৩ বছরে এডিসি-র উন্নয়নে ভিসন ডকুমেন্টের অর্ধেক প্রতিশ্রুতিও কি রক্ষা হল ?
জয়ন্ত দেবনাথ
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ মন্ত্রকে পাথেয় করে সমাজের সকল অংশের মানুষের সম উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৮ সালে বিজেপি আইপিএফটি-র সাথে জোট বেঁধে বিজেপি ত্রিপুরার শাসন ক্ষমতায় এসেছে। বলা হয়েছিলো বিগত ২৫ বছরে টানা বাম শাসকরা ত্রিপুরার জাতি উপজাতি অংশের মানুষের সার্বিক উন্নয়নে আশানুরূপ কাজ করেনি। বিশেষত উপজাতি অংশের মানুষ ২৫ বছরের বাম শাসনে সবচেয়ে বেশী বঞ্চিত ও উপেক্ষিত ছিল। তাই গত বিধানসভা ভোটের আগে প্রাক নির্বাচনী প্রচারে রাজ্যবাসীর কল্যানে বিজেপি ২৯৯ খানা লোভনীয় বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এর মধ্যে এডিসি এলাকার মানুষের উন্নয়নে ১৪টি সুনির্দিষ্ট বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। গত বিধানসভা ভোটের আগে বিজেপি অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিল-সরকার গঠন করতে পারলে ত্রিপুরার জনজাতি অংশের জনগনের আর্থ-সামাজিক, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের প্রতি দৃষ্টি দেবেন। মানুষ বিজেপি-আইপিএফটি জোটের নেতাদের প্রাতিশ্রুতি ও কথায় বিশ্বাস করে তাদের ভোট দিয়েছিল। আর ক্ষমতায় আসার পর ভিসন ডকুমেন্টে বর্নিত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সব কাজ করতে পারছেনা বিধায় গ্রাম পাহাড় শহরে আজ বহু মানুষ কর্মহীন, দিশাহীন। যদিও বিজেপি-র নেতা মন্ত্রীরা এই কথা মানতে নারাজ কিন্তু বিজেপি সরকারের জোটের শরিক আইপিএফটি-র নেতারা এডিসি-ভোটের মুখে বলতে শুরু করেছেন গত তিন বছরে বিজেপি রাজ্যের উপজাতি অংশের মানুষের সামগ্রিক কল্যাণে উল্লেখযোগ্য কোন কাজ করেনি।
বিজেপি সরকার ক্ষমতায় এসে গত তিন বছরে রাজ্যের উপজাতিদের উন্নয়নে কি কি কাজ করেছেন এব্যাপারে তথ্য দপ্তরের মাধ্যমে একটি প্রচার পুস্তিকা গত ৯ ফেব্রুয়ারী প্রকাশ হয়েছে। এর থেকে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তাতে একবার চোখ রাখলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে গত তিন বছরে বিজেপি সরকার এরাজ্যের উপজাতি অংশের মানুষের উন্নয়নের নামে কি কি করেছেন। বিজেপি-সরকারের তিন বছরের সাফল্যের গীত গাইতে গিয়ে ওই প্রচার পুস্তিকায় বলা হয়েছে- “১১৬টি বিদ্যালয়ে ককবরক ভাষাকে একটি বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ককবরক সহ আরও সাতটি ভাষার জন্য নতুন উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে। মাতৃভাষায় শিক্ষা দানে উৎসাহিত করতে ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন শ্রেণিতে চাকমা, গারো, মণিপুরী ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার পাঠ আরো উচ্চতর শ্রেণিতে শুরু হয়েছে। লুপ্তপ্রায় সংস্কৃতির পুনরুদ্ধারে রাজ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি পদ্মশ্রী থাংঙ্গা ডালং, পদ্মশ্রী বেণীচন্দ্র জমাতিয়া এবং পদ্মশ্রী সত্যরাম রিয়াং। এই সম্মান জাতীয়স্তরে রাজ্যকে গৌরবান্বিত করেছে”।
বিজেপি সরকারের তিন বছর পূর্তির সাফল্যের প্রচার পুস্তিকায় এই কটি কথাই বলা আছে। তবে অর্থমন্ত্রী হিসাবে উপ মুখ্যমন্ত্রী যীষ্ণু দেববর্মণ গত ১৯ মার্চ রাজ্য বিধানসভায় ২০২১-২০২২ সালের বাজেট ভাষণে রাজ্যের জনজাতিদের কল্যাণে গত তিন বছরে বিজেপি সরকার কি কি করেছেন তার একটা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। উপ মুখ্যমন্ত্রী যীষ্ণু দেববর্মণ রাজ্য বিধানসভায় যা যা বলার চেষ্টা করেছেন তার রূপরেখাটি অনেকটা এরকমঃ
সরকার ক্ষমতায় আসার তিন বছরের মধ্যে জনজাতিদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এক নতুন উচ্চতার শিখরে পৌছেছে। সারা বিশ্বে ‘রিসা’ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। সম্প্রতি হজাগিরি নৃত্যের প্রসার ও বিকাশে বিশেষ অবদানের জন্য শ্রী সত্যরাম রিয়াং পদ্মশ্রী খেতাব লাভ করেন। রাজ্য সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে ত্রিপুরার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী নাগরিকদের কল্যাণ এবং প্রত্যন্ত জনজাতি এলাকার ছাত্রছাত্রীদের গুনগত শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা। ৭টি একলব্য মডেল আবাসিক বিদ্যালয় নির্মানের কাজ শীঘ্রই শুরু হবে। জনজাতি ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাগত মানদন্ড উন্নত করতে রাজ্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। আবাসিক ছাত্রাবাস ও ছাত্রী আবাস গুলিতে শিক্ষার গুনগত মানোন্নয়নের লক্ষ্যে মিশন মোডে একটি বহুমুখী প্রকল্প গ্রহন করা হচ্ছে। মেধাবী দরিদ্র উপজাতি ছাত্রছাত্রীদের এককালীন ১ লক্ষ টাকা সহায়তা দেওয়া হবে। এস এস সি ( SSC), আইবিপিএস (IBPS), টিপিএসসি (TPSC), ইউপিএসসি ( UPSC), আর আর বি ( RRB), টেট (TET) ইত্যাদি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য উপজাতি ছাত্রছাত্রীদের ইন্সেন্টিভ ভিত্তিক কোচিং দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ত্রিপুরার উপজাতি ছাত্রছাত্রীদের সুবিধার্থে মেঘালয়ের শিলং-এ হোস্টেল নির্মানের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে।
যদিও পূর্ববর্তী সরকার বন আইন ( ROFT Act, 2006) -এর অধীন প্রায় ১.৩০ লক্ষ পাট্টা প্রদান করেছিল, কিন্তু বহু পাট্টা প্রাপকদের জমির সীমানা নির্ধারিত করা হয়নি, কিন্তু এখন রাজ্য সরকার জিপিএস (GPS) নির্ভর হস্তচালিত ডিভাইস-এর মত প্রযুক্তি ব্যবহার করে জমির সীমানা নির্ধারনের উদ্যোগ নিয়েছে। জমির মালিকদের জমির অধিকার সংক্রান্ত (Record of Rights) কাগজ দেওয়া হবে যাতে জমির পাট্টার বিস্তারিত বিবরণও থাকবে। জুম চাষ পদ্ধতিকে পুনর্বিন্যাস করতে বাজারজাতকরণের সুবিধা সহ টেকসই জৈব ও আধুনিক কৃষিকাজ (Sustainable Organic Farming) ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হবে। তাতে জুমিয়াদের জীবনযাপনের ধরণ ও আর্থ সামাজিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন আসবে। রাজ্য সরকার উপজাতি গবেষণা এবং সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট (Tribal Research and Cultural Institute)-এর ওয়েবসাইট পুনরায় ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে, যাতে যে কেউ সমস্ত ধরনের তথ্য অনলাইনে পেতে পারে।
তাছাড়া, রাজ্য সরকার জনজাতি সম্প্রদায়ের শিল্প ও সংস্কৃতির সংরক্ষনে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। সেই লক্ষ্যে রাজ্য সরকার ভারত সরকারের জনজাতি বিষয়ক মন্ত্রকের কাছে ৩৫১১ লক্ষ টাকার একটি প্রকল্পের প্রস্তাব জমা দিয়েছে। এই প্রস্তাব লেম্বুছড়াতে মিউজিয়াম সহ উপজাতি গবেষণা এবং সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট এর একটি অফিস কমপ্লেক্স নির্মাণ, ফুড কোর্ট, ১৯টি জনজাতি সম্প্রদায়ের জন্য কুটির নির্মান এর জন্য বরাদ্দ ধরা রয়েছে। সেজন্য লেম্বুছড়াতে ১০.০১ একর জমি চিহ্নিত করা হয়েছে এবং উপজাতি গবেষণা এবং সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটকে জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। ভারত সরকার এখন পর্যন্ত এই কাজে প্রশাসনিক ভবন ও বাউণ্ডারি ওয়াল নির্মানের জন্য ৪৬১.০৪ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছে। উপজাতি গবেষণা এবং সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট এছাড়াও বেশ কিছু গবেষনামূলক কাজ ও মূল্যায়নের প্রকল্পও হাতে নিয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে মিলে ২০২০-২১ সালে চারটি জাতীয় স্তরের সেমিনারের আয়োজন করা হয়। স্বামী বিবেকানন্দ স্টেডীয়ামে চারদিনব্যাপী জনজাতি সংস্কৃতি উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে এবং ৪১টি বই প্রকাশিত হয়। বর্তমানে ১৩৮৭টি বিদ্যালয়ে দ্বাদশ শ্রেনী পর্যন্ত ককবরক শেখানো হচ্ছে। ককবরক এবং আরও সাতটি সংখ্যালঘু ভাষার বিকাশে রাজ্যে বিভিন্ন মেগাজিন ও বই প্রকাশিত হচ্ছে। রাজ্যের ভাষাগত সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষার জন্য জেলা পর্যায়ের সেফগার্ডস বাস্তবায়ন কমিটি (District Level Safeguards Implementation Committee) গঠন করা হয়েছে। অর্থাৎ এক কথায় উপমুখ্যমন্ত্রী তথা অর্থমন্ত্রী-র বাজেট ভাষণেও গত তিন বছরে উপজাতি কল্যাণে বিজেপি সরকারের সাফল্য সীমিত। উপমুখ্যমন্ত্রী যীষ্ণু দেববর্মণ রাজ্য বিধানসভায় যা যা বলার চেস্টা করেছেন তারও প্রায় সিংহভাগই হচ্ছে আগামী দিনে কি কি করা হবে এব্যপারে। তাহলে গত তিনবছরে রাজ্যের উপজাতি অংশের মানুষের জন্যে নতুন করে হয়েছেটা কি? এই প্রশ্ন উঠা ও তোলা স্বাভাবিক। কেননা, ২০১৮ সালের বিধানসভা ভোটের প্রাক্কালে ভিসন ডকুমেন্টের নামে বিজেপি রাজ্যের উপজাতি অংশের মানুষের সার্বিক কল্যানে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দেখা গেছে সেসব প্রতিশ্রুতির খুব একটা কিছু বাস্তবায়ন বিজেপি সরকার গত তিন বছরে করতে পারেনি।
ত্রিপুরা বিধানসভা ভোট ২০১৮– এর প্রাক্কালে এডিসি এলাকার উন্নয়নে বিজেপি-র ভিসন ডকুমেন্টে বর্ণিত প্রধান প্রধান প্রতিশ্রুতি সমূহ ও তার রূপায়ণ (২২/৩/২০২১ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী)