সরকারী স্তরে বই ক্রয় ও সংবাদপত্র সরবরাহ বন্ধ থাকায় ত্রিপুরায় বহু লাইব্রেরী লুপ্তপ্রায়
জয়ন্ত দেবনাথ
রাজ্য জুড়ে সরকারী বেসরকারী সমস্ত লাইব্রেরী গুলিকে পুস্তক শূন্য করে রেখে লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রতি বছরই পুস্তক প্রেমীদের জড়ো করে আগরতলায় বই মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। গত চার পাঁচ বছর আগেও রাজ্যের অধিকাংশ স্কুলে ছোট করে হলেও একটি লাইব্রেরী বা বুক সেলফ ছিল। কিন্তু গত কবছর ধরে সরকারী তহবিলের অভাবে এসব লাইব্রেরী গুলিতে সরকারী স্তরে কোন বই এবং সংবাদপত্র সরবরাহ করা হচ্ছে না। লাইব্রেরী বলতে এক্ষণে শুধু আগরতলায় বীরচন্দ্র সেন্ট্রাল লাইব্রেরীতে কিছু বই বছরের একটা সময় ক্রয় করা হয়।
ইতিপূর্বে রাজ্যের বাইশটি কলেজের সব গুলিতেই একটি করে লাইব্রেরী ছিল। সেখানে মোটামুটি সব রকমেরই রেফারেন্স বইই পাওয়া যেতো। কিন্তু গত কবছর ধরে কোন কলেজেরই লাইব্রেরীর কোন অস্তিত্ব নেই। একই রকমভাবে তথ্য দপ্তরের লোকরঞ্জন শাখা গুলিতেও ইতিপূর্বে সরকারী স্তরে বই ক্রয় করে নানা রকমের রেফারেন্স বই গ্রামগঞ্জের বইপ্রেমীদের জ্ঞানের প্রসারে সরবরাহ করা হতো। তথ্য দপ্তর থেকে বিনামূল্যে দৈনিক সংবাদপত্র গুলিও লোকরঞ্জন শাখা গুলিতে সরবরাহ করা হত। সেসব প্রক্রিয়া অর্থাভাব বাম আমলেই বন্ধ হয়ে যায়। তথ্য দপ্তরের আওতাধীন প্রায় ৪৩২টি-র মতো লোকরঞ্জন শাখা রয়েছে কাগজেপত্রে। এগুলিতে এক্ষণে কি কাজ হচ্ছে দপ্তরেরও কেউ বলতে পারেন না। একইরকম ভাবে রাজ্যের বিভিন্ন জেলা গুলিতে যে ২৮টি-র মতো পাবলিক লাইব্রেরী রয়েছে সেগুলিও বন্ধ প্রায়।
ইতিপূর্বে বহু এনজিও পরিচালিত লাইব্রেরীতেও বই মেলার সময় বাল্কে বই ক্রয় করে পরে তা তথ্য দপ্তর এর মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়তো। অনেক ক্লাবেও লাইব্রেরী ছিল। সেখানেও সংবাদপত্র, সরকারী বই বা তথ্য দপ্তরের মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন সাফল্যের পুস্তিকা পৌঁছে দেওয়া হয়তো। এক্ষণে এসব পুরোপুরি বন্ধ। এমনকি তথ্য দপ্তর বা অন্যান্য সরকারী দপ্তর গুলি সারা বছর কোথায় কি কাজ করলেন এসব সাফল্য প্রচারেরও কোন উদ্যোগ নেই। গত বছর ২১শে জানুয়ারি স্টেট-হুড ডে ও ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে দুটি ফোল্ডার তথ্য দপ্তরের তরফে প্রকাশ করা হলেও কোন মিডিয়া হাউজেও এগুলি দপ্তর পৌঁছায়নি। অথচ বাম আমলে প্রতিটি ব্লক থেকে তাঁদের সাফল্যের ফিরিস্থি দিয়ে ছোট ছোট প্রচার পুস্তিকা বের করা হয়তো। কিন্তু মডেল ত্রিপুরায় সেসবই আজ ইতিহাস ও অতীত।
অনলাইন, ইন্টারনেটের যুগে যেখানে মানুষের বই পড়ার অগ্রাহ্য ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে, পৃথিবী জুড়ে যখন অনলাইন ইন্টারনেটে প্রচার ক্রমেই তেজি হচ্ছে তখন এরাজ্যের সরকার উল্টো পথে হাঁটছেন। ২০১৮ সালে বিজেপি আইপিএফটি জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেখা যাচ্ছে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তর গুলির নিজস্ব কাজকর্ম তথ্যাবলী প্রচারে যেসব ওয়েবসাইট গুলি রয়েছে যেগুলির কোন আপডেট করা হচ্ছেনা। দপ্তর বা নিগম গুলিতো বটেই রাজ্য সরকারের যে মূল ওয়েবসাইট রয়েছে (www.tripura.gov.in) সেই স্টেট পোর্টালের তথ্যও যথাযথ আপডেট করা হচ্ছে না। বহু লিঙ্ক এ গেলে দেখা যাচ্ছে পাঁচ বছর আগের তথ্য। অথচ তথ্য জানার অধিকার আইনেই বলা আছে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন কাজকর্ম, সিদ্ধান্ত, যেগুলি জনহিতে গৃহীত হচ্ছে তা যেন জনগন না চাইতেই পেতে পারে তার জন্য সরকারী প্রশাসনকে অনলাইনের মাধ্যমে তা সর্বদা ও দ্রুত আপডেটের ব্যবস্থা রাখতে হবে। কিন্তু এরাজ্যে এসবের কোন বালাই নেই। তথ্য জানার অধিকার আইনে তথ্য চাইলেও নিয়ম মোতাবেক তা সরবরাহ করা হয় না। অথচ বহু ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে এমন সব তথ্যের জন্যেও আর টি আই করতে বাধ্য করা হয় যেগুলি সরকারী প্রশাসনকে এমনিতেই জন সমক্ষে আনা উচিৎ। বড় রকমের কোন সরকারী সিদ্ধান্ত হলে একজন মন্ত্রী প্রেস কনফারেন্স করে তা বলে দেবেন। তাও লিখিত কিছু দেবেন না।
সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হল সরকারী সিদ্ধান্ত, কাজকর্মের প্রচারে তথ্য জানতে আই সি এ নামে রাজ্য সরকারের যে একটি তথ্য সরবরাহ উইং রয়েছে সেই দপ্তরের কাছে চাইলেও কোন সরকারী তথ্য পাওয়া যায়না। ওরা বলে দেন আর টি আই দিন। উদ্ভত অবস্থার প্রেক্ষিতে একদিকে যেমন রাজ্যে তথ্য জানার অধিকার থেকে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন একই রকম ভাবে তথ্যের অভাবে তথ্য নির্ভর বইপত্র প্রকাশেও ইদানিং সমস্যা হয়ে গেছে। আর এর চেয়ে আরও বেশী বড় সমস্যা হলো তথ্য নির্ভর স্থানীয় বই রাজ্যের স্কুল, কলেজ, এনজিও, লোকরঞ্জন শাখা কিংবা ব্লক, পঞ্চায়েতের লাইব্রেরী গুলিতে থাকছেনা বলে স্থানীয় যুবক যুবতী কিংবা বেকার চাকুরী প্রার্থীরা ইদানিং এসব লুপ্তপ্রায় লাইব্রেরী গুলিতে পা রাখতে চাইছেন না।
একইরকম ভাবে প্রয়োজনীয় সরকারি তথ্যের অভাবে রাজ্যের মিডিয়া হাউজ গুলিও প্রতিদিন নানাহ জটিল পরিস্থিতির মধ্যে পড়ছে। ডিজি, মুখ্যসচিব, সচিব কিংবা জেলা স্তরের এস পি, ডি এম ছাড়া মিডিয়ার সাথে কেউ কথা বলতে পারবেন না বলে বিজেপি আইপিএফটি জোট ক্ষমতায় এসে সার্কুলার জারি করে রেখেছেন। এর ফলে দৈনন্দিন সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে সাংবাদিকদেরও সমস্যার মুখে পরতে হচ্ছে। সাংবাদিকরা এই সার্কুলার প্রত্যাহার চেয়ে গত বেশ ক’মাস ধরে আন্দোলনও করে যাচ্ছেন। কিন্তু রাজ্য সরকার তার প্রত্যাহারে নারাজ। উদ্ভত অবস্থার প্রেক্ষিতে রাজ্যে তথ্য সঙ্কটের কারনে একদিকে যেমন তথ্য নির্ভর বই পুস্তক প্রকাশে সমস্যা হচ্ছে পাশাপাশি কোন ঘটনার ব্যাপারে সরকারি বয়ানের অভাবে সমস্যাগ্রস্ত মিডিয়া হাউজগুলিও।