বেকার সমস্যা গভীরতর হচ্ছে ত্রিপুরায়
জয়ন্ত দেবনাথ
২০১৮-এর ৯ মার্চে নতুন সরকার গঠন করে ৫ জুন ২০১৮ বিপ্লব দেব-এর নয়া মন্ত্রিসভা রাজ্যের আপামর বেকারদের কথা মাথায় রেখে তাদের ভাষায় বাম আমলের ভুলে ভরা নিয়োগ নীতি সংশোধন করে স্থানীয় বেকারদের স্থানীয়ভাবে বেশী করে সরকারী দপ্তরে নিয়োগের লক্ষ্যে একটা নয়া নিয়োগ পলিসি তৈরি করে দিয়েছিলেন। ইতিপূর্বে ভোটের আগে বিপ্লব দেব ও তৎকালীন বিজেপি-র অন্যতম বড় প্রচারের মুখ সুনীল দেওধর একটি ফোন নম্বর প্রচার করে “যে আগে মিস কল দেবে তাকে আগে চাকুরী” দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছি্লেন। তাছাড়া তারা তখন সবচেয়ে বেশী সোচ্চার ছিলেন সরকারী দপ্তরে বুড়োদের পুনঃ নিয়োগ নিয়ে। কিন্তু ইদানিং দেখা যাচ্ছে সরকারী দপ্তরে কিছু কিছু ক্ষেত্রে লোক নিয়োগ হলেও তা হচ্ছে বেসরকারী কোম্পানী মারফৎ। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘ভোকাল ফর লোকাল’-এর যে জয়ধ্বনি দিয়ে দেশজুড়ে আলোড়ন ফেলে দিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর সেই ইচ্ছাকেও বহু ক্ষেত্রে এরাজ্যের সরকারী দপ্তর গুলি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি দেখাচ্ছেন ক্রমাগত, তা কৃষি কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগই হোক কিংবা পর্যটন নিগমের এম ডি নিয়োগ কিংবা অডিট দপ্তরের অধিকর্তা বাছাই সব ক্ষেত্রেই খোঁজ চলছে পার্টটাইম ও বহিঃরাজ্যের লোক। প্রতিটি ক্ষেত্রেই লোক বাছাই-র যোগ্যতা এমন ভাবে নিরূপণ করা হচ্ছে স্থানীয় বেকার কিংবা অবসর-প্রাপ্তরা ইন্টারভিউ-র জন্যে আবেদনই করতে পারছেনা। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হল যেসব কোম্পানি গুলি আউট সোর্সিং-এর মাধ্যমে লোক সরবরাহ করছে এরাও খুব কম টাকা দিয়ে বেকারদের সরকারী দপ্তর গুলিতে সরবরাহ করছে। গত ২৬শে ফেব্রুয়ারি রাজ্য সরকারের কর্ম বিনিয়োগ দপ্তর রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ৪০০০ বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগের জন্যে পাঁচটি বেসরকারী কোম্পানীকে আউট সোর্সিং এজেন্সী হিসাবে ‘এমপেনেল্ড’ করেছেন। রাজ্য কর্ম বিনিয়োগ দপ্তরের অধিকর্তা নরেশ বাবু-র স্বাক্ষরিত ওই সরকারী মেমোরেন্ডাম অনুযায়ী আউট সোর্সিং কোম্পানী গুলির মাধ্যমে যেসব বেকাররা নিযুক্তি পাবেন তাদের গ্রুপ ডি বা সাপোর্ট স্টাফ ওয়ান ও টু-র নন মেট্রিক বিভিন্ন পদে কাজের জন্যে সর্বোচ্চ ৭২৮০ টাকা এবং বিভিন্ন টেকনিক্যাল পদে যেখানে পদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নুন্যতম স্নাতক, স্নাতকোত্তর বা এম বি এ সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭০৬৮ টাকা। এবং চাকুরী প্রার্থীর সর্বোচ্চ বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ বছর। অর্থাৎ রাজ্য কর্ম বিনিয়োগ দপ্তরের মেমোরেন্ডামেই বলে দেওয়া হয়েছে একজন এমবিএ কিংবা মাস্টার ডিগ্রির বেকারের সর্বোচ্চ বেতন হবে ১৭০৬৮ টাকা। অথচ যেসব পদগুলিতে এসব বেকারদের নিযুক্তি হবে, দেখা গেছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই সব পদ গুলি কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন প্রজেক্টের জন্য প্রযোজ্য। এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ওই প্রজেক্টে শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে বেতন অনেক বেশি টাকা ধরা রয়েছে। যেমন রাজ্য সরকারের এন এইচ এম কিংবা এম জে এন রেগা কিংবা পঞ্চায়েতের একজন ডাটা এন্ট্রি অপারেটরের বেতন যেখানে কেন্দ্রীয় প্রকল্পে ১০ হাজারেরও বেশী সেক্ষেত্রে কর্ম বিনিয়োগ দপ্তরের নির্ধারণ করে দেওয়া আউটসোর্স এজেন্সি গুলি বেতন অনেক কম। অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট যেখানে সম্প্রতি ও অতীত একাধিক রায়-এ সম কাজে সম বেতনের সুপারিশ করেছে সেক্ষেত্রে এরাজ্যে একই কাজের জন্যে একই রাজ্যের একেকটি দপ্তরের স্থায়ী ও অস্থায়ী কাজের জন্যে একেক রকম বেতন নির্ধারণ করে দেওয়া হলো সরকারী ভাবেই। তাছাড়া একজন এমবিএ কিংবা মাস্টার ডিগ্রীর স্কিলড ম্যান-পাওয়ার এত কম টাকায় পাওয়া যাবে কিনা তাও সন্দেহ। তাই দরপত্রের ভিত্তিতে কর্ম বিনিয়োগ দপ্তর পাঁচটি কোম্পানীকে বাছাই করলেও প্রকৃতপক্ষে যে এত কম টাকায় ভালো লোক পাওয়া যাবেনা এটা কর্ম বিনিয়োগ দপ্তরের একাধিক অফিসারও স্বীকার করেন।
পক্ষান্তরে, স্থানীয় বেকারদের কর্ম বিনোগের দপ্তরের মাধ্যমে নিয়োগের নামে এল ডি সি গ্রুপ-ডি ইত্যাদি বিভিন্ন পদে পাঁচ হাজার-এরও বেশী বিভিন্ন পদে জয়েন্ট রিক্রুটমেন্ট বোর্ড পত্র পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। আবার ‘সফেদ’ (SOFED)- এর মাধ্যমেও লোক নিয়োগের নামেও ক’দিন বাদেই পত্র পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। একই পদে লোক নিয়োগের নামে একবার বিজ্ঞাপন দেওয়ানো হচ্ছে কর্ম বিনিয়োগ দপ্তরের মাধ্যমে আবার সেই একই বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে ত্রিপুরা জয়েন্ট রিক্রুটমেন্ট বোর্ড-এর মাধ্যমে। বিজেপি আইপিএফটি জোট সরকার ক্ষমতায় আসার কিছুদিন বাদেই পুলিশের টি এস আর (আই আর)-এর দুটি নয়া ব্যাটেলিয়ানের জন্যে দুই হাজার লোক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারী হয়েছিল। ৪২ হাজারের মতো বেকার আবেদন করেছিল। কিন্তু দুই বছরেরও বেশী সময় হয়ে গেছে টি এস আর-এর এই নিয়োগ প্রক্রিয়া একটুকু এগুয়নি। একই রকমভাবে পুলিশের পাঁচ শতাধিক কনস্টেবল পদে, মাল্টি টাস্কিং, এল ডি সি, পাম্প অপারেটর, এগ্রি এসিস্টেন্ট ইত্যাদি পাঁচ হাজারেরও বেশী পদে এখন পর্যন্ত বিজ্ঞপ্তি জারী করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আরও একটি বড় চাঞ্চল্যকর বিষয় হলো কর্ম বিনিয়োগ দপ্তর, সফেদ কিংবা নবগঠিত কমন রিক্রুটমেন্ট বোর্ড চাকুরীর বিজ্ঞপ্তি জারীর সময় এটা বলছেন না যে কোন দপ্তরের জন্যে লোক নিয়োগের বিজ্ঞাপনটি তারা প্রচার করছেন। অথচ দপ্তরহীন হাজার হাজার শূন্য পদের নামে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারী হচ্ছে একের পর এক। আর কিছু দিন বাদে বাদেই মুখ্যমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী পরস্পর বিরোধী নানা রকম সংখ্যা দিচ্ছেন প্রচুর পরিমাণে বেকারদের চাকুরী এবং কর্মসংস্থান হচ্ছে বলে। কেননা, ৪ ডিসেম্বর, ২০২০ রাজধানীর শকুন্তলা রোডে আয়োজিত এক সভায় মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেন, ২০১৮ সাল থেকে ২০২০ সালের ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৪,৭৯৮ জনের নিয়মিত বেতনক্রমে চাকরি হয়েছে। এ সময়ে ডাই-ইন-হারনেসে চাকরি হয়েছে ৭৬৭ জনের। আউট সোর্সিংয়ে চাকরি পেয়েছেন ৪৫৮৭ জন, চুক্তি ভিত্তিক চাকরি হয়েছে ২৮৪৯ জনের। মুখ্যমন্ত্রী-র দাবি ৩৩ মাসে সব মিলিয়ে তেইশ হাজার চাকরি হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর তথ্য অনুসারে এই সময়ে স্বরোজগার, স্কিল ডেভেলাপমেন্ট সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সব মিলিয়ে লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। তাছাড়া, সাব্রুমে স্পেশাল ইকোনমিক জোন (SEZ) চালু হয়ে গেলে কম করেও আড়াই লাখের বেশী বেকারের কর্মসংস্থান হবে- মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যেই একাধিক বার একাধিক সভায় একথা বলেছেন।
পক্ষান্তরে, গত ১৪ জানুয়ারি ২০২১ মহাকরণে সাংবাদিকদের শিক্ষামন্ত্রী রতনলাল নাথ বর্তমান সরকারের সময়ে চাকরি প্রদানের কিছু তথ্য তুলে ধরেছেন। শিক্ষামন্ত্রী-র প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী গত ৩৩ মাসে রেগুলার পদে চাকরি হয়েছে ২৯৪৪ জনের, ২২৫০ জন চুক্তিবদ্ধ, আউটসোর্সিং-এর মাধ্যমে ১৯৫৬ জন, ৪০১ ডাই-ইন হার্নেসে চাকরি পেয়েছেন। চাকরির প্রক্রিয়ায় ১১ হাজার ৮০০ এবং ৩ হাজার ৩৭৩টি পদে শীঘ্রই অফার ছাড়ার বিষয়টি তুলে ধরেছেন শিক্ষামন্ত্রী। প্রশ্ন উঠেছে, আউটসোর্সিং-এর চাকরি মানেই সরকারি চাকরি কিনা, এটা সাধারণ ভাবে সকলের কাছে পরিষ্কার নয়। তবে এই সময়ের মধ্যে বিরোধীরা বিজেপি-র নির্বাচন পূর্ব ভিশন ডকুমেন্টের উল্লেখ করে রাজনৈতিক আক্রমণ শানিত করছে। ভিশন ডকুমেন্টে বিজেপি ঘরে ঘরে কম করেও একটি করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো। প্রতিশ্রুতি ছিলো বিজেপি ক্ষমতায় এলে প্রথম এক বছরে ৫০ হাজার বেকারের চাকরি প্রদান করা হবে। সেই ক্ষেত্রে অফার ছাড়া, নিয়োগ এবং শীঘ্রই নিয়োগপত্র ছাড়া সবকটি বিষয় যোগ করেও গত এক বছরে তা হয়নি। শিক্ষামন্ত্রী-র প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী ১৮ হাজারের মতো বিভিন্ন পদে চাকরি হয়েছে। আর মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ২৩ হাজার চাকুরি প্রদানের কথা এবং স্বরোজগার, স্কিল ডেভেলাপমেন্ট সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সব মিলিয়ে লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। ইতিমধ্যেই বিজেপি সরকারের তিন বছর পূর্ণ হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মানুষের ঘরে ঘরে কর্মসংস্থান, ৫০ হাজার বেকারকে প্রথম বছরেই চাকুরির প্রতিশ্রুতি পুরনে যে অনুযায়ী আশানুরূপ সাফল্য আসেনি এটা বিভিন্ন সময় মুখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর প্রদত্ত তথ্যেই স্পষ্ট।
উপরুন্ত, এবার রাজ্য সরকার বেসরকারি মালিকদের কাছে ফিডার পোস্ট সহ ৪ হাজার সরকারি পদে আউট সোর্সিং-এর মাধ্যমে লোক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতিমধ্যেই রাজ্য সরকারের মেন পাওয়ার দপ্তর পঞ্চায়েত এক্সটেনশন অফিসার, ফুড ইন্সপেক্টর, এক্সাইজ ইন্সপেক্টর, আই সি ডি এস সুপারভাইসর, স্টেনোগ্রাফার, পিএ, লেবার অফিসার, এক্সাইজ অফিসারের মতো পদেও বেসরকারি সংস্থাকে লোক সরবরাহের বরাত দিয়ে দিয়েছেন। মেন পাওয়ার দপ্তর মোট ৭টি ক্যাটাগরিতে ৪ হাজার সরকারি পদে আউট সোর্সিং-এর মাধ্যমে লোক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে - সাপোর্ট স্টাফ—এসএস -১, সাপোর্ট স্টাফ— এসএস- ২, জেনারেল অফিস স্টাফ (জিও এস -৩), জেনারেল টেকনিক্যাল অফিস স্টাফ (টিওএস-১) এবং টেকনিক্যাল অফিস স্টাফ (টিওএস-২)। এই ৭টি ক্যাটাগরিতে যথাক্রমে ৮০০, ৬০০, ৮০০, ৬০০, ৫০০, ৪০০ এবং ৩০০ লোক, অর্থাৎ মোট ৪,০০০ কর্মচারী সরবরাহের কথা বলা হয়েছে মেন পাওয়ার দপ্তর-এর একটি বিজ্ঞাপনে।
রাজ্য সরকারের তরফে সরকারী দপ্তরের ৪,০০০ পদ এভাবে আউট সোর্স করে দেওয়ার এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে চাঞ্চল্যই সৃষ্টি হয়েছে। কারণ ঐ পদ গুলোর মধ্যে অনেক গুলোই ফিডার পোস্ট। এতদিন ত্রিপুরা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই উল্লেখিত পদগুলিতে নিয়োগ চলছিল। সেই পদ্ধতির পরিবর্তনেই কর্মচারীদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে সবচেয়ে বেশী। কারন এই পদ গুলো এতদিন ধরে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এখন বেসরকারি কোম্পানির মাধ্যমে লোক নিয়োগ হলে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নটিও অচল হয়ে যাবে। সরকারি প্রশাসন যন্ত্রে কায়েম হবে বেসরকারি মালিকদের আধিপত্য। সব মিলিয়ে এক জটিল অবস্থার মুখে পড়বে রাজ্যের প্রশাসনিক ব্যবস্থা।
দেশজুড়েই আজকাল সরকারী চাকুরীর বাজারে মন্দা। তাই স্থানীয় বেকারদের স্থানীয় প্রশাসনে চাকুরী পাইয়ে দিতে আসাম, সিকিম, বিহার, মধ্য প্রদেশ থেকে শুরু করে মহারাষ্ট্র সরকার একের পর এক নানা রকম কঠোর আইন নিয়ে আসছেন। কিন্তু এরাজ্যের চাকুরী বাগিয়ে নিতে ভিন রাজ্যের বেকারদের সুযোগ করে দিচ্ছেন এরাজ্যের ‘জনপ্রিয় জনতার সবকা সাথ সবকা বিকাশের সরকার’। কেননা, ২ জানুয়ারি ২০২১ রাজ্য সরকারের সাধারণ প্রশাসন দপ্তর থেকে ২০১৮ সালের ৫ জুনের নিয়োগ নীতিতে সংশোধনী এনে বাংলা এবং ককবরককে ঢোকানো হলেও রাজ্য সরকারের চাকুরীতে বাংলা জানাটা পুরুপুরি বাধ্যতা মূলক করা হয়নি। শুধু বলা হয়েছে ইন্টারভিউতে বাংলা ও ককবরক জানার জন্য কিছু অতিরিক্ত নম্বর যোগ্যতা বাছাই-এর ক্ষেত্রে প্রদান করা হবে এবং তা শুধু সরকারি দপ্তরে ডাইরেক্ট রিক্রুটমেন্ট-এর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। এক্ষেত্রে আবার টেকনিক্যাল/হাইলি স্কিলড বিভিন্ন পদে স্থানীয় ভাবে যোগ্য প্রার্থী যেসব ক্ষেত্রে পাওয়া যাবে না সেই সব পদ গুলিতে এই শর্তটি প্রযোজ্য হবে না বলেই সংশোধনিতে উল্লেখ করে রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে অবশ্য টেকনিক্যাল/হাইলি স্কিলড মেন পাওয়ার কোন গুলি তা স্পষ্ট করে সংশোধনিতে বলা না থাকায় স্বাভাবিক ভাবেই সেসব পদে যে বহিঃরাজ্যের তথাকথিত কৃতিদেরই সুযোগ করে দেওয়ার ফন্দি এটে রাখা হয়েছে তা বলাই বাহুল্য।
রাজ্যের ট্রেডার ও ঠিকাদার মহলে ইতিমধ্যেই অভিযোগ উঠেছে, প্রশাসনের একটি অংশের অফিসাররা বহিঃরাজ্যের লোকদের ঠিকাদারী বা মালামাল সরবরাহের বরাত পাইয়ে দিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, যেসব আউট সোর্সিং কোম্পানি মারফৎ স্থানীয় যুবকদের চাকুরী হচ্ছে তা টিআরএলএম, জাইকা প্রজেক্টই হোক কিংবা টি এস ই সি এল বা স্কিল মিশন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিয়োগকর্তা এসব কোম্পানী গুলিও বহিঃরাজ্য থেকে আমদানী করা হচ্ছে। অথচ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব নিজেও ইদানিং ‘ভোকাল ফর লোকাল’ এর কথা বলছেন প্রতিটি সভা সমিতি কিংবা প্রচার সভায়। অথচ তার সরকারেরই বিভিন্ন প্রশাসনিক দপ্তর গুলিতে নিযুক্তি পাচ্ছেন বুড়ো আমলা অফিসার কিংবা বহিঃরাজ্যের ইঞ্জিনিয়ার বেকাররা। এক্ষেত্রে ত্রিপুরা বিদ্যুৎ নিগমের ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগের কথা নিয়ে ইতিমধ্যেই বহু চর্চা, আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। গেইট (GATE) পাশের ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট না থাকলে বিদ্যুৎ নিগমে জুনিয়ার ইঞ্জিনিয়ার পদে নিয়োগ বাছাই-র পরীক্ষাতেই বসা যাবেনা গুছের শর্ত আরোপ করে বিজ্ঞাপন প্রচারের কারনে স্থানীয় বেকার ইঞ্জিনিয়ারদের অনেকেই ইন্টারভিউতে বসতে পারেনি। কেননা, ত্রিপুরা বিদ্যুৎ নিগমের ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগে গেইট পাশের ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট কখনই বাধ্যতামূলক ছিলনা। তাই স্থানীয় বেকাররা পরীক্ষা দিয়ে গেইট পাশের ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট সংগ্রহের চেষ্টাও কখনো করেননি। ফলে স্থানীয় বেকাররা আবেদনপত্রই জমা দিতে পারেনি। আর এই সুযোগে বহিঃরাজ্যের বেকার যুবকরা চাকুরী বাগিয়ে নিয়েছে ত্রিপুরা বিদ্যুৎ নিগমে। মোট ২৩ জন জুনিয়ার ইঞ্জিনিয়ারকে গত বছর বিদ্যুৎ নিগমে নিয়োগ করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৯ জনই নিযুক্তি পেয়েছেন বহিঃরাজ্য থেকে। আর বিদ্যুৎ নিগম এই কান্ডটি যখন সংঘটিত করছিলেন তখন বিজেপি-র অন্য বড় রাজ্য মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ শিং চৌহান সে-সময় সে রাজ্যের বিধানসভায় আইন পাশ করিয়ে স্থানীয় সরকারী দপ্তরে বহিঃ রাজ্যের লোক নিয়োগে আইন করে বন্ধ করে দিলেন। শুধু তাই নয়, পার্শ্ববর্তী আসাম রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সানোয়াল তাঁদের নিয়োগ বিধিতে একথাটি পাকাপাকি ভাবে ঢুকিয়ে দিলেন যে, আসাম সরকারের চাকুরী পেতে হলে আসামীজ জানাটা বাধ্যতামূলক। একই রকমভাবে সিকিমের রাজ্য সরকার একধাপ এগিয়ে তাঁদের নিয়োগ পলিসিতে বলে রাখলো বাইরের রাজ্যের বেকাররা সিকিমে চাকুরী পেতে হলে সিকিম -এর ভাষা ও সংস্কৃতি দুই বিষয়েই সম্যক ধারনা থাকতে হবে, তা প্রশাসনিক দপ্তরেই হোক কিংবা স্কুল কলেজের শিক্ষক অশিক্ষক নিয়োগ কিংবা অধ্যাপকের চাকুরী। অর্থাৎ নিজের রাজ্যের ব্যবসা বানিজ্য, চাকুরীর সুবিদা যাতে অন্য রাজ্যের বেকারদের কাছে চলে না যায় সে লক্ষ্যে যখন দেশের বড় বড় রাজ্য গুলি আইনী ফাঁকফোকর খুঁজছেন তখন ত্রিপুরার সবকা সাথ, সবকা বিকাশের সরকার নিজেরাই নিজেদের সর্বনাশের রাস্তা প্রশস্থ করছেন।