।। কাব্যিক বিচার ।।
অরিন্দম নাথ
অনেক অনেকদিন আগের কথা ৷ একটি ছেলে একটি মেয়েকে খুব ভালোবাসতো । তারা ইংরেজি এক অক্ষরী । এক অক্ষরে নাম । ছেলেটির নাম এস (S), আর তার প্রেমিকার নাম নাম এ (A) ৷ দু`জনেই সচ্ছল পরিবারে জন্মেছে ৷ তবে তাদের অভিভাবকদের মধ্যে কোনও বনিবনা ছিল না ৷ তারা তখন সবে সাবালক-সাবালিকা হয়েছে, এই অবস্থায় মেয়েটি তার মাকে হারাল ৷ বাবাকে সে আগেই হারিয়েছিল । হঠাৎ করে মাকে হারিয়ে সে একটু দিশেহারা হয়ে পড়লো । নিজেকে সহায়হীন ভাবতে লাগলো ।
সে তখন ছেলেটির বাড়ি গেল । আশ্রয়ের খোঁজে ৷ ভরসার আশায় । বাড়িতে পা দিয়েই মেয়েটি এসের বাবার সামনে পড়ল । তিনি তাকে দেখে চিনতে পারলেন ৷ তাঁর মাথায় রাগ চাগিয়ে উঠল । তিনি চেঁচিয়ে বললেন, “তুমি কেন এখানে এসেছ? আমার বাড়িতে তোমার জায়গা হবে না ৷ আর এস-কে বলে রাখছি । আমার কথার অবাধ্য হলে, কিংবা তোমার সাথে মেলামেশা করলে তাকে ত্যাজ্য পুত্র করে ছাড়ব ৷”
এস তখন প্রতিষ্ঠিত । কিন্তু সে তার বাবার অমতে যেতে রাজি হল না ৷ ঘরের দরজা থেকেই বান্ধবীকে ফিরিয়ে দিল ৷ মেয়েটি এবার ছেলেটির এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু এইচ (H)-এর দ্বারস্থ হল ৷ এইচ তার বন্ধু এসের খুব সমালোচনা করল ৷ তারপর এ-কে বলল, “আমার বন্ধুকে আমি চিনি ৷ সে এই রকমই ৷ একদম মেরুদণ্ড হীন ৷ কিন্তু আমি বললেও কোনও কাজ হবে না ৷ তুমিতো যথেষ্ট স্বচ্ছল । তোমাকে নিজের পায়েই দাঁড়াতে হবে । এসকে ভুলে যাও । আমার এখন কাজ আছে, তুমি এখন আসতে পার ৷”
ছেলেটির আরেকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল ৷ তার নাম এল (L) । এবার মেয়েটি সেই বন্ধুর দ্বারস্থ হল ৷ সেই বন্ধুটিও প্রেমিকটির খুব সমালোচনা করল ৷ বলল, “আমার বন্ধু বরাবরই এই ধরনের ৷ আমি তাকে তোমার আগে থেকেই চিনি ৷ মনে হয় না সে আমার কথা শুনবে ৷ তবু চল, তার সাথে তোমার একবার মোলাকাত করিয়ে দিই ৷”
সে এস-কে একটি রেস্টুরেন্টে ডেকে আনল ৷ প্রেমিক-প্রেমিকার মোলাকাত করিয়ে দিল৷ কিন্তু ছেলেটি তার বাবার অমতে যেতে রাজি হল না ৷ ভালোবাসার ধনকে প্রত্যাখান করল ৷ তাকে বলল, ‘তুমি আমাকে ভুলে যাও ৷’
বন্ধুর সিদ্ধান্তে এল খুশি হল না ৷ তাদের দু`জনের মধ্যে বন্ধু-বিচ্ছেদের পরিস্থিতির সৃষ্টি হল ৷ সে মেয়েটিকে গাইড করল ৷ একজন উকিল এম (M)-কে নিয়োগ করল ৷ পারিশ্রমিক মেয়েটিই যোগালো ৷ উকিলবাবু মেয়েটিকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করলেন ৷
ছোটবেলায় কার কাছে গল্পটি প্রথম শুনেছিলাম মনে নেই ৷ তবে এই গল্পটির শেষে একটি প্রশ্ন থাকত ৷ পাঁচটি চরিত্র ‘A’, ‘S’, ‘H’, ‘L’ এবং ‘M’-কে নিয়ে ৷ চারিত্রিক গুণাবলীর বিচারে কে সবচাইতে ভাল ? তারপর কে ? এভাবে সাজাতে হত ৷ সাধারণত কোনও দুই ব্যক্তির পছন্দ এক রকম হত না ৷ এই চরিত্রগুলো একটু হলেও অর্থবহ ৷ ‘A’ এখানে Aim বা লক্ষ্য ৷ তেমনি ‘S’ হচ্ছে Selfishness বা স্বার্থপরতা ৷ ‘H’ হচ্ছে Heart বা হৃদ্যতা ৷ ‘L’ হচ্ছে Love বা ভালোবাসা ৷ ‘M’ হচ্ছে Money বা মাল-কড়ি ৷ জীবনে দাঁড়াতে গেলে এই পাঁচটি গুণের কমবেশি প্রয়োজন হয় ৷ কিন্তু খুব অল্প সংখ্যক লোককেই দেখতাম ‘S’-কে তালিকার প্রথমে রাখতে ৷ যার সম্ভবত: সঙ্গত কারণ আছে ৷ জীবনে স্বার্থপরতার প্রয়োজন আছে ৷ সেটাই ঘুরিয়ে বললে পেশাদারিত্ব ৷ তবু এর মধ্যে কিন্তু থাকে ৷
পুলিশের চাকুরীতে যোগ দিয়ে আমি প্রথমে যাই নতুন বাজার থানায় ৷ প্রশিক্ষণার্থী হিসাবে ৷ একদিন থানার কনস্টেবল এবং অফিসারদের গল্পটি বলি ৷ তারপর এই চরিত্রগুলি সম্পর্কে তাদের মতামত নিই ৷ সাদা কাগজে আলাদা আলাদা ভাবে ৷ এর মধ্যে একটি কনস্টেবল ‘S’-কে তালিকার প্রথমে রেখেছিল ৷ কনস্টেবলদের মধ্যে সেই ছিল সবচেয়ে শিক্ষিত৷ সে স্নাতক ৷ দেখতে একটু কালো ৷ সুঠাম স্বাস্থ্য ৷ সর্বক্ষণ বৌয়ের প্রশংসা করত ৷ ভালোবাসার বিয়ে ৷ বৌ কলেজে অনার্সের ছাত্রী ৷ কেন জানি মনে হয়েছিল কনস্টেবলটির মধ্যে একটা স্বার্থান্ধ রূপ বিরাজ করছে ৷
নতুন বাজার এলাকায় তখন চাকমা শরণার্থীদের ক্যাম্প ছিল ৷ শুক্রবারে করবুকে বাজার বসে ৷ দিন কয়েক পর এক শুক্রবারে করবুক বাজারে গিয়েছি ৷ সাথে থানার বড়বাবু৷ একজন ছোট দারোগা ৷ চারজন কনস্টেবল ৷ অতি শিক্ষিত কনস্টেবলটিও সেই দলে ৷ সাপ্তাহিক বাজার ৷ শরণার্থীদের উপস্থিতির কারণে খুব রমরমা ৷ করবুকের কাছেই পশ্চিম মাণিক্য-দেওয়ান গ্রাম ৷ সেখানে পাম্প-হাউস থেকে পাম্প চুরি গিয়েছিল ৷ বড়বাবু আর আমি গেলাম চুরির তদন্তে ৷ সাথে দুই কনস্টেবল ৷ গ্রামের প্রধান ৷ ছোট দারোগাবাবু ও অন্য দু`জন কনস্টেবল রইল বাজারে ৷ ঘুরে ঘুরে খবর সংগ্রহের জন্য ৷ সেই দলে স্নাতক ছেলেটি ৷ তদন্ত শেষ করে আমরা ফিরলাম ঘন্টা দু`য়েক পর ৷ ছোট দারোগাবাবু ও তার দল স্ট্যান্ডে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল ৷ আমার কথিত কনস্টেবলটির এক হাতে ব্যাগ-ভর্তি বাজার ৷ অন্য হাতে একজোড়া বুনো খরগোস ৷ পিঠে বন্দুক ৷ খরগোসকে এভাবে ঝুলানো অবস্থায় আগে দেখিনি ৷ প্রাণীগুলির চোখগুলি বড় পুতির মত জ্বল জ্বল করছিল ৷ অন্য পুলিশ কর্মীরাও টুক-টাক বাজার করেছিল ৷ বাঁশ করুল, কলার মোচা, শামুক ইত্যাদি ৷ তাদের কারো হাতেই থলে ছিল না ৷ এই দৃশ্য দেখে বড়বাবু উষ্মা প্রকাশ করলেন, ‘ঐ-তো, সাইরা লাইছে ৷’
আমি বললাম, ‘কি ?’
তিনি কনস্টেবল ছেলেটির নাম নিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁর সাংঘাতিক খাই ৷ একটু সুযোগ পাইছে, আর সাইরা লাইছে ৷ আওয়ার সময় দেখছি হাতে কিচ্ছু নাই ৷ গাড়ি-টারি থাইক্যা টাকা তুইল্যা, এই সপ্তাহের খোঁড়াক ম্যানেজ কইরা লাইছে ৷’
এরপর চাকুরী-সূত্রে বিভিন্ন জায়গায় বদলি হয়ে যাই ৷ আবার বছর ছয়েক পর উদয়পুরে যাই ৷ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসাবে ৷ তখন কনস্টেবল থেকে হাবিলদারদের ছুটি-ছাটা আমি দেখি ৷ লম্বা ছুটি হলে সাক্ষাৎকার নিই ৷ এমনি একদিনের সাক্ষাৎকার চলছে ৷ রিজার্ভ অফিসার সেই স্নাতক কনস্টেবলটিকে আমার সামনে পেশ করলেন ৷ তার সেই জৌলুস নেই ৷ সে ভালো করে হাটতে পারছিল না ৷ গাড়ি দুর্ঘটনায় প্রায় পঙ্গু হয়ে গেছে ৷ আমি তার ছুটি মঞ্জুর করলাম ৷ একবার মনে হল তার বৌয়ের কথা জিজ্ঞাসা করি ৷ পর মুহূর্তেই সেই খরগোস দু`টির চোখগুলি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল ৷ ছ`বছর আগে তাদের চোখের ভাষা বুঝতে পারিনি ৷ এবার বুঝতে পারলাম । কাব্যিক বিচার ৷