কৃষি বা ফার্ম বিল ২০২০ : দিগন্তকারী পদক্ষেপ ?

সজ্ঞয় রায়

কৃষি বিল 2020 নিয়ে ইদানীং রাজনৈতিক তরজা ও উত্তেজনা চরম ও তুঙ্গে। মূলত তিনটি বিল এর সঙ্গে জড়িত এবং কিছু দিন আগে গৃহীত হয়। প্রথমটি Farmers' Produce Trade and Commerce ( Promotion and facilitation) Bill , দ্বিতীয়টি Farmers' ( Empowerment and Protection) Agreement on Price Assurance and Farm Service Bill আর তৃতীয়টি Essential Commodities( Amendment) Bill. সরকার ও অনেক বিশেষজ্ঞ এর মতে ' ইহা বৈপ্লবিক ও কৃষি সংস্কারমুখী' পদক্ষেপ। এতো উপকৃত হবেন দেশের শতকরা আশি ভাগের সাধারণ কৃষক। দেশের কৃষকদের আর্থিক উন্নতির ও আনা হয়েছে। বিশেষ করে ছোট কৃষকদের লাভের কথা মাথায় রেখেই এ বিল আনা হয়েছে। আবার অনেকে এই বিলের বিরোধিতা করছেন এবং বলছেন কৃষি ও কৃষকের মেরুদণ্ড ভেঙে পড়বে এবং লাভবান হবে বড় কৃষক,পুঁজিপতি ও ব্যবসায়ীরা। অতিমারির সময়ে অধিকাংশ শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন, সেই ক্ষতি পূরণ করার জন্যই কৃষিকে বাজার অর্থনীতিতে ঠেলে দেওয়া হয়েছে এবং Essential Commodites Act শিথিল করা হয়েছে। অনেকই উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, বাজার থেকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ উঠে গেলে কৃষিতে 'বাজার ব্যবসা' র আস্ফালন বাড়বে। ফলে ব্যবসায়ীরা দাম নির্ধারণ করবে। কৃষকরা চাইলে ও দাম পাবে না বলে আশংকা। এছাড়াও কৃষি পণ্যে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ প্রবেশ করবে বলে অনেকই মনে করেন।



কিন্তু এটা অবশ্যই অনস্বীকার্য যে প্রচলিত আইনে কৃষক দের স্বার্থ সুরক্ষিত ছিল না, লঙ্ঘিত হচ্ছিলো কৃষকের স্বার্থ, ফসলের দাম না পেয়ে কৃষকের আত্মহত্যা করছিল, এবং কৃষির সমস্ত সুবিধা অকৃষক কিছু ব্যক্তি ও সংস্থা গ্রহন করছিল। ‘Farmers were mere price takers instead of price bargainers’, ফলে কৃষি আইনে পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল। যে কয়েকটি উল্লেখ যোগ্য সুবিধা কৃষি বিলের ফলে সৃষ্ট হবে, তার কয়েকটি নিম্নে বর্ণিত হল:

১. কৃষিজাত পণ্যের ন্যুনতম সহায় মূল্য( Minimum support price অথবা MSP) থাকছে। যদিও কেবলমাত্র 22টি কৃষি পণ্যের জন্য বর্তমানে MSP আছে, মাত্র 6 শতাংশ কৃষক ন্যুনতম সহায়ক মূল্যে কৃষিজাত পণ্য বিক্রয় করে। নীতি আয়োগ এর রিপোর্ট অনুযায়ী প্রায় 81 শতাংশ কৃষক MSP সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। সুতরাং যারাই MSP নিয়ে খুব বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করছেন তাদের এই তথ্যগুলিও বলা দরকার। বাস্তবে MSP কিন্তু Maximum Retail Price বা সর্বাধিক পণ্যের মূল্য, যা কৃষক পায়।

২. নতুন নিয়ম অনুযায়ী কৃষক উৎপাদিত পণ্য নিজের পছন্দ মত জায়গায় বা ব্যক্তির কাছে বিক্রি করতে পারবে। কোন ধরনের অন্ত: রাজ্য বা আন্ত:রাজ্য বিধি নিষেধ থাকছে না। ফলে, প্রচলিত APMC( Agricutural Produce Market Committee) নিয়ন্ত্রিত বাজারে বা মান্ডিতে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে কৃষক বাধ্য থাকবে না। ফলে পণ্যের বাজার মূল্য নির্ধারনের জন্য, মধ্যস্থ কারবারির উপর আর চাষিকে নির্ভর করতে হবে না। কমিশন এজেন্টদের দৌরাত্ম কমবে। ফড়িয়া দের মাধ্যমে কৃষি পণ্যের দাম নির্ধারণ ও বিক্রির জন্যই. মূলত ৭ টাকা MSP এর পেঁয়াজ ভোক্তারা ( consumers) 40 থেকে 50 টাকায় খরিদ করে। মান্ডি বা APMC ব্যবস্থায় চাষিরা কখনোই ন্যায্য ও উপযুক্ত দাম পেত না। যেহেতু APMC মার্কেট বা মান্ডি গুলি মধ্যস্থ কারবারি ও রাজনৈতিক নেতা ও দলের অবাধ বিচরণভূমি, তাই যে সমস্ত ব্যক্তি ও দল, এই কৃষি বিলের বিরোধীতা করছেন, তারা মূলত দালাল চক্রের মুখ পাত্র।

৩. Essential Commodities Act এ কৃষি জাত পণ্য মজুতের উপর বিধি নিষেধ শিথিল হচ্ছে, অর্থাৎ খাদ্য সামগ্রী মজুতের উপর বাধা থাকবে না। ফলে বড় বড় সংস্থা চাষির পাশে দাঁড়াবে। গ্রামে গুদাম ও প্রক্রিয়াকরন শিল্প গড়ে উঠবে। অতিরিক্ত গ্রামীণ কর্ম সংস্থান এর সুযোগ বাড়বে।

৪. নতুন কৃষি বিলে চুক্তিবদ্ধ চাষবাস( contract farming) এর কথা বলা হয়েছে। চুক্তিবদ্ধ চাষবাস শুরু হলে কৃষক যে সংস্থার সঙ্গে যে ফসল উৎপাদন নিয়ে চুক্তি বদ্ধ হবে, সেই ফসল উৎপাদন করবে। অর্থাৎ রবি মরশুমে আলু চাষে চুক্তি হলে আলুই উৎপাদন করবে। চুক্তিবদ্ধ চাষের প্রথম সুবিধা হল, কৃষক আগে থেকেই পণ্যের বাজার মূল্য জানবে আর ফসল মার খেলে সেই ক্ষতির সম্পূর্ণ দায় ভার কৃষকের উপর আসবে না, সংস্থার উপর ও বর্তাবে। অন্য দিকে কৃষক উন্নত চাষ পদ্ধতি, স্কিল ও টেকনোলজির সঙ্গে পরিচিত হবে, মূলধনের চাহিদা কমবে, জমির উৎপাদন ও উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধি পাবে।

৫. কৃষকের বিপণন ও পরিবহন খরচ কমবে, কারন উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য কোন বাড়তি অর্থ প্রদান করতে হবে না।

৬. তাছাড়া ইলেকট্রনিক ট্রেডিং এর ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে ইচ্ছুক ক্রেতা ঘরে বসে ও ক্রয় বিক্রয় করতে পারবে।

পরিশেষে, এটা বলা দরকার যে রাজ্য সরকারের APMC Act থাকবে, শুধু মাত্র inter-state ট্রেড এর বাইরে থাকবে। এই বিলের ফলে কৃষি ক্ষেত্রে একটি জাতীয় কাঠামো তৈরি হবে, যার ফলে কৃষকগণ কৃষি ব্যবসায় নিযুক্ত কোম্পানি, রপ্তানি কারী, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন ধরনের শোষণ বা বঞ্চনা থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারবেন। আশা করা যায় যে এই বিলের 50 ভাগ অংশ যদি সুষ্ঠু ভাবে কার্যকরী হয়, ভারতীয় কৃষির খোল নোলসা আগামী 3 থেকে 5 বছরের পরিবর্তিত হবে, এবং কৃষকের আয় বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে।




You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.