থমসনের রিপোর্টে ভারতে নারী নিরাপত্তা উদ্বেগজনক
প্রদীপ চক্রবর্তী
অসুর বিনাশিনী দেবী দুর্গার আরাধনার প্রাক্কালে বিশাল গনতান্ত্রিক দেশ আমাদের মহান ভারতের উপর ঝামা ঘষে দিয়েছে থমাস রয়টার্স ফাউন্ডেশন ।
ফাউন্ডেশন তার সর্বশেষ সমীক্ষা, রিপোর্টে বলেছে , নারীদের বসবাসের জন্য ভারত বিশ্বের চতুর্থ বিপজ্জনকতম স্থান। যেকোন শ্রেণি, বর্ণ, বা ধর্মের মহিলা এই নিষ্ঠুর হিংসা এবং বিকৃতির শিকার হতে পারেন, মহিলাদের হত্যা বা স্থায়ীভাবে জখম করার উদ্দেশ্যে করা এইসব পূর্বপরিকল্পিত অপরাধ যা নাকি নারীকে তার সঠিক ভূমিকায় নিয়োজিত করার একটি পাঠ হিসাবে কাজ করবে।
সমীক্ষা রিপোর্টে বলা হয়েছে ভারতে, যেসব মহিলা কোনো পুরুষের দেওয়া বিবাহের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন বা বিবাহবিচ্ছেদের দাবি জানিয়েছেন অ্যাসিড আক্রমণ তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধগ্রহণের একটি উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অ্যাসিডের স্পর্শে শরীরে স্থায়ী বিকৃতি ঘটে , মহিলার জীবন যন্ত্রণাময় করার দ্রুততম উপায়। অ্যাসিড আক্রমণ সংখ্যা বাড়তে থাকায় যদিও ভারত সরকার অ্যাসিড প্রস্তুত বিক্রয় ও পরিবহনের উপর বহু কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।
নাবালিকাকে জোর জবরদস্তি কিংবা অর্থের বিনিময়ে বিয়ে দেয়া যা বাল্যবিবাহ তা আমাদের পোড়া দেশে বহুদিন ধরেই প্রচলিত আছে এবং আজও তা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়নি। এই ধরনের বাল্যবিবাহ সাধারণত বেশী হয়ে থাকে উওরপ্রদেশ,ঝাড়খন্ড,বিহার,হরিয়ানায়। উওর পূর্ব ভারতে অভিভাবকদের নানা প্রলোভন দিয়ে , উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা বলে, অর্থ দিয়ে নাবালিকাদের হরিয়ানা ও অন্যান্য রাজ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।সেখানে তাদের বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে। ত্রিপুরা পুলিশ বেশ কয়েকজন নাবালিকাকে ভিনরাজ্যে থেকে উদ্ধার করেছে।
তথ্য বলছে বালিকাবধূরা বয়ঃসন্ধিকালে উপনীত হওয়ার আগে পর্যন্ত বাবা মায়ের সাথে থাকত। অতীতে, অল্পবয়সী বিধবাদের তীব্র যন্ত্রণাময় জীবনযাপনে বাধ্য করা হত, তাদের মাথা কামানো হত, সমাজের লাঞ্ছনার সহ্য করে তাদের বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করতে হত। ১৮৬০ সালে বাল্যবিবাহ বেআইনি ঘোষিত হয়েছে, তবে এই প্রথা এখনও সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ণ হয়নি।
১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিয়ন্ত্রণ আইন(Child Marriage Restraint Act) এবিষয়ে একটি প্রাসঙ্গিক আইন।
ইউনিসেফের "বিশ্বের শিশুদের অবস্থা-২০০৯(State of the World’s Children-2009)" প্রতিবেদন অনুসারে, ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী ৪৭% ভারতীয় মহিলা ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে করেন, যা গ্রামাঞ্চলে বেড়ে হয় ৫৬%। রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে যে পৃথিবীর ৪০% বাল্যবিবাহের ঘটনা ভারতেই ঘটে থাকে।
গার্হস্থ্য হিংসা সম্পাদনা
প্রাক্তন মহিলা ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী রেণুকা চৌধুরী বলেছিলেন ভারতে প্রায় ৭০% মহিলা গার্হস্থ্য হিংসার শিকার। ১৯৮৩ সালের ফৌজদারী আইনে ৪৯৮-এ ধারা "একজন মহিলার স্বামী বা স্বামীর আত্মীয় কর্তৃক তার প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন(Husband or relative of husband of a woman subjecting her to cruelty)” অন্তর্ভুক্তির মধ্যে দিয়েই গৃহাভ্যন্তরীণ হিংসার বিষয়টি প্রথম আইনি পথে মোকাবিলা করা হয়।
জাতীয় অপরাধ নিবন্ধীকরণ বিভাগ(National Crime Records Bureau) কর্তৃক প্রকাশিত তথ্য বলছে প্রতি তিন মিনিটে মহিলার বিরুদ্ধে একটি অপরাধের ঘটনা সংঘটিত হয়, প্রতি ২৯ মিনিটে একজন মহিলা ধর্ষিতা হন, প্রতি ৭৭ মিনিটে একজন মহিলা পণপ্রথার শিকার হয়ে মৃত্যু হয় এবং প্রতি নয় মিনিটে একজন মহিলা তার স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির লোকের নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে।
বিশাল ও মহান দেশ এই ভারত। ধনধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের ভারতের নারীদের জন্য পারিবারিক হিংসার থেকে সুরক্ষা আইনের(Protection of Women from Domestic Violence Act) আইনি রক্ষাকবজ থাকা সত্ত্বেও এধরনের ঘটনা বন্ধ হয়নি। এটা ঘটনা এবং উদ্বেগজনক।
ভারতে, নারীদের প্রতি যে কোনো ধরনের পারিবারিক হিংসা হয়ে থাকে স্বামী ও তার পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে। বধূদের উপর শারীরিক, মানসিক, বা যৌন নির্যাতন খুবই বিপজ্জনক। পারিবারিক হিংসা একটি অপরাধ বা অভিযোগ হিসাবে না দেখে একটি ব্যক্তিগত বা পারিবারিক বিষয় হিসেবে দেখা হয়। অভিযোগের প্রকার নির্ধারণে, বর্ণ, শ্রেণী, ধর্মীয় প্রবণতার বিষয়গুলি বিবেচনার মধ্যে রাখা হয়, যা কখনো কখনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে কিনা তা নির্ধারণ করে দেয়।
বহু গবেষণায় হিংসার প্রাদুর্ভাবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং অপরাধের ন্যায়বিচার করার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু বেশিরভাগ মহিলা অভিযোগ জানানোর ব্যাপারে অনাগ্রহী। এই মহিলারা ন্যায়বিচার, মর্যাদা এবং সমতালাভের সাংবিধানিক অধিকারের অধিকারী কিন্তু সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটকে সমর্থন করে তারা অভিযোগ জানানোর ব্যাপারে অনাগ্রহী। যেহেতু নারীরা হিংসার কথা বলতে এবং সাহায্য খুঁজতে অস্বীকার করছেন, তারা বহুক্ষেত্রে যথোপযুক্ত প্রতিকারও পাচ্ছেন ন বলে থমসনের রিপোর্ট বলছে।
পণপ্রথা বা যৌতুক সম্পাদনা
১৯৬১ সালে, ভারত সরকার পণপ্রথা নিষিদ্ধকরণ আইন পাস করে, যার ফলে বৈবাহিক ব্যবস্থাগুলিতে যৌতুকের দাবি বেআইনি তবে, কিছু জায়গায় যৌতুক সংক্রান্ত পারিবারিক হিংসা, আত্মহত্যা এবং খুনের ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৮০ এর দশকে এরকম অনেকগুলি মামলা দায়ের করা হয়েছিল।
১৯৮৫ সালে পণপ্রথা নিষিদ্ধকরণ (নববধূ এবং বরের পাওয়া উপহারের তালিকা বজায় রাখা) বিধি প্রণয়ন করা হয়। এই নিয়ম অনুযায়ী, বিবাহের সময় নববধূ এবং বরের পাওয়া উপহারের একটি স্বাক্ষরিত তালিকায় লিপিবদ্ধ রাখা উচিত। তালিকাটিতে প্রতিটি উপহারের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ, তার আনুমানিক মূল্য, উপহারদাতার নাম এবং প্রাপকের সাথে তার সম্পর্কের উল্লেখ থাকা উচিত। তবে, এই ধরনের নিয়মগুলি খুব কমই মেনে চলা হয়।
১৯৯৭ সালের এক রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে যে, প্রতিবছর ভারতে যৌতুক সংক্রান্ত কারণে কমপক্ষে ৫০০০ নারীর মৃত্যু হয় এবং প্রতিদিন কিছু সংখ্যক মহিলার 'রান্নাঘরের আগুনে' মৃত্যু হয় যা খুব সম্ভব ষড়যন্ত্রমূলক। বধূর অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুর এইসব ঘটনা ভারতেই সমালোচিত হয়। শহুরে শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে, যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন কমছে।
আমাদের এ রাজ্যে ও পনের দাবীতে বধূ নির্যাতন হয়ে থাকে,বহু বধূ হত্যার ঘটনা ঘটেছে।বহু ক্ষেত্রে অপরাধী গ্রেপ্তার হয়েছে।সাজা হয়েছে বলে তথ্য নেই।তবে এ রাজ্যে কিন্তু মহিলা কমিশন রয়েছে,তারা নানা সুপারিশ করেছে।
তবে এটা ঠিক গ্রামগঞ্জে এখনো নারী,বধূ নির্যাতন হচ্ছে, নাবালিকাদের অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে।এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্হা নেয়না ,এরা দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে।
অথচ এ রাজ্যে মহিলা নির্যাতন বেড়ে চলছে।
আগামীকাল থেকেই শুরু হচ্ছে মহিষাশুরমর্দিনী পূজা।আমরা সবাই দেবীর আরাধনা করব।অসুর বিনাশিনী র পূজা করব। কিন্তু সেই সব অসুর,দস্যুদের দলন কিভাবে হবে সেটাই আজ বড় প্রশ্ন।