৷৷ ভবঘুরে আত্মা ৷৷

অরিন্দম নাথ

(১) নিজেকে বোহেমিয়ান ভাবতে কেন জানি আমার ভালো লাগে । বেশ একটা সাহেব সাহেব ভাব আছে । শব্দটির সঙ্গে প্রথম পরিচয় শার্লক হোমসের গল্প পড়ে । তখন স্কুলে পড়ি । স্যার আর্থার কোনান ডয়েল কোনও একটি চরিত্রের বর্ণনায় এই শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন । বোহেমিয়ান ইংরেজি শব্দ । মধ্য ইউরোপের একটি অঞ্চল । চেক প্রজাতন্ত্রে অবস্থিত । এখানে প্রাচীনকালে কেল্টীয় বোইয়াই জাতি বাস করত । অশ্বারোহী যাযাবর । তাদের নাম থেকেই এসেছে বোহেমিয়া । বাংলায় বোহেমিয়ানের সঠিক প্রতিশব্দ নেই । বাদাইম্যা বা ভাদাইম্যা । যদিও এর সঙ্গে কিছুটা নঞর্থক অর্থ জড়িয়ে থাকে । এলোমেলো । ছন্নছাড়া । অনেক বেশী গ্রহণযোগ্য । বোহেমিয়ানরা মেধাবী হয় । বাদাইম্যারা স্বল্প-বুদ্ধির । ভবঘুরেরা উদাসীনভাবে ঘুরে বেড়ায় । তাদের পিছুটান থাকে না । সবকিছুর মিলিত হচ্ছে বোহেমিয়ান । 'বোহেমিয়ান সাইকি' বলেও একটি কথা আছে । ভবঘুরে আত্মা । ছোটবেলা থেকে সবার মধ্যেই কমবেশি বোহেমিয়ান সাইকি থাকে । কেউ হারিয়ে ফেলে । কেউ সযত্নে বহে বেড়ায় । আমি শেষোক্ত দলে । এই বোহেমিয়ান সাইকি বা পাগলামোর কারণেই এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াই । কখনও পায়ে হেঁটে । কখনও বাই-সাইকেলে । এখন প্রশাসনিক কাজের সুবাদে গাড়িতে । মনে মনে গুনগুনিয়ে গাই:

"জিন্দেগি কি সফর মে গুজর যাতে হ্যা য় যো মকান ও ফির নাহি আতে...

জীবনের যাত্রাপথে আমরা যেসকল স্থান পেরিয়ে আসি,

সেসব আর ফিরে আসে না, সেসব আর ফিরে আসে না...।"

এই সত্য অনুধাবন করতে সম্প্রতি গিয়েছিলাম আঠারমুড়া পাহাড়ের গিরিপদে । একসময় ছিল দুর্গম । এখন দুর্গম নয় । গাড়িতে যাওয়া যায় । আমার সফরসঙ্গী চারজন । একজন কমান্ড্যান্ট । একজন নায়েব সুবেদার । আমার দেহরক্ষী এবং ড্রাইভার । জয়ন্ত চক্রবর্তী টি এস আর দ্বাদশ বাহিনীর কমান্ড্যান্ট । সূর্য জমাতিয়া নায়েব সুবেদার । বহু যুদ্ধের সেনানী । আমার বিশ্বস্ত । তার হাত ধরেই ত্রিপুরায় প্রথম এ কে সিরিজ হাতিয়ার উদ্ধার হয়েছিল । সেটা ১৯৯৫ সাল । তেলিয়ামুড়ার রাঙ্খল পাড়ায় । এন এস সি এন বৈরীদের কাছ থেকে । সাথে ছিল সুকান্ত রায় নামে এক পুলিশ-কর্মী । আমাদের গন্তব্য তেলিয়ামুড়া থেকে নোনাছড়া হয়ে গঙ্গানগর । তারপর দাঙ্গাবাড়ি-অম্পি রাস্তা ধরে ফিরে আসা । আঠারমুড়া পাহাড়কে একবার পশ্চিম থেকে পূবে অতিক্রম করব । একবার পূব থেকে পশ্চিমে ।

(২) অগাস্ট মাসের ৫ তারিখ । এটা ২০২০ সাল । ভাদ্র মাস আসেনি । তথাপি যেন ভাদ্রের গরম । আগরতলা থেকে বেরুলাম বেলা একটায় । কালো স্কর্পিও গাড়ি । সঙ্গে দুইটি মারুতি জিপসিতে এসকর্ট । গাড়িটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলেও গরম লাগছিল । সজল বললো কালো রংয়ের গাড়িতে গরম বেশি লাগে । সজল আমাদের ড্রাইভার । আমি সহমত পোষণ করি । কারণ, তার কথায় বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রয়েছে । কালো রং সব আলো শুষে নেয় । তপনও একই কথা বলে । তপন আমার দেহরক্ষী । জিরানীয়াতে সূর্য আমার গাড়িতে ওঠে । তার বাহিনীর সদর জম্পুইজলায় । দেড় বছর আমি সূর্যদের টি এস আর বাহিনীকে কমান্ড করেছি । তার পরেও বিভিন্ন সময়ে তাকে ডেকে নিয়ে গেছি । কলের কাজ বলে হয় না । তেমনি ফৌজের কিছু কাজ আছে উপযুক্ত লোক ছাড়া হয় না । জঙ্গি মোকাবেলায় সূর্যের মত সাহসী এবং তৎপর ছেলে খুব কমই পেয়েছি ।

"ফুল খিলতে হ্যা, লোগ্ মিলতে হ্যা ,

লোগ্ মিলতে হ্যা মগর,

পতঝড় মে জো ফুল মুরঝা জাতে হ্যা

ও বহারো কে আনে সে খিলতে নহী...

ফুল ফোটে, লোকও মিলে, কিন্তু,

শীত এলে যে ফুল ঝরে যায়,

বসন্তে সেই ফুল আবার ফিরে আসে না ....।"

এমনি কিছু হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে বড়মুড়া পেরিয়ে তেলিয়ামুড়া পৌঁছে যাই । চাকমা-ঘাটে আমাদের দ্বাদশ ব্যাটেলিয়ন টি এস আরের সদর । অল্প সময়ের বিরতির পর আবার চলতে শুরু করি । দুপুর আড়াইটা । এবার আমার গাড়িতে জয়ন্তও বসেছে । খোয়াই নদীর ব্যারেজের উপর দিয়ে রাস্তা । মহারানীতে গোমতীর উপর এবং নেপালটিলায় মনু নদীর উপর এমনি ব্যারেজ দেখেছি । সেইগুলির তুলনায় এখানে জল নেই বললেই চলে । ভীষণই শুকনো । আমি ভাবতাম কোনও চাকমা ব্যক্তির নাম থেকে এসেছে চাকমাঘাট । খোয়াই নদীর ঘাট । সে হয়তো এখানে খেয়া পারাপারের ইজারা নিয়েছিল । এখানে ত্রিপুরী ও রিয়াংদের বাস । চাকমা সম্প্রদায়ের লোকেরা নেই বললেই চলে । প্রবাল বর্মণের 'ত্রিপুরার স্থাননাম' বইটি পড়ে প্রকৃত সত্য জানলাম । চাঙমা শব্দ থেকে এসেছে 'চাকমা' । চাঙমার অর্থ ঠান্ডা । এই ঘাটের জল ঠাণ্ডা । এখানে পৌষ-পার্বণে মেলা বসে । লোকজন পূর্ব পুরুষের স্মৃতিতে তর্পণ করে ।

(৩)খোয়াই নদীর দক্ষিণ পারে প্রথম জনপদ তুই-মধু । তুই অর্থ জল । নিশ্চয় মধুর মত মিষ্টি জল । জয়ন্ত বললো, এসি চালিয়ে গাড়ির কাচ একটু নামিয়ে দেওয়ার জন্য । হাওয়া ঢুকায় গুমোট ভাবটা কেটে গেল । এর পরের গ্রাম তুই কর্ম । ককবরকে কর্ম হচ্ছে হলুদ । এখানকার ছড়ার জল হলুদ । লাল মাটি । পীচকরা রাস্তা । পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তিনটে বটগাছ । স্থানটির সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে । এরপর আমরা চড়াই অতিক্রম করতে শুরু করলাম । ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি শুরু হল । গাড়ির এসি বন্ধ করে বৃষ্টির ছাট কিছুটা উপভোগ করলাম । একসময় কাঁকড়াছড়া এলো । ছড়াতে কাঁকড়া মেলে । তাই এই নাম । রাস্তার পাশে বন বিভাগ থেকে বনায়ন করা হয়েছে । চাপা, বকুল, অর্জুন, মেহগনি, জারুল ইত্যাদি প্রজাতির চারা গাছ । অন্যথায় বাঁশ এবং জঙ্গলের ছোটখাটো গাছ ছাড়া কিছুই নজরে আসে না । ন্যাড়া পাহাড় দেখে মন খারাপ হয়ে গেল । দ্রোণ কিংবা হেলিকপ্টারের সাহায্যে পাহাড়ে আম, জাম, কাঁঠাল, কড়ই, গামার ইত্যাদির বীঁচি ছড়ালে হয়তো পাহাড়ের শ্যামলিমা ফিরিয়ে আনা যেত । আমার মন চলে যায় আঠাশ বছর আগে । যখন আমি প্রথম এই পাহাড়ে পদার্পণ করি । তারপর বারবার এসেছি । আরও এগারো বছর পরে । দ্বিতীয় ইনিংস ছিল চার বছরেরও বেশি । তখনও ভীষণরকম দুর্গম । উগ্রবাদীদের রমরমা । এখন বৈরীদের উৎপাত অনেকটা কমেছে । রাস্তাঘাটের উন্নতি হয়েছে । কিন্তু বন-দস্যুদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গিয়েছে ।

(৪) এখন রাস্তার পাশাপাশি বিদ্যুতায়নও হয়েছে । তথাপি অধিকাংশ লোকজন সরল । প্রকৃতির পূজারী । রাস্তার দুই পাশে জুম ক্ষেত । একদম খাড়া । টিলার গা বেয়ে পাকা ধান । কাচি দিয়ে কাটা যাবে না । সূর্য বললো, মলসমদের জুম । কিছু রিয়াংদের । ধান কাটবে না । চা-পাতা তোলার মত মেয়েরা পিঠের খাড়াতে ধানের শিস তুলে নেবে ।এরপর এল বাহাদুর পাড়া । নেপালী বাহাদুর নয় । মলসমদের গ্রাম । দক্ষিণ দিকে পাহাড়ের উপর একটি শাখা রাস্তা । দুধরাই মলসম পাড়া, হাম-পাইলা পাড়া হয়ে নবজয় পাড়ার দিকে এগিয়ে গেছে । পাকা সেতু । পাকা ড্রেন । সব জায়গায় পীচ ঢালাই হয়নি । তবে ইটের সুরকী বিছানো রয়েছে । প্রধানমন্ত্রীর গ্রাম সড়ক যোজনার ফসল । এরপর এলো নোনাছড়া । নদীর জল খানিকটা লবণাক্ত । হয়তো বন্য প্রাণীরা এখানে এসে একসময় জল খেত । নোনাছড়া ব্রিজের পর প্রজা-বাহাদুর মলসম পাড়া । কিছু স্মৃতি মনে এল ৷জানুয়ারি ২১, ২০০৫ সাল । আমি তখন এস পি ধলাই । বৈরী বিরোধী অভিযানে এসেছি নোনাছড়ায় । জগবন্ধু পাড়া, কূপ-ছড়া, হনুমান পাড়া ইত্যাদি জনপদ পেরিয়ে । সঙ্গে আসাম রাইফেলস এবং টি এস আর । নোনাছড়া তখন বৈরীদের অঘোষিত সদর । প্রথম রাত্রি কাটালাম নবজয় পাড়ায় । যতক্ষণ আসাম রাইফেলস আমাদের সাথে ছিল ততক্ষণ জল এবং খাবারের অভাব অনুভূত হয়নি । দ্বিতীয় দিন সকালে নোনাছড়াতে তল্লাশি চললো । নিষ্ফলা অভিযান । আসাম রাইফেলসকে ছেড়ে দিলাম । আমরা ফিরবো সন্ধ্যার দিকে । উদ্দেশ্য আসাম রাইফেলস চলে গেলে বৈরীরা যদি বেরিয়ে আসে । মোকাবেলা করব ৷ আমাদের সঙ্গে শুকনো খাবার । প্রথমে পানীয় জল ফুরিয়ে গেল । দুপুরের পর যখন চলতে শুরু করলাম ক্ষুধা-তৃষ্ণায় আমরা কাতর । অধিকাংশ গ্রাম ফাঁকা । বৈরীদের অত্যাচারে বড় রাস্তার পাশে রি-গ্রুপিং ভিলেজে চলে গেছে । গ্রাম থেকে খাবার সংগ্রহ করে রান্না করার ইচ্ছেও আমাদের হারিয়ে গেছে । বাউন্ড বাই বাউন্ড সতর্কতার সঙ্গে ফিরাই আমাদের উদ্দেশ্য । ফলে ফল-ফসারি যা পাওয়া যাচ্ছিল তা খেয়েই ক্ষুন্নিবৃত্তি করছিলাম । এমনকি কাচা পেঁপেও খাচ্ছিলাম । জগবন্ধু পাড়ায় গাড়ির কাছাকাছি পৌঁছলাম রাত্রি এগারোটা নাগাদ । আমবাসায় এস পি বাংলোতে যখন ফিরলাম ক্যালেন্ডারের তারিখ বদল হয়ে ২৩ শে জানুয়ারি সমাগত হয়েছে । পরদিন দুপুরের পর থেকে ক্ষণে ক্ষণে প্রচণ্ড পেটব্যথা শুরু হল । ব্যথায় কুঁকড়ে যাই । পারমিতা বললো কোলাইটিসের প্রাথমিক অবস্থা । প্রজাতন্ত্র দিবস সামনে । এই সময় বৈরীরা ভীষণ তৎপর হয়ে উঠে । অঘটন ঘটিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে চায় । তাই অফিস থেকে ছুটি নেওয়া সম্ভব নয় । বাধ্য হয়ে দুই বেলা ব্যারালগান ইনজেকশন নিয়ে অফিস করি । পারমিতার চিকিৎসা এবং সেবায় তিন চারদিন পর সুস্থ হয়ে উঠি । এরপর আর কখনও অসুস্থ হয়ে নিজেকে এত অসহায় মনে হয়নি ।প্রজা-বাহাদুর মলসম পাড়া সর্দারের নাম থেকে । ভৃগুরাম পাড়ায় রিয়াং জনবসতি । মলসম এবং রিয়াং এই দুই জনজাতির লোকেরাই পাহাড়ের উঁচুতে থাকতে ভালোবাসে । রিয়াংদের মধ্যে সনাতন হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী । মলসমদের মধ্যে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের আধিক্য । বেশ কয়েকটি গাড়ি পেলাম । সবগুলোই গঙ্গানগরের দিক থেকে তেলিয়ামুড়ার দিকে যাচ্ছিল । এরমধ্যে অনেকগুলো ট্রিপার ট্রাক । রাস্তার কাজের মালপত্র ড্রপ করে ফিরছিল । ভৃগুরাম পাড়া এলাকায় রাস্তার পাশে ড্রেনের কাজ হচ্ছে ৷ মেঘলা হাওয়ায় বনজ গন্ধ ভেসে আসছিল । আমরা দুবিধায় পড়লাম । বুনো তুলসী না গাজা পাতার গন্ধ । রাস্তার পাশেই বুনো তুলসী গাছ । আবার কোনও লুঙ্গাতে লুকিয়ে গাজা চাষ হলেও অবাক হব না । তবে গাজার চারা এখন খুবই ছোট থাকার কথা ।

কলাবাড়িতে গঙ্গানগর থানার পুলিশরা গাড়িতে তল্লাশি করছিল । পাশেই এস পি ও ক্যাম্প । গঙ্গানগর হাসপাতালের পাশ দিয়ে যখন বাজারে পৌঁছলাম ঘড়িতে বেলা চারটে । গঙ্গানগরের ভোল এখন অনেক পাল্টে গেছে । গঙ্গানগর আর ডি ব্লকের সুদৃশ্য বিল্ডিং দাঁড়িয়ে আছে । আমরা গঙ্গানগর বাজারে কিছুক্ষণ সময় কাটালাম । জুমের সবজি কিনলাম । খবর পেয়ে থানার ও সি মৃণাল রিয়াং দেখা করতে এলো । ওর বাবা জনজাতি । মা বাঙালি । চেহারায় বাঙালির ছাপ । খুবই দায়িত্বশীল অফিসার । ছেলেটিকে ভালো লাগে । আমি কিছু লোককে দেখব বলে আশা করেছিলাম । দেখা হল না ।

"কুছ লোগ্ এক রোজ জো বিছড় জাতে হ্যা ,

ও হাজারো কে জানে সে মিলতে নহী

উম্র ভর চাহে কোই পুকারা করে ওনকা নাম

ও ফির নহী আতে, ও ফির নহী আতে .....

কিছু লোক একদিন হারিয়ে যায়,

হাজার লোকের দেখা মিললেও ওর দেখা মেলে না,

জীবনভর কেউ তার নাম নিয়ে ডাকলেও ফিরে আসবে না, ফিরে আসবে না .....।"

আবার চলতে শুরু করলাম । আমবাসা-গণ্ডাছড়া সড়ক ধরে । উনিশ মাইলে পৌঁছে থামলাম । মহকুমা পুলিশ অফিসার, আমবাসার সাথে দেখা । সঙ্গে টি এস আরের জওয়ানেরা । আমরা দাঁড়িয়ে কথা বললাম । তখন লক্ষ্য করলাম কুড়ি পঁচিশজন জনজাতি যুবক রাস্তার পাশের ঘরবাড়ি থেকে আমাদের দেখছে । বেশভূষায় সচ্ছল বলে মনে হয় । আগে কখনও এমনটা হয়নি । ছেলেগুলো রাজ্যের বাইরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করত । করোনার কারণে ঘরে ফিরে এসেছে । হয়তো বেকার । মন আবারও খারাপ হয়ে গেল ।

(৫) যখন দাঙ্গাবাড়ি অম্পি রাস্তায় ঢুকলাম ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা । দাঙগই ফা রাজার মেয়ে দাঙগইমা । অপরূপ সুন্দরী । কলই সম্প্রদায়ের মহিলা । তাঁর নাম থেকে দাঙ্গামা বাড়ি । অপভ্রংশ হয়ে দাঙ্গাবাড়ি । রাস্তার পাশে কয়েকটি রিয়াং শিশু দাঁড়িয়েছিল । সবাই কন্যা সন্তান । আমাদের গাড়ি দেখে জঙ্গলে গিয়ে দাঁড়ালো । কেন জানি অস্বাভাবিক মনে হল না । রাস্তার কন্ডিশন ভালো । পীচ ঢালা । এই রাস্তাটি আগের রাস্তার সমান্তরালে দাঁড়িয়ে । কিছুটা দক্ষিণে । ব্রিজের সংখ্যা কম । সেই অর্থে একটিও চড়াই উৎরাই নেই । পরের জনপদ হনুমান পাড়া । পাহাড় একদমই ন্যাড়া । শুধু দুই পাশে জুম খেত । সবুজ ধানের গাছ । এখনও ধানের শিষ গজায়নি । দেরিতে চাষবাস শুরু হয়েছে । এখানকার সবাই রিয়াং জনগোষ্ঠীর । রিয়াংরা মলসমদের চেয়ে অলস । এই হয়তো প্রমাণিত হয় ।

প্রথমবার হনুমান পাড়াতে আসার স্মৃতি মনে এল । আমার প্রথম বই 'তরমুজ পাগলা ও অন্যান্য গল্প' থেকে কিছু অংশ তুলে ধরব :

গন্ডাছড়া, ৫ জুল ১৯৯২, রবিবার । আজ আবার বৈরী বিরোধী অভিযানে গিয়েছিলাম, সাথে ধীমানবাবু এবং ডি এ আর । আজকের গন্তব্যস্থল হনুমান পাড়া । গ্রামের নামটি সার্থক । রাস্তায় প্রচুর হনুমান পেলাম । দুইটি উল্লুকও দেখেছি । সকালে বেরিয়ে গিয়েছিলাম । ফিরতে রাত হল, বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছে । সন্ধ্যার দিকে হরিণের ডাক শুনেছি । কালেশ্বর হরিণ । গ্রামে রিয়াং সম্প্রদায়ের লোকের বাস । অনেক স্থানে বিদ্যুতের খুঁটি ও তার পৌঁছেছে । কিন্তু বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি । জিজ্ঞেস করলাম কখন লাইন টানা হয়েছে ।

"পাচ ছয়মাস হইব কন্ট্রাক্টর কাজ কইরছে । এখনও আগুন দিছে না ।"

ওরা বিদ্যুতকে আগুন ভাবে । অনেকস্থানে এর মধ্যে তার চুরি হয়ে গেছে ।

বর্তমানে ফিরে আসি ৷ আমরা এগিয়ে চলি । উল্টো দিক থেকে একটি গাড়ি আসে । নিশ্চিত হই অপর পাশে পৌঁছাতে পারব । পরবর্তী জনপদ রাবণ পাড়া । রাবণজয় রিয়াংয়ের নামে । এখানে আমাদের একটি টি এস আর ক্যাম্প আছে । অনেকবার এসেছি । করোনার আবহে ঢুকলাম না । চোখের ভাষাতেই কুশল বিনিময় করলাম । রাবণপাড়া এবং ডক্টর-সিং মলসম পাড়ার মধ্যেকার রাস্তা নতুন হয়েছে । অ্যালাইনম্যান্ট আগেও ছিল । ধ্বস পড়ে রাস্তা বুজে গিয়েছিল । এখন মধ্যবর্তী বিশ কিলো বলে একটি জনপদ গড়ে উঠেছে । অম্পির দিক থেকে বিশ কিলোমিটার মাইলফলক হবে । রাস্তাতে দুটো জায়গায় মাটি দেবে গিয়ে বিরাট গর্ত হয়েছে । একটু কষ্ট করেই আমরা স্থান দুটি পেরুলাম । রাস্তার মেরামতি না হলে, এই বর্ষায় গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে ।

জয়ন্ত একটি গল্প বলল । 'ব্যাম্বু টু বি ওপেনড্' । মহামান্য রাজ্যপাল কোথাও পরিদর্শনে এলে স্থানীয় থানার বড়বাবুরা আগে আগে গাড়িতে প্যাট্রোলিং করেন । রাস্তা সাফ রাখেন । অনেক জায়গায় বাঁশের ড্রপ-গেট লাগিয়ে গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি করা হয় । সঙ্গে একটি ফৌজের ক্যাম্প থাকে । ওয়ারলেস সেটের এইসব ক্যাম্পের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা হয় । এমনি একটি ড্রপ-গেটের কাছাকাছি এসে বড়বাবু, ওয়ারলেস সেটে বললেন, "ব্যাম্বু টু বি ওপেনড্, ব্যাম্বু টু বি ওপেনড্ ।"

বাঁশের ড্রপ-গেট খুলে দাও । যারা ড্রপ-গেট সামলায় তারা বড়বাবুর ইন্সট্রাকশন ঠিকই ফলো করল । মুক্ত রাস্তা দিয়ে মহামান্য রাজ্যপালের কনভয় দ্রুত বেরিয়ে গেল । জয়ন্ত ছিল সেই কনভয়ে । তখন সে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার । তার সঙ্গে একজন সিনিয়র পুলিশ অফিসার ছিলেন । গাড়ির ওয়ারলেস সেটে তিনিও 'ব্যাম্বু টু বি ওপেনড্, ব্যাম্বু টু বি ওপেনড্', শুনছিলেন । সহাস্যে জয়ন্ত সেদিন 'ব্যাম্বু টু বি ওপেনড্, ব্যাম্বু টু বি ওপেনড্'- এর ব্যাখ্যা দিয়েছিল ।

মধ্যে একটি স্থানে দুটো ঝর্ণা পড়ল ৷ এখনও আগের মত বহমান দেখে ভাল লাগলো । ডক্টর সিং পাড়াতে আমাদের টি এস আর ক্যাম্পের সামনে দাঁড়াতে হল । ব্যাম্বু ড্রপগেট ক্লোস্ড । 'ব্যাম্বু টু বি ওপেনড্' বলার জন্য কেউ ছিল না । ক্যাম্প ইনচার্জের আহ্বানে সাড়া দিলাম । আবাসিকদের সাথে মত বিনিময় করলাম । চা-বিস্কিট খেলাম । ডক্টর সিং থেকে অম্পি তের কিলোমিটার । মধ্যে টিলাবাড়ি এবং গামাকো দুইটি জনপদ । এইসব এলাকায় মূলতঃ রিয়াং, মলসম এবং কলই সম্প্রদায়ের জনজাতি লোকজনের বাস । রাত্রি তখন সাতটা । অনেকটা পথ যেতে হবে । পথে আর থামলাম না । টিলাবাড়ির কাছাকাছি একটি স্থানে, একটি লোক প্রদীপ হাতে দাঁড়িয়েছিল । রাস্তার তেমাথা । সূর্য বলল, ডাইনের পূজা করছে । আমি বললাম, বুরাসার পূজা! সে বলল, ঠিক বুরাসা নয়, ডাইনির বিরুদ্ধে প্রতিষেধক পূজা । গ্রামের রাস্তার তে-মাথায় কিংবা চৌ-মাথায় দিতে হয় । একজন লোকই পূজা করে । কিছু একটা প্রাণীও উৎসর্গ করে ।

তেলিয়ামুড়াতে জয়ন্ত নেমে গেল । জিরানীয়াতে সূর্য । বাসায় যখন ফিরলাম, রাত্রি প্রায় পৌনে দশটা । আবার স্নান করলাম ৷ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতা পড়লাম :

“জীবন যখন রৌদ্র-ঝলোমল,

উচ্চকিত হাসির জের টেনে,

অনেক ভালোবাসার কথা জেনে,

সারাটা দিন দুরন্ত উচ্ছ্বল

নেশার ঘোরে কাটল। সব আশা

রাত্রি এলেই আবার কেড়ে নিও,

অন্ধকারে দু-চোখ ভরে দিও

আর কিছু নয়, আলোর ভালোবাসা।“

অনেকদিন পর খুব ভাল ঘুমুলাম ৷






You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
মন্তব্যের তারিখ (Posted On)মন্তব্যকারির নাম (Name)মন্তব্য (Comment)
09.12.2020Nantu Ranjan DasExcellent. The article should be published in tourism site.