আগরতলা প্রেস ক্লাবের নির্বাচন প্রসঙ্গে

সমীর ধর

মনোনয়ন পেশ,পরীক্ষা, প্রত্যাহার পর্ব শেষ। দুটো প্যানেল মুখোমুখি। চলছে প্রচার। আদালত স্থগিতাদেশ না দিলে ৮ নভেম্বর ক্লাব সদস্যরা দুবছর মেয়াদি কার্যকরী কমিটি গঠন করবেন।

প্রশ্ন ছিল, তাই উঠেছে। বিদায়ী কমিটি তো অবৈধ। জবরদখলকারী। অবৈধ কমিটির করা নির্বাচন বৈধ হয় কী করে ?

বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে উদাসীন বা নিরাসক্ত থেকে, অথবা কোনও বাধ্যকতায় ইচ্ছে করে এড়িয়ে, শুধুমাত্র পুঁথিগত বিচার করতে বসলে এই প্রশ্নটাই কিন্তু মুখ্য প্রশ্নের ছদ্মবেশে হাজির হতে পারে। অনেকের মধ্যে হয়েছেও। এটা অস্বাভাবিক নয়।

এটা খাঁটি সত্য যে, ২০১৮ সালে রাজ্যে নতুন সরকার আসার পর সম্পূর্ণ গায়ের জোরে নির্বাচিত কমিটিকে অপমানিত, বিতাড়িত করে এরা এসেছেন। অবৈধভাবে থেকে গিয়েছেন। জবরদখলের ৬ মাস পর নির্বাচন না করেই কিংবা লোকদেখানো প্রহসন করে তারা আরও দুবছর কাটিয়েও দিয়েছেন। এখন, অবৈধ কমিটির বৈধ মেয়াদও শেষ।

এবার কিন্তু তুড়ি মেরে আবার একটা প্রহসন করে আরও দুবছরের মৌরসী পাট্টা শুরু করা যাচ্ছে না। বরং, আজ্ঞাবহ তাঁবেদারদের নিশ্চিত পরাজয় ঠেকাতে নগ্ন হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে রাজ্য মন্ত্রিসভার এক প্রভাবশালী সদস্য সমেত শাসক দলের একাংশের বিরুদ্ধে। কিন্তু কেন ? শাসক দল, তাদের মন্ত্রিসভা, সরকার রাজ্যের সাংবাদিকদের ঐতিহ্যবাহী কিন্তু সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আগরতলা প্রেস ক্লাবের এবারের নির্বাচন নিয়ে এত দুশ্চিন্তায় কেন ?

তাহলে কি, পরিস্থিতিতে কোথাও বড় কিছু পরিবর্তন ঘটেছে ? ঘটছে ? এই পরিবর্তনের ধারা এগিয়ে যাক, আরও বেগবান হোক, মাননীয়রা চাইছেন না ? পরিস্থিতিতে পরিবর্তন যদি হয়ে থাকে, সেটা কী ?

১৯৮১ সালের ৩০ জানুয়ারি তখনকার বাম সরকারের মুখ্যমন্ত্রী নৃপেন চক্রবর্তীর দূরদর্শী উদ্যোগে গঠিত হয়েছিল আগরতলা প্রেস ক্লাব। জমি,বাড়ি,ক্লাব চালানোর বার্ষিক খরচ সবই দিয়েছিল সরকার। রাজনৈতিক মতাদর্শ ও পরিচয়ের ঊর্ধে থেকে রাজ্যের যশস্বী সাংবাদিক শ্রদ্ধেয় অমিয় দেবরায়-কে প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে সামনে রেখে অনিল ভট্টাচার্য, সত্যব্রত চক্রবর্তী, গৌতম দাশ, মিলন দে সরকার্-এর অ্যাডহক কমিটি প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনের আয়োজন করেছিল। প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন বলা যায় কিনা জানি না, তবে প্রতিষ্ঠাকালের জনা-কুড়ি সদস্যের একজন এবং সেই থেকে এই প্রেস ক্লাবের সাধ্য-সম্ভব সক্রিয় সদস্য রয়েছি ভেবে গর্বিত আমি । স্বভাবতই এই ক্লাব-এর মর্যাদা ও স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক পরিবেশ পুনরুদ্ধারের কথা আমাকেও ভাবতেই হবে।

প্রেস ক্লাব প্রসঙ্গে রাজনীতির কথা সাধারণভাবে আসা উচিত নয়, বলবেন অনেকেই। আমার মনে হয়, প্রেস ক্লাব তো আর অন্য গ্রহের নয়। বরং সাংবাদিকরা পেশাগতভাবেই রাজনীতির সংশ্রব এড়াতে পারেন না। তা ছাড়া, কথায় আছে, নগর পুড়লে দেবালয় বাঁচে না। গোটা রাজ্যের গণতান্ত্রিক পরিবেশ আক্রান্ত হলে আগরতলা প্রেস ক্লাব নিরাপদ থাকতে পারে না। প্রায় প্রতিটি নাগরিকের মুখে শুনুন , রাজ্যে মানুষের জীবন জীবিকা আক্রান্ত এই সরকার আসার পর থেকে। কিন্তু, প্রথম এবং সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত গণতন্ত্র। বিরোধী দলেরও লাখো সমর্থক আছেন। তাঁদের নিজস্ব মতামত পোষণ করা, প্রকাশ ও প্রচার করা, সমর্থন বাড়ানোর চেষ্টা করার অধিকার ততটাই আছে,যতটা শাসক দলের রয়েছে। সাংবাদিকরা সরকার এবং জনগণের মধ্যে যথাসাধ্য সেতুর কাজ করেন। সরকারকে জনগণ প্রশ্ন করবেন, তাদের প্রতিনিধি হিসেবে সংবাদ মাধ্যমও প্রশ্ন করবে , বিরোধীরা প্রশ্ন করবেন। সে প্রশ্নের ভাষা যত কর্কশই হোক, সারবস্তু থাকলে সরকার বিনীতভাবে তার জবাব দেবেন। অন্তত চেষ্টা করবেন। এটাই আমাদের দেশের সংবিধান ও গণতন্ত্রের মূল কথা।

কিন্তু, কষ্ট হলেও বলতে হবে, গত ৩১ মাসে আমাদের অভিজ্ঞতা বিপরীত। বিপুল অংশের মানুষ ভাবছেন, ডকুমেন্টের ঢালাও প্রতিশ্রুতিতে তাঁরা ভীষণ প্রতারিত হয়েছেন। সামান্য প্রতিবাদ করলেও তাঁরা আক্রান্ত ,লাঞ্ছিত হচ্ছেন। সে সবের বিস্তৃত উল্লেখ এখানে বাহুল্য । সংবাদ মাধ্যমের মধ্যে শুরু থেকেই আক্রান্ত ডেইলি দেশের কথা। মনে রাখবেন, মতাদর্শ জেনেই অনেকে যেমন এই পত্রিকা দুচোখে সহ্য করতে পারেন না, তেমনি বহু মানুষ এই পত্রিকা পছন্দ করেন, ভালোবাসেন, পড়েন, নিয়মিত কেনেন। টিভির পর্দায় বন্ধ করা হলো চ্যানেল দিনরাত-এর সম্প্রচার। বিজ্ঞাপন না দিয়ে, প্রকাশনা বন্ধ করে ত্রিপুরা থেকে চলে যেতে বাধ্য করা হলো আজকাল-কে। কিন্তু, এখানেই থামলো না। ক্রমেই সম্প্রসারিত হলো সংবাদ মাধ্যমের ওপর আক্রমণ। রাজধানী-সহ জেলা, মহকুমার সাংবাদিক, হকার, এজেন্টদে ওপর আক্রমণ চলছিলই। ক্রমে এলো কালা সার্কুলার, পছন্দমতো সংবাদ লেখার জন্য , অপছন্দের খবর না লেখার জন্য হুমকি। মুখ্যমন্ত্রীর সেই ইতিহাস সাক্ষী রেখে " মাফ না করার" হুঁশিয়ারি , বহুল-প্রচারিত পত্রিকা অফিসে টেলিফোন করে মহিলা সম্পাদক-কে ডাকাবুকো মন্ত্রীর ধমক ইত্যাদি । শুরুতে মুখ্যমন্ত্রী-ঘোষিত 'সরকারের অভিভাবক' ছিলেন যিনি, সেই বরিষ্ঠ সম্পাদকও বলতে বাধ্য হলেন, "সংবাদমাধ্যমের কন্ঠরোধ করা এইরকম স্বৈরাচারী সরকার ত্রিপুরায় কখনও আসেনি।"

অ্যাসেম্বলি অব জার্নালিস্টস সংগঠনের নামে ত্রিপুরার প্রথম সারির প্রতিটি সংবাদপত্রের সম্পাদক ও বিশিষ্ট সাংবাদিকরা এক মঞ্চে সমবেত হয়ে সরকারের এই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হলেন। এমনকি, সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে রাজ্যে ও কেন্দ্রে আসীন সরকারের ভূমিকার প্রতিবাদ করলেন। তাঁরা রাজ্যে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য এবং সংবিধান বাঁচাতে সবাই এগিয়ে আসুন বলে ডাক দিয়েছেন।

এটা পরিস্থিতির গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সূচক বলে আমরা অনেকেই মনে করেছি। অ্যাসেম্বলি অব জার্নালিস্টস সংগঠনের সঙ্গে আগরতলা প্রেস ক্লাবের নির্বাচনের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু প্রেস ক্লাব-কে সাংবাদিক-স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র-বিরোধী শক্তির হাতে ছেড়ে দিয়ে অ্যাসেম্বলির লড়াই শক্তিশালী হতে পারে না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে সাংবাদিকদের রাজ্যব্যাপী প্রতিবাদী আওয়াজের গর্ভ থেকেই অ্যাসেম্বলির সভাপতি সুবলকুমার দে-র নেতৃত্বে একটি প্যানেল উঠে এসেছে।

প্রশ্ন ছিল, তাই উঠেছে।

সুবলকুমার দে কেন ? তিনি তো নিজস্ব অ্যজেন্ডা নিয়ে প্রতিবাদী হয়েছেন। আজকাল বন্ধ করার পেছনে সুবলবাবুর ভূমিকা জেনেও সমীর ধর কী করে তাঁর সঙ্গে গেলেন ? জানতে চাই, সুবলবাবু না থাকলেও কি এই আমলে আজকাল বাঁচত ? বাঁচানোর চেষ্টাও তো কম হয়নি। বরং যার মনে যা-ই থাকুক, সুবলবাবুর মতো অভিজ্ঞ এবং কলম খুলে লেখার মতো সাহসী সম্পাদক এ রাজ্যে এই মুহূর্তে আর কয়জন আছেন ?

হ্যাঁ, সবার সব ভূমিকা আমরা বিলক্ষণ জানি। ভুলিনি কিছুই। প্রকাশ্যে বলিও। কারণ এগুলো সত্যি। কিন্তু, সংবাদমাধ্যমের কন্ঠরোধ করার বর্তমান পরিস্থিতি আরও বড় সত্যি।

কে কতটা সৎ, কতটা অসৎ, কে বড় -কে ছোট, কে ওয়ার্কিং -কে মালিক এই প্রশ্ন গুলো আছে। কিন্তু, আপাতত স্থগিত। সংবিধানের ১৯ নম্বর ধারায় বর্ণিত নাগরিকদের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার এই রাজ্যে লুন্ঠিত। এর পুনরুদ্ধার ছাড়া, এমনকি কোনও আদালতের ওপর থেকেও বর্তমান কালো মেঘের ছায়া দূর হবার নয়।

তাই, প্রেস ক্লাবের নির্বাচনে আমি ভোট দিতে যাবো। গণতন্ত্রের পক্ষের প্রার্থীদের জয়ী করার জন্য ভোট দেবো। অনেক ষড়যন্ত্র, অনেক অসত্য প্রচার, হুমকি বিভ্রান্তি, বিশ্বাসঘাতকতা সত্ত্বেও গণতন্রের জয় ঠেকানো যাবে না বলে আমার মতো অনেকেরই দৃঢ় বিশ্বাস।

দুজন মাননীয় সদস্য ২০১৮ সালের জবরদখল চ্যালেঞ্জ করে যে মামলা করেছিলেন, বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতার কল্যাণে কালের গর্ভে তার বাস্তব প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে গেছে। ১৯৮৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মজলিশপুর, গোলাঘাটি কেন্দ্রের ভোট গণনার ফল কীভাবে গায়ের জোরে পাল্টে দেওয়া হয়েছিল, নিজের চোখে দেখেছি। কারণ, গণনাকেন্দ্রে সশরীরে উপস্থিত রাজ্যের একমাত্র সাংবাদিক ছিলাম আমি। বামেরা ওই গণনা জালিয়াতির ফলেই সরকারচ্যুত হয়েছিলেন সেদিন। এ ছাড়া, উগ্রপন্থী ব্যবহার , ভোটের মধ্যে উপদ্রুত আইন জারি, সেনা নামানো ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়ে ওই নির্বাচনকে "সম্পূর্ণ প্রহসন" বলেছিলেন বামেরা।

তারপরও, নৃপেন-দশরথরা বিধানসভা বয়কট করেননি কিন্তু।

তুল্য নয় , প্রাসঙ্গিকও কি নয় ? আমার কথাগুলো কাউকে ব্যক্তিগতভাবে আঘাত করার জন্য মোটেই নয়। তবুও, কোনওভাবে কেউ দুঃখ পেয়ে থাকলে ক্ষমা প্রার্থী।

( সমীর ধর- এর ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া)


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.