।। গড়াগড়ি ।।

অরিন্দম নাথ

এই বছরের ইংরেজি নববর্ষ দিনের ঘটনা । প্রতি দিনের মত সকালে মেঘনাদবাবুরা বেরিয়েছেন মর্নিং ওয়াকে । সঙ্গে তাঁর বন্ধু অহনবাবু । আর কুকুর জলি । বন্ধু সার্থকনামা । অহন শব্দের অর্থ ভোর । এখন শীত । তথাপি তাঁরা খুব ভোরে বেরুন । পাঁচটার মধ্যে তাঁকে জলি জাগিয়ে দেয় । সে তাঁর ঘরেই ঘুমায় । নতুন কম্বল মুড়িয়ে, মেঝেতে ছোট্ট ম্যাটের উপর । ঘরে গুড-নাইট জ্বলে । মাঝেমধ্যে জলি সাফোকেটেড ফিল করে । তখন আগে জেগে যায় । ঘর-বাহির করে । প্রথম প্রথম বিষয়টি তিনি বুঝতে পারেননি । একদিন জলিই একটু দরজা ফাঁক করে, আবার ঘুমিয়ে পড়ে । এখন জানালা একটু ফাঁক করে দেন । সময় হলে জাগে । কোনও কোনও দিন তাঁকে জাগানোর জন্য পায়ে সুড়সুড়ি দেয় । তখন সার্কিটের কথা তাঁর মনে আসে । আরশাদ ওয়ার্সী মেঘনাদবাবুর একজন প্রিয় শিল্পী । তাঁরই অভিনীত 'জলি এল এল বি ওয়ান' দেখে কুকুরের নাম রাখেন জলি ।

জলি দেখতে কালো । মেঘনাদবাবুর এবং তাঁর বন্ধু অহনবাবু বিশ্বাস করেন জলির কিছু 'ইও' আছে । জলির ইও-টা যে কি বস্তু তাঁরা জানেন না । একম্ অদ্বিতীয়ম্ । এক্সট্রা ওর্ডিনারি । জলি পার্থিব বস্তু । আর্থলি ওবজেক্ট । তাঁর বন্ধুও বিশ্বাস করেন জলির মধ্যে অপার্থিব গুন রয়েছে । এক্সট্রা-টেরিস্টরিয়েল ওডিটি । ভোরে তাঁরা দেড় থেকে পৌনে দুঘণ্টা হাঁটেন । জলি তাঁদের গাইড । কখনও চেনা রাস্তায় । কখনও অচেনা রাস্তায় । নববর্ষের দিনে যেমন পাকা রাস্তা ধরে চলছিলেন । এক বৃদ্ধার সঙ্গে দেখা । একাকী তিনি হাঁটছেন । থান কাপড়েও তাঁকে ভীষণ ভালো লাগছিল । বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না, যৌবনে তিনি কত সুন্দরী ছিলেন । নববর্ষের দিনে সেই অপরিচিতার সঙ্গে কথা না বলে তিনি থাকতে পারলেন না । তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, "দিদিমা, আপনার বাড়ি কোথায়?"

- বাড়ি আর কোথায় বাবা! রোজ সকালে বৈষ্ণবের সমাধি একবার দেখে আসি ।

তারপর বৈষ্ণবের সমাধি তাঁদেরকে দেখালেন । আঙ্গুল দিয়ে নিজের ডেরাও দেখালেন । মেঘনাদবাবু এবার জিজ্ঞেস করলেন, "আপনার বয়স কত?"

- কম অইছে না ! পাকিস্তানের যুদ্ধের সময় ছয়-সাত বছরের ছিলাম ।

- বাংলাদেশের স্বস্বস্ব স্বাধীনতা যুদ্ধ ?

- না, পার্টিশনের সময় । আমরা মাইগ্রেশন কইরা আইছি । তোমরার বাড়ি কই?

- নন্দননগরে পুরানো সিনেমা হলের কাছে ।

- বৈষ্ণবের সঙ্গে সিনেমা দেখছি ।

তাঁর মনে এক অজানা প্রশান্তি । জলি এগিয়ে যায় । দিদিমার সাথে কথা বলার আরও ইচ্ছে থাকলেও তাঁরা দাঁড়ান না । জলি এবার একটি ফাঁড়ি রাস্তা ধরে । তাঁরাও আন্দাজ করেন, এই রাস্তায় বাড়িতে পৌঁছতে পারবেন । তথাপি নিশ্চিত হতে এক মহিলাকে পেয়ে জিজ্ঞেস করেন । তিনি তাঁদেরই বয়সী । এবার 'মাসি' সম্বোধন করেন । ভদ্রমহিলা বলেন, "খেতের লাইলে লাইলে নোয়াগাঁও বাজারে যাওয়া যায় ।"

কিছুক্ষণ হাঁটার পর রাস্তা ছেড়ে জমির আলপথ ধরেন । এক জায়গায় পৌঁছে, তাঁদের মনে হল ডেড এন্ডে পৌঁছে গেছেন । জমিতে জল আটকে রাখা হয়েছে । কিছু জমিতে হাল পড়েছে । কিছু জমি অকর্ষিত । সামনে বাড়িঘর । এত ভোরে চরাচরে কাউকে দেখা যাচ্ছে না । একপাশে বড় একটি নালা । হঠাৎ তারা আবিষ্কার করলেন নালাতে একটি পাকা স্ল্যাব রয়েছে । এই খবরে জলি খুব খুশি । একপ্রস্ত জলে নেমে স্নান করে নিল । এবার নতুন রাস্তায় শীতলা বাড়ি পৌঁছলেন । তারপর পরিচিত রাস্তা । তাঁরা এগিয়ে যান । দুই বন্ধু বলাবলি করেন আজও জলি মাটিতে গড়াগড়ি খাবে কি না । প্রতিদিন বেরুবার আগে জলি তাঁদের কোনপথে নিয়ে যাবে আন্দাজ করার চেষ্টা করেন । দুই তাঁদের অনুমান প্রায়শই মেলে না । প্রায়ই জলি অপছন্দের রাস্তায় যেতে চায় না । একটি জায়গায়, রাস্তার পাশে একটি বটগাছ আছে । এখন এখানে মুসলিম মহল্লা । আগে এখানে একটি হিন্দু পরিবার থাকতো । তারা অন্যত্র চলে গেছে । বটগাছের নীচে এখনও পূজার পর মাটির মূর্তি রেখে দেওয়া হয় । বটগাছটিকে পেঁচিয়ে একটি লাল শালু কাপড় বাধা । গাছটির নীচ দিয়ে যাওয়ার সময় জলি রোজ দাঁড়িয়ে পড়ে । তারপর একটি নির্দিষ্ট যায়গায় মাটিতে গড়াগড়ি খায় । এমন নয় যে সেখানে অন্য কুকুর সময় কাটায় । এদিনও এর অন্যথা হয় না । দুই বন্ধুই এর আপাত কোনও ব্যাখ্যা খোঁজে পান না ।

মেঘনাদবাবুর মনে আসে মহাভারতের একটি গল্প । রাজসূয় যজ্ঞ করার পর যুধিষ্ঠির প্রচুর ধন-দৌলত দান করেন । যুধিষ্ঠিরের মনে ভীষণ অহংকার । হঠাৎ সেখানে একটি নেউল এসে পৌঁছায় । তার শরীরের একটি পাশ সোনা দিয়ে মুড়ানো । সে যজ্ঞস্থলের মাটিতে গড়াগড়ি খায় । তারপর নিরাশ হয়ে যুধিষ্ঠিরকে বলে, "না, এবারও হলো না ।"

তারপর সে একটি গল্প বলে । তখন খুব দুর্ভিক্ষ চলছে । হয়তো করোনা পরবর্তী আর্থিক মন্দার মত । একটি ব্রাহ্মণ পরিবার সারাদিনের সংগ্রহ কিছু চাল রাঁধতে পেরেছে । এই দিয়ে ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলা, ছেলে এবং ছেলের বৌ খুব কষ্টে-সৃষ্টে খিধে নিবারণ করতে পারবে । এমন অবস্থায় একজন অতিথি হাজির হলেন । তিনি ভীষণই ক্ষুধার্ত । প্রথমে ব্রাহ্মণ তাঁর খাবারের অংশ অতিথিকে দিলেন । কিন্তু এতে অতিথির খিধে মেটে না । এবার ব্রাহ্মণী তাঁর অংশ দিলেন । তথাপি অতিথি পরিতৃপ্ত হন না । এবার ছেলে তার খাবারের অংশ দেয় । তাতেও অতিথির পরিতৃপ্তি হয় না । এবার ছেলের বৌ তার অংশ অতিথিকে খেতে দেয় । অতিথি এবার পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলেন । অতিথি ছিলেন স্বয়ং ধর্মরাজ । সেই খাবার স্থলে অল্প কয়েকটি খাদ্য দানা পড়েছিল । নেউল তা খেয়ে, তৃপ্তিতে মাটিতে গড়াগড়ি দেয় । তখন তার শরীরের অর্ধেক অংশ সোনার হয়ে যায় । সেই থেকে যেখানেই দান-ধ্যান, যজ্ঞ হয়, সেখানেই নেউল গিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দেয় । কিন্তু তার শরীরের বাকি অংশের পরিবর্তন আসে না ।

নেউলের গল্পে যুধিষ্ঠিরের দর্প চূর্ণ হয় । মেঘনাদবাবু কোথায় যেন, এর সঙ্গে জলির আচরণের মিল খুঁজে পান । জলিতো অন্যসব বটগাছের নীচে কিংবা ধর্মস্থানে গড়াগড়ি খায় না ! দুই বন্ধুই তাই হতবাক হন ।

সবশেষ খবর, মেঘনাদবাবু একটি ব্যাখ্যা পেয়েছেন । কোনও কোনও জায়গার গন্ধ বেড়াল-কুকুরের ভালো লাগে । সেখানে তারা গড়াগড়ি খায় । গায়ের মধ্যে সেই জায়গার সেন্ট লাগিয়ে আসে । ঠিক যেমন আমরা গায়ে আতর মাখি ।






You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.