সতী বেণী লক্ষ্মী : উপন্যাসের অবয়বে দহন কথা
সৌম্যদীপ দেব
ঘটনা ১৮৮৬। রাজ সিংহাসনে তখন বীরচন্দ্র মাণিক্য। উপযুক্ত যুবরাজ রাধাকিশোর মাণিক্য। সিংহাসন নিয়ে তেমন কোনো উশৃঙ্খলতা নেই। রাজ্যের পরিস্থিতি স্বাভাবিক, তবে মহারাজ ব্রিটিশ সরকারের আনুগত্য মেনে নিতে পারবেন না - আর ইংরেজ তখন প্রাদেশিক সব রাজ্যের ক্ষমতা হাতে নিয়ে রাজ শাসনকে জব্দ করতে একপ্রকার অন্তরাল চেষ্টায় মগ্ন। ১৮৮৭ পর পর দুটি মৃত্যু! সতীদাহ রাজ্যে প্রভাব বিস্তার করছে। যুবরাজ এর প্রবল বিরোধী হলেও মহারাজ চিন্তায় আবিষ্ট। তিনি জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিগত নিয়মে সহসা হস্তক্ষেপ করে তাদের চটাতে চান না।
১৮২৯ সালেই সতীদাহ নিষিদ্ধ হয়। কিন্তু মেঘের ঘনঘটা। সাল তখন ১৮৮৭। দুটি শিশু কন্যার সতী হবার ঘটনা। রাজ বাড়িতে খবর এসেছে। সেই কথা অন্দরমহলেও কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে। বড্ড কম বয়সে দুটি তাজা প্রাণের দহন রাজ অন্দরেও অনেকেই মানতে পারেনি। নিছন্দবতী দেবী ও বেণী লক্ষ্মী দেবী সতী হয়েছেন।পৃথিবীর মায়া তারা ত্যাগ করেনি জবরদস্তি মায়া কাটানো হয়েছে। লেখক মোহাম্মদ মুরাদ মিঞা অত্যন্ত সুকৌশলে শুধু মূল ঘটনাটাকেই উপজীব্য করে কাহিনির সাথে সামঞ্জস্য রেখে সমান্তরালে প্লট নির্মাণ করেছেন। ফলে ত্রিপুরার নিজস্ব কথার মর্ম গাঁথার এক ঐতিহাসিক তথ্য নির্ভর গ্রন্থ হয়ে রয়েছে মোহাম্মদ মুরাদ মিঞার লেখা ' সতী বেণী লক্ষ্মী'।
সতীদাহ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে ছোট- বড় মিলিয়ে বেশ কিছু কাজ রয়েছে। কিন্তু উওর- পূর্বের পার্বত্য রাজ্য ত্রিপুরায় এই ধরনের কাজ বিরল। লেখক অবশ্যই এখানে নিজ দক্ষতায় স্বতন্ত্রতার পরিচয় রেখেছেন। পাশাপাশি এক স্নেহ প্রবণ রাজার চিত্রে বীরচন্দ্রকে উপস্থাপন করে রাধাকিশোরকে পিতার বিপক্ষে কথা বলিয়েছেন। তবে কাহিনি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। ফলে আলোচ্য উপাদান হ্রাস পেয়েছে। নানা দিকের রসায়নে ঘটনাটি যদি আরো কিছুটা বড় হতো তবে বিষয়ের প্রতিষ্ঠা ও কাহিনির অনুসঙ্গে সুশৃঙ্খল একটা সামঞ্জস্যতা বজায় থাকতো বলেই প্রতিত হয়।
ত্রিপুরার সাহিত্যে নারীর অবস্থান রাজ আমলেও সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলো বলা যায় । তবে নারীর অবস্থান সমাজে কোথায় এটা অবশ্যই মূল্যায়ন করার কথা বলে 'সতী বেণী লক্ষ্মী' র মতো আখ্যান । কেননা কুসংস্কারের দাম্ভিকতা, বর্বরতা প্রাণ নাশের আশঙ্কা তৈরি করেছে সেই কিশোরী নারীর কাছে । লেখক তাঁর ব্যতিক্রমী কাজের জন্য প্রতিষ্ঠিত। পাঠকের কাছে সমাদৃত। তবে সতীদাহের ঘটনা নির্ভর এটাই ত্রিপুরার এক ও অন্যতম আখ্যান । লেখক কোনো পরিচ্ছেদ করেননি প্রত্যক্ষে। তবে পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হয়না কিছু খন্ড খন্ড অংশ রয়েছে এই উপন্যাসোপম আখ্যানে।
প্রথম সূচনাতেই জামাতিয়া সম্প্রদায়ের গঙ্গামোহন সেনাপতির মৃত্যু। সমাজের নিষ্ঠুর চিত্রে নয় বছরের বালিকা মেয়ে বেণী লক্ষ্মীর সতী হওয়ার ঘটনা। লেখক লিখেছেন - " নদীতীরে হিংস্র মানুষের জটলায় মেঘলা চিতার নজর। উদয়পুরের সহমরণে শিশু নারীর আর্তনাদ বেণী লক্ষ্মী এখন শত্রু, ওকে চিতায় জ্বলেপুড়ে মরতে হবে। মানুষ মানুষকে খুন করতে চায়, উন্মাদ মানুষের দল। " যার বাল্যখিল্য দিন যাপন করার কথা সেই কথিত সতীদাহের পুণ্যতা তাকে নিতেই হবে এটা ত্রিপুরার পক্ষে উষ্ণ বাতাস সঞ্চার করলো।
কাহিনির মাঝামাঝি অংশে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় জুড়ে দিয়ে ঘটনার ঘনঘটার বদলে মেদ বাড়িয়েছেন লেখক। এই অংশটি পাঠক মাত্রেই অপ্রয়োজনীয় মনে হবে! তবে এই নাটকীয় সংলাপ অংশে বহু রাজ চরিত্রের সমাবেশ ঘটেছে। বীরচন্দ্র,মনমোহিনী, রাধাকিশোর, কর্ণেল মহিম, রাধারমণ, উমাকান্ত ( পলিটিক্যাল এজেন্ট), ড. লায়েল ( চট্টগ্রাম ব্রিটিশ কমিশনার) , তুলসীবতী, মনোমঞ্জরী, অনঙ্গমোহিনী, ভুবন ( পন্ডিত), রত্ন মঞ্জরী সহ এক ঝাঁক রাজ চরিত্র সংলাপে বাক্য বিনিময় করেছে। এখানে সতীদাহ বিরোধী রাধাকিশোরের স্বতন্ত্র বাক্য রাজার উদ্দেশ্যে -
" আমার মতে, ব্রিটিশ সরকারের মতলবের সঙ্গে পেরে ওঠা যাবে না। মামলায় গেলে আমাদের তেমন লাভও হবে না মনে হচ্ছে। তবে কমিশনারের প্রস্তাবটা কিন্তু ভাল। বরং আপনি বিশেষ আইনে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করার আদেশ জারি করতে পারেন। "
রাজা ব্রিটিশ আইন চালু করার মতে সায় দেন না। কিন্তু উপায়ও তো নেই। এই ভাবে একে একে সতীদাহের ঘটনায় রাজা চাপের মুখে পরেছেন সভাসদ ও অন্দরমহলের। একটা অংশের কাছে এই প্রথায় আঘাত আনতে গেলে গোষ্ঠী ভুক্ত সম্প্রদায়ের নিজস্বতায় আঘাত পরবে ফলে তারা রাজার বিরুদ্ধে যেতে পারে। আবার অপর অংশের মতামত এহেন সতীদাহের ঘটনা বীরচন্দ্রের শাসনাধীনে মানায় না। ভাবুক বৈষ্ণব কবি রাজা গভীর ভাবনার অতলে বিহ্বলিত হলেন। এই ভাবনা মানবতার। এই ভাবনা রাজ্য শাসনের। বীরচন্দ্র কবিতা পড়ছেন -
" সুখে দুখ গিয়াছে ডুবিয়া, /
দুঃখের হৃদয়ে আজি, নেশার আধেক ঘোরে /
রহিয়াছে কি সুখ ছাইয়া। /
নয়নে ভাসিছে গত সুখের স্বপন /
পাইয়া তোমার সেই সুখ সম্মিলন।// "
আর আখ্যানটির শেষ অংশে আবার ফিরে এসেছে বেণীলক্ষ্মীর সমবয়সী ছেলে রেবতীমোহন অনাথ - অনাহারে জরাজীর্ণকায় জীবনপাতের দৃশ্য। খেলার সাথী সৎ মাকে সে নিজেই আঘাত করেছে। মৃত্যু শয্যায় নিয়ে গেছে। এখন অনুতাপ - পরিতাপ। আর কিছুই তার করার নেই। সংসার ও চরাচর তার কাছে শূন্য। জীবিত ও মৃতের মাঝখানে তার বসবাস। কিন্তু একটা ছোট বউ তার আশেপাশে ঘোরে - অজ্ঞাত পরিচয় আখ্যানে। বয়স বারো। অবশেষে সমস্ত দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে মহারাজ বীরচন্দ্রের স্বগতোক্তি -
" আচ্ছা ঠিক আছে, কর্ণেল মহিম তুমি রাধাবাবুর সঙ্গে বসে আদেশনামা বার করার ব্যবস্থা কর। আমি সাক্ষর করে দেব। রাজ প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে তা পাঠিয়ে দেবে। ডাকবাদকদের দিও, পাহাড়েও সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করার বিষয়ে প্রচারও করতে বলবে। "
ষাট বছরের উপর সময় গাললো আইন পাশের পর তা ত্রিপুরায় কার্যকর হতে - কারণ তিপ্রা জনজাতি গোষ্ঠীর নিজস্ব নিয়মে মহারাজ হস্তক্ষেপ চান না । তবুও রাজ্য বাঁচাতে নিরুপায় মহারাজ - করতেই হবে আইন। সতীদাহ এক বর্বর কুসংস্কারের ছবি - শুধু এক নিয়মের জালে অবক্ষয় ছাড়া আর কি হতে পারে নামান্তরে! কথাকার আখ্যানভাগের শেষ দিকে বলছেন এরকম তিনটি ঘটনার কথা। তবে আখ্যান জুড়ে যে রাজকীয় ডায়লেক্ট যুক্ত আছে তা কতটা বাস্তবোচিত এটা একটা প্রশ্নের সৃষ্টি করে। স্বল্প পরিসরে সত্য ও ঘটনার তাৎপর্যে এই আখ্যান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তবে উপন্যাস হিসাবে মান্যতা দিতে গেলে এর কিছু সংশোধন প্রয়োজন পরবে। তাই হয়তো উপন্যাসের অবয়বে আখ্যান বলাই শ্রেয়।