পূর্বোত্তরে চা শিল্প,সমস্যা ও সম্ভাবনা
পান্নালাল রায়
February 24, 2025
উত্তর পূর্বাঞ্চলের ঐতিহ্যের চা শিল্প আজ এক সমস্যার মুখে পড়েছে।উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি এবং সেই তুলনায় উৎপাদিত চায়ের মূল্য না মেলায় এই অঞ্চলের চা শিল্প সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।অথচ এই অঞ্চলের চা শিল্পের ক্ষেত্রে রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। যদি চা শিল্পের বর্তমান সমস্যা কাটিয়ে না উঠা যায় তবে অদূর ভবিষ্যতে তার উপর নির্ভরশীল এই অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক মানুষ সমস্যায় পড়তে পারেন। চা শিল্পের ক্ষেত্রে সরকারি সহায়তারও দাবি উঠছে।এদিকে চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরী বৃদ্ধি কার্যকরের দাবিও উঠছে।
উত্তর পূর্বাঞ্চল হচ্ছে দেশের মধ্যে শিল্পে অনগ্রসর একটি অঞ্চল। বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পে এই অঞ্চলের অবস্থান উল্লেখ করার মতো নয়।অসম বাদে অন্যত্র তা নেই বললেই চলে।এমন কি অসমেও এর অবস্থান তেমন সন্তোষজনক নয়।উত্তর পূর্বাঞ্চলে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের ক্ষেত্রে যে বিপুল সম্ভাবনা ছিল তারও পূর্ণ সদ্ব্যবহার হয়েছে এমনটা বলা যাবে না।উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্যে হস্ত তাঁত ও হস্তজাত শিল্পের বিপুল সম্ভাবনা ছিল।অন্তর্দেশীয় বাজার বাদ দিলেও বিদেশের বাজারেও এই অঞ্চলের হস্ততাঁত ও হস্তজাত শিল্পের বিরাট বিপনন সম্ভাবনা ছিল।বিক্ষিপ্ত ভাবে কোনও কোনও রাজ্যে মাঝে মাঝে এ রকম উদ্যোগ পরিলক্ষিত হলেও এর সুসংহত রূপের প্রকাশ ঘটেনি।ত্রিপুরার বাঁশবেতের কাজ,নাগাল্যান্ড ও মণিপুরের হস্ততাঁত উৎপাদিত সামগ্রী ইত্যাদির সর্ব ভারতীয় স্তরে ভালো বাজারের পাশাপাশি বিদেশের বাজারেও এ সবের বিপনন সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু এই সম্ভাবনার যথাযথ সদ্ব্যবহার হয়নি।যাইহোক, এ রকম প্রেক্ষাপটে অসম ও ত্রিপুরার চা শিল্প উত্তর পূর্বাঞ্চলের শিল্প ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।তাই এই শিল্পের সমস্যা এই অঞ্চলের জন্য নানা ভাবে উদ্বেগ বয়ে আনবে।অথচ উত্তর পূর্বাঞ্চলে এই শিল্প খুবই সম্ভাবনাপূর্ণ। এই অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক মানুষ চা শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানও হচ্ছে এই শিল্পের মাধ্যমে।উন্নত মানের চা উৎপাদন করে দেশ-বিদেশে আরও বাজার সৃষ্টি সহ শিল্পটির আরও সম্প্রসারণ এবং তাতে আরও কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে।
অসমের চা শিল্পের এক সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।প্রায় দু'শো বছর আগে অসমে চা শিল্পের পত্তন হয়েছিল। বৃটিশদের হাত ধরে ঊনবিংশ শতাব্দীতে আসামে এই শিল্পের সূচনা ঘটে।ত্রিপুরায় অবশ্য তুলনায় এই শিল্পের বয়স কম।প্রায় একশো দশ বছর আগে ত্রিপুরায় চা শিল্পের সূত্রপাত হয়েছিল।কথিত আছে ,স্কটিশ অস্ত্র ব্যবসায়ী রবার্ট ব্রুস ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে আসামে বুনো চা চারা আবিষ্কার করেছিলেন।আরও জানা যায় যে,আসামের মণিরাম দেওয়ানের কাছ থেকেই ব্রুস সিংফো জনজাতিদের চা উৎপাদনের কথা প্রথম জানতে পেরেছিলেন,তখন সাধারণ ভাবে তা জ্ঞাত ছিল না।ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে বাণিজ্যিক ভাবে আসামে চা চাষ শুরু করে।ত্রিপুরায় মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোর মাণিক্যের রাজত্বকালে(১৯০৯-২৩ খ্রিঃ) চা শিল্পের সূচনা ঘটে।তাঁর আমলে রাজ্যে ৪০টি চা বাগান গড়ে উঠেছিল। উল্লেখ করা যায় যে,এই রাজার উদ্যোগেই ত্রিপুরায় খনিজ সম্পদের অনুসন্ধানের কাজ শুরু হয়েছিল। ত্রিপুরায় ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম কৈলাসহরের হীরাছড়াতে গড়ে উঠেছিল চা বাগান। নানা ভাবেই এই অঞ্চলের চা শিল্প ইতিহাস আর ঐতিহ্যের আলোয় উদ্ভাসিত।১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ এবং পরবর্তীকালের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গেও এই অঞ্চলের চা শিল্পের এক ক্ষীণ যোগসূত্র রয়েছে।
সারা দেশের মধ্যে চা উৎপাদনের শীর্ষে রয়েছে অসম। সারা দেশে যতটা চা উৎপাদিত হয় তার অর্ধেকের বেশি উৎপাদিত হয়ে থাকে অসমেই।সারা দেশে চায়ের উৎপাদনের পরিমাণ যেখানে ১৩৪৪ মিলিয়ন কেজি সেখানে অসমেই এই পরিমাণ ৬৮০.৫ মিলিয়ন কে.জি।অসমে প্রায় ৮০০টি টি এস্টেট রয়েছে।এ ছাড়া রাজ্যটিতে রয়েছেন প্রায় দেড় লক্ষ ক্ষুদ্র চা উৎপাদক।প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে অসমের বিপুল সংখ্যক লোক এই চা শিল্পের সঙ্গে জড়িত। অসম সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য রাজ্যেও চা উৎপাদিত হয়ে থাকে।উত্তর পূর্বাঞ্চলে চা উৎপাদনের ক্ষেত্রে অসমের পর দ্বিতীয় স্হানে রয়েছে ত্রিপুরা।ত্রিপুরায় বছরে ৯ মিলিয়ন কে.জি চা উৎপাদিত হয়ে থাকে।রাজ্যে ৫৪টি টি এস্টেট রয়েছে।এ ছাড়াও রাজ্যে প্রায় আড়াই হাজার ক্ষুদ্র চা উৎপাদক রয়েছেন। রাজ্যে চা প্রক্রিয়াকরণে ২৩টি কারখানা রয়েছে।গোটা দেশের মধ্যে যে ১৬টি রাজ্যে চা উৎপাদিত হয় তার ষষ্ঠ স্হানে রয়েছে ত্রিপুরা।অসম,ত্রিপুরা ছাড়াও উত্তর পূর্বাঞ্চলের অরুণাচল প্রদেশ,নাগাল্যান্ড, মেঘালয়,মিজোরাম,মণিপুর ও সিকিমেও কম বেশি চা উৎপাদিত হয়ে থাকে।
অসম তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের চা শিল্প নানা ভাবেই সংকটের মুখে পড়েছে।অসমের চা বিদেশের বাজার হারাচ্ছে। সাম্প্রতিক কালে চায়ের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বাগান কর্তৃপক্ষ সংকটের সম্মুখীন হচ্ছেন। গত ২০২৪ সালে অসম সহ গোটা দেশে চায়ের উৎপাদন ৭.৮% শতাংশ আগের বছরের তুলনায় হ্রাস পেয়েছিল।প্রবল তাপ প্রবাহ ও বন্যাকে এ জন্য দায়ী করা হয়েছে। কিছুদিন আগে যোরহাটে আসাম টি প্ল্যান্টার্স এসোসিয়েশনের(এটিপিএ) বার্ষিক সভায় চা শিল্প নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে যে,অসমের চা শিল্প সংকটের মধ্য দিয়ে চলেছে।চায়ের মূল্য হ্রাস এর অন্যতম কারণ।পাশাপাশি চায়ের উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে চলেছে।এটিপিএ'র অধ্যক্ষ জানিয়েছেন,অসম থেকে বিদেশে রপ্তানী করা চায়ের পরিমাণ ক্রমেই কমছে।বিদেশের বাজার কমে যাওয়ায় রাজ্যে উৎপাদিত অতিরিক্ত চা থেকে যাচ্ছে দেশের বাজারে।এতে চাহিদার তুলনায় যোগান বেশি হচ্ছে।পরিণতিতে মূল্য হ্রাস পাচ্ছে চায়ের। ত্রিপুরার চা শিল্পের সাম্প্রতিক চিত্রও ভিন্ন কিছু নয়।ত্রিপুরার বিশিষ্ট চা শিল্পপতি অঞ্জন দাস বললেন, রাজ্যের ছোট ও মাঝারি চা বাগান গুলো আজ অস্তিত্বের লড়াই করছে।তিনি বললেন, চায়ের উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে,কিন্তু উপযুক্ত মূল্য উঠছে না।এদিকে অসমের চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি কার্যকর সহ চা শ্রমিকদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের দাবিতে আগামী ৩রা মার্চ দিশপুর চলো অভিযানের ডাক দিয়েছে অখিল ভারতীয় চা মজদুর সংঘ।
এই অঞ্চলের চা শিল্পের ইতিহাস ঐতিহ্য প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে,১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহের সময় আসামে মণিরাম দেওয়ানের হাত ধরে যে সলতে পাকানোর কাজটি হয়েছিল তার পেছনেও রয়েছে চা শিল্প!এক সময় ইংরেজদের বিশ্বস্ত কর্মচারী ছিলেন তিনি।পরবর্তী সময়ে তিনি আসাম টি কোম্পানির দেওয়ান পদে যোগ দিয়ে কৃতিত্বের পরিচয় দেন।চালু করেন নতুন নতুন বাগান।চা শিল্পে অভিজ্ঞতার পর মণিরাম চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজেই যোরহাটে দুটি নতুন বাগান করেন।কিন্তু তারপর তিনি তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। মণিরাম লক্ষ্য করেন যে,ইউরোপিয়ানরা বাগান করার জন্য কম মূল্যে যে ভাবে পতিত জমি পান সেই সুযোগ থেকে ভারতীয় বলে তাকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এ ছাড়াও নানা ভাবে বাধার সৃষ্টি করে তাকে পথে বসিয়ে দেয়া হয়।তিনি এটা উপলব্ধি করেন যে,ভারতীয়দের কোনও স্বাধীন উদ্যোগ তারা বরদাস্ত করবে না।এরপরই মণিরাম বিক্ষুব্ধ হয়ে ক্ষমতাচ্যুত রাজাকে সামনে রেখে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সলতে পাকাতে থাকেন। অবশ্য শেষপর্যন্ত নানা কারণে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। সেদিন লুসাই পাহাড় সন্নিহিত বরাক উপত্যকায় চা বাগান গড়ে তুলতে গিয়েও শিকার প্রিয় লুসাইদের প্রতিরোধের মুখে পড়েছিল ইংরেজরা।চা বাগান গড়ে তোলায় লুসাইদের শিকারের ভূমিতে টান পড়েছিল।বারবার আক্রান্ত হয়েছিল চা বাগান।হতাহত হয়েছিল অনেক মানুষ। এই ভাবেই শেষপর্যন্ত ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে লুসাইদের সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠে। পরিণতিতে ইংরেজ আধিপত্য কায়েম হয় সেদিনের লুসাই পাহাড় অর্থাৎ আজকের মিজোরামে।পরবর্তীকালে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গেও চা বাগানের এক যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়।শতাধিক বছর আগে করিমগঞ্জের চরগোলায় চা শ্রমিকদের আন্দোলন ও দলে দলে বাগান ছেড়ে চলে যাওয়া এবং পরবর্তী শ্রমিক ধর্মঘটের ঘটনা সমূহ নিঃসন্দেহে এই অঞ্চলের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।ইউরোপিয়ান বাগান মালিকদের অকথ্য নির্যাতন আর নিষ্পেশনে সেদিন চা শ্রমিকদের ব্যাপক হারে অভিনিষ্ক্রমণ ঘটেছিল বাগান ছেড়ে।এদিকে ত্রিপুরার ক'টি চা বাগানেও অগ্নিযুগে বিপ্লবী তৎপরতার কথা জানা যায়।১৯২৭/২৮ সালের কোনো এক সময় কৈলাসহরের মনুভ্যালি চা বাগানে আত্মগোপন করেছিলেন বিখ্যাত বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত। কৈলাসহরের অপর একটি চা বাগান কালীশাসনও বিপ্লবী তৎপরতার সাক্ষী হয়ে আছে।একদা কৈলাসহরে অনুশীলন সমিতির তৎপরতা ছিল এবং এর কেন্দ্র ছিল কালীশাসন চা বাগান। এই ভাবে ত্রিপুরা সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের চা শিল্পের সঙ্গে স্বাধীনতা আন্দোলনের যোগসূত্র নিয়ে আরও চর্চার অবকাশ রয়েছে।
যাইহোক, উত্তর পূর্বাঞ্চলের ঐতিহ্যের এই চা শিল্প আজ নানা ভাবেই সংকটের মুখে পড়েছে।বিদেশে এই অঞ্চলের চায়ের বাজার কমছে।কখনও জলবায়ুর প্রভাবে উৎপাদন কমছে।সর্বোপরি উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে উৎপাদিত চায়ের মূল্যের সামঞ্জস্য হচ্ছে না।ব্যয় বাড়ছে,দাম মিলছে না।এই সংকট থেকে অসমের চা শিল্পকে রক্ষার জন্য এটিপিএ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।গ্যাসের মূল্য হ্রাস সহ বাগান গুলোতে শ্রমিকদের রেশনের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেয়ার জন্যও সরকারের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে।এ ছাড়াও বিদেশে চায়ের বাজার বাড়াতে সরকার যাতে এগিয়ে আসে সেই অনুরোধও রেখেছে তারা।ত্রিপুরার ক্ষেত্রেও পরিকাঠামোগত সরকারি সহায়তার দাবি উঠছে।চা শিল্পপতি অঞ্জন দাস বললেন, রাজ্যের চা শিল্পের সংকট ত্রাণে বিদ্যুৎ,পরিবহন,কয়লা সহ বিভিন্ন ম্যাশিনারী ক্রয়ের ক্ষেত্রে সরকারি ভর্তুকি প্রয়োজন।সেই সঙ্গে রেশনে ভর্তুকির পরিমাণ বৃদ্ধির কথাও বলেন তিনি।আগেই বলা হয়েছে যে, উত্তর পূর্বাঞ্চল শিল্পে পশ্চাদপদ অঞ্চল। এই অঞ্চলে কর্ম সংস্থান সহ আর্থিক বিকাশে চা শিল্পের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।তাই এই শিল্পের সংকট ত্রাণে সরকারি স্তরে অচিরেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গৃহীত হবে এমনটা আশা করা যায়।
আরও পড়ুন...