সংবিধানের 16 নং ধারা অনুযায়ী সরকারী দপ্তরে আউটসোর্সিং বেআইনী
পুরুষোত্তম রায়বর্মন
21 মার্চ সন্ধ্যার সময় একদল যুবক যুবতী এসেছিল চেম্বারে। তাদের অনেকেই বিএসসি নার্সিং পাস করেছে । বাকিরা জি এম এন ডিগ্রিধারী। পড়াশোনা করে চাকরি প্রত্যাশী। ত্রিপুরাতে স্টাফ নার্স এর 468 টি পদ খালি। রোগী অনুপাতে নার্সের সংখ্যা অত্যন্ত কম। হাসপাতালগুলোতে নার্সদের উপর কাজের অত্যধিক চাপ। এক একজন নার্সকে 50- 60 জন করে রোগী দেখতে হয় । শূন্য পদে নিয়োগের অপেক্ষায় নার্সিং কোর্স শেষ করা ছাত্র ছাত্রীরা। অধীর অপেক্ষা। আগন্তকদের কাছে আসার কারণ জানতে চাইলাম । তারা জানালো, রিজিওনাল ক্যান্সার সেন্টারে, যা বর্তমানে অটল বিহারি বাজপেয়ির নামে নামাঙ্কিত, 26 জন স্টাফ নার্সকে নিয়োগ করা হয়েছে গোপনে লোকচক্ষুর অন্তরালে। তারা জানালো , নিয়োগের জন্য দরখাস্ত আহবান করে কোন বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়নি । স্বভাবতই তারা দরখাস্ত করার কোন সুযোগ পায়নি। তাদের প্রত্যেকেরই যোগ্যতা ছিল স্টাফ নার্স পদে নিযুক্ত হওয়ার। কিন্তু তাদেরকে ঘুমে রেখে 26 জনকে নিয়োগ করা হয়েছে। আমি তাদের কাছ থেকে জানতে চাইলাম , তোমরা কিসের ভিত্তিতে বলছো , 26 জন স্টাফ নার্সকে বাঁকা পথে নিয়োগ করা হয়েছে। তখন তারা আমাকে তথ্যের অধিকার আইনে প্রাপ্ত কাগজপত্র দেখালো। আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পে অটল বিহারি বাজপেয়ি রিজিওনাল ক্যান্সার সেন্টারে চুক্তির ভিত্তিতে 26 জন স্টাফ নার্সকে নিযুক্ত করা হয়েছে। হাসপাতালে রোগী কল্যাণ সমিতির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই 26 জন স্টাফ নার্সকে নিযুক্তির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল লোকমান্য মাল্টিপারপাস কোপারেটিভ সোসাইটিকে। ওই সোসাইটি দায়িত্ব পেয়ে 26 জন স্টাফ নার্সকে নিযুক্তি দিয়েছে । আউটসোর্সিং। বহুদিন ধরেই আউটসোর্সিং শুরু হয়ে গেছে। ডবল ইঞ্জিনের হীরা সরকার সরকারী পদে নিযুক্তির ক্ষেত্রে বাঁকা পথ অনুসরণ করছে। মিসকলে হাজার হাজার চাকরির গল্পের গাছ থেকে সবগুলো পাতা ঝরে পড়ে গেছে। দাঁড়িয়ে আছে আউটসোর্সিংয়ের দানব বিকট চেহারা নিয়ে। যে কিছু পদে চাকরি হচ্ছে সেখানে ন্যূনতম বেতনে দাসখত দিয়ে প্রাইভেট এজেন্সিগুলোকে মোটা টাকার বিনিময়ে চাকুরী বিক্রি হচ্ছে।
আউটসোর্সিং এর অর্থ হল যোগ্য প্রার্থীরা নিযুক্তির জন্য বিবেচিত হওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন । এই যে 26 জন স্টাফ নার্স কে নিয়োগ করা হলো তার জন্য কোন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছিল না । যদি বিজ্ঞপ্তি থাকতো তবে সমস্ত যোগ্য প্রার্থীরা আবেদন করার সুযোগ পেতেন । বিবেচিত হওয়ার সুযোগ পেতেন। সংবিধানের 16 ধারায় স্পষ্টভাবে নির্দেশ দেওয়া আছে "There shall be equality of opportunity for all citizens in matters relating to employment or appointment to any office under the State". অর্থাৎ সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সমস্ত যোগ্য প্রার্থীদের বিবেচিত হওয়ার সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে এবং যোগ্য প্রার্থীদের মধ্য থেকে স্বচ্ছ এবং সুষ্ঠ বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্য থেকে যোগ্যদের নির্বাচিত করে নিয়োগ করতে হবে। সরকার পরিচালিত নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি হয়, স্বজনপোষণ হয় তা সত্যি। এর বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে । সহকারী পদে নিযুক্তির দায়িত্ব কি বেসরকারি সংস্থাকে দেওয়া যায় ? সরকারী পদে নিযুক্তির ক্ষেত্রে সব নাগরিকের জন্য সম সুযোগ নিশ্চিত করার সাংবিধানিক দায়িত্ব কি সরকার ছেড়ে দিতে পারে বেসরকারি সংস্থার হাতে। এই দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার অর্থ হল সরকারের অবশ্য পালনীয় সাংবিধানিক দায়িত্ব অস্বীকার করা। যে যুবক যুবতীরা আমার কাছে এসেছিল তারা জানালো যে প্রাইভেট এজেন্সির বিরুদ্ধে মোটা টাকার বিনিময়ে চাকুরী বিক্রির অভিযোগ আছে । স্বভাবতই তারা ক্ষুব্দ ও হতাশ। আমি তাদেরকে বললাম, তোমরা একটা কাজ করো , সরকারে যারা আছেন তাদেরকে বলো সরকার চালানোর দায়িত্বটাও প্রাইভেট কোম্পানির হাতে তুলে দিয়ে আপনারা কেন বিশ্রামে যাচ্ছেন না। তারা উত্তরে কিছু বলল না।
এই মানসিক প্রস্তুতি এখনো তাদের হয়নি। কিন্তু ঘটনা প্রবাহ তাদের মত শিক্ষিত বেকারদের নিয়ে যাচ্ছে এমন জায়গায় যেখানে দাঁড়িয়ে তাদের কাছে তীব্র আন্দোলন ছাড়া অন্য বিকল্প থাকবে না। আউটসোর্সিং এর অর্থ হল পেটুয়া কিছু সংস্থাকে চাকরি বিক্রির লাইসেন্স দেওয়া। সরকারী পদে ন্যূনতম মজুরিতে আধুনিক দাস শ্রমিক নিযুক্তির ব্যবস্থা করা এবং যারা আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে ন্যূনতম মজুরিতে চূড়ান্ত অসম্মানজনক বিবিধ শর্তে চাকরি পাবেন কর্মস্থলে তাদের কোনো অধিকার থাকবে না। থাকবে শুধু অনিশ্চয়তা ও অপমান। সমস্ত অধিকারহীন ক্লীবে পরিণত হবে । যুবক যুবতীদের সাথে আলাপচারিতায় বললাম আউটসোর্সিং উদার অর্থনীতির বিষময় ফল। তারা ভয়-ভীতি কাটিয়ে এই বাঁকা পথে আউটসোর্সিং এর নামে পেটুয়া সংস্থার মাধ্যমে চাকরি বিক্রির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে তৈরী জানালো। দুই ফ্রন্টে লড়াই চাই । আদালতে ও আদালতের বাইরে। যুবকদের এই লড়াইয়ের পাশে আমরা থাকবো।