক্ষতা,পারদর্শিতা, গুণাগুণ , প্রশিক্ষণ, আর্থিক যোগান সবই দ্বিতীয় পর্যায়ের তালিকাভুক্ত। লেখক লিখে চলেছেন। অনাদিকালে কে পাঠ করবে, কতজন পাঠক পাওয়া যাবে - এসব ভাবনা লেখক ভেবে লিখতে বসেন না ; আর বসার কথাও নয়। কিন্তু এই সৃষ্টিকে পাঠকের দরবারে নিয়ে যান একজন প্রকাশক। তাঁর দায়িত্ব ও ভূমিকা কোনো অংশে কম নয়। কালের গায়ে এই সঞ্চয় তো প্রকাশকের হাত ধরেই হয়। সমস্ত রমক শিল্প নৈপুণ্য একটা শিল্পকে আদর্শ করে তোলার ক্ষেত্রে সর্বোতভাবেই দায়ী থাকে। তাই এখানে উপেক্ষার নয়, বরং নন্দন চর্চা ও মননশীলতা অনেক বেশি প্রাধান্য পায়।

আমার এই নিবন্ধের ক্ষেত্র ভূমি ত্রিপুরার প্রকাশনা শিল্প। ভারতবর্ষের ছোট প্রান্তিক অরণ্য বেষ্টিত রাজ্য ত্রিপুরা। এখানে সফলতা যেমন ধরা দিতে সময় নেয়, তেমনি সেই সফলতার পেছনে থাকে এক হৃদয় বিদারক ইতিহাস।যদিও পৃথিবীর সব ইতিহাসই কালের গায়ের ক্ষত - আঘাত গুলোকেই স্বযত্নে তুলে রাখে। ইতিহাস অনুপ্রেরণা যোগায় কালকে জয় করে কালজয়ীর কেতন উড়িয়ে দিতে। তাই আমার এই নিবন্ধে আমি ইতিহাস ও বর্তমানকেই পুনরায় অবলোকন করেছি ভাবি কালের পাঠকের দৃষ্টিকোণে। কিভাবে গড়ে উঠলো ত্রিপুরার প্রকাশনা শিল্প? কারা এই কাজে অগ্রনী ভূমিকা পালন করলেন? কি কি বাঁধার সম্মুখীন হলেন? আরো কি কি করা যেতে পারতো? এই সবই তুল্যমূল্য বিচার্য রূপে উঠে এসেছে এই নাতিদীর্ঘ আলোচনাকে কেন্দ্র করে।

বলা হয় যে ' বই পড়তে যে ভালোবাসে, তার শত্রু কম'। কথাটা ধ্রুব সত্য না হলেও মিথ্যা নয়। ত্রিপুরা রাজ্যে পর পর বহু রাজার শাসনকাল বিগত হয়েছে এবং এখানে রাজ কার্যের ভাষা ছিলো বাংলা ভাষা। অর্থাৎ রাজ কার্য পরিচালিত হতো বাংলা ভাষায়। এই নিয়ে বিষদে আমি অন্য আলোচনায় বলার চেষ্টা করেছি, তাই এখন আর সেদিকে যাচ্ছি না। ত্রিপুরায় প্রকাশনার ইতিহাস দীর্ঘ দিনের। প্রকাশনার সূত্রপাত রাজন্য শাসিত ত্রিপুরায় এই কথা স্পষ্টতই জানা যায়। কেনোনা ছয় খন্ডে প্রকাশিত 'রাজমালা' সেই সাক্ষ বহন করে চলেছে।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ষাটের দশক থেকে সত্তরের দশকে ত্রিপুরায় মূলত ব্যক্তিগত উদ্যোগেই গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তখন সলিল কৃষ্ণ দেববর্মণের 'জেলের ভেতর বুকের ভেতর ' , বিমল চৌধুরীর লেখা ' মানুষের চন্দ্র বিজয় ও তারানাথ ' এই দুটি বই পৌণমী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৭২ সালে আরো দুটি গ্রন্থের কথা জানা যায় যেগুলো সম্পূর্ণ আগরতলা থেকেই ছাপাই - বাধাই হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। এক - কথাসাহিত্যিক সুবিমল রায়ের প্রথম গল্প সংকলন ' বিবর্ণ আবির' যা কল্যাণ গুপ্ত ও সুজয় রায় মিলে সমকাল ব্রততী থেকে করেছিলেন। আর দুই- কবি মিহির দেবের ' বাংলাদেশ, স্বদেশ ও আমি '। দীর্ঘদিনের প্রকাশক সাহিত্য সচেতন ব্যক্তিত্ব দেবানন্দ দাম তাঁর 'প্রকাশনা বই বইমেলা ' গ্রন্থে অত্যন্ত তথ্যপূর্ণ মতামত ব্যক্ত করেছেন "সত্তরের দশকেই 'সৈকত ' প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয় কবি কল্যাণব্রত চক্রবর্তীর কবিতার বই, ' অন্ধকারে প্রণামের ইচ্ছা হয় '। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে সন্তোষ পুরকায়স্থ ব্যক্তিগত উদ্যোগে কয়েকটি বই প্রকাশ করেন। এর মধ্যে অমল কুমার মিত্রের 'ক্রীড়াঞ্জলি' বইটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। " আধুনিক ছাপার ব্যবস্থা তখন নেই, লেটার প্রেসে মুদ্রণ করেই সূচনার পথ ক্রমশ প্রশস্থ হয়েছিল।

১৯৮১ সালে প্রথম আগরতলা বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রকাশনা শিল্পের একটা অন্তর স্রোত বিশেষ লক্ষ্য করা যায়। যা ত্রিপুরার প্রকাশনা শিল্পে গতি সঞ্চার করেছিল। বইমেলা হলেই পাঠক একত্রিত হবেন আর বইমেলাই পাঠকের কাছে বই পৌঁছে দেওয়ার একটা অন্যতম মাধ্যম ছিলো তখন। এখনকার মতো অত্যাধুনিক অনলাইন বিক্রির ব্যবস্থা তো সেই সময়ে দাঁড়িয়ে ভাবাই যায় না । তাই বছর ঘুরে বইমেলাই যেনো চাতকের মতো অপেক্ষা রত পাঠকদের জন্য দুর্গা পূজার সামিল। ত্রিপুরার প্রকাশনা শিল্পের তখন বেশ কিছু প্রকাশনী সুনাম অর্জন করেছে। পৌণমী,সৈকত, ত্রিপুরা দর্পণ, জ্ঞান বিচিত্রা, অক্ষর, নব চন্দনা, মানবী, ভাষা, স্বাগতম, বিদ্যা প্রকাশ, জয়ন্তী প্রকাশনী, মৌমিতা, রাইটার্স ইত্যাদি। এখানে উল্লেখ্য যে প্রায় সূচনা লগ্নের এই প্রকাশনী গুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি এখনো সমানভাবে নিজেকে ধরে রেখেছে, বিকাশ ও সমৃদ্ধি পথ মসৃণ করে।

আধুনিক প্রকাশন ব্যবস্থার সূচনা খুব বেশি দিনের পুরনো ধারণা নয়। মূলত গত দুই দশকে প্রকাশনা শিল্পে নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার তার গতিকে অনেক বেশি তরান্বিত করেছে। প্রচ্ছদ, টাইপ, মুদ্রণ, বাধাই সবেতেই এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। ফলত কাজে গতিও এসেছে আগের তুলনায় দ্বিগুণ। সম সময়ের কিছু দৃষ্টান্ত স্থাপন করলে তা অনেক বেশি স্বচ্ছ হবে। যে রাজ্যে আজ থেকে ( ২০২১) কুড়ি বা তিরিশ বছর আগেও একটা উপন্যাস লিখতে গেলে হয়তো লেখককে এই ভাবনা তাড়িত করেছে যে, কে প্রকাশ করবে? আর আজ আমরা দেখছি ২০১৯ আগরতলা বইমেলায় রাজ্যের উদীয়মান প্রকাশন সংস্থা তুলশী পাবলিশিং হাউস থেকে ৫৯০ পৃষ্ঠার সুবৃহৎ উপন্যাস প্রকাশিত হচ্ছে ঔপন্যাসিক সুবিলম রায়ের। এটা নিশ্চিত ভাবেই সাফল্যের ইঙ্গিত বহন করে। তারপর ২০২১ বইমেলাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সময়ের আর এক প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনী নীহারিকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে ৭০ টি ভিন্ন স্বাদের গ্রন্থ।যা শুধু সাফল্যই নয় রেকর্ড তৈরি করেছে। এই দৃষ্টান্ত গুলো একটাই কথা বলে শহর আগরতলা বা আগরতলার শহরতলী সহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চল আজ যা দেখা যাচ্ছে তা কুড়ি বছর আগেও এমন ছিলো না। অর্থাৎ ত্রিপুরা তথা আগরতলার আর্থসামাজিক - সাংস্কৃতিক ও মূল্যবোধের নবীকরণ এতো দ্রুত পরিবর্তন ঘটেছে যা অবিশ্বাস্য রকমের হলেও এটাই সত্য। যেখানে একটা বই প্রকাশ করতে গেলে ভাবতে হয়েছে সেখানে এখন প্রায় প্রতি বছর ৩০০ র কাছাকাছি বা তারও বেশি বই গড়ে প্রকাশিত হয়ে চলেছে। এই বইগুলোর মধ্যে বেশির ভাগ বইয়ের ছাপাই, বাধাই, প্রচ্ছদ,ডিজাইন অত্যন্ত উন্নত মানের ; বলা যায় জাতীয় স্তরের বা আন্তর্জাতিক মানের। এছাড়াও মুখাবয়ব,সাতদিন, নান্দীমুখ,স্রোত সমসময়ে সমানতালে কাজ করে চলেছে।এই উন্নয়নকে অবশ্যই মান্যতা দিতে হবে এবং এই উন্নয়নের কৃতিত্ব সর্বাংশেই ত্রিপুরার প্রকাশনী শিল্পের সাথে যারাই যুক্ত আছেন তাঁদের সকলের প্রাপ্য।

ত্রিপুরার প্রকাশনা শিল্পে আরো কিছু প্রকাশনা একটা সময় কাজ করেছে সমানভাবে , কিন্তু সময়ের বহমানতার সাথে আজ এই গুলো লুপ্ত। ত্রিবেগ, সমকাল ব্রততী, পোর্শিয়া, আবহমান সহ আরো বেশ কিছু প্রকাশনা, যাঁদের কিছু কিছু ভালো গ্রন্থ ত্রিপুরার সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিল । কিন্তু এখানেও আশার আলো আছে। লুপ্তির সাথে সাথেই সৃষ্টির আনন্দ মিশে থাকে। তিনকাল, আমাদের কফি হাউস,ত্রিষ্টুপ ( ত্রিপুরা শাখা) সহ আরো বেশ কিছু প্রকাশনীর নতুন প্রতিষ্ঠা রাজ্যের সাহিত্য পরিসরকেই সমৃদ্ধ করবে। গুটি গুটি পায়ে চলতে চলতে এরাও একদিন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তুলতে পারবে বলেই বিশ্বাস।

একটা সময় ছিলো যখন বই প্রকাশ হতো শুধু বইমেলাকে কেন্দ্র করেই। এই ধারণার পরিবর্তন হয়েছে অনেকাংশেই। এখন ২৫ শে বৈশাখ, প্রাক্ দুর্গা পূজা, ভাষা দিবস সহ নানা সময়ে বছরভর বই প্রকাশিত হচ্ছে। আধুনিক সমাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থায় এটা অবশ্যই প্রয়োজনীয় ও ইতিবাচক দিক। এছাড়াও ত্রিপুরা পাবলিশার্স গিল্ড আয়োজিত ' পুস্তক মেলা' পাঠকের কাছে তাঁর পছন্দের বইটি তুলে দেওয়ার জন্য একটা বিশেষ সুযোগ। কলেবরে এই আয়োজন সামান্য থেকে আজ বিশালে পরিণত হয়েছে। রাজ্যের জেলা স্তরে আয়োজিত বইমেলা গুলোর ভূমিকা এখানে অস্বীকার করা যায় না। আগরতলা বইমেলা দেখার আগে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী পাঠক সমাজ জেলা বইমেলার আনন্দ উপভোগ করেই থাকেন।

দিন দিন এতো অগ্রগতির পরেও অনেক বাঁধা - বিঘ্নকে অতিক্রম করেই এখানে প্রকাশনা শিল্প নিজস্বতার বলিষ্ঠ উচ্চারণ শানিত করে চলেছে। উপহার হিসাবে 'বই ' এই ধারণা এখানে একেবারেই জনপ্রিয় নয়, যা হলে আখেরে সমাজের জন্যই কল্যাণকর। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা সঠিক থাকলে এই শিল্প অনেক বেশি ও দ্রুত এগিয়ে যেতে সক্ষম হতে পারতো।বহিঃরাজ্য থেকে ছেপে আনার ব্যয় বহুলতা, বই বিপণনে এখানকার প্রকাশকেরদের প্রচার- প্রসারে কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে, যা ভবিষ্যতে কাটিয়ে উঠতে পারলে হয়তো বইয়ের বিপণন আরো উন্নত তর হবে।এছাড়াও পান্ডুলিপি নির্বাচন একটা ভালো গ্রন্থের জন্য আবশ্যিক, এডিটিং, প্রুফ রিডিং সহ বেশ কিছু অভাব এখানে সফলতার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে । বর্তমান সময়ে 'অনলাই লার্নিং ' ব্যবস্থা ছাপা বইয়ের কদর করে না বরং ' ই- বুক' অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায়। এটা শুধু ত্রিপুরা নয় সর্বত্রই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

বাংলা ভাষা ছাড়াও মণিপুরী, চাকমা,ককবরক, ইংরেজি সহ অন্যান্য ভাষাভাষী পাঠকের সহাবস্থান এখানকার পাঠ সংস্কৃতিকে উর্বর করে তুলেছে। বহু সংখ্যক লিটল ম্যাগাজিনের প্রকাশ ও গুণমান যেকোনো বঙ্গভাষী অঞ্চলের ছোট পত্রিকাকে সমান টক্কর দিতে পারে বলেই বিশ্বাস রাখি। এছাড়াও দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক সব মিলিয়ে নিয়মিত প্রকাশের উন্মাদনা তো রয়েইছে।

শত বাঁধা অতিক্রম করে ত্রিপুরার প্রকাশনা শিল্প সলতে পাকানোর পর্ব শেষ করে এখন পূর্ণ যৌবনে দৃপ্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে। লেখক- পাঠক ও প্রকাশ এখানে একে অপরের সহোদর। আর এই মনোভাব এই শিল্পের জন্য খুব জরুরী। কেনো না বই কোনো পণ্য নয়, বই মনের আরাম, জীবনের মুক্তির দূত। এখানেই ধরা দিতে হবে সকলকে, একবার নয় বারংবার পুনর্বার। তাই অনায়াসেই একথা বলা যায় ত্রিপুরার প্রকাশনা শিল্পের ভবিষ্যত সম্ভাবনা ক্রমশ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে ,যা সময়ের ব্যবধানে এক নতুন দিগন্তের সূচনা ঘটাবে ।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.