সত্যি বলছি- এত কম সময়ের শাসনে মিডিয়ার উপরে এভাবে খড়গহস্ত হতে কোনও মুখ্যমন্ত্রী-কে দেখিনি
প্রদীপ চক্রবর্তী
রাজ্যে ভয়াবহ ও উদ্বেগজনক করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব রাজ্যের একাংশ সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর সংবাদ পরিবেশনের অভিযোগ এনে হুমকি দিয়েছেন যে "যারা নিয়মিত এসব সংবাদ পরিবেশন করছে তাদের তিনি কোন অবস্থায় মাফ করবেন না"। মুখ্যমন্ত্রী যখন এই হুমকি দিয়েছেন ঠিক সেদিনই সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে এক স্বতোপ্রনোদিত ভাবে গৃহীত জনস্বার্থ মামলায় হাইকোর্ট কোভিড মোকাবিলা ব্যবস্থাপনা নিয়ে রাজ্যের কাছে কৈফিয়ত তলব করেছেন।
মুখ্যমন্ত্রী সাব্রুমে সংবাদপত্রের একাংশের ভূমিকা নিয়ে যেমন সরব হয়েছেন এবং হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তা তিনি হয়তো বা দিতেই পারেন।কেননা এটা হয়তো তাঁর বাক- স্বাধীনতার অধিকার। কিন্তু এটা তো ঘটনা অনুরূপ সাংবিধানিক স্বাধীনতা মিডিয়ারও রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রিত ভূমিকা অবলম্বন করতে হবেই। সাংবাদিকরা তো আইনের উর্ধ্বে নয়।
তববে এটাওতো ঘটনা যে বিজেপি-আইপিএফটি -র শাসন কালে রাজ্যের বেশ কয়েকটি চ্যানেল বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে বেশ কটি সংবাদপত্র।কয়েকজন সাংবাদিক ও সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, গভীর রাতে সংবাদপত্র অফিসে পুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে। একটি ওয়েব পোর্টাল -এর অফিসেও তল্লাশি হয়েছে, মামলা হয়েছে। ত্রিপুরার সবচেয়ে প্রথম নিউজ ওয়েব পোর্টালে বিনা নোটিশে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ‘ভোক্যাল ফর লোকাল’ ইস্যূতে সত্যনিষ্ট আর্টিকেল প্রকাশের পর বি জে পি অফিসে সিনিয়র সাংবাদিক জয়ন্ত দেবনাথ-কে প্রেস কনফারেন্স করে হুমকী দেত্তয়া হয়েছে। পোর্টালের বিজ্ঞাপন বন্ধ করা হয়েছে। অন্যান্য সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াতে বিজ্ঞাপন আশানুরূপ ভাবে প্রদান করা হচ্ছে না একটি অনুগত চ্যানেল ছাড়া। এটি অভিযোগ নয়, বাস্তব। অন্যদিকে রাজ্য সরকার সংবাদপত্র কেনাও বন্ধ করে দিয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে মুখ্যমন্ত্রী-র হুমকি প্রাসঙ্গিক হয়তোবা। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব- এর কাছ থেকে এই ধরনের হুমকি প্রত্যাশিত নয়। কেননা তিনি বরাবরই সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলেন। খবর বা অভিযোগ হল বিপ্লব কুমার দেব-কে ভ্রান্ত পথে পরিচালনা করছেন কয়েকজন পরামর্শ দাতা। এরা নাকি সবসময় মুখ্যমন্ত্রী-র অফিসে, আবাসে কাজে অকাজে ঘুরঘুর করে থাকেন। অন্যদের ক্ষতি করতে মুখ্যমন্ত্রীর নাম ও তার অফিসের এক পরিযায়ীকে ব্যবহার করেন বলে অভিযোগে প্রকাশ। ঘনিষ্ঠরা বলে থাকেন এই চক্র সময় সুযোগ পেলেই অন্য সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর অভিযোগ করে মুখ্যমন্ত্রীর কানে বিষ ঢেলে দিয়ে থাকেন। একজন তথাকথিত প্রভাব শালী টিভি সাংবাদিক আছেন যিনি নিজেকে মুখ্যমন্ত্রীর কাছের লোক দাবী করে অফিসারদের ভয় দেখিয়ে সরকারী বিজ্ঞাপন আদায় করে থাকেন বলেও প্রকাশ। ওই ভদ্রলোক পেশার বাইরে গিয়ে বিভিন্ন বরাত আদায় করছেন এবং ফ্ল্যাক্স প্রিন্টিং-এর বরাত থেকে শুরু করে বহু সরকারী কাজ থেকে মুখ্যমন্ত্রীর নাম করে কমিশনের ভিত্তিতে অন্যদের পাইয়ে দিচ্ছে বলে লোকজন বলাবলি করে থাকেন। তিনিই মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব-কে সবচেয়ে বেশী বিভ্রান্ত করছেন বলে অভিযোগে প্রকাশ।
সংবাদে প্রকাশ নিজ দলের আরেক শ্রেনীর কজন নেতা রয়েছেন যারা বিপ্লব বাবুকে মিথ্যে তথ্য দিয়ে পরিচালনা করার চেষ্টা করছেন। পৃথিবীর ইতিহাস বলে - গনমাধ্যমের বিরোধীতা করে কোন শাসক বেশী দিন ক্ষমতার তখতে থাকতে পারেনি।এ রাজ্যের ইতিহাসও অন্তত তাই বলে। নৃপেন চক্রবর্তীও মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন একসময় সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন। কিন্তু দশরথ দেব তেমনটা করেননি। পরবর্তী সময়ে মানিক সরকার- এর দলও তাদের শাসনকালের শেষ দিকে সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন। তবে মানিক সরকার নিজে পারতপক্ষে বিরোধের রাস্তায় যাননি। বিশেষ কিছু পরিস্থিতিতে তিনি স্হানীয় সংবাদপত্রকে এড়িয়ে চলতেন। কিন্তু এখনকার শাসকের মতো কখনো কথায় কথায় মিডিয়ার বিজ্ঞাপন বন্ধ করেননি। থানায় এফ আই আর করেননি।
এটা ঠিক মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব রাজ্যের উন্নয়নের জন্য সচেষ্ট এবং তার আন্তরিকতা নিয়ে সংশয় নেই।মনে প্রানেই তিনি চান রাজ্যের উন্নয়ন। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে কি এমন পরিস্থিতি বা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে যার ফলে মুখ্যমন্ত্রী একাংশ সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে এভাবে প্রকাশ্য বিষোদগার করেছেন? প্রকাশিত সংবাদ ভুল হলে সরকারী তরফে প্রতিবাদ দেওয়া যেতেই পারে। বা আইনী ব্যবস্থাও নেয়া যেতে পারে। কিন্তু সেসব এড়িয়ে তিনি একাংশ সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে তো নিজেকে বিতর্কিত করে তুলেছেন। এখন করোনা মহামারী আবহে রাজ্য জুড়ে মানুষ উদ্বেগ রয়েছে। এ রাজ্যের করোনা জনিত চিকিৎসা প্রশ্নের মুখে। প্রায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর মিছিল চলছে। শুক্রবারও দশজনের মৃত্যু হয়েছে। হাইকোর্ট পর্যন্ত উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এবং সরকার -এর বক্তব্য জানতে চেয়েছে। কেননা, সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো করোনা আক্রান্ত রোগীদের আত্মজন হাসপাতলে চিকিৎসাধীন রোগীদের সাথে কথা পর্যন্ত বলতে পারছেননা। সরকারী ভাবেও রোগীদের শারিরীক অবস্থা নিয়ে কোন কিছু জানানো হয়না। মৃত্যুর ৪৫/৭২ ঘন্টা পর পরিবার পরিজনদের মৃত্যুর খবর জানানো হয়। এটা কেন হবে? আর এসব নিয়ে মিডিয়া খবর প্রকাশ করলেই মিডিয়ার উপর খড়গহস্ত হতে হবে? সব মিডিয়াতেই তো খবর প্রকাশিত হয়েছে যে অক্সিজেনের অভাবেই জিবিতে বেশীরভাগ মৃত্যু হচ্ছে। শুক্রবার রাতেও বিধায়ক সুদীপ রায় বর্মন এক বায়ো মেডিক্যাল ইন্জিনিয়ার রাতুল দে-কে নিয়ে জিবি হাসপাতালে গিয়ে অক্সিজেন পাইপলাইন সারাই করে বেশ কজনের প্রান রক্ষা করেছেন। আরও তথ্য হলো ৭ ই আগষ্ট পর্যন্ত জিবিতে অক্সিজেন সরবরাহ স্বাভাবিক ছিল না। কেন এমন অবস্থা হবে? মুখ্যমন্ত্রী তো কয়েক দফায় বৈঠক করেছেন।তবে কেন এমনটা হবে। দায় তো সঙ্গত কারনেই কি মুখ্যমন্ত্রীকে নিতে হবে না? সাংসদ প্রতিমা ভৌমিক তো গত কদিন ধরে প্রায় প্রতিদিন এজিএমসি-তে অবস্হান করছেন। আগে থেকে কেন তাকে এই দায়িত্তটি দেওয়া হলোনা? দায়িত্ব নিয়েই তিনি কি কি পদক্ষেপ নিয়েছেন? যদি জিবি-র কোভিড ইউনিটে অক্সিজেন সরবরাহ স্বাভাবিক থাকে তাহলে কেন রাতুল দে- কে নিয়ে গত 11 সেপ্টেম্বর মধ্য রাতে স্হানীয় বিধায়ককে জিবি হাসপাতাল ছুটে যেতে হয়েছে? এসব তথ্য সংবাদপত্রে তো প্রকাশিত হবেই। এসব প্রকাশ করাই তো সংবাদপত্রের দায়িত্ব। এসব প্রকাশ করার অর্থ তো বিরোধীতা নয়। দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনের অভিজ্ঞতায় বলছি- চিলে কান নিয়ে গেছে বলে উদভ্রান্তের মত চিলের পেছন পেছন ছুটা তো বাস্তবিকতা নয়।