৷৷ সহস্রাব্দের ফুল ৷৷

অরিন্দম নাথ

অহন শব্দের অর্থ ভোর ৷ অহনবাবু মেঘনাদবাবুর প্রাতঃভ্রমণের পার্টনার ৷ দুজনের বাড়ি একই মহল্লায় ৷ আগরতলার নন্দননগরে ৷ তাঁদেরকে সঙ্গ দেয় মেঘনাদবাবুর কুকুর ৷ জলি ৷ তিনি ডাকেন, জলি এল এল বি ৷ আরশাদ ওয়ারশির 'জলি এল এল বি' মেঘনাদবাবুর ভালো লাগে ৷ ছবিটি সেরা হিন্দি ফিচার ফিল্ম হিসেবে ২০১৩ সালে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল ৷ জলির গায়ের রং কালো ৷ মুখের কাছে হালকা সাদার ছোপ ৷ বয়স দুই পেরিয়েছে ৷ মানুষের হিসেবে, সাত দুগুণে চৌদ্দ অতিক্রম করেছে ৷ জলির উৎসাহেই তাঁরা রোজ হাঁটেন ৷ সঙ্গে প্রায়ই আরেকজন সঙ্গী থাকে ৷ তাঁরা গড়ে সাত কিলোমিটার পথ পাড়ি দেন ৷ ছোট্ট ছোট্ট পায়ে জলি এপথ অতিক্রম করে ৷ তাঁদের কাছে বিষয়টি বিষ্ময়ের ৷ দুইজনেরই বিশ্বাস জলি তাঁদের কথা বুঝতে পারে ৷ কিছুদিন আগে পর্যন্ত তাঁরা দিল্লী পাবলিক স্কুল, চাঁদমারি, ভালুকিয়া লুঙ্গা, সেভেণ্টিনাইন টিলা, জিবি, ইন্দ্রনগর ইত্যাদি এলাকা ঘুরে আসতেন ৷ জিবি হাসপাতালে যখন তখন কোভিড রোগীর আনাগোনা ৷ এই নিয়ে মেঘনাদবাবুর ঘরে কিছুটা অসন্তোষ বিরাজ করত ৷ কয়েকদিন পর লক্ষ্য করলেন, জলি ওপাশটায় যেতে চায় না ৷ যাবে, তবে কোলে করে যাবে ৷ তখন ভাদ্রমাস ৷ এমন নয় যে ওইপাশে জলির চাহনে ওয়ালা নেই ৷ জলি যেহেতু পথপদর্শক, তাঁরা মেনে নিলেন ৷ কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম ৷ আজকের ঘটনা ৷ একটি গ্রামীণ রাস্তায় তাঁরা প্রায়ই চলাচল করেন ৷ দিন দশেক ওই পথে ওনারা যাননি ৷ কিছু জায়গায় কাঁদা থাকে ৷ সেই রাস্তাটি আসার আগে তাঁরা দুইজন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলেন ৷ কাঁদা শুকালো কি না ৷ রাস্তাটি আসামাত্র, জলি তাঁদের টেনে নিয়ে চললো ওই পথে ৷ কাঁদা শুকিয়ে গেছে ৷ আজ জলিরও মুড ভালো ছিল ৷ গতকাল সে মেঘনাদবাবুর ঘরে ঘুমিয়েছে ৷ অন্যদিন একাকী বারান্দায় ঘুমায় ৷ একাকী ঘুমালে কুকুররা ভূতের স্বপ্ন দেখে ৷ ভয়ে চিৎকার করে ৷

সকাল পাঁচটায় তাঁরা বেরুন ৷ মুষলধারে বৃষ্টি না হলে এর অন্যথা হয় না ৷ এই বছর তালাবন্দির দিনগুলি ছাড়া, এখন অবধি তিন চার দিন কামাই হয়েছে ৷ মেঘনাদবাবুর ধারনা বরুণ দেবতা এই সময় একটু ব্রেক দেওয়া পছন্দ করেন ৷ অন্য মর্নিং ওয়াকের পার্টিরাও তাঁদের দলটিকে উৎসাহ দেয় ৷ অনেক সময় ছোট বাচ্চারা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে ৷ ডগি এবং লাঠি উপভোগ করে ৷ মেঘনাদবাবুর হাতে কনক-আইচ বাঁশের একটি লাঠি থাকে ৷ উন্মাদ প্রেমিকদের আক্রমণ থেকে জলিকে বাঁচাতে লাঠিটি কাজে আসে ৷ অস্ত্রটি কয়েক বছর আগে তাঁর এক সুহৃদ তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন ৷

মর্নিং ওয়াক পার্টির মধ্যে সাধারণত দু`টি গ্রুপ থাকে ৷ বছর কুড়ির আশপাশের একটি গ্রুপ ৷ এদের মধ্যে একটি বড় অংশ জনজাতি সম্প্রদায়ের মেয়েরা ৷ বিবাহিত, অবিবাহিত ৷ দেখে মনে হয়, অধিকাংশ গ্রামীণ পরিবেশ থেকে উঠে এসেছে ৷ অনেকে স্কুটি এবং গাড়ি চালানো শেখে ৷ দ্বিতীয় গ্রুপের মধ্যে মেঘনাদবাবুরা পড়েন ৷ তাঁদের সবার বয়স চল্লিশের উপরে ৷ ঊর্ধ্বসীমা অনেক ক্ষেত্রে সত্তর স্পর্শ করে ৷ অনেকে স্বামী-স্ত্রী মিলে একত্রে প্রাতঃভ্রমণ করেন ৷ অনেক বিধবা নারী-পুরুষও এই দলে থাকেন৷ অহনবাবুর এক মেয়ে ৷ রিমি ক্লাস এইটে পড়ে ৷ তখনও করোনা অতি-মারীর প্রকোপ শুরু হয়নি ৷ সে এক ম্যাডামের বাড়িতে গিয়ে পড়তো ৷ দিদিমণির বয়স ত্রিশের কোঠায় ৷ বিবাহিত ৷ উচ্চ-শিক্ষিত ৷ রিমির সমবয়সী ওনার একটি মেয়ে আছে ৷ স্বামী ভালো চাকুরী করেন ৷ তিনি ইতিহাস ও সোশাল সায়েন্স গ্রুপ পড়ান ৷ অহনবাবুর মোবাইলে অনেক সময় মেয়ে লেসন আদান-প্রদান করত ৷ রিমি যখন পড়তে যেত বাবার মোবাইল নিয়ে যেত ৷ ভদ্রমহিলা ছাত্রীর কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে নিতেন ৷ তারপর অহনবাবুর ফেইসবুক প্রোফাইল থেকে নিজের প্রোফাইলে পোস্ট করা পাবলিক পোস্টিঙে কমেন্ট করতেন ৷ লাইক দিতেন ৷ অধিকাংশই কবিতা ৷ কিছু ফেইক ফেইসবুক একাউন্ট থেকেও লাইক দিতেন ৷ প্রশংসাসূচক মন্তব্য করতেন ৷ রিমি তাঁর বাবার এবং নিজের অসন্তোষ জানাল ৷ কিন্তু দিদিমণির স্বভাবে পরিবর্তন এলো না ৷ অহনবাবু এবার ফেইসবুক একাউন্ট লগ-আউট করে মোবাইল দিতেন ৷ ম্যাডাম রিমির কাছে পাসওয়ার্ড চাইলেন ৷ রিমি বললো সে জানে না ৷ যদিও সে জানত ৷ দিদিমণির বিকার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সে মিথ্যে বললো ৷

উপরের চিত্রগুলির সঙ্গে আপাতদৃষ্টিতে কোনও মিল নেই ৷ তবু মেঘনাদবাবু যোগসূত্র খুঁজেন ৷ সম্প্রতি এর একটি ব্যাখ্যা পেয়েছেন ৷ তাঁর মনে হয়েছে ম্যাডাম সহস্রাব্দ প্রজন্মের সদস্য ৷ সহস্রাব্দের সন্ধিক্ষণে যারা জন্মায় তাদের মধ্যে বিচিত্র এক প্রবণতা দেখা যায় ৷ মোটামুটিভাবে একেকটি প্রজন্মের জন্মানোর সময়কাল পনের থেকে বিশ বছর ৷ এর অর্থ ১৯৮৫ থেকে ২০০০ সালের আশেপাশে যারা জন্মেছে তারা সহস্রাব্দ প্রজন্ম ৷ মেঘনাদবাবু এবং অহনবাবু আগের প্রজন্মের সন্তান ৷ রিমি পরের প্রজন্মের সন্তান ৷ এশিয়া এবং উপমহাদেশের অহনবাবুর প্রজন্মের লোকেরা দারিদ্র দেখেছেন ৷ একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙ্গন দেখেছেন ৷ বিশ্বায়ন এবং আধুনিকতার হাতছানি সহ্য করেছেন ৷ জীবনে দাঁড়ানোর জন্য লড়াই করেছেন ৷ এই লড়াই ছিল বেশ দীর্ঘ ৷ কোনও শটকাট ছিল না ৷ তাঁদের প্রজন্মের বেশিরভাগ লোক আজ মোটামুটি বিত্তশালী ৷

শিক্ষিত পরিবারের এই প্রজন্মের একটি বড় অংশের ছেলে-মেয়ে প্রাচুর্যের মধ্যে মানুষ হয়েছে ৷ তারা যা বায়না করেছে, মা-বাবা তাই যুগিয়েছেন ৷ বিনিময়ে বাবা-মায়েরা চেয়েছেন ছেলে-মেয়েরা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-প্রফেসর হবে ৷ অভিবাদকদের চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে বিদ্যাব্যবসায়ীরা ব্যাঙের ছাতার মত কারিগরি কলেজ খুলেছে ৷ মেধা সেখানে সবক্ষেত্রে বিচার্য বিষয় নয় ৷ অর্থ থাকলে ডিগ্রি অর্জন সমস্যা নয় ৷ এই ছেলেমেয়েরা যখন কর্মক্ষেত্রে পদার্পণ করে চোখে সর্ষে-ফুল দেখে ৷ তাদের সময়েই কম্পিউটার, মোবাইল এবং ইন্টারনেট প্রযুক্তি শিখরে পৌঁছেছে ৷ অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, তারা কঠিন প্রতিদন্ধীতার মধ্যে পড়ে ৷ একদিকে স্বপ্ন দেখে স্টার্টঅ্যাপ করে সহসাই বড়লোক হবে ৷ ফেইসবুক, ওলা, ওবের, জুম ইত্যাদি স্টার্টঅ্যাপেরই ফসল ৷ পৃথিবীতে প্রতি বছর কয়েক কোটি স্টার্টঅ্যাপ নথিভুক্ত হয় ৷ এরমধ্যে এক শতাংশেরও কম সফল হয় ৷ যদিও এই সংখ্যাটি বিশাল ৷ বাকিরা হতাশায় ডোবে যায় ৷ অনেকে চাকুরীতে ঢুকে ৷ সেখানেও অল্পতে খুশি থাকে না ৷ তার বসও তার উপর চাপ দেয় ৷ সেও সহস্রাব্দের প্রজন্মের প্রোডাক্ট ৷ প্রতিদন্ধিতার বাজারে কেউই ভাইবোন হয় না ৷ তবে পিয়র গ্রুপ সাহায্য করে ৷ এক অন্ধ অন্য অন্ধকে খুব কমই পথ দেখাতে পারে ৷

এই অবস্থায় অভিবাদকদের পক্ষে তাদের সামলানো ভীষণই কষ্টকর হয় ৷ একেকটি ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন তৈরি হয় ৷ বাবা-মাকে এই পৃথিবীতে নিয়ে আসার জন্য গালি দেয় ৷ নিজেদের নিয়ে মগ্ন থাকতে পছন্দ করে ৷ শুধু নিজেকেই ভালোবাসে ৷ অমনোযোগী ৷ অলস প্রকৃতির ৷ সর্বক্ষণ আশা করে খাবার-দাবাড়ের কোনও সমস্যা থাকবে না ৷ সবকিছু তৈরি পাবে ৷ নিজের ঘরের ময়লা অন্যরা পরিষ্কার করে দেবে ৷ দ্রুত উন্নতি করে বড়লোক হতে চায় ৷ ডাক্তার হলে ঔষধ কোম্পানি থেকে কমিশন নেয় ৷ প্রোডাক্ট লেখার বিনিময়ে ভেট নেয় ৷ অন্যের বক্তব্যকে মর্যাদা দেয় না ৷ অল্পতেই অধৈর্য হয়ে পড়ে ৷ মোবাইল তাদের কাছে প্রাণের চেয়েও প্রিয় ৷ সারাক্ষণ মোবাইলে গেইমস খেলে ৷ আশা করে তাদের ফেইসবুক পোস্ট বন্ধুরা লাইকে ভরিয়ে দেবে ৷ বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে স্থায়ী সম্পর্কে জড়ায় না ৷ অনলাইন ডেটিং পছন্দ করে ৷ কারণ দুপক্ষই একই রকম চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ৷ তাদের জৈবিক ঘড়ির কাটা অন্তত তিন থেকে চার ঘণ্টা দেরীতে চলে ৷ সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ঘুম ভাঙ্গে না ৷ অনেকে হতাশাগ্রস্ত হয়ে নেশা করে ৷ মাতাল হয় ৷ ডিস্কো থেকে যায় ৷ অনলাইন জুয়া খেলে ৷ অতিরিক্ত কোনও কিছুই ভালো নয় ৷ অনেকে চরম হতাশায় আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়৷

মেঘনাদবাবু ভাবেন, আমরা পৃথিবীতে আসি মা-বাবার বিনোদনের সুবাদে ৷ জীববিজ্ঞানীরা বলেন, গান-বাজনা-গল্প-কবিতা সবকিছু ঘটে কিছু হরমোনের ক্ষরণে ৷ এনডোরফিন, সেরোটোনিন, ডোপামিন আর অক্সিটোকিন ৷ ডিস্কোতে নাচে এনডোরফিন ও অক্সিটোকিন হরমোনের প্রভাবে ৷ সিনেমা থিয়েটারে শিল্পীদের পারফরমেন্স নির্ভর করে সেরোটোনিন ও ডোপামিন হরমোনের উপর ৷ ক্রিয়েটিভটি, ভালোলাগা, যৌনতা, সুখী-ভাব সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে এই ডোপামিন ৷ ফিল গুড হরমোন ৷ বিশেষজ্ঞদের মতে দুধ, পনির, দইয়ের পাশাপাশি প্রাণীজ প্রোটিন, ফলমূল, সবজি, ডার্ক চকলেট ইত্যাদি খেলে ডোপামিন বৃদ্ধি পায় ৷ অ্যালকোহল, ক্যাফেইন ও পরিশোধিত চিনি খেলে ডোপামিন হ্রাস পায় ৷ ব্যায়াম করলে এবং প্রাতঃভ্রমণেও ডোপামিন ক্ষরণ হয় ৷

মেঘনাদবাবুদের মনে সৃজনশীলতা জাগে ৷ জলির আচরণ থেকে তাই অনেক কিছু কল্পনা করেন ৷ মজার বিষয় হচ্ছে তামাক, মদ, কোকেইন, হেরোইন, ইয়াবা, অ্যালকোহল, গাঞ্জা প্রভৃতিও পরোক্ষ অথবা প্রত্যক্ষভাবে ডোপামিনের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ করে ৷ তাই অনেকেই এইসব মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে ৷ ডোপামিন বেশি বেশি নিঃসরিত হলেই কেউ বেশি সুখী হবে এমনটা নয় ৷ ডোপামিনের আধিক্যের কারণে হ্যালুসিনেশন, উম্মাদ-প্রবণতা বা বাতিক রোগ হতে পারে ৷ পারিভাষিক ভাষায় একে বলা হয় সিজোফ্রেনিয়া ৷ আর অল্প ক্ষরণে হতে পারে পারকিনসন রোগ ৷ সাম্যাবস্থা বজায় রাখা খুবই জরুরি ৷ মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখতে মর্নিং ওয়াক এবং সুষম খাদ্যের বিকল্প নেই ৷ সহস্রাব্দের প্রজন্মের এইসবের প্রতি আগ্রহ কম ৷ প্রতিটি সন্তান আমাদের কাছে ফুলের মত ৷ এই ফুলের খুব কমই খুশবুদার ৷




You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
মন্তব্যের তারিখ (Posted On)মন্তব্যকারির নাম (Name)মন্তব্য (Comment)
30.09.2020Biswanath BhattacharyaExcellent as usual