করোনা আবহে দুই পাহাড়ের ভিন্নমুখী জীবন চিত্র,জুমিয়াদের অর্থ হাঙ্গরের পেটে
প্রদীপ চক্রবর্তী
ত্রিপুরা উপজাতি এলাকা স্বশাসিত জেলা পরিষদের ভোটের আগে পাহাড় জুড়ে ক্ষুধার কান্নার কলরোল। এই কান্না খাওয়ার জন্য, কাজের জন্য, পানীয় জলের জন্য।কান্নার কলরোলের তীব্রতা ক্রমশ: বেড়েই চলেছে। যে বয়সে ছেলেমেয়েদের অ-আ পাঠ করার কথা সে বয়সে এরা জাতীয় সড়কের পাশে বসে শাক বনের আলু বিক্রি করছে। দিনভর এরা উদোম গায়ে বসে থাকে,গাড়ী এলে ছুটে যায় সবজী নিয়ে, কেনার জন্যে এরা কাকুতি মিনতি করে,বেলা গড়িয়ে সময় জলের দরে বিক্রি করে দিয়ে থাকে। এখন তো শাকসবজি,তরিতড়কারীর সময়। জুমের ফসল অল্পবিস্তর উঠছে। কিন্তু সব কিছু কেমন জানি ওলটপালট হয়ে গেছে। অথচ এমন হওয়ার কথা নয়।
লংতড়াই উপত্যকা-র বিভিন্ন এলাকায় কোভিড জাঁকিয়ে বসেছে। কোভিডের দাপটে নাভিশ্বাস উঠার উপক্রম। মূলতঃ ছামনু ও তার আশপাশের এলাকায় এই কোভিড দাপট। কিন্তু প্রত্যন্তে এই দাপট নেই বলা চলে। স্হানীয় লোকজন অন্তত তাই বলছে। ছামনু সদরে বিশাল বাজার বসে। সপ্তাহে দুদিন হাট বসে। হাটে লোকজনের ঢল নামে। সামাজিক দূরত্বের কোন বালাই নেই। যে যার ভাবে চলে, বাজার করে, মিষ্টির দোকানে আড্ডা মারে। প্রশাসন দেখেও না দেখার মত থাকে। লংতড়াই উপত্যকা এক বিশাল এলাকা। পার্বত্য অঞ্চলে জনজাতিয়দের বসবাস। জীবনের সাথে লড়াই করে জনজাতিয়রা টিকে আছে। বেঁচে থাকাটাই এক আশ্চর্য।পরিশ্রুত পানীয় জলের নামগন্ধ নেই, নেই যাতাকল। পানীয় জল বলতে ছড়া, নালা- ঝর্নার জলে ভরসা। ভোর থেকে রাত জলের জন্য লড়াই চলে। এক কলসী জল ভরতে ৪/৫ ঘন্টা সময় লাগে। প্রাকৃতিক যে সব উৎস সেগুলিকে ঘিরে চলে অনেক সময় জনতার মিনি খন্ডযুদ্ধ। এটা চলে সারা বছর। পোড়া কপাল এদের। স্বাধীনতার এতগুলি বছর পেরিয়ে গেলেও এরা পানীয় জলের জন্য লড়াই করে। কোন একসময় লংতড়াই উপত্যকা জুড়ে কলেরা মহামারী দেখা দিয়েছিল। প্রচুর প্রানহানি হয়েছে। উপত্যকা জুড়ে নেমে এসেছিল দূর্ভিক্ষ। আশীর দশকে লংতড়াই উপত্যকা জুড়ে ছিল ভয়াবহ মৃত্যুমিছিল। ৮০/৯০ র দশকের এই ভয়াবহ উদ্বেগজনক চিত্র আমি প্রত্যক্ষ করেছি। ছামনুর জল বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল। ৯০/৯১ র পরিস্থিতি এমন আকার ধারণ করেছিল সরকারকে নোঙর খানা করতে হয়।ছামনু গোবিন্দ বাড়ী সড়কের ১৮/২৩ মাইলে এইসব নোঙরখানা করা হয়। তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী নগেন্দ্র জমাতিয়া সেখানে পড়েছিলেন। তাঁর সেই অবদানের কথা এখনো ছামনুবাসী কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরন করেন। এডিসির নির্বাহী সদস্য শ্রীদাম দেববর্মাও দূভিক্ষ পীড়িত অঞ্চলে ত্রানকাজ করেন।
তৎকালীন ব্লক কংগ্রেস সভাপতি ঝুলন বিকাশ বরুয়া, যিনি এখন সাংবাদিকতা করেন তাঁর মতে লংতড়াই উপত্যকায় খাদ্যের সংকট নেই। কেননা জুমিয়ারা বিনে পয়সায় চাল পেয়েছেন, তদোপরি দুই টাকা কেজি দরে চাল পাচ্ছেন। তবে কাজ নেই। রেগার কাজ সেখানে অমাবস্যার চাঁদ। বনের লতাপাতা দিয়ে সবজী করে এরা ক্ষুন্নিবৃত্তি করছেন।
কিন্তু আঠারমুড়ার চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। বিপরীত মানে লংতড়াই উপত্যকা থেকে। আঠারমুড়ায় প্রচন্ড খাদ্য সংকট,পানীয় জলের সংকট,কাজের সংকট। রেগার কাজের নামগন্ধ নেই। মাঝেমধ্যে যাও বরাদ্দ হয়ে থাকে তা রাঘববোয়ালের পেটে যায়। ব্লকে গেরুয়া নেতা, গ্রামে আইপিএফটি নেতারা সব টাকা হাঙ্গরের মত খেয়ে নেয়। রেশনের চাল,করোনার চাল গরীব নাঙা জুমিয়াদের কাছে পৌঁছে নি। রাঘববোয়ালের দল সব খেয়ে নিচ্ছে। রেশন তো দূর অস্ত। রাস্তা নেই,রেশন পন্য যাবে কি করে? ডিলাররা সব নেতাদের সাথে মিতালী করে ভাগ বাটোয়ারা করে নিচ্ছে। এটা সারাবছরই চলে। লিঙ্ক রোড যা আগে হয়েছিল সেগুলির এখন অস্তিত্ব নেই।অথচ অর্থ যথারীতি বরাদ্দ হচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় রেশন সামগ্রীবাহী গাড়ী চলতে পারেনা। সঙ্গতকারনেই পন্য সামগ্রী যায় না।জুমিয়াদের বরাদ্দ পন্য খোলাবাজারে আসছে। স্বাস্হ্য কর্মী মেতে পারেনা।যেতে পারেনা ডিব্লিউএসের গাড়ী। রাস্তা থাকলে জুমিয়ারা অন্তত জল পেত। কিন্তু রাস্তা নেই,জল ও যায়না। অথচ কাগজে কলমে নিত্যদিন জল সরবরাহ করা হচ্ছে।
জুমিয়াদের বারমাসের খবরাখবর রাখেন শব্দকুমার জমাতিয়া। গত ৩০ বছর ধরে তিনি আঠারমুড়ার সুখদুঃখের সাথে যুক্ত। অর্থাৎ সমস্যা কর্তৃপক্ষের নজরে নিয়ে যান। তিনি জানিয়েছেন আসাম আগরতলা জাতীয় সড়কের দু'পাশে যেসব জুমিয়া বসতি রয়েছে তারা পানীয় জল পাচ্ছেন। নির্দিষ্ট পয়েন্টে ট্যাঙ্কারে জল পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। এরা জল পাচ্ছেন। কিন্তু আঠারমুড়ার বাসিন্দারা রেশন পাচ্ছেন না,পাচ্ছেন না অন্যান্য পরিষেবা। গিরিবাসীরা জাতীয় সড়কের পাশে জুমের ফসল নিয়ে বসে থাকে। বিক্রি হলে ভাত জুটে।
এই বয়সে যাদের স্কুলে যাবার কথা তাঁরা বসে থাকে জাতীয় সড়কের পাশে।এতো দূ্র্ভাগ্য এদের। এদের দিন কবে ঘুরবে আজ সেটাই লাখ টাকার প্রশ্ন।