৷৷ মোবাইল প্রণয় ৷৷

অরিন্দম নাথ

ফেইসবুকে অচিন্ত্য আলোলিকার ছবি দেখছিল । বন্ধু রূপমের মেয়ে । তারা দুজনে সমবয়সী। ফেইসবুকের বাইরেও বন্ধু । ব্যক্তি জীবনে । দু'জনে নিজেদের সুখ-দুঃখের কথা বলে । মত বিনিময় করে । মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে রূপম ভীষণ চিন্তিত । অচিন্ত্য ভেবে পায় না, বন্ধুকে কি পরামর্শ দেবে । সে একটি সরকারি দপ্তরে চাকুরী করে । গ্যাজেটেড পোস্ট । রূপম বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী । বেতন ভালোই । তবে প্রচণ্ড খাটুনি । প্রচুর ট্যুর করতে হয় । জন্মদিনের পোশাকে আলোলিকার ছবি । অনুষ্ঠানে তারও নিমন্ত্রণ ছিল । কোভিডের কথা ভেবে যায়নি । একটি উপহার পাঠিয়ে দিয়েছিল । ভারি মিষ্টি মেয়ে । চোখগুলি খুব সুন্দর । বেশ একটা দীপ্তি আছে । 'চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে' । রবিঠাকুর মনে হয় এই আলোর কথাই উল্লেখ করেছেন ।

অচিন্ত্য ও রূপমের ক্বচিৎ দেখা হয় । দুজনের একটি কমন ঠেক আছে । তার স্ত্রী পালবী চাকুরী করে । শিক্ষিকা । সম্প্রতি বদলি হয়েছে । অন্য একটি জেলায় । রূপমের স্ত্রী প্রণতি হাউস-ওয়াইফ । গানে বিশারদ । আগে কয়েকটি গানের টিউশন করত । কোভিডের কারণে টিউশন ছেড়ে দিয়েছে । অনেকদিন দুটো পরিবার একত্রে সময় কাটায়নি । বন্ধুকে কি পরামর্শ দেবে, এই ভেবে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে ।

আলোলিকাকে বয়সের তুলনায় একটু বড় দেখায় । কিছুটা মোটাসোটা । এনিয়ে ক্লাসের মেয়েরা তাকে কিছুটা উত্যক্ত করে । এতদিন করোনার কারণে স্কুল বন্ধ ছিল । ইদানীং খুলেছে । এই সেশনে এখনও সে স্কুলে যায়নি । বস্তুত ক্লাস নাইনে ওঠা অবধি নতুন ক্লাসে তার যাওয়া হয়ে ওঠেনি । শুধু ভর্তির ফিস জমা দেওয়ার সময় বাবা-মার সঙ্গে গিয়েছিল । অনলাইনে লেসন নিয়েছে । পরীক্ষাও দিয়েছে । দুজন শিক্ষক তাকে বাড়িতে এসে পড়ান । এর বাইরে, দুজনের কাছে গিয়ে পড়তে যায় । ইদানীং সে ডায়েট কন্ট্রোল করতে শুরু করেছে । বাবা-মার আদরের জন্য পারে না । তাদের কাছে সে এইটুকু মেয়ে । বাবাকে সে ভীষণ ভালোবাসে । বাবার কষ্ট বুঝে । মেয়েরা বাবা-আন্ত-প্রাণ হয় ।

ইদানীং প্রণতির সঙ্গে মেয়ের প্রায়ই তর্ক হয় । মেয়ের বিশ্বাস, মা তাকে সময় দেয় না । হয়তো এর পেছনে সারবত্তা আছে । প্রণতি সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে । অনেক রাত্রি অবধি বন্ধুদের মোবাইলে গান শুনায় । সে অন্য এক জগতে বাস করে ৷ সকালে দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে । ঘরের ষোলআনা কাজ রূপম করে । মেয়ে সাহায্য করে । প্রণতি কাজের লোক রাখতে দেয় না । অনেক সময় রূপম সকাল সকাল বেরিয়ে যায় । তখন সকালের রান্না নিজেই করে । মেয়েকে টিউটরের কাছে নিয়ে যায় । নিয়ে আসে । অনেক সময় মেয়ে দাদুর বাড়িতে অপেক্ষা করে । প্রণতি রাঁধতে গেলে অনেক সময় বিপত্তি ঘটায় । তরকারি পুরিয়ে ফেলে । সারাক্ষণ মোবাইলে কথা বলে । প্রণতি আগে এমন ছিল না । মোবাইল আলোলিকা এবং রূপমের জীবনে বিভীষিকা নিয়ে এসেছে । যেন জীবনের অন্তরের আলো শুষে নিচ্ছে । প্রণতিকে বললেও, শুনে না । রূপম বেশি কিছু বলতে ভয় পায় । যদি কোনও হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে । প্রণতি টিভি দেখতেও পছন্দ করে না ।

অনেক সময় আলোলিকা মনীষাদির কাছে চলে যায় । সে কলেজে পড়ে । তাদের প্রতিবেশী। রূপমের সঙ্গে লুডো খেলতে তার ভালো লাগে । বাবা বাড়িতে থাকলে তার আব্দার পূরণ করে । সে মাঝে মধ্যে টি ভি দেখে । আগে সি আই ডি প্রোগ্রাম তার খুব ভালো লাগত । এখন ভালো লাগে না । ক্রাইম প্যাট্রোল ভালো লাগে । প্রণতির মন বাসায় টিকে না । আলোলিকা তখন ছোট ক্লাসে পড়ত । মেয়েকে স্কুল বাসে তুলে দিয়ে, প্রায়ই বাবার বাড়ি চলে যেত । একই শহরে বাড়ি ৷ তখন রূপমও অফিসের কাজে বাইরে থাকতো । প্রণতিই মেয়েকে বাস-স্ট্যান্ড থেকে আনা-নেওয়া করত । মেয়ে দুইদিন বাস থেকে মা-কে একজন আঙ্কলের বাইকের পেছনে দেখতে পায় । স্ট্যান্ডে প্রণতিকে নামিয়ে লোকটি চলে গিয়েছিল । রূপমকে বলায়, প্রণতি মেয়ের উপর খাপ্পা হয় । প্রথমে অস্বীকার যায় । পরে স্বীকার করে । একজন মেয়ে বান্ধবীর নামে নামটি মোবাইলে সেইভ ছিল । রূপম ভদ্রলোককে ফোনে ডাকায় । সে আসে না । দেখা করার সৎসাহস অর্জন করতে পারেনি । শ্বশুর-শাশুড়ির হস্তক্ষেপে বিষয়টি সেখানেই চাপা পড়ে ।

আরও একজনের প্রতি আলোলিকার রাগ আছে । রাগ না ঠিক নয় । রাগাশ্রয়ী ভালোবাসা। বিদিত মেসোর সবকিছুই তার ভালোলাগে । ঘুরে বেড়ানো । পরিবারের সবাইকে নিয়ে আড্ডা দেওয়া । ছুটির দিনে পিকনিক করা । শুধু তাদের দুই পরিবারই থাকে । স্মিতা মাসি । মেসো । আর বোন মৃদুলা । দিদি এবার কলেজে ভর্তি হবে । দুই পরিবারেই স্মিতা মাসি শেষ কথা । মাও মাসির ভীষণ ন্যাওটা । কথায় কথায় মাসিকে দিয়ে তাকে বকুনি দেন । ফাস্টফুড খেতে মেসো ভীষণ ভালোবাসেন । বিদিতবাবু বড় চাকুরী করেন । প্রণতির চোখে দিদি-জামাইবাবুর সবকিছু ভালো লাগে । মেয়ে আলোলিকা তা মানতে চায় না । মেয়ের ব্যক্তিত্বের কাছে প্রণতি প্রায়ই হেরে যায় । 'প্রাণে গান নাই' । সে বাঁশিতে সেই গান খুঁজে বেড়ায় ।

রূপম বিদিতবাবুর আচরণের একটি বিচিত্র ব্যাখ্যা দিয়েছে । তাঁর ভায়রা ডায়াবেটিসের রোগী । সবসময় ইনসুলিন নেন । তার ধারণা ভূতে পাওয়ার মত ওনার এটি একটি বাহানা । হঠাৎ সব ভরসা হারিয়ে মানুষ অপ্রাকৃত আচরণ করে । মায়ের আদর হারিয়ে, অনেক সময়েই কৈশোরে বাচ্চারা বাড়িতে অলৌকিক পরিবেশের সৃষ্টি করে । রূপমের ধারণা বিদিতবাবুও সেইরকম আচরণ করেন । মধুমেহ রোগের কারণে তাঁকে বেছে খেতে হয় । তিনি এর থেকে পরিত্রাণ খুঁজেন । ঘন ঘন আসর বসিয়ে তাঁর জন্য নিষিদ্ধ জিনিস খান । লোভকে তিনি দমন করতে পারেননি । হয়তো তিনি অজান্তেই এসব করেন ।

মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে রূপম শঙ্কিত হয় । অচিন্ত্যর কাছে পরামর্শ চায় । সে বন্ধুকে বলে, “একদিক থেকে বিচার করলে তোর মেয়ে ছোটবেলা থেকেই দৃঢ়চেতা হয়ে উঠেছে । তুই যতদূর পারিস মেয়েকে সঙ্গ দিবি । ‘তারের বীণা ভাঙল, হৃদয়-বীণায় গাহি রে’ ৷ তোদের দুজনের ভালোবাসাই পারবে প্রণতিকে মোবাইল প্রণয় থেকে ফিরিয়ে আনতে ৷”




You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.