একটি অজানা ছেলের গল্প
অরিন্দম নাথ
বাংলাদেশ যুদ্ধের পরের বছরের কথা ৷ ছেলেটির বয়স তখন সবে দশ বছর । ক্লাস ফাইভে পড়ে । বয়সের তুলনায় এক ক্লাস আগে । তখন ত্রিপুরায় তিনটি জেলা । দশটি মহকুমা । দুইটি জেলা নতুন হয়েছে । উত্তর ত্রিপুরা এবং দক্ষিণ ত্রিপুরা । ওর বাড়ি উত্তর ত্রিপুরাতে । ধর্মনগর মহকুমায় । তখন স্কুলে ভর্তি নিয়ে কড়াকড়ি ছিল । সিক্স প্লাস না হলে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করা হত না । ছেলেটির বাবা বিজ্ঞানের শিক্ষক । তিনি ভাবতেন, যে ছেলে-মেয়েদের জন্ম জুন মাসের পর, তারা অনেকটা পিছিয়ে পড়বে । তাঁর ছেলের জন্ম অক্টোবর মাসে । ছেলের জীবন থেকে দশটি মাস চলে যাবে ৷ শুভঙ্করের ফাঁকিতে ! তিনি গ্রামের স্কুলের বড় দিদিমণির সঙ্গে দেখা করলেন । হাকিম নড়ে, কিন্তু হুকুম নড়ে না । এবার তিনি নিজের স্কুলের বড় দিদিমণির কাছে কথাটি পারলেন । দুই বড় দিদিমণির মধ্যে ভীষণ বন্ধুত্ব। তাঁরা ভদ্রলোককে একটি পরামর্শ দিলেন । ছেলেকে পরের বছরের শুরুতে ক্লাস টু-তে ভর্তি করে দিন । আইন বলছে, সিক্স প্লাস ওয়ানে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হবে । ক্লাস টু-তে সরাসরি ভর্তি হতে হলে বয়সের কোনও বাধ্য-বাধকতা নেই । সুতরাং ছেলেটি কিছুদিন গৃহ-শিক্ষিকার কাছে পড়াশুনার তালিম নিল । পরের বছর ক্লাস টু-র ভর্তি পরীক্ষায় বসলো । উত্তীর্ণ হয়ে যথাসময়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হল ।
তখন ক্লাস টু-তে তিনটে বিষয় পড়ানো হত । বাংলা, অংক আর রামায়ণ । রামায়ণ সহায়ক পাঠ । পরীক্ষা দিতে হত না । ছেলেটির বাবার ভয় ছিল ৷ বয়স অল্প বলে ছেলে যদি পিছিয়ে পড়ে । ক্লাস টিচার ছিলেন মীরা ভট্টাচার্য । ভীষণই স্নেহময়ী দিদিমণি । ওনার পরশে ছেলেটি মানিয়ে নিল । সেবার অ্যানুয়েল পরীক্ষায় অংকে পেল সাতাত্তর । আর বাংলায় তেহাত্তর । ক্লাসে প্লেসও পেল । ক্লাস থ্রি থেকে পাঁচটি বিষয় । বাংলা ও অংকের পাশাপাশি ইংরেজি, সমাজবিদ্যা এবং বিজ্ঞান । অংকে ছেলেটি ভাল । বরাবর লেটার-মার্কস পায় । অন্য বিষয়গুলিতে ফলাফল আশানুরূপ নয় । সারাদিন বাউণ্ডুলেপনা করে বেড়ায় । যাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় সত্যিকার অর্থে সেইসব ঘরে শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি । ভাইবোন তখন তারা পাঁচজন । সে দ্বিতীয় । দাদা তার চেয়ে তিন ক্লাস উপরে পড়ে । পড়াশুনায় ভীষণ ভালো । বাবা-মার বাধ্য ছেলে । আর সে বদমেজাজি । বাবার কাছে পড়তে চায় না । দাদাকে যে মাসিমা পড়ান তাঁর কাছে সে পড়বে না । তিনি বড় মাসিমা । বি এ পাশ । এমনকি বিজ্ঞানের শিক্ষক বাবার কাছেও পড়বে না । সে ছোট মাসিমার কাছেই পড়বে । উনার কাছেইতো সে ক্লাস টু অবধি পড়েছে । উনি যে ক্লাস টু-র উপরের ছাত্র পড়ান না ! ছেলেটি নাছোড়বান্দা । অগত্যা ছোট-মাসিমা রাজি হলেন । তিনি রোজ তাকে নিয়ে পড়াতে বসবেন । তাঁর সামনে স্কুলের হোমটাস্ক শেষ করতে হবে । অংক ছাড়া অন্য সব বিষয়ে হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষার রেজাল্ট তার খারাপ হত । তখন তাকে ভয় দেখানো হত । ফেল করলে চায়ের দোকানে বয়ের কাজে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে । ফাইনাল পরীক্ষা এলে ছেলেটি আদাজল খেয়ে লেগে পড়ত । মজার বিষয় হল দিব্যি পাশও করে যেত । কখনও সখনও ক্লাসে প্লেসও থাকত ।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়ে গেছে । নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে । ওদের বাড়ির লাগোয়া একটি সরকারি গেস্ট হাউস ছিল । সেখানে মিলিটারিদের ছাউনি পড়েছিল । একজন কর্নেল থাকতেন । ছেলেটি এবং তার বন্ধু-বান্ধবেরা মিলিটারিদের তাবুতেই কাটাত । ট্রেন্স কাটা দেখত । ফৌজের লোকেরা খুব আদর করত । ওরা হয়তো দেখে থাকবে কর্নেল সাহেব মাঝেমধ্যে ছেলেটির বাবার সঙ্গে গল্প করতেন । পড়াশুনার প্রতি ছেলেটির এই খামখেয়ালিপনা দেখে বাড়ির বড়রা ঠিক করলেন ওকে আর্মি স্কুলে ভর্তি করে দেবেন । ছেলেটিও প্রস্তাবে একপায়ে রাজি । তখন ক্লাস সিক্স থেকে আর্মি স্কুলে ভর্তির সুযোগ ছিল । ভর্তি পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপ করল । পরীক্ষা হবে আগরতলায় । এর আগে ছেলেটি এতটা দূরের পথ কখনও পাড়ি দেয়নি । মামার বাড়ি কাছাড়ের আনিপুরে । অল্প দূরত্ব । বাসে কিংবা ট্রেনে যাওয়া যায়। গ্রামের বাড়ি চামটিলায় । বড় পিসির বাড়ি কৈলাশহর । খুবই কম দূরত্ব । কিন্তু তাহলে কি হবে, পাহাড়ি পথে অল্প দূরত্ব চললেই ছেলেটি বমি করে ভাসিয়ে দিত ।
ধর্মনগর থেকে আগরতলার দূরত্ব দুশো কিলোমিটার । মুড়ির টিন বাস । ছেলেটির বাবা যাত্রার একদিন আগে দুটো টিকিট কেটে আনলেন । বাসের সামনের দিকে । আগরতলায় কোথায় গিয়ে ওরা উঠবে । এক কাকু আছেন । বাড়ি শিবনগরে । উদীচী ক্লাবের সাথে । খুন-খারাপের জন্য অঞ্চলটির তখন ভীষণ বদনাম । ধর্মনগরে তাদের প্রতিবেশী ছিলেন তৎকালীন ত্রিপুরার স্বাস্থ্য-মন্ত্রী মনোরঞ্জন নাথ । ভদ্রলোক পরলোক গমন করেছেন । পেশায় ছিলেন আইনজীবী । কখনও হাসতেন না । ওনার ছয় ছেলে । এক মেয়ে । ছোট ছেলে দুজন ছেলেটির সমবয়সী । ওদের বাড়িতেই ছেলেটির অনেক দুপুর কাটত । মাসিমার স্নেহ পরশে । তবে মন্ত্রী মহোদয়কে ছেলেটি এড়িয়ে চলতো । চোখাচোখি হলেই ডাকতেন । নাম জিজ্ঞেস করতেন । নাম বললে প্রতিবাদ করতেন । ছেলেটির দাদার নাম ওর নামের উপর বসিয়ে দিতেন ৷ বেশ কিছুক্ষণ উকিলি জেরার পর ছুটি মিলত । ধর্মনগরে থাকলে উনি সামনের ঘরে বসতেন । বড় রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতেন । উনার দৃষ্টি এড়ানোর জন্য ছেলেটি ওই জায়গাটি দৌড়ে পালিয়ে যেত । ঠিক হল, আগরতলায় গিয়ে ওরা উঠবেন মন্ত্রী মহোদয়ের কোয়ার্টারে ।
মুড়ির টিন বাস । নামের পেছনে দুটো যুক্তি কার্যকর । মুড়ির মত ঠেসে গাড়ি ভর্তি করে যাত্রী নিয়ে যায় । গাড়ির বডি মেরামতির জন্য অনেক সময়, মুড়ির টিন কেটে তাপ্পি দেওয়া হত । নির্দিষ্ট দিনে অ্যাভুমিন টেবলেট খেয়ে ছেলেটি চাপল গাড়িতে । তথাপি আঠারমুড়া পেরুনর সময় ছেলেটি বমি করল । বাকি রাস্তা বাবার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে এল । গাড়ি থামল আগরতলা মোটরস্ট্যান্ডে । এখনকার পুরাতন মোটরস্ট্যান্ড । তখন সন্ধ্যা । শহর দেখে ছেলেটির মন ভরে গেল ।
মোটরস্ট্যান্ডে অনেকগুলো ট্যাক্সি দাড়িয়ে আছে । কিছু অ্যাম্বাসেডর সাদা রংয়ের । কিছু কালো রংয়ের । অপেক্ষাকৃত ধনীরা ওইসব চলত । গরীবদের জন্য ছিল টাউন-বাস এবং রিকশা । ওরা রিকশায় চাপলেন । খুবই পরিচ্ছন্ন শহর । রাস্তাগুলো তখনকার দিনের আন্দাজে ভীষণ প্রশস্থ । হকার শূন্য । দুই পাশের ঘরবাড়ি এবং দোকানের বারান্দা ছিল নজরকাড়া । পিলারগুলি একইরকম । গোলাকৃতি । কামান চৌমুহনীতে হোসেন শাহের কামান দেখা ছেলেটির উইশ-লিস্টে ছিল । বাংলার নবাব হোসেন শাহ ত্রিপুরা আক্রমণ করে পরাজিত হন । সেই ইতিহাস সে বইতে পড়েছে । ত্রিপুর সৈন্যরা তার কামান ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিল । সেই কামানটিকে ঘিরে আগরতলার কামান চৌমুহনী । দেখে ঠিক মন ভরলো না । কামানের চারপাশে হকাররা ভিড় করেছিল । একপাশে বারান্দায় কিছু হিন্দুস্থানি শ্রমিকের জটলা । ওরা গোল হয়ে বসে কীর্তন করছিল । ঢোল এবং অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ ছাপিয়ে কারও কারও গলার আওয়াজ বেসুরো শোনাচ্ছিল ।
মন্ত্রী মহোদয়ের কোয়ার্টার বর্তমান শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জ্জী লেনে । এখনকার মত ক্লামজি ছিল না । সামনের দেয়াল খুব একটা উঁচু নয় । আখাউড়া ড্রেন তখন অনেকটা প্রশস্থ ছিল । নাব্যতাও বেশী ছিল । কোয়ার্টার থেকে উমাকান্ত একাডেমী এবং ভিক্টোরিয়া ম্যামরিয়াল হাসপাতাল বা ভি এম হসপিটাল সরাসরি দেখা যেত । হাসপাতালটির পত্তন হয় ১৯০৩ সালে । সেটা সামনে লিখা ছিল ৷ তখন গ্রীষ্মের ছুটি ছিল । উমাকান্ত একাডেমী বন্ধ । সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কিছু ছেলে স্কুলের সুইমিং পুলে দাপাদাপি করত । পুকুরের পাশে বেশ কয়েকটি গাছ । ডালগুলি জলের অনেকটা উপর পর্যন্ত ছড়িয়ে । ছেলেগুলো গাছ বেয়ে উপরে ওঠে জলের মধ্যে ডাইভ দিত । বার বার । এই দৃশ্য দেখে ছেলেটির আর চোখের পলক পড়ে না । কোয়ার্টারের একজন আবাসিক বলল, মন্টু দেবনাথ এবং তার সঙ্গী-সাথী এরা । মন্টু দেবনাথ জিমনাস্ট । ত্রিপুরার প্রথম অর্জুন পুরস্কার প্রাপক ।
যথাসময়ে ছেলেটি আর্মি স্কুলে ভর্তির পরীক্ষা দিল । পরীক্ষায় সে বিশেষ ভালো ফল করতে পারলো না । তার বাবার কাছে অবশ্য এরজন্য কোনও গঞ্জনা শুনতে হয়নি । ওই প্রজন্মের পিতারা বিশ্বাস করতেন অমৃত প্রাপ্তি বড় কথা নয়, অমৃতের সন্ধানে যাওয়াটাই মুখ্য । তিনি ছেলেকে আগরতলা শহর এবং শহরতলী ঘুরিয়ে দেখালেন । উনার এক সময়ের বড় দিদিমণির কাছে নিয়ে গেলেন । শ্রীমতি অপরিজিতা রায় ৷ দিদিমণি ছেলেটিকে আশীর্বাদ করলেন।
ফেরার পথে গাড়িতে টিকিট পড়ল একদম পেছনের দিকে । ছেলেটি আবার বমি করে কাহিল হয়ে পড়ল । কিছু খেতে ইচ্ছে করছিল না। বিরাশি মাইলে পৌঁছলে বাবা ভীষণ মমতায় শসা কিনে খাওয়ালেন । আগরতলা থেকে ফেরার পর ছেলেটির মধ্যে কিছু পরিবর্তন এল । এবার সে একাকীই পড়ত। ইতিমধ্যে সে ক্লাস সিক্সে উঠেছে । ধর্মনগর বীর বিক্রম ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হয়েছে। গ্রামের স্কুল ছেড়ে শহরের স্কুলে এসে পড়াশুনাকে সিরিয়াস-ভাবে নিতে শুরু করে । যোগাভ্যাস করে ৷ পড়াশুনার প্রতি তার মনোযোগ বৃদ্ধি পায় । সে আরও আত্মবিশ্বাসী হয় । ক্লাস এইট থেকে সে প্রথম হতে শুরু করে । তার বাবার কাছ থেকে ইংরেজিতে তালিম নেয়। পরীক্ষায় ভালোই ফল করে ৷ যদিও তাঁর বাবা খুশি হননি ৷ তবে ছেলের আত্মবিশ্বাসের বাহবা দিতেন ৷ ছেলেটি দ্বাদশ পর্যায়ে বাংলা মাধ্যমের স্কুলে পড়েও ইংরেজিতে বিজ্ঞানের বিষয়গুলি উত্তর করেছিল ৷ সে আর্মি অফিসার হতে পারেনি ৷ পুলিশ অফিসার হয়েছে ৷ ছেলেটির লেখা কিছু বই আগরতলা বইমেলায় স্থান পেয়েছে । অনুরোধ রইলো পড়ে দেখার ।