একুশে ফেব্রুয়ারি এবং আঙ্ নন হামজাগ !

শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ

February 21, 2025

‘আঙ্ নন হামজাগ’ অর্থাৎ ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলাম। কবিতাটি বেরিয়েছিল ত্রিপুরা সরকারের ‘গোমতী’ সাহিত্য পত্রিকায়। পরে অবশ্য অন্য পত্র পত্রিকাতেও পুনর্মুদ্রিত হয়। কবিতাটির সারমর্ম এমন - এক বঙ্গভাষী যুবক ত্রিপুরায় আশ্রয় পেয়েছে । সে রাজ্যটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং জনজাতিদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়। যুবক প্রেমে পড়ে পার্বতী রিয়াং নামে এক জনজাতি রমণীর। এদিকে উপত্যকায় তখন শুরু হয় অস্থিরতা । অন্তহীন বঞ্চনা আর দরিদ্রতা ছিল এর প্রধান কারণ । অসন্তোষের আগুন তাই ছড়িয়ে পড়ে পাহাড়ে। অনুরণিত হয় নতুন স্বাধীন ত্রিপুরা গড়ার আওয়াজ । রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য তখন অন্যান্য ত্রিপুরি যুবকযুবতীর মতো পার্বতী রিয়াংও একদিন অস্ত্র হাতে অরণ্য অভ্যন্তরে হারিয়ে যায় ! সেই যুবক কিন্তু ভুলতে পারে নি পার্বতীকে। হিমেল কুয়াশা নেমে আসা এক মেঘলা দিনে নিঝুম নিরালা চা বাগানে দাঁড়িয়ে সেই যুবক তার প্রেমিকা পার্বতীর কথা ভেবে আকুল হয়। নিঃসঙ্গ যুবকটি বিষণ্ণ উপত্যকার মাঝে দু হাত বাড়িয়ে চিৎকার করে বলে, ‘’পার্বতী, তুই কোথায় ! ফিরে আয়। আমি যে তোকে ছাড়া থাকতে পারবো না। আঙ্ নন হামজাগ, পার্বতী। আঙ্ নন হামজাগ … আমি তোকে ভালোবাসি।‘’

ভাষা এবং ভালোবাসা যে আসলে মানুষের একটি স্বতঃস্ফূর্ত সহজাত প্রবৃত্তি - সেই কথাই আঙ্ নন হামজাগ কবিতার মাধ্যমে ব্যক্ত করতে চেয়েছিলাম। মানুষের ভালোবাসার মাধ্যম যে ভাষাতেই হোক না কেন - তাকে মর্যাদা দেওয়া উচিত। সেই অভিব্যক্তির ওপর কোনও শর্ত বা বিধিনিষেধের দায় চাপানো অনুচিত এবং অনৈতিক। মানবিকতা বিরোধী এসব কাজ। ত্রিপুরায় রাধামোহন ঠাকুর এবং দৌলত খান আহমেদ’এর উদ্যোগে যে ককবরক ভাষার ক্রমবিকাশ শুরু হয়েছিল – তাকে একদা রুদ্ধ করার অপচেষ্টা হয়েছিল। ৩ মার্চ, ১৯৭৫’এ রচিত হয়েছিল ত্রিপুরার এক কলঙ্কিত ইতিহাস । সেদিন আবেদন পত্র দাখিলের জন্য একটি প্রতিনিধি দল গিয়েছিল দক্ষিণ ত্রিপুরার জোলাইবাড়ির তহসিল কাছারিতে। সেই আবেদন পত্রে অন্যান্য দাবী দাওয়ার সঙ্গে ত্রিপুরি ভাষা ককবরক’কে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবী জানানো হয়েছিল। বিনা প্ররোচনায় পুলিশ তখন নিরস্ত্র জনতার উপর গুলি চালায় । গুলিতে আহত হন অনেকেই । নিহত হন ধনঞ্জয় ত্রিপুরা; পার্বত্য রাজ্যের ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ।

ভাষা নিয়ে অনেক আখ্যান, কাহিনী তৈরি হয়েছে। এদের মধ্যে আলফোনস দাউদেত (১৮৪০-১৮৯৭)’র গল্প ‘’দ্য লাস্ট ক্লাস: দ্য স্টোরি অব আ লিটল অ্যালসেশিয়ান’’ সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিকতা লাভ করেছে। জার্মানির সীমান্তবর্তী ফরাসী গাঁয়ের ছেলে তার ভাষা ফরাসীতেই লেখাপড়া করতো। কিন্তু একদিন স্কুলে যাওয়ার পর শিক্ষকের কাছে জানতে পারে, জার্মানেরা তাদের গ্রামটি দখল করে নিয়েছে। এরই ফলশ্রুতিতে শাসক জার্মানেরা সেই স্কুলে ফরাসী ভাষায় লেখাপড়া বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে। ফরাসীর পরিবর্তে লেখাপড়ার মাধ্যম হবে জার্মান। নিজের ভাষায় আত্ম সংস্কৃতি চর্চা করতে না পারার চরম অনিশ্চয়তাবোধ তখন সেই ছোট্ট ফরাসী গাঁয়ের সবাইকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। এই বোধের প্রেক্ষিতেই গড়ে উঠেছে বিশ্ব বিখ্যাত গল্পটি।

মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়া হলে বা স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করলে মানুষ সেই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সরোষে প্রতিবাদে গর্জে উঠবেই। বন্দুক বা বেয়নেটের মাধ্যমে সেই প্রতিবাদকে প্রতিহত করা অসম্ভব ! প্রায় একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটে বরাক উপত্যকাতে। ১৬ মার্চ, ১৯৯৬’এ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার স্বীকৃতির আন্দোলনে শহীদ হন বিশ্বের দ্বিতীয় নারী ভাষা শহীদ সুদেষ্ণা সিংহ। পুলিশের গুলিতে আহত হন সেদিন সহস্রাধিক বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাযোদ্ধা। শহীদ সুদেষ্ণার স্মরণে ভারত ও বাংলাদেশের মণিপুরীরা ১৬ মার্চ ভাষাদিবস পালন করে থাকে।

এই ঘটনার অন্তত সাড়ে তিন দশক আগে ১৯ মে ১৯৬১’এ অসমের শিলচর রেল স্টেশনের সামনে পুলিশের গুলিতে বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন ১১ জন। নিহতেরা হলেন কমলা ভট্টাচার্য, কানাইলাল নিয়োগী, চন্ডীচরণ সূত্রধর, হিতেশ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্রকুমার দেব, কুমুদরঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুকোমল পুরকায়স্থ। এই ঘটনার পরে অসম সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তৈরি হয় শিলচর স্টেশনের সামনে ১১ জনের স্মৃতিতে শহিদ বেদি ।

রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ’এর জন্মের অন্যতম কারণ ছিল ভাষা আন্দোলন।

২১শে মার্চ, ১৯৪৮ সালের, ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক জন সমাবেশে মহম্মদ আলি জিন্না স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, ‘’পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হবে উর্দু - অন্য কোন ভাষা নয়।‘’ ইংরেজিতে দেয়া সেই বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, "আমি খুব স্পষ্ট করেই আপনাদের বলছি যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, এবং অন্য কোন ভাষা নয়। কেউ যদি আপনাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে তাহলে সে আসলে পাকিস্তানের শত্রু।"

তমদ্দুন মজলিস সেই সময় 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু' নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছিল। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরে অধ্যাপক ড. কাজী মোতাহার হোসেন, দৈনিক ইত্তেহাদের সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ, আর তমদ্দুন মজলিস প্রধান অধ্যাপক আবুল কাসেমের নিবন্ধ ছিল। "ভাষার প্রশ্নটি যে "পাকিস্তানের এক অংশের ওপর আরেক অংশের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ আধিপত্য বিস্তারের সাথে জড়িত" এই বোধ তখন সবার মধ্যে জন্মাতে শুরু করেছে - বলেছিলেন আবুল মনসুর আহমদ । বইয়ে একটি চমকপ্রদ কথা লিখেছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন তার নিবন্ধে। তিনি লিখেছিলেন, "...যদি গায়ের জোরে উর্দৃকে বাঙালি হিন্দু-মুসলামের উপর রাষ্ট্রভাষা রূপে চালাবার চেষ্টা হয়, তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে। কারণ ধূমায়িত অসন্তোষ বেশী দিন চাপা থাকতে পারে না । শীঘ্রই তাহলে পূর্ব-পশ্চিমের সম্বন্ধের অবসান হবার আশংকা আছে। "এ সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে করাচিতে।

তৎকালীন পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লক্ষ লোকের মধ্যে ৪ কোটিরও বেশি লোকের ভাষা বাংলা - অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষাই বাংলা। তাই বাংলাকে নিছক পাকিস্তানের একটি প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে দেখা উচিত নয়, বাংলারও হওয়া উচিত অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। প্রতিবাদী ছাত্রেরা ঢাকায় ছাত্ররা ক্লাস বর্জন ও ধর্মঘট করে। ১১ই মার্চ ১৯৪৮ সালে পূর্ব বাংলায় পালিত হয় 'ভাষা দিবস'। ঢাকায় ১১ মার্চ বিভিন্ন সরকারি ভবনের সামনে বাংলা ভাষার জন্য বিক্ষোভ হয়, দুজন মন্ত্রীকে পদত্যাগপত্র স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেন বিক্ষোভকারীরা, পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মি. নাজিমুদ্দিনকে গণপরিষদ ভবন থেকে বের করে নিতে সেনাবাহিনী ডাকতে হয়েছিল।

পুলিশ যে আন্দোলনকারী নেতাদের গ্রেফতার করে তাদের মধ্যে ছিলেন শামসুল হক, অলি আহাদের মতো অনেকে, আর শেখ মুজিবুর রহমান - পরে যিনি হয়েছিলেন ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের নেতা এবং বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি। এই নেতাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১৩-১৫ই মার্চ ঢাকায় ধর্মঘটও পালিত হয়েছিল।বাংলা’কে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সালের ঢাকায় বিক্ষোভ হয়। বিক্ষোভকে দমানোর জন্য পুলিশ গুলি চালায়। প্রাণ হারায় আবুল বরকত, রফিকউদ্দিন আহমদ, শফিউর রহমান, আবদুস সালাম, আবদুল জব্বার, ওয়াহিদুল্লাহ, আবদুল আউয়াল, কিশোর অহিউল্লাহ, সিরাজুদ্দিন প্রমুখ। এরপর স্তিমিত হবার পরিবর্তে ভাষা আন্দোলন বরং আরও বেগবান হয়ে উঠে। 'ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে নিতে চায়' গান গেয়ে লাখো লোক পথে নেমে পড়ে। আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হতে থাকে ভাষা আন্দোলনের গান। মুক্তির গান। সবাই গাইতে থাকে, 'তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি' , ভুলবো না সেই একুশে ফেব্রুয়ারি, ...'সালাম সালাম হাজার সালাম' ......এবং আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি ! উল্লেখ্য, সাংবাদিক ও লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে গানটি রচনা করেন। ১৯৫৪’এ প্রভাত ফেরি'তে প্রথম গানটি গাওয়া হয়েছিলো। এই গান গাওয়ার অপরাধে পাকিস্তানি শাসক ঢাকা কলেজ থেকে ১১ জন ছাত্রকে বহিষ্কার করে। বর্তমানে এই গানটি হিন্দি, মালয়, ইংরেজি, ফরাসি, সুইডিশ, জাপানিসহ ১২টি ভাষায় গাওয়া হয়। পাকিস্তানি শাসক শেষ পর্যন্ত মাথা নত করতে বাধ্য হয়। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ অনেক ত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা অর্জন করে।

১৭ নভেম্বর, ১৯৯৯’ এ ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারি’কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। বাংলাদেশিদের দ্বারা সংগঠিত ভাষা আন্দোলনের প্রতি শ্রদ্ধার অংশ হিসেবেই ২১ ফেব্রুয়ারিকে এই ঘোষণার সপক্ষে রায় দেয় ইউনেস্কো। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০০ থেকেই গোটা বিশ্ব জুড়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে উদযাপিত হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস।

আরও পড়ুন...


Post Your Comments Below

নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।

বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।

Free Download Avro Keyboard

Fields with * are mandatory





Posted comments

Till now no approved comments is available.