৷৷ শঙ্খ লাগা ৷৷
অরিন্দম নাথ
মাস দুয়েক আগের কথা । শ্রাবণের এক দুপুর । মেঘনাদবাবু নিজের অফিসে বসে কাজ করছিলেন । আগরতলার শহরতলিতে তাঁর অফিস । বাধারঘাট এলাকায় । পাশে নিরাপত্তা রক্ষীবাহিনীর কিছু ব্যারাক । সবজি বাগান । তারপর আম জাম কাঁঠালের একটি বাগান । এই বাগানটি রাজ্যের এক প্রাক্তন মন্ত্রীর । তিনি অনেকদিন হয়েছে গত হয়েছেন। তাঁর উত্তরাধিকারীরা কিছু অংশ বিক্রি করে দিয়েছেন । দেখভালের অভাবে জঙ্গলাকীর্ণ । সেদিন হঠাৎ বাইরে একটু হৈ চৈ । চারটে সাপ শঙ্খ লেগেছে । চারটেই দাঁড়াশ সাপ । এই দৃশ্য দেখে মেঘনাদবাবু খুশি হলেন । সাপেরা এখনও বিলুপ্ত হয়নি । হিন্দুরা সাপের শঙ্খ লাগাকে শুভ হিসেবে মানে । একই প্রজাতির দুইটি সাপের মধ্যে যৌন সঙ্গমকে শঙ্খ লাগা বলে । এখানে অবশ্য দুই জোড়া সাপ । বন্য প্রেমে । অনেকে মোবাইলে ধরে রাখলো । এক সময় সাপগুলো বিদায় নিল । একজন আধিকারিক দাঁড়িয়ে ছিলেন । তাই জওয়ানেরা সাপগুলির তৎক্ষণাৎ ক্ষতি করতে পারল না । দুইদিন পর এক ছুটির দিনে একটি সাপ মারা পড়ল । সাপটি তাঁর অফিস লাগোয়া একটি ঘরে বাসা বেঁধেছিল । ত্রিপুরার জনজাতিদের মধ্যে বিশেষত: চাকমা, মগ ও রিয়াং সম্প্রদায়ের লোকেরা সাপের মাংস খায়। ভয় থেকে সাপটিকে মারা হয়নি । খাবার জন্যই খুন ৷ সঙ্গে প্রমাণ লোপাট করা হয়েছিল।
সাপের শঙ্খ লাগা তিনি ছোটবেলা অনেক দেখেছেন । তাঁদের বাড়ি ছিল ধর্মনগরে । চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগের মহকুমা শহর । পরিবেশ ভীষণই গ্রামীণ । তাঁদের বাসার পাশেই একটি বাড়ি ছিল । বিশাল এলাকা নিয়ে । বিরাট বিরাট গাছ । এরমধ্যে দুটো বটগাছ । যারা বাসিন্দা ছিলেন, তারা বাড়িটি বিক্রি করে আরও গ্রামের দিকে চলে গিয়েছিলেন । এরপর বেশ কয়েক বছর পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল । ফলে জঙ্গলে ভরে গিয়েছিল বাড়িটি । বনবিড়াল, সাপ, শেয়াল প্রভৃতি প্রাণী সেখানে বাসা বেধেছিল । প্রায়ই সাপেরা রোদ পোহাত। কখনও শঙ্খ লাগত । একবার সাপের প্রেম নিবেদন দেখতে পেয়ে কুঞ্জদা একটি বিছানার চাদর পেতে দিয়েছিলেন । সাপগুলি চাদরে ওঠার পর তিনি কি খুশি । তিনি তখন সবে বিয়ে করেছিলেন । এই চাদর বিছানায় পাততেন কি না, তাঁর জানা নেই । তবে কুঞ্জদার যমজ ছেলে হয়েছিল । তিনি পিওনের কাজ করতেন । তাঁর ছেলেরা এখন কি করছে তিনি জানেন না । তবে সামাজিক দিক থেকে খুব যে উন্নতি করেছে এমনটা নয় । হলে মেঘনাদবাবু জানতেন । কুঞ্জদা দিলখোলা মানুষ ছিলেন । রেডিওতে ক্রিকেটের কমেন্ট্রি শুনতেন । মেঘনাদবাবুরও সেই নেশা ছিল । তিনি তাঁকে দেখতে পেলেই দূর থেকে নাম ধরে ডেকে জিজ্ঞেস করতেন, "আমার রেডিওতে তিনটে উইকেট পড়েছে । তোমারটায় কয়টা পড়ল ?"
তখন রেডিও ট্রান্সমিশন উত্তর জেলায় ঠিক ঠাক পৌঁছাত না । অনেক সময়েই সাউন্ড ফ্লাকচুয়েট করত । নতুন রেডিওকে, নতুন বৌয়ের সঙ্গে তুলনা করা হত । প্রথম প্রথম সব স্টেশন ধরে । তারপর নাকি বিগড়ে যায় । বিপরীতটিও নিশ্চয় সত্য ।
তাঁদের গ্রামে একজন জমিদার ছিলেন । ভদ্রলোক সম্ভবত ত্রিপুরা টেরিটোলিয়াল কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন । বিশাল বাড়ি । মুখ্য আকর্ষণ ছিল বিশালাকার একটি পুকুর এবং অতীত দিনের একটি পালকি । পুকুরটির প্রশস্থ পার । দুটো ঘাট । একটি জমিদার বাড়ির লোকজনের ব্যাবহারের জন্য । অন্যটি সর্বসাধারণের ব্যাবহারের জন্য । পাড়ার বাচ্চাদের থেকে শুরু করে আবাল বৃদ্ধ-বনিতা সেখানে স্নান করতে যেত । বিশেষ করে, দোলের সময় রং খেলার পর সবাই গণ-স্নান করতে যেত । ছোটদের দলের সঙ্গে মেঘনাদবাবুও যেতেন । লাই খেলতেন । পুকুর পাড়ের বড় বড় গোলাচ ফুল গাছে উঠতেন। অন্য দের সঙ্গে দোল খেতেন । যতক্ষণ না ডাইয়া পিঁপড়ে তাঁদেরকে তাড়াত ।
তাঁর এক পিসির বান্ধবী ছিলেন জমিদারবাবুর মেয়ে । সেই সুবাদে পিসির এসকর্ট হিসেবে তিনি যেতেন । পালকিতে ঢুকে দেখতেন । অনেক সময় ওই পিসিও তাঁদের বাড়িতে আসতেন । সঙ্গে তাঁদের বাড়ির কুকুর টম আসত । কালো রংয়ের অ্যালসেসিয়ান কুকুর । টমের সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল । সন্ধ্যার পর ফেরার পথে তিনি সঙ্গে যেতেন । বড় রাস্তা দিয়ে অনেকটা ঘুরে যাতায়ত করতেন ।
তাঁদের বাড়ি এবং জমিদার বাড়ির মধ্যে শর্টকাট একটি রাস্তা ছিল । কিন্তু বর্ষাকালে চলাচলের অনুপযোগী । ধানের জমি । পরিত্যক্ত জলাভূমি এবং দল-ঘাসের একটি পতিত জমি । জমিদারেরাই ওই জমির মালিক । দিনের বেলা জমির আল ধরে সাবধানে যাওয়া যেত । ঘাসের জমিতে প্রচুর সাপ থাকত । আর রাত্রিতে অনেক সময় আলেয়ার বাতি জ্বলত । ঘাস পচে মিথেন গ্যাসের সৃষ্টি হত । মোদ্দা-কথা জরুরি দরকার ছাড়া বর্ষায় শর্টকাট রাস্তা বাচ্চারা নিত না । যেতে হলে, আবার পরিত্যক্ত বাড়িটির উপর দিয়ে যেতে হত ।
তবু তিনি এবং পাড়ার বাচ্চারা ওই বাড়িতেই পড়ে থাকতেন । ওইপাশ দিয়ে গিয়ে জলায় ছিপ পাতলে প্রচুর মাছ ধরা পড়ত । প্রতিদিনই অবধারিত সাপের সঙ্গে চোখাচোখি হত । ঢিল মারতেন । কখনও সখনও পরিষ্কার জলের উপর দিয়ে সাপ সাতার কেটে যাওয়ার সময় বড় মুলি বাঁশ দিয়ে আঘাত করতেন । জল তরল হলেও, জলের তলের এগেইনস্টে বাড়ি পড়লে সাপ জখম পায় । মারাও যায় । মারা না পড়লে ভয় পেতেন । সাপ যদি রাত্রিতে এসে প্রতিশোধ নেয় । ঠাকুরমা সাপকে আটকে রাখার মন্ত্র জানতেন । ধুলাপড়া মন্ত্র । সাপের চোখে ধুলো দিয়ে, নাতিকে বাঁচিয়ে রাখা । একটি রুমাল কিংবা পরিষ্কার গামছায়, মন্ত্র পড়ে একটি গিঁট্টো দিয়ে দিতেন । সেটা বালিশের নিচে রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমাতেন । পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে, সূর্যের দিকে চেয়ে গিঁট্টো খুলে সাপকে মুক্তি দিতে হত । অন্তত ছোটবেলায় মেঘনাদবাবুর এই বিশ্বাস ছিল ।
জমিদার বাড়ির পুকুরে মাঝে মাঝেই জেলেরা বেড়াজাল ফেলত । চাপিলা মাছের ফলনের জন্য পুকুরটি উৎকৃষ্ট ছিল । পাশাপাশি বিশাল বিশাল কাতল, মৃগেল, রুই এবং পরে সিলভার কার্ফ ধরা পড়ত । অনেকগুলি কাতল এবং মৃগেল দশ বারো কেজির ওপর ওজন ছিল । তুলনায় রুইগুলো ছ'সাত কেজি ওজনের । সার্পিনাস কারফিউ ক্বচিৎ মিলত । ছোট আকারের । এই মাছের পোনা পুকুরে নতুন ফেলতেন না । এইগুলো নাকি পুকুর পারে গর্ত করে ফেলে । একবার একটি বিশাল বোয়াল ধরা পড়েছিল । প্রায় দশ কেজি । এই মাছ ধরা দেখার মজাই আলাদা । সেদিন দুপুরের পর এমনি জাল পড়েছে । জমিদার বাবুর পুকুরে । তিনি দৌড়লেন পড়ো-বাড়ির উপর দিয়ে । উদ্দেশ্য জলা জমির আল ধরে পুকুর পারে পৌঁছে যাবেন । একটি জায়গায় দু'টো টিলার মধ্যে নিচু রাস্তা । টিলা থেকে নেমে পায়ে চলা রাস্তা ধরে যেতে হয় পুকুরের দিকে । এত তাড়াহুড়োর মধ্যে লক্ষ্য পড়ার কথা ছিল না । তবু নজর গেল । অন্য পাশের টিলা এবং রাস্তা জুড়ে শুয়ে আছে একটি বিশাল পাইথন । সম্ভবত: রোদ পোহাচ্ছে । তারা তখন অজগর নামেই জানতেন । কত রাজপুত্র, মন্ত্রী-পুত্র, কৌটালপুত্রকে গিলে খেয়েছে এই সাপ । অন্তত রূপকথা তাই বলতো । তারপর কোনও বীর রাজকুমার তরোয়াল দিয়ে সাপের পেট চিরে বেড়িয়ে আসতেন । সঙ্গে আগের গিলে খাওয়া লোক-লস্কর ।
সেইদিন থেকে তাঁর শর্টকাট যাত্রা স্থগিত হল । যদিও সাপটিকে আর পরে দেখেননি। তবে সাপের উপর তিনি আরও খাপ্পা হয়ে উঠলেন । সুযোগ পেলেই মারতেন । শুধু একটি বাস্তুসাপ ছাড়া । বিশাল আকারের দুধরাজ । চাদের আলোতে, তাদের নিজেদের পুকুর পার ধরে যেত । কোনও অনিষ্ট করত না । তাদের বাড়ির সঙ্গেই একটি মাঠ ছিল । খানিকটা কচ্ছপের পিঠের মত । অনেক সময়েই সাপ মাঠটি অতিক্রম করত । তিনি দৌড়ে গিয়ে লেজে ধরে হ্যাচকা টান মারতেন । তারপর মাথার উপর ঘোরাতেন । এইভাবে সাপ ধরাতে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন । অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থাকতো দাঁড়াশ সাপ । শেষে তার মধ্যে একটি পরিবর্তন আসে । অকারণে সাপ মারেন না । দুই তিনটি আহত দাঁড়াশ সাপকে আর্নিকা খাইয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করেন । একটি ছাড়া সবগুলোই মারা যায় । একটি সুস্থ হয়ে পালিয়ে যায় । কিংবা অন্য কোনও প্রাণীর শিকার হয়ে যায় ।
সাপের সঙ্গে বৈরিতা বিরোধী চুক্তির পেছনে আরেকটি ঘটনা পরোক্ষভাবে দায়ী । তাঁর দাদু যখন মারা যান তিনি ক্লাস টুতে পড়েন । দাদা বছর তিনেকের বড় । বোন বছর পাঁচেকের ছোট । সেরিব্রাল স্ট্রোক হয়ে দাদু হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন । এর আগে শরীরের একটি দিক অবশ হয়ে গিয়েছিল । অগ্রহায়ণের রাত্রি । বাড়িতে তাঁরা তিন ভাইবোন, মা এবং একজন দূর-সম্পর্কের মাসি । অন্যরা হাসপাতালে । রোগীর সেবায় । মা গিয়েছেন পুকুরে । ঘরের লাগোয়া পুকুর । মধ্যে উঠোন । একটি শঙ্খুনি সাপ পুকুর থেকে উঠে ঘরের দিকে যাচ্ছিল । প্রতিবেশী পুরুষদের ডাকা হল । সবাই সাপটি না মারার পক্ষে । কার্বলিক এসিড ছিটানো হল । কিন্তু সাপ নাছোড়বান্দা । ঘরের দিকে যাবেই । শ্লথ গতিতে । অগত্যা উপস্থিত সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল, সাপটিকে মেরে ফেলবে । সেই অনুযায়ী সাপটিকে মারা হল । তারপর পুড়িয়ে, ছাই একটি নারকেল গাছের তলায় পুতে দেওয়া হল । তখন ফোনের এত প্রচলন ছিল না । পরদিন সকালে তাঁর পিসি এলেন মন কালো করে । রাত্রিতে আনুমানিক ওই সময়টাতেই তাঁর দাদু প্রচণ্ড ছটফট করেন । নার্স একটি ইনজেকশন দিতে গিয়েছিল । সূচটি ভেঙ্গে কোমরের মাংসের মধ্যে আটকে যায় । এরপর তাঁর দাদু এক সপ্তাহ বেচেছিলেন । রাস পূর্ণিমার দিন মারা যান । বয়স হয়েছিল আশি বছর ।
এমন না যে সেদিন সাপটিকে না মারলে দাদু অমর হয়ে যেতেন ৷ মেঘনাদবাবু বিষয়টি নিয়ে বড় হয়ে চিন্তা করেছেন ৷ তাঁর মনে হয়েছে এরমধ্যে একটি মিথ জড়িয়ে আছে ৷ মহাভারতের সর্প নিধন যজ্ঞের ৷ অভিমন্যুর ছেলে ছিলেন পরীক্ষিত ৷ হস্তিনাপুরের রাজা হন ৷ একদিন শিকার করতে গিয়ে হরিণের পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেন ৷ ক্ষুধা আর তৃষ্ণায় কাতর হয়ে এক মুনির আশ্রমে ঢুকেন ৷ মুনি তখন দুধ পান খাচ্ছিলেন ৷ রাজা কিছু খেতে চান ৷ মুনি মৌন থাকেন ৷ সেখানে একটি মরা সাপ পড়েছিল ৷ সেটি মুনির গলায় ঝুলিয়ে দেন ৷ মুনির ছেলে শৃঙ্গী বাড়িতে ছিলেন না ৷ তাঁর এক বন্ধু কৃশের কাছ থেকে এই ঘটনা জানতে পারেন ৷ তিনি বাবার গলাতে মরা সাপ দেখে অভিশাপ দেন সাত দিনের মধ্যে রাজা পরীক্ষিত তক্ষক নামক সাপের কামড়ে মারা যাবেন । এই অভিশাপ শুনে মুনি তাঁর মৌনতা ভঙ্গ করেন ৷ রাজা পরীক্ষিতকে জানান ৷ পরীক্ষিত সব প্রটেকশন নিয়েও বাঁচতে পারেন না ৷ একটি ফলের মধ্যে ছোট পোকার আকারে তক্ষক রাজা অবধি পৌঁছে যান ৷ তক্ষকের বিষে রাজা মারা যান ৷ পরীক্ষিতের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে জন্মেজয় হস্তিনাপুরের রাজা হন ৷ তিনি তাঁর বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে সর্প নিধন যজ্ঞ করেন ৷ সব সাপকে পুড়িয়ে মারতে শুরু করেন ৷ কিন্তু তক্ষক বেঁচে যায় ৷ ইন্দ্র ছিলেন তাঁর বন্ধু ৷ তাঁর মধ্যে মানুষ এবং সাপের রক্ত বইত ৷ তিনি যখন তখন ব্রাহ্মণের বেশ নিতে পারতেন ৷ পুরাণ অনুযায়ী দেবী মনসার বিয়ে হয়েছিল জরৎকারু মুনির সঙ্গে ৷ মনসা বাসুকি নাগের বোন । এই দম্পতির ছেলে আস্তিক মুনি । তিনি সর্প নিধন যজ্ঞ বন্ধ করতে মুখ্য ভূমিকা নেন ৷ তাই সাপেরা বেঁচে যায় ৷ তাঁর ধারনা এই মিথ থেকেই মানুষ বিশ্বাস করে কিছু কিছু সাপ মানুষের রূপ নিতে পারে ৷ তাই হয়তো শঙ্খ লাগার প্রতি মানুষের এই বিমুগ্ধতা ৷