ভুল আমরা করেছি সবাই, বাঁচতে হলে ভ্যাকসিনের জন্য অপেক্ষা ছাড়া এখন আর অন্য কোনো উপায় নাই

চন্দন ভৌমিক

করোনা মহামারি যার পোশাকি নাম "কোভিড-১৯" ২০১৯ -এর ডিসেম্বরের কোন এক সময়ে চীনের উহান প্রদেশ থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল। প্রথম পর্যায়ে উহান প্রদেশ আক্রান্ত হয়ে চীনের অন্যান্য কিছু প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ল, তারপর উহান সহ চীনের আক্রান্ত প্রদেশ গুলির মধ্যে যাতায়াত কারি (কর্মসূত্রে) যাত্রীরা নিজ নিজ দেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অজান্তে বহন করে নিয়ে গেল মারন ভাইরাস কোভিড-১৯ কে। মূলত ২০২০-এর জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মাঝামাঝি অবধি আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলের মাধ্যমে খুব তাড়াতাড়ি ভাইরাস পৌছে গেল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। মার্চ থেকে এপ্রিল মাস খুব দ্রুতলয়ে বিশ্বের উন্নত দেশগুলির প্রথম সারির ধনাঢ্য দেশ আমেরিকা, ইতালি, ইংল্যান্ড সহ বেশীরভাগ দেশ আক্রান্ত হয়ে পড়ে। মৃত্যুর মিছিল ক্রমবর্ধমান হতে থাকে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পঙ্গু বা অসহায় হয়ে পড়ে।

আমাদের দেশে এর আগমন একই সময়ে ঘটতে থাকেলেও কেন্দ্রীয় সরকারের সময়োচিত ও সঠিক পদক্ষেপ গ্রহন করার ক্ষেত্রে উদাসীনতা এবং সর্বোপরি ২৪শে ফেব্রুয়ারী আহমেদাবাদে "নমস্তে ট্রাম্প" নামক জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রচুর লোকের সমাগম ঘটিয়ে করোনা ভাইরাসের সংক্রমন প্রথম পর্যায়ে পৌছে দেওয়া হয়।

১৭২০ সালে প্লেগ, ১৮২০ সালে কলেরা, ১৯২০ সালে স্প্যানিশ ফ্লু এবং ২০২০ সালে করোনা ভাইরাসের আক্রমন বিশ্বের সমস্ত দেশ ও জনগোষ্ঠীকে সংকটের মুখে এনে দাড় করিয়ে দিয়েছে।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত ডাক্তার ও বিজ্ঞানীদের দেওয়া ধারনা অনুযায়ী মহামারী মূলতঃ চারটি পর্যায়ে সংক্রমন ঘটাতে থাকে।

প্রথম পর্যায়ঃ সংক্রমিত এলাকা থেকে পরিযায়ীদের মাধ্যমে একস্থান থেকে অন্যস্থানে, এক দেশ থেকে অন্যদেশে পরিবাহিত হতে থাকে। প্রথম পর্যায়টা মারাত্মক না হলেও এখান থেকেই ভাইরাস ছড়াতে শুরু করে। এই সময়ে স্থানীয় মানুষদের মধ্যে সংক্রমন ঘটে না। শুধু যাদের সংক্রমিত জায়গায় বেড়ানোর (কর্মসূত্রে ও বিভিন্ন কারনে) ইতিহাস রয়েছে, তারাই সংক্রমিত হয়ে থাকে।

দ্বিতীয় পর্যায়ঃ এই পর্যায়ে স্থানীয়দের মধ্যে সংক্রমন ঘটতে শুরু হয়। সংক্রমিত এলাকায় ভ্রমন করে আসা ব্যক্তিদের মাধ্যমে। সাধারনতঃ পরিবারের লোকজন ও বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে ছড়াতে শুরু হয়। এই পর্যায়ে সংক্রমন ছড়ানো এবং সংক্রমিত ব্যক্তিদের সহজে পৃথকীকরন করা যায়।

তৃতীয় পর্যায়ঃ এই পর্যায়ে সংক্রমনের কারন ও হদিস পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। যাদের কোন ভ্রমনের ইতিহাস নেই তাদের মধ্যে ভাইরাসের আক্রমন হতে থাকে। সংক্রমন চরম পর্যায়ে যেতে থাকে এবং নিয়ন্ত্রনে বাইরে যেতে শুরু করে।

চতুর্থ ও চরম পর্যায়ঃ এই পর্যায়ে সংক্রমন কোন কারন ও ইতিহাস ছাড়াই সম্পুর্ন নিয়ন্ত্রনের বাইরে গিয়ে ছড়াতে থাকে। পাড়া, মহল্লা হয়ে সমস্ত দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

৪র্থ পর্যায়ে খুব দ্রুতলয়ে সমস্ত সরকারী ও বেসরকারী ব্যবস্থাপনা ভাঙ্গতে শুরু করে। যেমন- ১) স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্রমশ অসহায় হয়ে পড়ে। স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন পেশার লোকজন আক্রান্ত হতে শুরু করে।

স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হতে শুরু করে এবং অনেকে মৃত্যুর কোলে ডলে পড়ে। মৃত্যুভয় এবং সংক্রমনের ভয়ে অধিকাংশ পরিষেবা প্রদানকারীরা দায়িত্ব কর্তব্য থেকে পিছু হঠতে শুরু করে। এই সময়ে মানব সভ্যতা এক অমানবিক পর্যায়ে প্রবেশ করতে শুরু করে। বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত রোগী, অথর্ব রোগী সঠিক ও সময়মত চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

বেশ কিছু ঘটনায় দেখা যাচ্ছে ত্রিপুরাতে ও অ্যাম্বুল্যান্সে এবং হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে রোগীর মৃত্যু ঘটছে। মৃতদেহ ঘন্টার পর ঘন্টা ট্রলিতে, মেঝেতে পড়ে থাকছে। কঠোর নিয়মাবলীর কারনে মৃতের আত্মীয়স্বজন কাছে না আসতে পারার জন্য মৃতদেহ সঠিক ভাবে প্যাকিং ও ধরার লোকের অভাবে দীর্ঘক্ষন বেওয়ারিশ লাশের মত পড়ে থাকছে। সৎকার করতে গিয়েও দীর্ঘক্ষন হয়রানির স্বীকার হতে হচ্ছে। আবার পরিষেবা ভেঙ্গে পড়ার কারনে অনেক রোগী ও মৃতদেহের খোঁজ মিলছেনা। এছাড়া কিছু অসাধু চক্র গড়ে উঠেছে যারা ৫০০/১০০০ টাকার বিনিময়ে কোভিড আক্রান্ত রোগীর পথ্য, খাওয়া বা জীবনদায়ী ঔষধ পৌছে দিচ্ছে। এমনও ঘটনা ঘটেছে যে, রোগী কেমন আছে, মৃত না জীবিত অথবা রোগীর ছবি মোবাইলে ক্যামেরা বন্দি করে যারা এনে দেখান তাদের উপটোকন দিতে হচ্ছে।

সর্বক্ষণের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রী না থাকায় ত্রিপুরাতে স্বাস্থ্য পরিষেবায় অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়া একটা উল্লেখযোগ্য কারন। মুখ্যমন্ত্রীর ম্যারাথন বৈঠক, দৌড়ঝাঁপ সত্বেও অবস্হার খুব একটা পরিবর্তন হচ্ছে না। উল্টে ভি আই পি অথিতি সৎকার করে একশ্রেণীর ডাক্তার ও স্বাস্হ্য কর্মীর সময় ব্যয়িত হচ্ছে। একাংশ ডাক্তার ও স্বাস্হ্য কর্মী প্রানভয়ে মু্মর্ষ ও জটিল রোগীর পরিষেবা প্রদান থেকে দূরে থাকছেন। আবার বিরাট অংশের ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্য কর্মী বিরামহীন কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু তাতেও সংকুলান হচ্ছে না প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও পরিকল্পনার অভাব।

এই অমানবিক চিত্রটা প্রকট হয়ে উঠেছে দিন দিন সর্বত্রই। আমাদের দেশ তথা বিভিন্ন রাজ্যে একই অবস্থা। রাজ্য বা অঞ্চল ভেদে কিছুটা তারতম্য আছে হয়ত।



এই অবস্থা থেকে যদি অতিসত্বর উত্তরন না ঘটে তাহলে এর সূদূর প্রসারী প্রভাব পড়তে পারে, যেমন-

১) স্বাস্থ্য পরিষেবা সম্পূর্ন ভেঙ্গে পড়তে পারে। কোভিডের চিকিৎসার পাশাপাশি জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীরা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। মৃতদেহ বেওয়ারিশ ভাবে পড়ে থাকবে। মৃতদেহ সৎকারের ব্যবস্থা পর্যায়ক্রমে ভেঙ্গে পড়তে পারে।

২) জরুরী পরিষেবা যেমন বিদ্যুৎ, জল, যোগাযোগ ব্যবস্থা বাজারহাট, খাদ্য প্রক্রিয়াকরন স্থবির হয়ে যেতে পারে। পরিষেবা প্রদানকারিরা আক্রান্ত হয়ে পরিষেবা দেওয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

৩) সামাজিক সমস্ত রকমের ব্যবস্থা ও সরকারি ব্যবস্থাপনা লোকের অভাবে পঙ্গু হয়ে যেতে পারে।

৪) সমাজের মূল কাঠামোকে ধরে রাখার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাও ধ্বসে পড়তে পারে।

৫) আর্থিক সংকট তীব্র আকার ধারন করতে পারে। কাজ হারিয়ে, খাদ্যের অভাবে অংখ্য লোক অনাহারে মৃত্যুমুখে পতিত হবে।



ন্যশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে ভারতে ৪২৪৮০ জন কৃষক ও দিন মজুর আত্মহত্যা করেছেন। এমনিতেই বর্তমান দেশে প্রতিদিন ৩৮ জন বেকার ও ১১৬ জন কৃষক আত্মহত্যা করছেন। কোভিডের মৃত্যু এর থেকে আলাদা। এই সংখ্যা আগামী দিনে আরও বাড়তে থাকবে।

এর থেকে নিষ্কৃতি পেতে আমরা মানব সমাজ একমাত্র চিকিৎসা বিজ্ঞানের কাছে অসহায় হয়ে তাকিয়ে আছি কবে এই মারন রোগের ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হবে এবং কবে আমরা মৃত্যু মিছিলের হাত থকে রেহাই পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসব।

অতিমারির চতুর্থ বা বর্তমান পর্যায়ে বিশ্বের মানব সমাজ চরম সংকটের সম্মুখীন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে চার শতক পড়েও আগের মহামারির গুলির মত একই পরিস্থিতির শিকার বা অসহায়ত্ব কেন বোধ করব আমরা? বর্তমান সময়ে আমরা প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের উন্নতির চরম পর্যায়ে থেকেও আমরা মৃত্যু মিছিলকে কেন আটকাতে পারছিনা। আজ 10 সেপ্টেম্বর 2020 এই লেখাটি যখন লিখছি করোনায় বিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যা ২,৮১,০১,০৪২ মৃত্যু ৯,০৯,২৬৮, ভারতে আক্রান্ত ৪৪,৬৫,৮৬৩, মৃত্যু ৭৫,০৬২।

ত্রিপুরায় আক্রান্ত ১৭,৭৯৫ ও মৃত ১৭২।

আমরা কি ভ্যাকসিন না বের হওয়া পর্যন্ত এই বাড়ন্ত সংখ্যাগুলি শুধু গুনতে থাকব? মৃত্যু মিছিল কি ১০০ মিলিয়ন সংখ্যাকে পেরিয়ে যাবে?

কিছু দেশ ও কোম্পানী খুব দ্রুত ভ্যাকসিন নিয়ে আসার চেষ্টা করছে। অনেকেই এখন তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে রয়েছে। কিন্তু গত পরশু দেখা গেল অক্সফোর্ডের তৈরী ভ্যাকসিনে বিপত্তি। ভ্যাকসিন প্রয়োগের পর এক ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

যখন করোনাতঙ্কে গোটা বিশ্ব ও আমাদের দেশ জবুথুবু তখন কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্যের শাসক করোনার আবহের আড়ালে রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ বিক্রি করে দেওয়া, কর্ম সংকোচন, গনতন্ত্রের বিভিন্ন স্তম্ভের উপর ক্রমাগত আঘাত ও কুক্ষিগত করার প্রয়াস প্রতিনিয়ত চলছে।

সংক্রমনের শুরুতে শাসক গোষ্ঠী ও তাদের অনুগামীরা অনেকে করোনার প্রতিষেধক হিসাবে গোমূত্র, গোবর, পাপড়, তালি, থালি, অকাল দেওয়ালি অন্যান্য অবৈজ্ঞানিক তথ্য জনগনের সামনে তুলে ধরেছিলেন।

আজ তারাই মুখে কুলুপ এটে বসে আছে। ভি আই পি ও নেতা মন্ত্রীরা সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবায় ভরসা না করে, দামী দামী বেসরকারী হাসপাতালে (বেদান্ত, নয়ডা) গিয়ে চিকিৎসা করছেন। কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে, হয়ত এই টাকা জনগনের পকেট থেকেই যাবে।

করোনা সংক্রমনের শুরুতেই সঠিক পরিকল্পনার অভাবে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক হাজার হাজার কিলোমিটার পায়ে হেটে বাড়ী ফিরেছে। অনেকেই রাস্তাতেই মারা গেছে। বাড়িতে এসে কাজ ও খাদ্যের অভাবে মারা যাচ্ছে।

এই অতিমারি থেকে পরিত্রান পেতে হলে আমাদেরকে ভ্যাকসিন এর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া এখন আর অন্য উপায় নাই। তবে আমাদের যেমন সতর্ক থাকতে হবে তেমনই সরকারকে প্রতি পরিবারের খাদ্যের যোগান চালু রাখতে হবে। অতিমারির কালে প্রতিটি পরিবারকে পর্যাপ্ত ভাতা দিতে হবে। স্বাস্থ্য পরিষেবাকে যে কোন মূল্যে সক্রিয় করে রাখতে হবে। কর্ম সংস্হানের ব্যবস্হা করতে হবে। সরকার জনসাধারনের প্রয়োজনেই নির্বাচিত হয়েছেন, কাজেই জনগনকে বাচানোর দায়িত্ব তাদেরকেই নিতে হবে।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.