ক্ষমতা দখলে অঢেল প্রতিশ্রুতি ও প্রচার পারদে প্রতিদিনই শান দিচ্ছে বঙ্গ বিজেপি
বিশেষ প্রতিনিধি
২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগেই ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে বিজেপি কেন্দ্রে সরকার গঠন করেছিল। প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। তখন বিজেপি’র সভাপতি ছিলেন অমিত শাহ। সেই সময়ে রাজ্য রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক থাকা বিজেপি’র সভাপতি ছিলেন রাহুল সিনহা। ইনি যখনই কিছু বলেন যাত্রাপালার অভিনেতার ঢঙে মুচকি মুচকি হেসে বলেন--ভাবটা এমনই যেন তিনি রাজনীতি যতটা বোঝেন আর কেউ ততটা বোঝেন না। বিপুল রাজনৈতিক জ্ঞান সমৃদ্ধ এই নেতা আজ পর্যন্ত কোনো স্তরেই জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন নি। তৃণমূল স্তরের শক্তিশালী সংগঠক বলেও তাঁকে কেউ গালিগালাজ করে নি। বঙ্গ বিজেপি’র সভাপতি হিসেবে শুধু তিনি-ই নন--প্রায় সকলেরই পারফরমেন্সের নথিপত্র ঘাঁটলে বিশেষ রকমফের দেখা যাবে না। আদি বিজেপি নেতা-কর্মীদের সাংগঠনিক দক্ষতা ভোটরাজনীতিতে তাদের সাফল্যের খতিয়ান ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত যা দেখা গেছে তা একেবারেই আলোচনার যোগ্য নয়। তাই ২০১৪ সালে কেন্দ্রের ক্ষমতা দখলের পর বাংলার দিকে চোখ ফিরিয়েও রীতিমতো হতাশ হয়েছিলেন মোদী-শাহ জুটি। ২০১৬ সালের নির্বাচনে এঁরা দু’জন বঙ্গ বিজেপি’র মুখ হয়ে ওঠার চেষ্টাও কিছু কম করেন নি। কিন্তু বঙ্গ বিজেপি’র আদি নেতা-কর্মী গোষ্ঠীদের নিয়ে কিছুই প্রায় করে উঠতে পারেন নি। এইসব বোলচালসর্বস্ব ভোঁতা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যে খুব বেশি কিছু করা যাবে না সেটা গভীরভাবেই উপলব্ধি করে সারদা-নারদা-রোজভ্যালি কেলেঙ্কারির তদন্তসংস্থা সিবিআই ও ইডি’র দিকে নজর দিলেন। সিবিআই-ইডি’র জালে অনেকেই জড়িয়ে যাওয়ায় রাজ্যরাজনীতির সমীকরণ বদলে যেতে থাকলো। ইতিমধ্যেই তৃণমূল তাদের বিরোধীশূন্য আগ্রাসী রাজনীতির উন্মত্ততায় মূলস্রোতের রাজনীতিতে অত্যন্ত দৃষ্টিকটূ শূন্যতা তৈরি করে ফেলেছিল। বাম-কংগ্রেসের কোমর ভেঙে দিয়ে তৃণমূল যখন দিগ্বিজয়ীর উল্লাসে আত্মপ্রত্যয়ের শিখরে উঠে গিয়ে ধরাকে সড়া জ্ঞান করছে--ঠিক সেই সময়েই দলের অভ্যন্তরে ক্ষমতা ও প্রভাবপ্রতিপত্তি বৃদ্ধির যে লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছিল তাতে তৎকালীন দলের সেকেণ্ড-ইন-কম্যাণ্ড মুকুল রায় রীতিমতো কোণঠাসা হচ্ছিলেন--অপমান হেনস্থার শিকার হচ্ছিলেন। তবুও ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ভোট ম্যানেজার হিসেবে দলকে নানান প্রতিকূলতার মধ্যেও বিপুল জয় এনে দিয়েছেন। মোদী এবং শাহ তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে এ সব কিছুই লক্ষ্য করছিলেন। বিজেপি’র পক্ষে তার বঙ্গফ্রন্ট নিয়ে বাম-কংগ্রেসকে অপ্রাসঙ্গিক করে প্রধান বিরোধী শক্তি হয়ে ওঠা সম্ভব ছিল না যদি তৃণমূলই তাদের হয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটুকু এগিয়ে না রাখতো। ফলে মুকুল দল ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা মুকুলকে লুফে নিলেন। ঠিক তখন থেকেই তৃণমূলের লক্ষ্মীছাড়ার হাল হতে শুরু করলো। তার পর থেকে আজ এই ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্ মুহূর্ত পর্যন্ত সব টুকুই এক উল্লেখযোগ্য ইতিহাস। মুকুলের তৃণমূল ত্যাগ ও বিজেপিতে যোগদান--এটা একটা বড় ফ্যাক্টর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে বঙ্গ বিজেপি’র ইতিহাসে।
বিজেপি’র সম্ভাবনাকে মুকুলের চাণক্য রাজনীতি একদিক থেকে যখন বাড়িয়ে চলেছে--অন্যদিক থেকে তৃণমূলের দিশেহারা রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলোও বিজেপি’র সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে যাচ্ছিল পাশাপাশি। প্রচার মঞ্চে লাগাতার ‘তুই-তোকারি’ ‘বাপ তুলে হুমকি’ অবিরত বিশ্রী মোটাদাগের শব্দ ব্যবহারও বিশেষ ফ্যাক্টর হিসেবে উঠে আসছিল। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মানহানির নালিশ ঠুকে সমন পাঠানোর বিষয়টাও কিন্তু বিশেষ ক্ষেত্রে ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছে।
শুভেন্দু-রাজীব সহ প্রায় শ’খানেক জনপ্রতিনিধি-সাংগঠনিক পদাধিকারী নেতা-কর্মীদের দলে ধরে রাখার চেষ্টা না করে তাদের চোর-আপদ-আবর্জনা চিহ্নিত করাটাও বিজেপি’র পক্ষে ইতিবাচক ফ্যাক্টর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই প্রবণতাই দলের ভাঙনকে তরান্বিত করেছে--ভাঙন এখনও সম্পূর্ণ হয় নি। গতকালই বেশ নাটকীয় আবহে দল ছেড়েছেন পাণ্ডবেশ্বরের বিধায়ক জিতেন তেওয়ারি। যখনই কেউ দল ছাড়ছেন সঙ্গে সঙ্গে তাকে চোর দুর্নীতিগ্রস্ত সুযোগসন্ধানী হিসেবে দেগে দেওয়া হচ্ছে কিন্তু বলা হচ্ছে না দলত্যাগের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তারা দলের সম্পদ হিসেবে গ্রহণযোগ্য ছিল কি ভাবে ! ঠিক এই পয়েন্টে যেসব অস্বস্তিকর প্রশ্ন উঠছে--যার যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর তৃণমূলের কাছে নেই--সেগুলোও বিজেপি’র পক্ষে সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেওয়ার মতো ফ্যাক্টর হয়ে যাচ্ছে।
প্রচণ্ড দ্বিচারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে দলের পক্ষে মারাত্মকরকমের অস্বস্তি বাড়ানো কুণাল ঘোষকে দলের মুখপাত্র করা, গত লোকসভা নির্বাচনেই বিষ্ণুপুর কেন্দ্রে অনুপস্থিত সৌমিত্র খাঁ-এর পক্ষে দাঁড়িয়ে যে সুজাতা মণ্ডল মমতার বিরুদ্ধে বিষাক্ত আক্রমণ শানিয়েছেন, অকথ্য ভাষায় নির্বাচনী মিছিল-মিটিং তাতিয়েছেন--সেই সুজাতা মণ্ড লকেই বিভিন্ন এলাকায় প্রধানবক্তা হিসেবে পাঠানো হচ্ছে। সিপিএেমর আঁতেল যুবনেতা হিসেবে যে ঋতব্রত বাংলার অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রকে দিল্লীতে চরম হেনস্থা করলেন--যাঁর বিরুদ্ধে অনৈতিক যৌনতার অভিযোগ রয়েছে--সেই ঋতব্রতকে দলে টেনে নিয়ে তাকে প্রার্থী করা হচ্ছে। চিটফাণ্ড কেলেঙ্কারিতে জেল খেটে আসা মদন মিত্র এখন শুভেন্দু-রাজীবের শূন্যস্থান পূরণের স্বপ্নে মাতোয়ারা হয়ে হাতে আধখানা কুমড়ো নিয়ে বিচিত্র সাজপোষাকে কোমর দুলিয়ে নাচাগানা করছেন কিন্তু কোনোরকম বাধা পাচ্ছেন না--বরং প্রশ্রয় পাচ্ছেন--এসবই উল্লেখযোগ্য ফ্যাক্টর হয়ে উঠছে।
বিগত কয়েক মাসে যেসব দল নবান্ন অভিযান করেছে তার মোকাবেলা রাজ্য পুলিশ-প্রশাসন যে কায়দায় করেছে সেগুলোও বিশেষ ফ্যাক্টর হিসেবে উঠে এসেছে। রাজ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যে গণতান্ত্রিক স্পেস কমতে কমতে একেবারে খাদের কিনারে পৌঁছে যাওয়াটাও কিন্তু ফ্যাক্টর বলে অনেকেই মনে করছেন। ছোটবড় অসংখ্য ফ্যাক্টর ছাড়াও বিজেপি’র সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিয়েছে রাজ্যরাজনীতিতে জোট ফ্যাক্টর।
প্রথমে বাম-কংগ্রেস জোট তৃণমূলকে হাল্কা স্বস্তি জোগালেও পরিস্থিতিটা আমূল বদলে গেল এই জোটের মধ্যে আব্বাস সিদ্দিকী’র আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই। দুই চব্বিশপরগণা, হাওড়া, হুগলী, দুই মেদিনীপুর (বিশেষ করে নন্দীগ্রাম), নদীয়া সহ বেশ কিছু মুসলিম অধ্যুষিত কেন্দ্রে তৃণমূলের একচেটিয়া আধিপত্য ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়ে গেছে। সিংহভাগ মুসলিম ভোটই প্রভাবিত হয় ধর্মগুরুর প্রভাবে--রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাবে নয়। আব্বাস সিদ্দিকী যেভাবে এবং যে ভঙ্গিতে ভারতীয় সেকুলর ফ্রন্ট নামে একটি দল তৈরি করে নির্বাচনী যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তাতে স্পষ্টতঃই আকাশে এখন অশনি সঙ্কেত। তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কে ভাইজান নয় নয় করেও ৬ থেকে ৭% ভোট কেটে নেবেন এবং গোটা পাঁচেক আসনও বাম-কংগ্রেসের বদন্যতায় পেয়ে যেতে পারেন। এই আসনগুলো আসবে তৃণমূলের স্টক থেকেই।
তৃণমূলের কোনো কোনো ভোটপণ্ডিত মনে করছেন--বাম-কংগ্রেস জোট হওয়ায় বিজেপিতে চলে যাওয়া বাম-কংগ্রেস ভোট লাফিয়ে চলে আসবে নিজের নিজের দলের পাশে। এখানে কিন্তু বেশ বড়রকমের প্রশ্ন থাকছে। বিজেপি’র পাশে যারা গেছে--গত লোকসভা নির্বাচনেও যারা পাশে ছিল তারা এখন কোন্ যুক্তিতে কেন ফিরে আসবে? এই মুহূর্তে বিজেপি’র ভবিষ্যৎ যখন বেশ উজ্জ্বল--তখন হাওয়া মোরগরা বাম-কংগ্রেসের অনুজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখেও ফিরে আসবে ভাবাটা একেবারেই যুক্তিসঙ্গত নয়। বরং আব্বাস সিদ্দিকীর বোলচাল যারা বেশ কিছুকাল থেকে শুনে আসছেন তারা বাম-কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর ‘হৃদ্যতা’ মোটেও ভালো চোখে দেখছেন না। যারা (হিন্দু ভোটার) ভাবছিলেন বাম-কংগ্রেসকে একটু সমর্থন করা যাক--তাদের একটা বড় অংশই চলে যাবে বিজেপি’র পাশে। কয়েকদিন আগেই আমি লিখেছিলাম--সুযোগসন্ধানী কর্মী-সমর্থক-ভোটার, যারা হাওয়া বুঝে এক দল থেকে অন্য দলের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় তাদের রাজনীতি মতাদর্শ নৈতিকতা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা থাকে না। তাই গত দু’বছরের মধ্যে যারা বিজেপির পাশে চলে গিয়েছে তারা এই মুহূর্তে বিজেপিকে ছেড়ে বাম-কংগ্রেসের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পাশে আসবে কেন? তারা বিজেপি ছেড়ে যাওয়ার কথা এই মুহূর্তে একেবারেই ভাববে না। এখন তো মুকুল-শোভন-শুভেন্দু-রাজীব-জিতেন তিওয়ারির মতো নেতারা তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন--এর একটা মারাত্মক ইম্প্যাক্ট এবারের ভোটে পড়বেই। এর ওপর রয়েছে সংখ্যালঘু ভোটের একাধিক ভাগে বিভাজনের প্রতিক্রিয়া। এবারের বাংলার ভোট প্রসঙ্গে মনে পড়ছে উত্তরপ্রদেশের বিগত দু’টি নির্বাচনের কথা। সেখানে সপা-বসপা-কংগ্রেসের মধ্যে সংখ্যালঘু ভোট ভাগ হয়ে যাওয়ার কারণে অমুসলিম ভোটের সিংহভাগই চলে গিয়েছিল বিজেপি’র দিকে--যার ফলে বেশ কিছু সংখ্যালঘু অধ্যুষিত কেন্দ্রেও বিজেপি জিতেছে। যেমন গত লোকসভা নির্বাচনে মালদা থেকে কোচবিহারের সংখ্যলঘু প্রধান জেলাতেও বিজেপি আসন দখল করতে পেরেছে। এবারে তাই তাদের সাফল্যের হার আরও বাড়বে। এটাও একটা বেশ বড় মাপের ফ্যাক্টর।
বিজেপি লক্ষ্য করেছিল--২০১৬ সালের নির্বাচনে তৃণমূল বিরোধী ভোট তিন ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়ায় তৃণমূল বড়সড় জয় পেয়ে যায় প্রচুর দুর্নীতির (সারদা-নারদা-কাটমানি-তোলাবাজি) অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও। গত লোকসভা নির্বাচনে এই একই ঘটনা ঘটেছিল খানিকটা কম হলেও--সুস্পষ্টভাবেই। একুশের বিধানসভা নির্বাচনেও বিজেপি বিরোধী ভোট তিন-চার ভাগে ভাগ হতে চলেছে। আব্বাস সিদ্দিকী এবং পৃথকভাবে হলেও মিম এবারে তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কে উল্লেখযোগ্য ফাটল ধরাবেই। এর ফলে গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি’র প্রাপ্ত ভোটের হার দু’তিন শতাংশ বাড়লেও কমবে না বলেই মনে হচ্ছে আমার। উল্টোদিকে তিন-চার শতাংশ ভোট তৃণমূলের কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। এমনটাই বিজেপি মনেপ্রাণে চেয়েছিল। বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ-এর সম্মিলিত ভোট কিছুটা বাড়লেও আসন সংখ্যা মিলিত ভাবে ৩০-৩৫-এর বেশি হবে বলে মনে হয় না।
ফলে প্রচারের নতুন ঘরানা থেকে হাইভোল্টেজ দলবদল সহ একাধিক ইস্যুকে সঙ্গে নিয়ে ২০২১ এর বাংলার নির্বাচনী ময়দানে কার্যত সাড়া ফেলে দিয়েছে বিজেপি। যে দলকে ২০১৬ সালেও কার্যত রাজ্যরাজনীতিতে সেভাবে তাৎপর্যের জায়গায় রাখেননি বহু রাজনৈতিক বিশ্লেষক--এবার ভোটের আগে রাজ্যরাজনীতির 'টাফ ফাইট' এ বিজেপি কীভাবে হাওয়া তাদের পক্ষে নিয়ে আসতে পারে তা নিয়ে তারাই বহু চুলচেরা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছেন। বহু রাজনৈতিক বিশ্লেষক একাধিক ফ্যাক্টরকে রাজ্যে বিজেপির উত্থানের কারণ হিসাবে তুলে ধরেছে।
প্রসঙ্গত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ফুঁসে ওঠা ক্ষোভই বিজেপিকে রাজ্যে স্বাগত জানিয়ে দিয়েছে। এদিকে তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে গ্রাউন্ড লেভেলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হতে শুরু করাও একটি ফ্যাক্টর বলে মনে করছে কিছু মহল। বাংলায় যখন ধীরে ধীরে মমতা বিরোধিতা বা তৃণমূলের অন্দরে ক্ষোভের মেঘ জমা হয়েছে, তখন বাইরে থেকে মোদী প্রভাব তুঙ্গে ওঠে ২০১৯ লোকসভা ভোটে। যা বিজেপিকে বাংলায় জমি দখলে সাহায্য় করেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
২০২১-এর ভোট মেরুকরণের নির্বাচন। আর তা বিজেপির হিন্দুত্ববাদে জোর দিয়ে প্রচার শানানোর ঘটনা দিয়েই আরও বেগ পেয়েছে রাজ্যে। বাংলায় ৩০ শতাংশ মুসলিম ভোট। রাজনৈতিক বিশ্লেষক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের (তৃণমূল নয়) দাবি, এই ৩০ শতাংশ কার্যত বাদ দিয়েই বিজেপি প্রচারে শান দিচ্ছে। উল্লেখ্য, ভোটব্যাঙ্ক নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে দেখা যায়নি বিজেপিকে। হাবেভাবে বিজেপি স্পষ্ট করে দিয়েছে যে বাকি ৭০ শতাংশ ভোট নিয়েই তারা বাংলা দখলের আশায় রয়েছে। আর সেই জায়গা থেকেই সংখ্যালঘু অধ্যুষিত মালদায় এদিন প্রচার বিশুদ্ধ হিন্দুত্বে জোর দিয়েছেন যোগী আদিত্যনাথ।
২০১৯ লোকসভা ভোটে বিজেপির ভোট শেয়ার ছিল ৪০.৬৪ শতাংশ। সেই জায়গা থেকে যদি ৭০ শতাংশকেই নিজের ভোটের হিসাবে বিজেপি ধরে নেয়, তাহলে ৭০ এ ৬০ শতাংশ ভোট বিজেপিকে নিজের দিকে আনতে হবে। যদি বিজেপির পক্ষ থেকে মুসলিম ভোট একেবারেই বাদ দেওয়া হয়, তাহলে ২৯৪ থেকে ৬০ থেকে ৭০ টি আসন বিজেপির এমনিই কেটে যেতে পারে। ২০০ আসন দখলের লক্ষ্যে সেক্ষেত্রে বিজেপির পাখির চোখ ২১৪ থেকে ২২৪ টি আসন হতে পারে। যা কার্যত পাখির চোখ করতেই হবে বিজেপিকে। তাও আবার তৃণমূলের মতো প্রতিপক্ষকে হারিয়ে। ফলে 'কিন্তু','যদি' ফ্য়াক্টরও সেক্ষেত্রে থেকেই যাচ্ছে।
বিজেপির অন্দরমহল সূত্রের দাবি, তৃণমূল, আর বাম-কংগ্রেসের শক্তি দুটি ভাগে বিভাজিত হওয়ার তারা সুবিধা পেতে পারে। সেক্ষেত্রে মিমের আগমন ও আব্বাসদের পার্টি তৃণমূলের থেকে মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক ছিনিয়ে যেমন নেবে, তেমনই বিজেপি বিরোধী বেশ কিছু ভোট কংগ্রেস ও বামেদের খাতায় যাবে। যা আখেরে বিজেপিকে লাভের গুড় দিতে পারে।
প্রসঙ্গত, বিজেপি এ রাজ্যে সেভাবে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে ছাপ ফেলতে পারেনি। তবে ২০১৯ সালে মুকুল রায়ের মতো হেভিওয়েট বিজেপিতে যোগ দেন, ততদিনে নেতৃত্বে দিলীপ ঘোষেরও আবির্ভাব ঘটে। ফলে দ্রুত শিরোনাম কাড়তে থাকে বিজেপি। এরপর ২০২১ ভোটের আগে তৃণমূলের তাবড় নেতা শুভেন্দু থেকে রাজীবরা বিজেপিতে প্রবেশ করে সংগঠনের হাত যেমন শক্ত করেন, তেমনই বাড়িয়ে দেন 'বিস্তার'। দলের এই বিস্তারের দিকেই তাকিয়ে ছিল নেতৃত্ব। যা ২০১৯ লোকসভা থেকে মুকুল, দিলীপ, কৈলাস, অর্জুনরা শুরু করেন। আর ২০২১ এর আগে তা ফুলে ফেঁপে ওঠে। তবে শুধু প্রতিশ্রুতি ও প্রচার পারদে শান দিয়ে বিজেপি মমতার গড় দখল করতে পারে কি না, তার উত্তর তোলা আছে সময়ের দরবারে।