৷৷ অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনে ৷৷

অরিন্দম নাথ

(১)

সায়ন্তনের সঙ্গে আজ বিকলে দেখা । হঠাৎই একটি কাজে তার অফিসে গিয়েছিলাম ৷ ত্রিপুরা সিভিল সার্ভিসের অফিসার । বয়সের গাম্ভীর্য আসতে শুরু করছে । চুলে হালকা পাক । হবারই কথা । আমার সঙ্গে বয়সের ফারাক বছর দশকের । আমি জীবনের সায়াহ্নে পৌঁছে গেছি । তার সাথে প্রথম যখন দেখা, সে নেহাতই কিশোর । সবে ক্লাস নাইনে উঠেছে । মফস্বল শহরের একটি সরকারি অফিসে কাজ করি । ছোট পদে । বয়স পঁচিশ ছুঁই ছুঁই । প্রথম পোস্টিং । এর আগে একটি পত্রিকা অফিসে কাজ করতাম । নিউজ ইডিটিং করার কাজ । পড়াশুনার অভ্যাস ছিল । বয়সও অল্প । হাতের কাজ জমা থাকত না । চটপট সেরে ফেলতাম । বাকি সময় দৈনিক পত্রিকা মুখস্থ করতাম । সাময়িকী পড়তাম। কখনও পাবলিক লাইব্রেরি থেকে গল্পের বই এনে পড়তাম । ক্বচিৎ সহকর্মীদের সঙ্গে ক্যারাম খেলতাম । ছুটির দিনেও অফিসে আসতাম । মূলত: পত্রিকা পড়ার নেশায়। সায়ন্তনও আসত । পত্রিকা পড়তে । ছুটির দিনে সকালে । অন্যান্য দিন আসত না। মাঠে ক্রিকেট খেলত । আমার সঙ্গে পরিচয় হবার পর গল্পের বই পড়তে নিয়ে যেত। সে খুব দ্রুত পড়তে পারত । বই ফেরত দিতেও কখনও কখনও বিকেলে অফিসে আসত । তখন গল্প করত । সে আমার ভীষণ ন্যাওটা হয়ে গিয়েছিল । ওকে আসতে দেখলেই সহকর্মীরা ইশারায় বলতো, "মলয়, তর মিতা আইতাছে ।"

আমার ছোট ভাইবোন নেই । বয়সের তুলনায় রুগ্ন । ফর্সা । ছেলেটির প্রতি আমার কেমন জানি মমত্ববোধ জন্মে গিয়েছিল । ওর চোখগুলো কথা বলতো। মনের ভাব লুকাতে পারত না । মনে মনে ভাবতাম, কবি সুকান্তও জানি কৈশোরে সায়ন্তনের মত ছিল । তাদের বাড়ি ছিল আমাদের অফিস লাগোয়া । ওরা তিন ভাই । এক বোন । ভাইবোনদের মধ্যে সে ছোট । বাবা ছিলেন ওজন ও পরিমাপ দপ্তরের ইন্সপেক্টর । মা গৃহিনী । এইসব অফিসের নাম শুনলেই আমরা আঁতকে উঠি । দুর্নীতি দুর্নীতি গন্ধ আসে । ভদ্রলোক ছিলেন দৈত্যকূলে প্রহ্লাদের মত । তিন রকমের ম-এর নেশা বর্জিত । ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনার প্রতি নিবেদিত প্রাণ । ভদ্রলোকের রুচির পরিচয় অবশ্য ছেলে-মেয়েদের নাম থেকেই পেয়েছিলাম । খুবই আন-কমন নাম । সায়ন্তনের কাছ থেকে নামের সাথে সাথে অর্থও জেনেছিলাম । সৌপায়ন, সোমশুভ্র, মেহক এবং সায়ন্তন । বড়দা সৌপায়নের নামের অর্থ ওপরে ওঠার সিড়ি । ভদ্রলোক একটি দপ্তরের চিপ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কিছুদিন আগে অবসরে এসেছেন । সেজদা ডাক্তার । গাইনোকোলজিস্ট । দেখতে চাঁদের মতই শুভ্র । খুবই মিষ্টি ব্যবহার। দিদি মেহক একটি কলেজে পড়ান । রসায়নের অধ্যানপিকা । তাঁর উপস্থিতি সুগন্ধ ছড়ায় । তাঁদের তিনজনের চেয়ে সায়ন্তন বয়সে অনেকটা ছোট । সূর্যাস্তের পরের সময়কে সায়ন্তন বলে । সায়ন্তন ছাড়া ওদের পরিবারের অন্য কারও সঙ্গে আমার কোনওদিন কথা হয়নি । দূর থেকে মনে হয়েছে ভাই-বোনদের মধ্যে সায়ন্তনই পড়াশুনায় পিছিয়ে পড়েছিল । একসময় কিছুটা সাইড-ট্র্যাকে চলে গিয়েছিল । আবার নিজের প্রচেষ্টাতেই জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ।

(২)

আগেই বলেছি আমি গল্প-উপন্যাস পড়তাম । সায়ন্তনকে গল্প-উপন্যাসের চরিত্র বলে মনে হত । কখনও মনে হত, সে যেন সমারসেট মমের স্যালভাটোর। মানুষ হিসেবে টু গুড, প্রেমিক হিসেবে টু বেড । সায়ন্তনের নিজের বিচারে সে মাধ্যমিকে ভালো ফল করেছিল । স্টার মার্কস নিয়ে পাশ করেছিল । চারটে বিষয়ে লেটার ছল। কিন্তু তার বাবা খুশি ছিলেন না । ওনার আশা ছিল ছেলে বোর্ডে স্ট্যান্ড করবে । মাধ্যমিকের পর থেকেই তার মধ্যে একটি পরিবর্তন আসতে শুরু করে । রাজনীতির প্রতিও কিছুটা আকৃষ্ট হয় । প্রচ্ছন্ন অতিবাম রাজনীতি । তখন ভারতে জরুরী অবস্থা সবে শেষ হয়েছে । বাইরে সোভিয়েত রাশিয়া এবং আমেরিকার মধ্যে ঠাণ্ডা যুদ্ধ । ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার ভীষণ সখ্যতা । টলস্টয়, চেকভ, দস্তয়ভস্কির বইগুলো গিলে খেত । পাশাপাশি পার্ল এস বাক, রমা রোলা, ভিক্টর হুগোদের লেখাও পড়ত । চীনের কমিউন প্রথাও তাকে আকৃষ্ট করত । গ্রামে গ্রামে ঘুরতে তার ভালো লাগতো।

সমমতাদর্শী তার কিছু বন্ধুও জুটে গিয়েছিল । পড়াশুনার দিক থেকে তারা তার মত ট্যালেন্টেড নয় । সায়ন্তন ছিল বিজ্ঞানের ছাত্র । অন্যরা কলা বিভাগের। উৎস মানুষ । প্রবীর ঘোষ তাদের মুখে মুখে ঘুরত । অনেকে কবিতা লিখত । সায়ন্তন কবিতা ভালোবাসত । লিখত না । বাবা তাকে বাধা দিতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, এই ছেলেদের সঙ্গে মিশলে তাঁর ছেলে সংস্কৃতির দিক থেকে ধনী হবে। তিনি নিজেও ছাত্রজীবনে এইরকম টার্বুলেন্সের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন । এসব কথা সায়ন্তন আমাকে বলেছিল অনেক পরে । তখন সে সিভিল সার্ভিস অফিসার হয়নি । ব্যাংকে ক্লার্ক-কাম-কেশিয়ার হিসেবে কাজ করত । অন্য একটি শহরে । বাড়িতে পারতপক্ষে আসত না ।

(৩)

মেয়েদের প্রতি সায়ন্তনের অবসেশন প্রথমদিকে ছিল না । দিদি পড়াশুনা নিয়েই পরে থাকতেন । ভাই বাড়ির সবার আদরের । পড়াশুনায়ও ভালো । একটু বোহেমিয়ান ভাব আছে । বাবা কেন জানি প্রশ্রয় দেন । মেহক এই নিয়ে মাথা ঘামাতেন না । দিদির বন্ধুরা সায়ন্তনের চেয়ে বয়সে বড় । তারাও তার প্রতি আগ্রহ দেখাত না । সবমিলিয়ে সে মেয়েদের এড়িয়ে চলা পছন্দ করত । এই পরিস্থিতিতে তার পরিচয় হয় মিথীর সাথে । বয়সে সায়ন্তনের চেয়ে বছর তিনেকের ছোট । ওর দাদা হর্মন তাদের সহপাঠী ছিল । সে যেহেতু পড়াশুনায় ভালো বন্ধুরা প্রায়ই তাকে হায়ার করে নিত । স্কুলে অনেক কিছুই তাদের কাছে আবছা থাকত । সায়ন্তন বেশ বুঝিয়ে দিতে পারত । এমনি করে তার আরেকটি সার্কেল ছিল । মনস্তাত্ত্বিক জগতের বাইরে । পাঠ্যপুস্তকের সুবাদে । সে ভাবত, দুটোর প্রতিই বুঝি জাস্টিস করছে । অজান্তেই সে জ্যাক অফ অল ট্রেডস্ মাস্টার অফ নানে পর্যবসিত হচ্ছিল ।

মফস্বল শহরের স্কুলে সেইরকম কম্পিটিশনও ছিল না । বাঘ নেই বনে শেয়াল রাজা ৷ সে আত্মতুষ্টিতে ভুগত । মিথী ভালো নাচ জানত । গীতিনাট্যে শ্যামা, চিত্রাঙ্গদার ভূমিকায় অভিনয় করত । সে মাঝেমধ্যে তাদেরকে চা দিয়ে যেত । হর্মন না থাকলে কথা হত । সামান্যে । 'দাদা বসতে বলেছে' । সে তার সামনে কেমন যেন আড়ষ্ট থাকত । তবে তার প্রতিটি কাজের মধ্যেই সত্যনিষ্ঠার ছাপ থাকত । সায়ন্তনের তাকে ভালো লাগত । যেন তার ছোট বোন । শুধু একদিন তার মন উদাস হয়েছিল । হর্মনের ঘরটি ছিল দোতলার চিলে কোঠায় । মিথীর বাবা নেই । মায়ের সঙ্গে নীচে থাকতো । সেদিন সন্ধ্যার পর বন্ধুকে বিদায় জানিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছিল । বাকের মুখে খালি গলায় ভেসে এলো, "বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে, ঝরা বন গোলাপের বিলাপ শুনে ...।।"

(৪)

হুমায়ুন আহমেদ বলেছেন, দুধরনের মানুষের মধ্যে পাগলামি প্রকাশ পায় । এক হল প্রতিভাবান মানুষ । আর এক হল কর্মহীন মানুষ । মিথী যখন সায়ন্তনের সঙ্গে কথা বলতো মাথা নিচু করে রাখত । চোখের মনি উপরের দিকে আনাগোনা করত। তারমধ্যে একটি লজ্জাবোধ কাজ করত । কবি একেই হয়তো বলেছেন, "জয় ক'রে তবু ভয় কেন তোর যায় না,. হায় ভীরু প্রেম, হায় রে...।" সায়ন্তন এই চাহনির কাছে কেমন যেন গুটিয়ে যায় । সে হর্মনদের বাড়িতে যাওয়া কমিয়ে দিল । তার মধ্যে একটি দ্বিধাবোধ কাজ করছিল । ভাইবোনদের কেউই তখনও বিয়ে করেনি । প্রেম করা তো দূর অস্ত । বাড়ির পরিবেশ ভীষণই রক্ষণশীল । 'প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, কে কোথা ধরা পড়ে, কে জানে--'। মীথির সাথের সেদিনের সেই ঘটনার পর কোথাও গানের কলি ভেসে আসলে অজান্তেই সে উৎকর্ণ হয়ে শুনত । ওদের পাড়াতেই ছিল একটি পরিবার । ভদ্রলোক কোওপারেটিভ দপ্তরের সহকারী রেজিস্টার। ভদ্রমহিলা শিক্ষিকা । ওঠাওঠি দুই মেয়ে । পূবালী আর পৃথা । প্রথমে ওরা অন্যত্র ভাড়া থাকতেন । তারপর সায়ন্তনদের পাড়ায় এসে বাসা করেন । দুই বোনই সুন্দরী। বিশেষ করে পূবালী । সে তখন ক্লাস টেনে পড়ে । পড়াশুনায় ভালো । দুই বোনই গান শিখত। সুরেলা গলা । তাদের সঙ্গে সায়ন্তনের কথা হত না । তবে দৃষ্টি বিনিময় হত । মানুষের চোখ হচ্ছে মনের আয়না । দু'জনই ছিল সুনয়না । পৃথা বুঝিবা মৃগনয়না । পৃথার স্বভাব ছিল অনেকটা মিথীর মত । তার মধ্যে চঞ্চলতা কম ছিল । সায়ন্তনের সামনাসামনি হলে মাথা নিচু করে চলে যেত । পূবালী সামনে তাকাত । ওর চোখের মনি ল্যাটারেলি মুভ করত । কখনও কৌণিক । এই দৃষ্টির সামনে সায়ন্তন হার মানল । ভালোলাগা একটি অনুভূতি । একটি আবেগ । এক ধরনের পাগলামো । মানুষকে অন্ধ করে দেয় । এরপর থেকে পূবালীদের বাড়ির দিকে সায়ন্তনের যাওয়া বেড়ে গেল । অনেক সময়েই তার যাওয়ার সাথে ওদের বাড়িতে গানের রেওয়াজের সমাপতন ঘটত । বাতাসে ভেসে আসত:

"আকাশে আজ ছড়িয়ে দিলাম প্রিয়

আমার কথার ফুল গো আমার গানের মালা গো

কুড়িয়ে তুমি নিও...।"

সে জানত না গায়িকা কে । তবু মনে মনে ভাবত পূবালীই গাইছে । তার মন চাইত, প্রত্যুত্তরে গায় :

"ওগো প্রিয় , তব গান

আকাশ-গাঙের জোয়ারে

উজান বহিয়া যায় ।

মোর কথাগুলি বুকের মাঝারে

পথ খুঁজে নাহি পায় ।।"

ওদের মধ্যে কখনও কথা হত না । শুধু চোখের ভাষায় ভাব বিনিময় হত। কমন কিছু ঠেক ছিল । সেখানে দুজনেই যেত । একে অপরকে এড়িয়ে । সায়ন্তনের মধ্যে তার বাড়ির কনজারভেটিজম প্রভাব বিস্তার করত । আবার পাড়াতে থাকলে দু'জনে দুজনকে ফলো করত । তার পড়াশুনার বাইরের বন্ধুদের সঙ্গে সায়ন্তন প্রায়শই আড্ডা দিত । অনেক সময় ফিরতে মধ্য রাত্রি পেরিয়ে যেত। সায়ন্তন ফিরলেই পূবালীদের বাড়ির আলো নিভত । সে মনে মনে গাইত:

"তোমারি আঁখির মত আকাশের দুটি তারা

চেয়ে থাকে মোর প্রাণে নিশীথে তন্দ্রাহারা ।

সে কি তুমি ? সে কি তুমি ?"

(৫)

ইতিমধ্যে পূবালী মাধ্যমিক পাশ করেছে । প্রথম বিভাগে । সে আর্টস নিয়ে পড়তে শুরু করে । সায়ন্তনও হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছে । টেনেটুনে প্রথম বিভাগে । তার বাবা খুশী হন না । ওনার ইচ্ছে ছিল ছেলেকে রাজ্যের বাইরে ভালো ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়াবেন । সে জেনারেল লাইন নিয়ে পড়তে চায় । তিনি আপত্তি করেন না । আগরতলায় এম বি বি কলেজে ভর্তি হয় । তখন ছাত্র-রাজনীতি রাজ্যে চরম আকার নিয়েছে । সায়ন্তন এই রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না । সে পড়াশুনায় মন দেয় । মনে মনে জেদ পুষে রাখে । নিজেকে পূবালীর যোগ্য করে তুলতে হবে । ছুটি-ছাটায় বাড়িতে গেলে পূবালী আগের মতই বিহেব করে । দিন এগিয়ে যায় । বাড়িতে গেলে সে তার তাত্ত্বিক বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটায় । আবার এর মধ্যেই একটি উইন্ডো বের করে । পূবালীকে ফলো করে ।

কলেজে তখন গণ্ডগোল । পড়াশুনা তখন শিকেয় ওঠার জোগাড় । একটি ছেলে খুন হয় । অনেক ছাত্রছাত্রী কলেজ ছেড়ে পালিয়ে যায় । ত্রিপুরা ছেড়ে পড়তে আসামের কলেজে ভর্তি হয় । কাছাড়ে । গৌহাটিতেও তখন গণ্ডগোল । আসুর আন্দোলন । তবু সে অধ্যাবসায়ের সাথে পড়া চালিয়ে যায় । এরই মধ্যে কিছু শিক্ষক ছিলেন ফাঁকিবাজ । অনার্সের সিলেবাস কমপ্লিট করতেন না । এই অবস্থায় সে পার্ট-ওয়ান পরীক্ষা দেয় । কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরীক্ষা। প্রশ্নের ধারা হঠাৎ করে বদলে গিয়েছিল । অপঠিত চ্যাপ্টারগুলো থেকে উত্তর করা ছিল বাধ্যতামূলক । একবার ভাবলো প্র্যাক্টিকেল পরীক্ষা ড্রপ দিয়ে পরের বছর আবার পরীক্ষায় বসবে । তখন নিয়ম ছিল দুবারের চেষ্টায় পার্ট-ওয়ান কমপ্লিট করতে হবে । অন্যথায় আবার পাসকোর্সে ভর্তি হতে হবে । সাপ-লুডো খেলা । কোনও মই নেই । সবার রেজাল্টই খারাপ হয় । সে যথারীতি টপ করে ।

সায়ন্তন এবার কেমন যেন নিজেকে ইনসিকিউর মনে করে । একদিন একান্তে ডেকে নিয়ে পূবালীর সাথে কথা বলে । তাদের কথোপকথন হয় ইংরেজিতে । সায়ন্তনই শুরু করে, "সরি টু ডিস্টার্ব ইউ.... আই হ্যাব আ ফিলিং.... আর ইউ ইন্টারেস্টেড ইন মি?"

পূবালী সম্ভবত এর জন্য প্রস্তুত ছিল না । সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, "নট্ অ্যাকজেক্টলি ! ....আই অ্যাম ইন লভ উইথ অ্যানাদার পার্সন....হ্যা ব আই হার্ট ইউ?"

- নট্ অ্যাট অল....স্টে ব্লেসড্...প্লিজ ডু নট ফ্লার্ট...

তারা দু'জন, দুই জনের পথে এগিয়ে যায় । সেদিন রাত্রিতে সায়ন্তন ডাইরি লিখে । অনেক দিনের পুষে রাখা আবেগ সে বলতে পেরেছে । হোক না সেটা হার । আর সবচেয়ে বড় কথা, তারা নিজেরাই নিজেদের সমস্যার সুরাহা করতে পেরেছে । সে মির্জা গালিবের কয়েকটি পঙক্তি লিখে রাখে :

"ইয়া রব, ও না সামঝে হ্যায় না সামঝেংগী মেরী বাত

দে অর দিল উনকো জো না দে মুঝকো জবান অর...

হে খোদা, সে না বুঝতে পারে আমাকে, না বুঝতে পারে আমার কথা

তাকে দাও ভিন্ন হৃদয়, অথবা আমাকে দাও ভিন্ন বাচনভঙ্গি ।"

(৬)

জীবন এগিয়ে চলে । সায়ন্তন এখন বাড়িতে কম আসে । সে পড়াশুনায় নিজেকে মগ্ন রাখে । অনার্সের পার্ট টু-তে সে খুব ভালো ফল করে । তথাপি গড়ে যে মার্কস পায় তাতে অল্পের জন্য সে কলেজের শিক্ষকতার চাকুরী মিস করবে । এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য রাজ্যের বাইরে চলে যায় । বাড়িতে যখনই আসত নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে রাখত । বাড়ি-ঘরের কাজকর্মে নিজেকে ব্যস্ত রাখত । ইতিমধ্যে পূবালী হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছে । খুব ভালো রেজাল্ট করেছে । কলেজে ভর্তি হয়েছে । সেও তখন শহরের বাইরে থাকে । পৃথার সাথে দেখা হয় । সে মাথা নুইয়ে ধীর গতিতে চলে যায় । ইউনিভার্সিটির পড়ার শেষ দিক থেকেই সায়ন্তন কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিতে শুরু করে । বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজাল্ট বেরুবার আগেই ব্যাংকের চাকুরীটা পেয়ে যায় । ন্যাশনালাইজড্ ব্যাংক । তার পোস্টিং হয় ত্রিপুরার আরেকটি মফস্বল শহরে ।

ঘটনাচক্রে আমিও তখন সেখানে পোস্টেড । ছোট্ট শহর । একটি নতুন প্রাণী এলেও ঘণ্টা খানেকের মধ্যে খবর হয়ে যায় । তখন সায়ন্তনের সঙ্গে আমার ঘন ঘন দেখা হয় । সে অকপটে সবকিছু আমাকে ব্যাক্ত করে । বলে, ছোট চাকুরী করে, এইজন্য তার মনে কোনও ব্যথা নেই । তাকে দুঃখ দেয় পরিচিত মানুষ জনের ব্যবহার । সমাজে যেন ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়ার, এই দুইটিই কুলীন শ্রেণী । আমি তাকে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিতে উৎসাহ যোগাই । সে কথা দেয়, যেখানে আছে সেখান থেকে নিজের উত্তরণ ঘটাবে ।

(৭)

বছর দুয়েকের মধ্যেই এক চান্সেই সে সিভিল সার্ভিস ক্লিয়ার করে । ব্যাংকের চাকুরী ছেড়ে দেয় । সেদিন সে বাড়ি থেকে আগরতলা যাচ্ছিল । নতুন চাকুরীতে যোগ দেবে । পূবালী তখন আগরতলায় এম এ পড়ছে । কাকতালীয়ভাবে বাসে দুজনের পাশাপাশি সীট পরে । তাদের মধ্যে স্বাভাবিক কথাবার্তা হয় । দুপুরের খাবার বিল সায়ন্তন মেটায় । তখন আসাম-আগরতলা সড়কে এসকর্ট প্রথায় গাড়ি চলত । মনু থেকে তেলিয়ামুড়া পর্যন্ত এসকর্ট থাকত । তেলিয়ামুড়ায় পৌঁছে অন্য যাত্রীরা হালকা হবার জন্য নেমে গিয়েছিল । তারা দুজন পাশাপাশি বসে গল্প করছিল। হঠাৎ পূবালী তাকে বলে, "সায়নদা, আমি মনে হয় এম এ কমপ্লিট করতে পারবো না । মা-বাবা আমার বিয়ের সম্বন্ধ দেখছেন ।"

সায়ন্তন কোনও মন্তব্য করে না । যার সঙ্গে তার প্রেম ছিল, তার কথাও জানতে চায় না । আগরতলা পৌঁছা অবধি সে নীরব থাকে । যদিও তার মনের ভিতর বাজছিল একটি গান :

"মুছাফির মোছ রে আঁখিজল

ফিরে চল আপনারে নিয়া

আপনি ফুটেছিল ফুল

গিয়াছে আপনি ঝরিয়া ।।"

আগরতলায় পৌঁছে, দুজনে দুজনের পথে চলে যায় । এরপর আর তার সাথে সায়ন্তনের দেখা হয়নি । যখনই সে বিদায়ের মুহূর্তটুকু ভাবে চিত্রাঙ্গদা গীতিনাট্যের কথা মনে আসে । নিজেকে চিত্রাঙ্গদার মত ভাবতে ভালো লাগে । রাজকুমারী চিত্রাঙ্গদা যখন কুরূপা ছিল, অর্জুন তাকে ভালোবাসেনি । মদন-দেবের বরে যখন সে সুরূপা হল, অমনি অর্জুনের প্রেম উথলে পড়ল । আমরা প্রায়শই প্রেমকে বৈষয়িক বেড়াজালে জড়িয়ে ফেলি । এর পেছনে হয়তো পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলী এবং আবহ কাজ করে । সায়ন্তন এবং পূবালী দুজনেই আজ জীবনে সুখী। ভালো চাকুরী করছে । দুজনেই সংসারী ।

শেষের অংশটুকু আজ তার কাছে শুনলাম । তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ওভারঅল কেমন আছ । সে মোবাইলের ইউ টিউবে একটি গান বাজিয়ে দেয়:

"মধুর, তোমার শেষ যে না পাই প্রহর হল শেষ--

ভুবন জুড়ে রইল লেগে আনন্দ-আবেশ ....॥"

আমি তাকে শুভকামনা জানিয়ে বিদায় নিই । তখন ইথারে গানের পরবর্তী কয়েকটি কলি ভাসছিল ।

'সায়ন্তনের ক্লান্ত ফুলের গন্ধ হাওয়ার 'পরে, অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনে সকল অঙ্গ ভরে...।' প্রেমের মধ্যে একটি জৈবিক ব্যাপার থাকে । প্রেমের আগুন জ্বালালে জ্বলে না । নেভালে নেভে না । সত্যিকারের ভালোবাসা পুড়িয়ে নির্বাণ এনে দেয় । অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনের হাতছানি । বিরহের মধ্যেই আনন্দ লুকিয়ে থাকে ।




You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.