৷৷ ‘কিক্ কিকিউ, কিক্ কিকিউ’ ৷৷
অরিন্দম নাথ
সুদৃশ্য একটি হলঘর ৷ মোটামুটি ভর্তি ৷ সামাজিক দূরত্ব মানতে গিয়ে মধ্যে একেকটি চেয়ার খালি রাখা হয়েছে ৷ বলাবাহুল্য দর্শকরা সবাই মুখোশ পরে আছে ৷ আমি দর্শকাসনে ৷ প্রথম সারিতে বসে আছি ৷ প্রেক্ষাগৃহের দরোজা জানালা খোলা ৷ সময় দিনের বেলা ৷ মঞ্চের স্থানটিতে কিছু আলো-আঁধারির সৃষ্টি করা হয়েছে ৷ কখনও মনে হয় টেলিস্কোপিক ভীশন ৷ কখনও বাইনোকুলার ৷ থ্রি-ডি ভীশনও হতে পারে ৷ ভানুমতীর খেলা চলছে ৷ যাদুকর এবং তাঁর সহযোগীরা মুখোশ পরে আছেন ৷ মুখোশে একটু বিশেষত্ব আছে ৷ ঠোঁটের কাছটায় গাঢ় কমলা-হলুদ রং ৷ জাদুকরের আলখাল্লাতেও বৈচিত্র্য ৷ গাঢ় বাদামি রঙের কাপড়ের তৈরি ৷ টুপিটায় একটি ঝুঁটি রয়েছে ৷ যেন ভাত শালিক ৷ আবহে লঘু সঙ্গীত ৷
“এসো প্রিয়, মন রাঙায়ে ধীরে ধীরে ঘুম ভাঙায়ে
মন মাধবী বন দুলায়ে, দুলায়ে, দুলায়ে ৷”
যাদুকর ওয়াটার অফ ইণ্ডিয়া দিয়ে শুরু করেন ৷ একটি কুঁজো উপোর করে বালতিতে জল ঢালেন ৷ জল গড়ানো শেষ হলে একটি ট্রের মধ্যে রেখে দেন ৷ আবার কিছু পরে কুঁজো উপোর করে বালতিতে জল ঢালেন ৷ আবারও কিছুটা জল গড়িয়ে পড়ে ৷ ম্যাজিকটি আমার কিছুটা আইডিয়া আছে ৷ আমার ধারনা কুঁজোর গায়ে একটি সূক্ষ ছিদ্র আছে ৷ জলের মধ্যে পিং পং বল জাতীয় কিছু একটা ভাসে ৷ কুঁজো ওলটালে গলায় আটকে যায় ৷ জলের ফ্লো কমে যায় ৷ ছিদ্রে আঙ্গুল দিয়ে ঢেকে রাখলে বায়ুচাপের অভাবে জল গড়ায় না৷ আবহ সঙ্গীত বাজতে থাকে৷
যাদুকর এবার তাঁর টুপিকে উল্টো করে হাতে নেন ৷ সবাইকে দেখান ভেতরটা খালি৷ তারপর ঠিক তাঁর পেটের কাছটিতে মাটির সমান্তরালে বাঁ-হাত দিয়ে ধরেন ৷ টুপির একটি পাশ তাঁর আলখাল্লাতে ঠেকানো থাকে ৷ টুপি থেকে বিভিন্ন সামগ্রী বেরুতে থাকে ৷ প্রথমে টেবিল ঘড়ি, প্লাস্টিকের ফুল, টেডি বিয়ার ইত্যাদি নির্জীব বস্তু ৷ যাদুকরের সহায়ক দুইজন সুন্দরী মেয়ে ৷ তারা সুর্মাপরা চোখে বিড়াল পদচারণায় জিনিসগুলিকে স্টেজের একপাশে টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখে ৷ সবাই তাদের চলার ভঙ্গী এবং ভুরুর চাহনি ভীষণ উপভোগ করে ৷ এবার বেরুলো একটি জ্যান্ত ইঁদুর ৷ একজন সহকারিণী পেল্লায় লাফ মারল ৷ দর্শকরা হাসিতে ফেটে পড়ল ৷ এই হাসির রেশ মিলাতে মিলাতেই টুপি থেকে একটি বেড়াল বেরুল ৷ আর বেরিয়েই ইঁদুরের পেছনে ছুটল ৷ একদম দর্শকদের মধ্য দিয়ে গিয়ে দরোজা দিয়ে বেরিয়ে গেল ৷ এরপর বেরুলো একটি কোকিল বা পাপিয়া ৷ আমি আগে জাদুকরের থলে থেকে পায়রা বেরুতে দেখেছি৷ কোকিল বেরুতে এই প্রথম দেখলাম ৷ সবশেষে পরপর বেরুলো একটি শালিক ও একটি বাজ পাখি ৷ অবাক হয়ে দেখলাম পাখি দুটো শান্ত হয়ে একটি লাঠির উপর বসেছে ৷ লাঠিটি দুইপাশে দড়ি বেধে ঝুলানো ছিল ৷ আগে লক্ষ্য করিনি ৷
"শোন ‘পিউ পিউ’ ডাকে পাপিয়া
মোরে সেই সুরে ডাক ‘পিয়া, পিয়া’
তব আদর-পরশ বুলায়ে, বুলায়ে, বুলায়ে ৷”
এবার জাদুকর এক বিস্ময়কর খেলা দেখালেন ৷ সত্যিকথা বলতে কি এইজন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না ৷ জাদুকরের কথায় একজন সহকারী শালিকটিকে তাঁর কাছে নিয়ে এলেন ৷ জাদুকর ওয়াটার অফ ইণ্ডিয়ার কুঁজো থেকে একটি গ্লাসে কিছু জল নিলেন ৷ মন্ত্র পড়লেন । শালিকটিকে বাক্সে রেখে জাদুকর মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে দিলেন ৷ ভোজবাজির মত শালিক মিলিয়ে গেল ৷ সুবেশী এক সুন্দরী রমণী বেড়িয়ে এলেন ৷ মহিলা জাদুকরকে আলিঙ্গন করলেন ৷ জাদুকর এবার তার পরিচয় দিলেন, “ইনি আমার স্ত্রী ৷ আমি একটি গ্রামে থাকতাম৷ আমার বাবা-মা ছোটবেলাতেই মারা গিয়েছিলেন ৷ দাদির কাছে মানুষ ৷ সারাদিন বাউণ্ডুলের মত ঘুরে বেড়াতাম ৷ একদিন এক গুরু পেয়েগেলাম ৷ তিনিই আমাকে ভানুমতীর খেল শেখান ৷ আমি বিড়াল, কুকুর, পাখি বিভিন্ন প্রাণীর রূপ নিতে পারতাম ৷ এই মেয়েটি গরিব ৷ মা মরা ৷ সে এক দূরের এক গ্রামে থাকত ৷ গ্রাম-বাসীরা একদিন আমাদের বিয়ে দিয়ে দিল ৷ বিয়ের পর আমি ম্যাজিক দেখানো ছেড়ে দিলাম ৷ শরীরের উপর দিয়ে ভীষণ ধকল যায় ৷ তখন অবধি বৌ কখনও আমার যাদু দেখেনি ৷ সে রোজ রোজ বায়না করত জাদুর খেলা দেখার ৷ এই নিয়ে আমাদের মধ্যে মান-অভিমান হত ৷ একদিন আমি রাজি হয়ে গেলাম ৷ তাকে বললাম দু`টি গ্লাসে জল নিয়ে আসতে ৷ আলাদা আলাদা মন্ত্র পড়লাম ৷ একটি গ্লাসে মানুষ থেকে পাখিতে রূপান্তরের মন্ত্রপূত জল ৷ অন্যটিতে পাখি থেকে পুনরায় মানুষ রূপে ফিরে আসার জল ৷ আজ যেটা আপনারা চাক্ষুষ করলেন ৷ এরপর বৌকে বললাম, আমি পাখির রূপ নিচ্ছি ৷ তুমি অন্য গ্লাসের মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে আমাকে আবার মানুষ বানিয়ে নিও৷ এই বলে আমি মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে পাখি হলাম ৷ শালিক পাখি ৷ বৌ অবাক হয়ে হাততালি দিতে লাগল ৷ আনন্দের আতিশয্যে তার পায়ে লেগে মানুষে রূপান্তরের জলের গ্লাসটি মাটিতে গড়িয়ে পড়ল ৷ যখন সম্বিৎ হল কাঁদতে থাকলো ৷ শেষে বাকি গ্লাস থেকে জল ছিটিয়ে নিজেও শালিকের রূপ নিল ৷ সে মানুষ হিসেবে থেকে যেতে পারত ৷ কিন্তু শালিক হওয়াই পছন্দ করে৷ প্রকৃত প্রেমী ৷"
“যদি আন কাজে ভুলে রহি
চলে যেও না হে মোর বিরহী
দিও প্রিয়, কাজ ভুলায়ে, ভুলায়ে, ভুলায়ে ৷”
বৌটির মধ্যে এবার কিছু শরমের আভাস ৷ জাদুকর পরবর্তী খেলার দিকে এগিয়ে গেলেন ৷ আরেকটি গ্লাসে জল নিলেন ৷ মন্ত্র পড়লেন ৷ এবার বাজ পাখিটিকে বাক্সে রাখলেন ৷ তারপর মন্ত্রপূত জল বাজ পাখির গায়ে ছিঁটালেন ৷ এক নিগ্রো মহিলা বেরিয়ে এলেন ৷ তিনি নিজেই পরিচয় দিলেন, “আমি কবি মায়া অ্যাঞ্জেলু । আমার জন্মনাম মার্গারিট অ্যানি জনসন ৷ যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের সেইন্ট লুইতে আমার জন্ম ৷ ছোটবেলা থেকে আমার কষ্টের জীবন ৷ বেঁচে থাকার জন্য আমি যৌনকর্মী থেকে নাইট ক্লাবের নৃত্যশিল্পী অনেক ভূমিকায় কাজ করেছি ৷ বাস–কন্ডাক্টরের কাজ করেছি ৷ মার্টিন লুথার কিংয়ের সঙ্গে কালো মানুষের জন্য লড়াই করেছি ৷ জন এফ কেনেডির অভিষেকে উপস্থিত থেকেছি ৷ বিল ক্লিনটনের প্রথম অভিষেকেও আমন্ত্রিত ছিলাম ৷ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আমাকে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম প্রদান করেছেন ৷ আমার সাত খণ্ড আত্মজীবনীর প্রথমটির নাম ‘আমি জানি খাঁচার পাখি কেন গান গায়’ ৷”
সবাই একযোগে দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে কবি মায়া অ্যাঞ্জেলুকে সম্মান জানায় ৷ তিনি একটি চেয়ারে বসেন ৷ আমি তাঁর বয়স আন্দাজ করার চেষ্টা করি ৷ এরপর থট রিডিং এর খেলা শুরু হয় ৷ জাদুকর দর্শকদের মনের কথা বলতে পারেন ৷ একে একে দুই তিনজন দর্শক মঞ্চে এগিয়ে গেলেন ৷ সবাই তাঁর ভাবনা সংক্ষেপে একটি করে কাগজে লিখে রাখল ৷ জাদুকর একে একে বলে দিলেন ৷ সবাই বললো, একদম সঠিক । হল আবারও হাততালিতে ভরে উঠলো৷ তিনি হঠাৎ আমায় মঞ্চে ডাকলেন ৷ তারপর বললেন, আমি জানি একটু আগে আপনি কি ভাবছিলেন ৷ আমি কিছু বলার বা লিখার আগেই তিনি বলতে থাকলেন ৷ গতকাল প্রাতঃভ্রমণে বেড়িয়ে আপনারা বাড়ির কাছে একটি জায়গায় ইলেকট্রিক তারের উপর বসে শতাধিক শালিককে কিচির মিচির করতে দেখেছেন ৷ আপনার মনে প্রশ্ন জেগেছে শালিকের এই জমায়েতের কারণ কি ?
- ঠিক তাই!
- আপনি নিশ্চয় ভালো করে লক্ষ্য করেছেন ৷ শালিকরা ‘কিক্ কিকিউ কিক্ কিকিউ’ করে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল ৷ এ`টা আসলে, ‘দলে দলে আস’, ‘দলে দলে আস’, বলে ডাকাডাকি ৷ তিনচার দিন ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিল ৷ সবার সাথে কথা বলে আবহাওয়া পরিবর্তনের পূর্বাভাস নিশ্চিত করা হচ্ছিল ৷ দক্ষিণ-পশ্চিম বায়ু আসার ঠিক আগে শালিকরা ডাকে ‘পিকিউ! পিকিউ!’ কুড়ি থেকে তিরিশ সেকেন্ড ৷ কখনও এক নাগাড়ে ৷ তারপর দশ থেকে পনেরো সেকেন্ড চুপ করে থাকে । এই ডাক চলে বজ্র-বিদ্যুৎ সহ ঝড়বৃষ্টির আট থেকে ছত্রিশ ঘণ্টা আগে পর্যন্ত ৷ অন্য সময় ডাকবে, চিড়িক! চিড়িক! তবে দলবেঁধে ঝগড়াঝাঁটির সময় ডাকের কোনও গ্রামার থাকে না ৷
কবি মায়া অ্যাঞ্জেলুর কথা আমার মনে আসে ৷ আমি জাদুকরকে বলতে যাই, “এটা কি করে সম্ভব ? মায়া অ্যাঞ্জেলু কিছুদিন আগে ৮৬ বছর বয়সে মারা গিয়েছেন !"
হঠাৎ ভোজবাজির মত সবকিছু মিলিয়ে যায় ৷ আমি বুঝতে পারি, এতক্ষণ আমি এক বিচিত্র স্বপ্ন দেখছিলাম ৷